যৌথ নদী কমিশন অকার্যকরঃ বন্ধুত্ব কখনও একতরফা হয় না
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানি বণ্টন, নদীভাঙন রোধ ও পানি ব্যবস্থাপনাসহ সংশ্লিষ্ট সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের লক্ষ্যে গঠিত হয় যৌথ নদী কমিশন বা জেআরসি। গৃহীত নীতিমালায় বছরে জেআরসির অন্তত ৪টি বৈঠকের শর্ত ছিল। প্রথম দু’বছরে ১২টি বৈঠক জেআরসির আশাতিরিক্ত তত্পরতার স্বাক্ষর। এর পেছনে যে উদ্দেশ্য কাজ করছিল সেটা তখন বোঝা যায়নি।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের প্রবল আপত্তির মুখে গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা ব্যারাজটি ভারত পরীক্ষামূলকভাবে চালু করে। এরপর থেকেই জিআরসি নিয়ে আগ্রহে ভাটা পড়ে ভারতের। তখনই তাদের প্রস্তাবে বাত্সরিক বৈঠক ৪টির স্থলে ২টি করার সিদ্ধান্ত হলেও তাও কার্যকর হয়নি। ফলে বিগত ৩৭ বছরে জেআরসির বৈঠকের সংখ্যা মাত্র ৩৬টি। প্রথম ১২টি বাদে সবই হয়েছে বাংলাদেশের চাপাচাপিতে। এ সময়কালে ৪০টি বৈঠক ডাকার পরও বাতিল করতে হয়েছে ভারতের অনীহার ফলে। ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া থেকেই তাদের এ ভূমিকার কারণ স্পষ্ট হয়ে যায়। বিএনপি জোট সরকারের আমলে সর্বশেষ কক্সবাজার বৈঠকটিও বাতিল হয়ে যায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সমস্যার কারণে। ২০০৫ সালের পর ভারত জেআরসির বৈঠক অনুষ্ঠানে একদমই রাজি হয়নি। সে বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা বৈঠকে উভয়পক্ষই যে ৭টি বিষয়ে একমত হয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করে তার বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত করাই যে আসল উদ্দেশ্য সেটা বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। বিষয়গুলো হলো, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানির সুষম বণ্টন, সীমান্ত নদীগুলোর ভাঙন প্রতিরোধে যৌথভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ, ভারতের বস্লল আলোচিত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের বিষয়ে বাংলাদেশকে অবহিতকরণ, টিপাইমুখে ভারতের বাঁধ নির্মাণের আগে বাংলাদেশের সঙ্গে পর্যালোচনা ও প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত প্রদান, বন্যার সময় এক দেশ অপর দেশকে আগাম সতর্কীকরণ ও তা থেকে উত্তরণের পদ্ধতি গ্রহণ, গঙ্গার পানি বণ্টন সংক্রান্ত ফারাক্কা চুক্তির বাস্তবায়ন পর্যালোচনা এবং সে বিষয়ে যৌথ টাস্কফোর্স গঠন। এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ভারতের সচেষ্ট হওয়া দূরের কথা, এক বছরের মধ্যে একতরফাভাবে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ শুরু করে চুক্তি লগ্ধঘন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ভাটির দেশ বাংলাদেশের অনুমতি না নিয়ে, কোনো ধরনের তথ্য-উপাত্ত না দিয়ে স্বয়ং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাঁধ নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করা বৃহত্ প্রতিবেশীর গায়ের জোর প্রদর্শন করা ছাড়া আর কিছুই নয়। যে কোনো বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হওয়া এড়াতেই বন্ব্দু রাষ্ট্রের দাবিদার ভারত এখন জেআরসি নিয়ে একদম চুপ মেরে আছে।অথচ জেআরসির বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়িত না হওয়ায় ইতোমধ্যে বাংলাদেশের জলবায়ু, পরিবেশ ও প্রতিবেশে মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা মরুকরণের শিকার হয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা অস্বাভাবিক বন্যায় উত্তরাঞ্চলের সীমান্ত জেলাগুলোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে প্রায়ই স্লমকি সৃষ্টি হয়েছে। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ উত্কণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। জেআরসির বৈঠকে বিষয়গুলো আলোচনার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কোনো চিঠিকেই ভারত পাত্তা দেয়নি। গত ৪ বছরে এ ধরনের ১০টি চিঠির সর্বশেষটি দেয়া হয়েছে গত মাসের শেষ সপ্তাহে। এখন পর্যন্ত তার কোনো জবাব আসেনি বলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা ঘন ঘন শোনা গেলেও বাস্তবে তার কোনো প্রমাণ মেলে না। দীর্ঘদিনের জাতীয় গুরুত্বসম্পন্ন সমস্যা সমাধানে তাদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে খোলাসা করে দেশবাসীকে কিছুই জানানো হচ্ছে না। কিছুদিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির ভারত সফরকালে আশা করা গিয়েছিল জেআরসি বৈঠকের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। কিন্তু সেটি আলোচনায় না আসায় সংশ্লিষ্টরা হতাশা ব্যক্ত করেছেন। এ নিয়ে সরকারি মহল থেকেও পরিষ্কার করে কিছু বলা হয়নি। এখন প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরের সময়ও বিষয়টি উহ্যই থাকবে কিনা সে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন না তুলেও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি প্রতিবেশী দেশটির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বন্ব্দুত্ব কখনও একতরফা হয় না। বৃহৎ প্রতিবেশী হিসেবে দু’দেশের বন্ধুত্ব সম্পর্কের উন্নয়নে ভারতের ভূমিকাই প্রধান, এটা অস্বীকার করা যাবে না। বর্তমান সরকারের যথাযথ ভূমিকার ওপরই এখন আমাদের জাতীয় স্বার্থ নির্ভর করছে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগেই জেআরসির বৈঠক অনুষ্ঠিত না হলে দু’দেশের শীর্ষ বৈঠকে বিষয়টির আলোচনা অনিশ্চিত থেকে যাবে। সে অবস্থায় একতরফাভাবে সমস্যাটি উত্থাপন করা ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে আর কোনো পথ খোলা থাকবে না। এমন আশা কি পূরণ হবে?
No comments