অর্থনীতি পেছনদিকে চলতে শুরু করেছেঃ দেখানো স্বপ্ন যেন দুঃস্বপ্ন না হয়
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুঃশাসনে জর্জরিত মানুষ আশা করেছিল নতুন সরকার দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনবে, লণ্ডভণ্ড অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট হবে। কিন্তু সরকারের ১০ মাস সে আশাকে আশঙ্কায় বদলে দিয়েছে। এখন ক্ষমতাসীনদের মুখের কথার সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ২০১৩ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের পর্যায়ে উন্নীত করার স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠবে কি না সে প্রশ্ন এখন ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে। দেশের অর্থনীতির হালচাল সে রকম আভাসই দিচ্ছে।
সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, জঙ্গি দমনসহ বিভিন্ন ইস্যুকে যতটা প্রাধান্য দিচ্ছে জাতীয় অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বিনিয়োগ, রফতানি ও শিল্প প্রবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রবণতা ততটাই উপেক্ষিত হতে দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আশাবাদী বক্তব্য আর ভবিষ্যতের স্বপম্ন দেখানোর বেশি কিছু মানুষের চোখে পড়ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, গত অর্থবছরের জুলাই-আগসল্ট সময়ের তুলনায় চলতি বছর একই সময়কালে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমে গেছে ৭৫ মিলিয়ন ডলার বা ৩৭.৩১ শতাংশ। গত বছরের ২০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের স্থানে এবার এসেছে ১২৬ মিলিয়ন ডলার। আরেক হিসাবে গত বছরের জানুয়ারি-আগসল্ট, এই আট মাসে এফডিআই নিবন্ব্দন হয়েছিল ৬৭ কোটি ৯৪ লাখ ডলার। চলতি বছর একই সময়ে এর পরিমাণ ৬১ কোটি ৭৫ লাখ ডলার অর্থাত্ ৯ শতাংশ কম। আরেক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে সরকারি বিনিয়োগের হার যেখানে ছিল ৪.৯৫ শতাংশ, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪.৬৩ শতাংশ। নানা সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বিএনপি জোট সরকারের শেষ অর্থবছর ২০০৫-০৬ সালে শিল্পে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১.৪১ শতাংশ আর গত এপ্রিলের হিসাবে তা মাত্র ৪.৩৩ শতাংশে নেমে এসেছে। এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, অর্থনীতির ক্ষেত্রেও জরুরি অবস্থার ধারা বদল হওয়ার কোনো আলামত নেই। শুধু বিনিয়োগের ক্ষেত্রেই নয়, রফতানি খাতেরও একই দশা। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রফতানি আয় কমেছে ৫১৮ মিলিয়ন ডলার অর্থাত্ ১১.৮২ শতাংশ। শুধু গত বছর সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় চলতি বছর সেপ্টেম্বরেই রফতানি আয় কমেছে প্রায় ২৯ শতাংশ। অথচ গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল ৪২.৩৯ শতাংশ। আমদানি খাতেও নেতিবাচক প্রবণতা স্পষ্ট। বর্তমান সরকারের আমলে দেশে ভোগ্যপণ্য আমদানি তুলনামূলকভাবে বেড়েছে আর কমেছে ইন্টারমিডিয়েট পণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি। কাঁচামাল ১২.০৬ শতাংশ আর ইন্টারমিডিয়েট পণ্য আমদানি কমেছে ১০.০১ শতাংশ। মূলধনী ও অন্যান্য যন্ত্রপাতির আমদানিও ৩.৩ শতাংশ কমেছে। এসবই দেশের শিল্পায়ন ও বিনিয়োগের অধোগতি প্রমাণ করে। আর একটা দুঃসংবাদ হচ্ছে, গত এক বছরের ব্যবধানে জনশক্তি রফতানিও প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।এসব তথ্য বিরোধী রাজনীতিকদের প্রচারণা বলে উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই। নতুন সরকার যে অর্থনীতির ক্ষেত্রে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে মোটেই সক্ষম হয়নি বিদ্যমান পরিস্থিতি তার বড় সাক্ষী। শিল্প স্থাপনে অন্যতম পূর্বশর্ত গ্যাস ও বিদ্যুতের দুষ্প্রাপ্যতাই শুধু নয়, অবকাঠামোগত সমস্যা এবং আইনশৃগ্ধখলা পরিস্থিতির অবনতিও অর্থনীতির পশ্চাত্গতি ত্বরান্বিত করছে। সরকারের নীতি-পরিকল্পনার অস্পষ্টতাও একটা বড় কারণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্রমবর্ধমান মূল্যসম্ফীতি। মাত্র তিন মাসে যা বৃদ্ধি পেয়েছে আড়াই শতাংশ। শিগগিরই এটা ডাবল ভিজিটে পৌঁছবে বলে আশঙ্কা জেগেছে। এমন অবস্থায় অর্থমন্ত্রী সফররত বিদেশি ব্যবসায়ীদের সামনে সত্যবাদীর মতো বিনিয়োগে চরম মন্দার কথা স্বীকার করলেও আমার দেশ প্রতিনিধিকে আশার কথা শুনিয়েছেন—আগামী প্রান্তিকে বিনিয়োগ ও রফতানির ক্ষেত্রে বর্তমান মন্দাবস্থা থাকবে না। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে এ মুহূর্তে দেশি বিনিয়োগের মতোই বিদেশি বিনিয়োগের বড় কোনো প্রস্তাব নেই বিনিয়োগ বোর্ডের কাছে।
অতএব, অর্থমন্ত্রীর আশাবাদ বাস্তবায়নে অন্যসবকিছু বাদ দিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকারের সর্বশক্তি নিয়োগ করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। বিনিয়োগের জন্য যেমন বিদ্যুত্, গ্যাস, ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন প্রয়োজন; তেমনি আমদানি-রফতানির বাধা অপসারণও জরুরি। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের আমদানি-রফতানিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটির বর্তমান অবস্থা গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। ফলে ব্যবসায়ীদের খরচ ৫ থেকে ৭ ভাগ বেড়ে গেছে। বর্তমান সরকার যে অগ্রাধিকার নির্বাচনে গুরুতর ভুল করেছে এটা তার বড় প্রমাণ। অর্থনীতির গতি স্বাভাবিক না হলে সমাজ ও রাজনীতি স্বাভাবিক থাকবে এমন গ্যারান্টি কেউ দেবে না। এটা বুঝতে দেরি করার একটাই পরিণতি, অর্থনীতির চাকা পেছন দিকে চলা অব্যাহত থাকা। কথায় বলে ভূতের পা পেছনে চলে। আমাদেরও কি শেষ পর্যন্ত সে দশায় পেয়ে বসবে?
No comments