কারখানা-কারবালা-কারাগার-কার! by ফিরোজ আহমেদ
"(শাস্তি প্রদান প্রক্রিয়ায়) যা ঘটে চলছিল, তার একমাত্র ব্যাখ্যা ছিল : এই সব কিছুই করা হচ্ছে অপরাধ দমনের জন্য, সতর্ক করার জন্য, অপরাধীদের সংশোধন করার জন্য এবং তাদের প্রতি 'আইনসম্মত প্রতিশোধ' প্রদান করার জন্য...বইগুলোতে এমনটাই বলা ছিল। বাস্তবে কিন্তু এই কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্যগুলোর সঙ্গে সামান্য পরিমাণেও সাদৃশ্যপূর্ণ এমন কোনো ফলাফল পাওয়া গেল না। পাপাচার বন্ধ হওয়ার বদলে তার বরং আরো বিস্তার ঘটল; ভীতি ছড়িয়ে পড়ার
বদলে অপরাধীরা উৎসাহিতই হলো (বহু ভবঘুরে স্বেচ্ছায় কারাগারেই ফেরত আসত); সংশোধনের বদলে সব ধরনের পাপই আরো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিকশিত হতো; সরকারি পদক্ষেপগুলো প্রতিশোধস্পৃহা দুর্বল করার বদলে এমন সব মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে দিল, প্রকৃতিগতভাবে যারা প্রতিশোধপরায়ণ ছিল না।
তাহলে কেন ঘটছে এসব? নেখলিউদফ নিজেকে জিজ্ঞেস করল, আর কোনো উত্তর খুঁজে পেল না।" (লিও তলস্তয়, রেজারেকশনে)
১৮৯৯ সালে তাঁর নিজের শেষ উপন্যাস 'রেজারেকশনে' এই ছিল কারাগার ও শাস্তি প্রদান প্রক্রিয়া বিষয়ে লিও তলস্তয়ের মূল্যায়ন। নেখলিউদফ একটা খ্রিস্টীয়-আধ্যাত্মিক উত্তর শেষমেশ পেয়েছিল, বস্তুত তা তলস্তয়েরই আত্মানুসন্ধান। সেই উত্তরের সঙ্গে কেউ একমত না হতে পারেন, কিন্তু যে মৌলিক দুটি পর্যবেক্ষণ এই অনুচ্ছেদটিতে তিনি করেছিলেন, তাতে ভিন্নমতের জায়গা খুব কমই। প্রথম পর্যবেক্ষণটি এই : আইনতত্ত্ব বা জুরিসপ্রুডেন্স-বিষয়ক গ্রন্থগুলো যে লক্ষ্য নিয়ে শাস্তির ব্যবস্থাগুলো নির্মাণ করেছে, তা অর্জিত হয়নি সামান্য পরিমাণেও। সংশোধন দূরে থাক, তলস্তয়ের ভাষায় 'পাপ' কিংবা আইনের ভাষায় 'অপরাধ' বহুগুণে বেশি ছড়াতেই কারাগারগুলো বেশি বেশি ভূমিকা রাখে (তার পরও তলস্তয় যেটি বিবেচনা করেননি, বিচারব্যবস্থা তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হোক কিংবা ব্যর্থ হোক, সমাজের নতুন একটা ক্ষমতা-কাঠামোর জন্য প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের তেমন একটি কাজ কারাগার যথাযথভাবেই সম্পন্ন করছে)। আর দ্বিতীয়টি হলো এই, অপরাধীর পাপস্পৃহা দমন করে অনুগত জনগোষ্ঠী বানানো শাস্তি প্রদান প্রক্রিয়ার লক্ষ্য হলেও প্রায়ই তা উল্টো প্রতিক্রিয়ারও জন্ম দেয়, সবগুলো বিপ্লবী মুহূর্তে কারাগারকে আমরা দেখি বন্দিদের প্রতি সহমর্মিতা আর নিজে বন্দি হওয়ার আশঙ্কা মানুষকে আরো বেপরোয়া পরিবর্তনকামীতে পরিণত করে।
কারাগারগুলো আসলে তাদের জন্য নির্মিত নয়, যারা সেখানে আছে। বরং এটার লক্ষ্য যারা কারাগারে নেই তারা। অপরাধকে সমাজে একটা কাম্য মাত্রায় সীমিত রাখাটা সংশোধন প্রক্রিয়ার একটা গৌণ উদ্দেশ্য, মুখ্য উদ্দেশ্য হলো অনুগত জনগোষ্ঠী নির্মাণ।
অপরাধ আর পাপের মধ্যে একটা উৎপত্তিগত সম্পর্ক আছে_দুয়েরই একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো নিয়ম লঙ্ঘন। কিন্তু পাপী যেখানে ধর্মীয় বা ঐশী কোনো নিয়ম ভঙ্গ করে, তখন সেটি হয় পাপ, আর যখন তা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কোনো ক্ষমতার বিধি লঙ্ঘন করে, তখন তা অপরাধ, মোটা দাগে এই পাপের সঙ্গে অপরাধের পার্থক্য। কিন্তু এ দুই কিন্তু প্রায়শই পরস্পরের সীমা লঙ্ঘন করে, পাপ অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়, অপরাধও পাপ হিসেবে। আবার বহু কাজ পাপজনক, কিন্তু অপরাধজনক নয়, বহু অপরাধ পাপ নয় আদৌ।
দুয়ের এই জড়িয়ে থাকার সূত্রপাত আসলে আদিম সমাজে, যখন ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল গৌণ, গোত্রে প্রচলিত সব কিছুই সমষ্টির স্বার্থে পরিচালিত হতো। ফলে যা কিছু গোত্রের জন্য মঙ্গলজনক, তা-ই ছিল কানুন, আবার তা-ই ছিল ঈশ্বরের ইচ্ছাও। অর্থাৎ প্রাচীন বৈদিক বা সেমিটিক বা আর সব সমাজে ঐশী আকাঙ্ক্ষা আর গোত্রের জন্য ভালোমন্দত্বে কোনো পৃথকতা ছিল না। কিন্তু ব্যক্তিগত মালিকানার উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন-সনাতন ঐশী আকাঙ্ক্ষা আর গোত্রের ভালোমন্দত্ব সর্বদা একসূত্রে গাঁথা আর সম্ভব হলো না। এই দ্বন্দ্বেরই একটা আভাস পাওয়া যায় প্লেটোর সেই বিখ্যাত প্রশ্নে : কোনো একটা কিছু ধর্মসম্মত বলে দেবতারা তা ভালোবাসেন, নাকি তা ধর্মসম্মত কারণ ঈশ্বর এটাকে ভালবাসেন?
সেই সমাজগুলো গোত্রগত ভাঙনের মুখোমুখি হয়ে যতবার ক্রমাগত নতুন নতুন নৈতিক বিধি তৈরি করতে বাধ্য হয়েছে, এই দার্শনিক প্রশ্নটিই একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোতেও উঁকি দিয়েছে একটু বিবর্তিত হয়ে, নৈতিকভাবে যা মঙ্গলকর তা-ই কি ঈশ্বরের আকাঙ্ক্ষা কারণ তা নৈতিক, নাকি এটা নৈতিকভাবে মঙ্গলকর, কারণ এটাই ঈশ্বরের আকাঙ্ক্ষা? ব্যক্তির মাঝে এই অধিকৃত সেনাছাউনিই সভ্যতা, ইতিহাসের একটা পর্বে তারই মনস্তাত্তি্বক রূপ ধর্মের মধ্য দিয়ে তার প্রকাশ যথেষ্ট ছিল, যদিও মালিকানার এই নির্দিষ্ট স্তরটিকে সুরক্ষা প্রদান, আবার স্বয়ং মালিকদের হাত থেকে সমাজ ও নিপীড়িতকে সুরক্ষা প্রদানের দ্বন্দ্বে ধর্মীয় বিধিগুলোর বাইরেও আইন আর বিধিনিষেধও তাকে প্রতিনিয়ত তৈরি করে যেতে হয়েছে।
২.আমাদের চেনা কারাগারের জন্ম কিন্তু এই সেদিন। ঊনবিংশ শতকের ইউরোপে। সামন্তযুগের প্রায় গোটা সময়ই কারাগারে আটক করে রেখে শাস্তি দেওয়া বা সংশোধনের প্রক্রিয়াটি ছিল অচেনা। বেত্রাঘাত, অঙ্গচ্ছেদ বা প্রাণদণ্ডই ছিল অপরাধ অনুযায়ী শাস্তির বিহিত। শুধু ইংল্যান্ডে ৩১৫ রকমের কাজের জন্য প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা ছিল। বহু ক্ষেত্রেই শুধু রাজনৈতিক বিরোধী বা ক্ষমতার প্রতিপক্ষকে দমন নয়, কঠোর সামন্তশাসনের প্রতি জনগণের ভক্তি ও সমীহ উদ্রেকই ছিল এই কঠোর শাস্তির লক্ষ্য। আধুনিক জেলখানার পূর্বসূরি 'ডানজন' বা দুর্গপ্রকোষ্ঠে আটক করে রাখা হতো কোনো বিশেষ কারণে বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে এমন প্রতিপক্ষ বা অপরাধীকে। সেটাকে কিন্তু আজকের কারাদণ্ডের সঙ্গে তুলনা করা চলবে না, কেননা নির্দিষ্ট মেয়াদ বলে একেবারেই কিছু নেই সেখানে। এই পরিস্থিতির এক ধরনের অবসান আগেই ঘটা শুরু করলেও তা মূর্ত রূপ পেল অষ্টাদশ শতকে। কৃষি থেকে হাজার হাজার চাষার উচ্ছেদ এবং অন্যদিকে সদ্য গজিয়ে ওঠা বা সাবেকি নগরগুলোতে শ্রমিক, কর্মহীন কিংবা আধাবেকার জনগোষ্ঠীর উপস্থিতিতে একের পর এক রাজনৈতিক বিপ্লবে উথালপাতাল ইংল্যান্ডের চেহারার অনেকটাই ধারণা পাওয়া যাবে ক্রিস্টোফার হিল রচিত 'দ্য ওয়ার্ল্ড টার্নড আপসাইড ডাউন' গ্রন্থটিতে, প্রোটেস্ট্যান্ট ইংল্যান্ডে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতাধন্য অ্যাংলিকান চার্চ ছাড়াও সক্রিয় বহুসংখ্যক প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদিক গোষ্ঠীর বিস্তারিত বর্ণনা সেখানে আছে।
ফ্রান্সে অবশ্য পুলিশ বাহিনী পৃথকভাবেই আগে থেকে সংগঠিত ছিল, কেননা সেখানে রাষ্ট্র ছিল ইংল্যান্ডের চেয়ে অনেক বেশি সুশৃঙ্খল আর সুগঠিত। এদের যেমন বাস্তিলের মতো বিশাল সব বন্দিশালা ছিল, তেমনি ছিল গ্রেপ্তার করার আইনগত ব্যবস্থাও : ষবঃঃবৎং ফবপধপযবঃ. আধুনিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানার এটিই পূর্বসূরি, এর বলে যেমন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করা হতো, তেমনি এমনকি মালিক-কারিগর ছোটখাটো বিরোধ কিংবা নৈতিক-সামাজিক যেকোনো অপরাধের জন্যও কাউকে আটক করার ব্যবস্থা করা যেত। এর জন্য রীতিমতো কর্মব্যস্ত একটি সচিবালয় ছিল, কারো অবাধ্যতা, বেয়াড়াপনা বা অনৈতিক কাজের কোনো নালিশের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ একমত হলেই পুলিশ ছুটত লঙ্ঘনকারীকে গ্রেপ্তার করতে; আধুনিক কারাগারের সঙ্গে এর একটা বড় প্রভেদ এই যে এখানে বন্দিত্বের কোনো নির্দিষ্ট মেয়াদ ছিল না। যতক্ষণ না অভিযোগকারী তার অভিযোগ তুলে নিত বা বিষয়টার মীমাংসা হতো, অভিযুক্ত কারাগারেই বন্দি থাকত। আধুনিক কারাগারের ধারণাটি কিন্তু এসেছে এই পুলিশ-গ্রেপ্তারি পরোয়ানা-অনির্দিষ্ট মেয়াদে আটক রাখার ফরাসি ঐতিহ্য থেকেই। মাত্র ঊনবিংশ শতকে এসেই ব্রিটেনে আজকে যা কারাগার নামে পরিচিত, তা সাধারণ বস্তুতে পরিণত হয়। আধুনিক কারাগারব্যবস্থার জন্ম লন্ডনে, জেরেমি বেনথাম এর স্বপ্নদ্রষ্টা। কাউকে তার শাস্তির অংশ হিসেবে বা সংশোধনের উপায় হিসেবে বন্দি করে রাখাটা ছিল এর মূল ভাবনা। কারাগার আর প্রাচীন সামন্ত বিচারপ্রক্রিয়ার অন্তর্বর্তী একটা কাল অবশ্য ইউরোপজুড়ে গেছে নির্বাসন, অবমাননা, জরিমানা আর শারীরিকভাবে পুনরায় অপরাধ না করতে দেওয়ার নানা বন্দোবস্তের মাধ্যমে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই সব কিছু হটিয়ে সংশোধনের প্রধান ব্যবস্থা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে কারাগার।
৩. তলস্তয়ের উদ্ধৃতির দ্বিতীয় তাৎপর্যটিতে যাই এবার। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের স্থায়ী-অস্থায়ী বাসিন্দাদের মনস্কামনা পূরণ করার দায় দুজন সিদ্ধ পুরুষের_একজজন আয়না শাহ বাবা, আরেকজন মাকু শাহ বাবা। বহু আগেই দুজনই প্রয়াত, তাঁদের দেখেছেন এমন কারাবাসীরাও নিঃশেষিতপ্রায়। আয়না শাহ বাবার হাতে থাকত একখানি আয়না, সেই আয়নায় তিনি বালা-মুসিবত আগাম দেখতে পেতেন, ভবিষ্যদ্বাণী করতেন। কোনো সন্দেহ নেই কারাগারই অনিশ্চিততম ঠিকানা, এখানে যিনি তিন দিনের জন্য এসেছেন অথবা তিরিশ দিনের জন্য, খুব সামান্য কিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণে। ফেলে আসা গৃহ, সমাজ, জীবিকার অনিশ্চয়তা শুধু নয়, ভেতরকার পরিস্থিতিও সর্বদাই সংগ্রামমুখর।
কারাগারে সমাজের সব কিছুই ঘনীভূত আকারে থাকে বলেই সমাজের প্রবণতাগুলোও অনেক বেশি আকারে কারাগারে উপস্থিত থাকে, সংক্রমিত হয়। তাৎপর্যপূর্ণ, ১৯৭৫ সালে কারামুক্ত আধাবামপন্থী কবি আল মাহমুদ বেরিয়ে এলেন ডানপন্থী হিসেবে। কবির স্পর্শকাতর অচেতন মনে হয়তো ষাটের দশকজুড়ে বিকশিত যে বামপন্থী আর জাতীয়তাবাদী_উভয়টির একাংশের ব্যর্থতা আর আরেকাংশের লুণ্ঠনপ্রবৃত্তি গোটা জাতির মধ্যে যে জাতীয় হতাশার জন্ম দিয়েছিল, তারই পরিণতিতে প্রথমে আধ্যা@ি@@@ক স্বপনে ডুব দেওয়াও (কখনো কখনো তার রাজনৈতিক প্রকাশ) ডানপন্থায় নিমজ্জিত হওয়ার সহজ পথটিই অনুসরণ করেছে। কিন্তু আলোচ্য বিষয়টি হলো, ভীতি আর শ্রদ্ধা জাগানোর যে লক্ষ্য নিয়ে কারাগারের জন্ম, তাতে কতটুকু সফল তা। ব্রেখটের কবিতার ওই ইতালীয় কারাবন্দি সেনার পেনসিলে লেখা 'লেনিন দীর্ঘজীবী হোন' কথাটির মতো, কর্তৃপক্ষ যেটিকে মুছতে গিয়ে রীতিমতো দেয়াল খোদাই করে ফেলল, আর তাতে কথাটি আরো বেশি করে ফুটে উঠল। বন্দি সেনাটি তখন বলছে, 'এবার কারাগারের দেয়ালটার হাত থেকে মুক্ত হও, বাপু!'
৪. একদিকে যেমন স্মরণ রাখা জরুরি, পূর্ব-পশ্চিম-নির্বিশেষে কারাগার সমাজের অমানবিকতম পরিসর, মানুষকে এখানে সভ্যতার সব অর্জন ছেড়ে দিয়েই টিকে থাকতে হয়। কিন্তু আরেক দিকে এই প্রশ্নটা করা যেতে পারে, পশ্চিমের কারাগারগুলো কি পূর্বের চেয়ে কম অমানবিক নয়? এর উত্তরটা আমরা পাব যদি কারাগারের জন্মের সঙ্গে সমাজ বিবর্তনের সম্পর্কটা আরেকবার স্মরণ করি।
গোটা দুনিয়াই আজকে কারখানা-সভ্যতার কারবালা-কারাগার। এজিদের সেনাবাহিনী সতর্কভাবে এখানে ফোরাত নদীকে পাহারা দিচ্ছে, তৃষ্ণা মেটাতে যে নদীতে নামবে, তীরন্দাজের তীর তাকেই বিদ্ধ করবে মুহূর্তেই। (সংক্ষিপ্ত)
[শিলালিপি ১২ মে ২০১১]
তাহলে কেন ঘটছে এসব? নেখলিউদফ নিজেকে জিজ্ঞেস করল, আর কোনো উত্তর খুঁজে পেল না।" (লিও তলস্তয়, রেজারেকশনে)
১৮৯৯ সালে তাঁর নিজের শেষ উপন্যাস 'রেজারেকশনে' এই ছিল কারাগার ও শাস্তি প্রদান প্রক্রিয়া বিষয়ে লিও তলস্তয়ের মূল্যায়ন। নেখলিউদফ একটা খ্রিস্টীয়-আধ্যাত্মিক উত্তর শেষমেশ পেয়েছিল, বস্তুত তা তলস্তয়েরই আত্মানুসন্ধান। সেই উত্তরের সঙ্গে কেউ একমত না হতে পারেন, কিন্তু যে মৌলিক দুটি পর্যবেক্ষণ এই অনুচ্ছেদটিতে তিনি করেছিলেন, তাতে ভিন্নমতের জায়গা খুব কমই। প্রথম পর্যবেক্ষণটি এই : আইনতত্ত্ব বা জুরিসপ্রুডেন্স-বিষয়ক গ্রন্থগুলো যে লক্ষ্য নিয়ে শাস্তির ব্যবস্থাগুলো নির্মাণ করেছে, তা অর্জিত হয়নি সামান্য পরিমাণেও। সংশোধন দূরে থাক, তলস্তয়ের ভাষায় 'পাপ' কিংবা আইনের ভাষায় 'অপরাধ' বহুগুণে বেশি ছড়াতেই কারাগারগুলো বেশি বেশি ভূমিকা রাখে (তার পরও তলস্তয় যেটি বিবেচনা করেননি, বিচারব্যবস্থা তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হোক কিংবা ব্যর্থ হোক, সমাজের নতুন একটা ক্ষমতা-কাঠামোর জন্য প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের তেমন একটি কাজ কারাগার যথাযথভাবেই সম্পন্ন করছে)। আর দ্বিতীয়টি হলো এই, অপরাধীর পাপস্পৃহা দমন করে অনুগত জনগোষ্ঠী বানানো শাস্তি প্রদান প্রক্রিয়ার লক্ষ্য হলেও প্রায়ই তা উল্টো প্রতিক্রিয়ারও জন্ম দেয়, সবগুলো বিপ্লবী মুহূর্তে কারাগারকে আমরা দেখি বন্দিদের প্রতি সহমর্মিতা আর নিজে বন্দি হওয়ার আশঙ্কা মানুষকে আরো বেপরোয়া পরিবর্তনকামীতে পরিণত করে।
কারাগারগুলো আসলে তাদের জন্য নির্মিত নয়, যারা সেখানে আছে। বরং এটার লক্ষ্য যারা কারাগারে নেই তারা। অপরাধকে সমাজে একটা কাম্য মাত্রায় সীমিত রাখাটা সংশোধন প্রক্রিয়ার একটা গৌণ উদ্দেশ্য, মুখ্য উদ্দেশ্য হলো অনুগত জনগোষ্ঠী নির্মাণ।
অপরাধ আর পাপের মধ্যে একটা উৎপত্তিগত সম্পর্ক আছে_দুয়েরই একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো নিয়ম লঙ্ঘন। কিন্তু পাপী যেখানে ধর্মীয় বা ঐশী কোনো নিয়ম ভঙ্গ করে, তখন সেটি হয় পাপ, আর যখন তা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কোনো ক্ষমতার বিধি লঙ্ঘন করে, তখন তা অপরাধ, মোটা দাগে এই পাপের সঙ্গে অপরাধের পার্থক্য। কিন্তু এ দুই কিন্তু প্রায়শই পরস্পরের সীমা লঙ্ঘন করে, পাপ অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়, অপরাধও পাপ হিসেবে। আবার বহু কাজ পাপজনক, কিন্তু অপরাধজনক নয়, বহু অপরাধ পাপ নয় আদৌ।
দুয়ের এই জড়িয়ে থাকার সূত্রপাত আসলে আদিম সমাজে, যখন ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল গৌণ, গোত্রে প্রচলিত সব কিছুই সমষ্টির স্বার্থে পরিচালিত হতো। ফলে যা কিছু গোত্রের জন্য মঙ্গলজনক, তা-ই ছিল কানুন, আবার তা-ই ছিল ঈশ্বরের ইচ্ছাও। অর্থাৎ প্রাচীন বৈদিক বা সেমিটিক বা আর সব সমাজে ঐশী আকাঙ্ক্ষা আর গোত্রের জন্য ভালোমন্দত্বে কোনো পৃথকতা ছিল না। কিন্তু ব্যক্তিগত মালিকানার উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন-সনাতন ঐশী আকাঙ্ক্ষা আর গোত্রের ভালোমন্দত্ব সর্বদা একসূত্রে গাঁথা আর সম্ভব হলো না। এই দ্বন্দ্বেরই একটা আভাস পাওয়া যায় প্লেটোর সেই বিখ্যাত প্রশ্নে : কোনো একটা কিছু ধর্মসম্মত বলে দেবতারা তা ভালোবাসেন, নাকি তা ধর্মসম্মত কারণ ঈশ্বর এটাকে ভালবাসেন?
সেই সমাজগুলো গোত্রগত ভাঙনের মুখোমুখি হয়ে যতবার ক্রমাগত নতুন নতুন নৈতিক বিধি তৈরি করতে বাধ্য হয়েছে, এই দার্শনিক প্রশ্নটিই একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোতেও উঁকি দিয়েছে একটু বিবর্তিত হয়ে, নৈতিকভাবে যা মঙ্গলকর তা-ই কি ঈশ্বরের আকাঙ্ক্ষা কারণ তা নৈতিক, নাকি এটা নৈতিকভাবে মঙ্গলকর, কারণ এটাই ঈশ্বরের আকাঙ্ক্ষা? ব্যক্তির মাঝে এই অধিকৃত সেনাছাউনিই সভ্যতা, ইতিহাসের একটা পর্বে তারই মনস্তাত্তি্বক রূপ ধর্মের মধ্য দিয়ে তার প্রকাশ যথেষ্ট ছিল, যদিও মালিকানার এই নির্দিষ্ট স্তরটিকে সুরক্ষা প্রদান, আবার স্বয়ং মালিকদের হাত থেকে সমাজ ও নিপীড়িতকে সুরক্ষা প্রদানের দ্বন্দ্বে ধর্মীয় বিধিগুলোর বাইরেও আইন আর বিধিনিষেধও তাকে প্রতিনিয়ত তৈরি করে যেতে হয়েছে।
২.আমাদের চেনা কারাগারের জন্ম কিন্তু এই সেদিন। ঊনবিংশ শতকের ইউরোপে। সামন্তযুগের প্রায় গোটা সময়ই কারাগারে আটক করে রেখে শাস্তি দেওয়া বা সংশোধনের প্রক্রিয়াটি ছিল অচেনা। বেত্রাঘাত, অঙ্গচ্ছেদ বা প্রাণদণ্ডই ছিল অপরাধ অনুযায়ী শাস্তির বিহিত। শুধু ইংল্যান্ডে ৩১৫ রকমের কাজের জন্য প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা ছিল। বহু ক্ষেত্রেই শুধু রাজনৈতিক বিরোধী বা ক্ষমতার প্রতিপক্ষকে দমন নয়, কঠোর সামন্তশাসনের প্রতি জনগণের ভক্তি ও সমীহ উদ্রেকই ছিল এই কঠোর শাস্তির লক্ষ্য। আধুনিক জেলখানার পূর্বসূরি 'ডানজন' বা দুর্গপ্রকোষ্ঠে আটক করে রাখা হতো কোনো বিশেষ কারণে বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে এমন প্রতিপক্ষ বা অপরাধীকে। সেটাকে কিন্তু আজকের কারাদণ্ডের সঙ্গে তুলনা করা চলবে না, কেননা নির্দিষ্ট মেয়াদ বলে একেবারেই কিছু নেই সেখানে। এই পরিস্থিতির এক ধরনের অবসান আগেই ঘটা শুরু করলেও তা মূর্ত রূপ পেল অষ্টাদশ শতকে। কৃষি থেকে হাজার হাজার চাষার উচ্ছেদ এবং অন্যদিকে সদ্য গজিয়ে ওঠা বা সাবেকি নগরগুলোতে শ্রমিক, কর্মহীন কিংবা আধাবেকার জনগোষ্ঠীর উপস্থিতিতে একের পর এক রাজনৈতিক বিপ্লবে উথালপাতাল ইংল্যান্ডের চেহারার অনেকটাই ধারণা পাওয়া যাবে ক্রিস্টোফার হিল রচিত 'দ্য ওয়ার্ল্ড টার্নড আপসাইড ডাউন' গ্রন্থটিতে, প্রোটেস্ট্যান্ট ইংল্যান্ডে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতাধন্য অ্যাংলিকান চার্চ ছাড়াও সক্রিয় বহুসংখ্যক প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদিক গোষ্ঠীর বিস্তারিত বর্ণনা সেখানে আছে।
ফ্রান্সে অবশ্য পুলিশ বাহিনী পৃথকভাবেই আগে থেকে সংগঠিত ছিল, কেননা সেখানে রাষ্ট্র ছিল ইংল্যান্ডের চেয়ে অনেক বেশি সুশৃঙ্খল আর সুগঠিত। এদের যেমন বাস্তিলের মতো বিশাল সব বন্দিশালা ছিল, তেমনি ছিল গ্রেপ্তার করার আইনগত ব্যবস্থাও : ষবঃঃবৎং ফবপধপযবঃ. আধুনিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানার এটিই পূর্বসূরি, এর বলে যেমন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করা হতো, তেমনি এমনকি মালিক-কারিগর ছোটখাটো বিরোধ কিংবা নৈতিক-সামাজিক যেকোনো অপরাধের জন্যও কাউকে আটক করার ব্যবস্থা করা যেত। এর জন্য রীতিমতো কর্মব্যস্ত একটি সচিবালয় ছিল, কারো অবাধ্যতা, বেয়াড়াপনা বা অনৈতিক কাজের কোনো নালিশের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ একমত হলেই পুলিশ ছুটত লঙ্ঘনকারীকে গ্রেপ্তার করতে; আধুনিক কারাগারের সঙ্গে এর একটা বড় প্রভেদ এই যে এখানে বন্দিত্বের কোনো নির্দিষ্ট মেয়াদ ছিল না। যতক্ষণ না অভিযোগকারী তার অভিযোগ তুলে নিত বা বিষয়টার মীমাংসা হতো, অভিযুক্ত কারাগারেই বন্দি থাকত। আধুনিক কারাগারের ধারণাটি কিন্তু এসেছে এই পুলিশ-গ্রেপ্তারি পরোয়ানা-অনির্দিষ্ট মেয়াদে আটক রাখার ফরাসি ঐতিহ্য থেকেই। মাত্র ঊনবিংশ শতকে এসেই ব্রিটেনে আজকে যা কারাগার নামে পরিচিত, তা সাধারণ বস্তুতে পরিণত হয়। আধুনিক কারাগারব্যবস্থার জন্ম লন্ডনে, জেরেমি বেনথাম এর স্বপ্নদ্রষ্টা। কাউকে তার শাস্তির অংশ হিসেবে বা সংশোধনের উপায় হিসেবে বন্দি করে রাখাটা ছিল এর মূল ভাবনা। কারাগার আর প্রাচীন সামন্ত বিচারপ্রক্রিয়ার অন্তর্বর্তী একটা কাল অবশ্য ইউরোপজুড়ে গেছে নির্বাসন, অবমাননা, জরিমানা আর শারীরিকভাবে পুনরায় অপরাধ না করতে দেওয়ার নানা বন্দোবস্তের মাধ্যমে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই সব কিছু হটিয়ে সংশোধনের প্রধান ব্যবস্থা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে কারাগার।
৩. তলস্তয়ের উদ্ধৃতির দ্বিতীয় তাৎপর্যটিতে যাই এবার। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের স্থায়ী-অস্থায়ী বাসিন্দাদের মনস্কামনা পূরণ করার দায় দুজন সিদ্ধ পুরুষের_একজজন আয়না শাহ বাবা, আরেকজন মাকু শাহ বাবা। বহু আগেই দুজনই প্রয়াত, তাঁদের দেখেছেন এমন কারাবাসীরাও নিঃশেষিতপ্রায়। আয়না শাহ বাবার হাতে থাকত একখানি আয়না, সেই আয়নায় তিনি বালা-মুসিবত আগাম দেখতে পেতেন, ভবিষ্যদ্বাণী করতেন। কোনো সন্দেহ নেই কারাগারই অনিশ্চিততম ঠিকানা, এখানে যিনি তিন দিনের জন্য এসেছেন অথবা তিরিশ দিনের জন্য, খুব সামান্য কিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণে। ফেলে আসা গৃহ, সমাজ, জীবিকার অনিশ্চয়তা শুধু নয়, ভেতরকার পরিস্থিতিও সর্বদাই সংগ্রামমুখর।
কারাগারে সমাজের সব কিছুই ঘনীভূত আকারে থাকে বলেই সমাজের প্রবণতাগুলোও অনেক বেশি আকারে কারাগারে উপস্থিত থাকে, সংক্রমিত হয়। তাৎপর্যপূর্ণ, ১৯৭৫ সালে কারামুক্ত আধাবামপন্থী কবি আল মাহমুদ বেরিয়ে এলেন ডানপন্থী হিসেবে। কবির স্পর্শকাতর অচেতন মনে হয়তো ষাটের দশকজুড়ে বিকশিত যে বামপন্থী আর জাতীয়তাবাদী_উভয়টির একাংশের ব্যর্থতা আর আরেকাংশের লুণ্ঠনপ্রবৃত্তি গোটা জাতির মধ্যে যে জাতীয় হতাশার জন্ম দিয়েছিল, তারই পরিণতিতে প্রথমে আধ্যা@ি@@@ক স্বপনে ডুব দেওয়াও (কখনো কখনো তার রাজনৈতিক প্রকাশ) ডানপন্থায় নিমজ্জিত হওয়ার সহজ পথটিই অনুসরণ করেছে। কিন্তু আলোচ্য বিষয়টি হলো, ভীতি আর শ্রদ্ধা জাগানোর যে লক্ষ্য নিয়ে কারাগারের জন্ম, তাতে কতটুকু সফল তা। ব্রেখটের কবিতার ওই ইতালীয় কারাবন্দি সেনার পেনসিলে লেখা 'লেনিন দীর্ঘজীবী হোন' কথাটির মতো, কর্তৃপক্ষ যেটিকে মুছতে গিয়ে রীতিমতো দেয়াল খোদাই করে ফেলল, আর তাতে কথাটি আরো বেশি করে ফুটে উঠল। বন্দি সেনাটি তখন বলছে, 'এবার কারাগারের দেয়ালটার হাত থেকে মুক্ত হও, বাপু!'
৪. একদিকে যেমন স্মরণ রাখা জরুরি, পূর্ব-পশ্চিম-নির্বিশেষে কারাগার সমাজের অমানবিকতম পরিসর, মানুষকে এখানে সভ্যতার সব অর্জন ছেড়ে দিয়েই টিকে থাকতে হয়। কিন্তু আরেক দিকে এই প্রশ্নটা করা যেতে পারে, পশ্চিমের কারাগারগুলো কি পূর্বের চেয়ে কম অমানবিক নয়? এর উত্তরটা আমরা পাব যদি কারাগারের জন্মের সঙ্গে সমাজ বিবর্তনের সম্পর্কটা আরেকবার স্মরণ করি।
গোটা দুনিয়াই আজকে কারখানা-সভ্যতার কারবালা-কারাগার। এজিদের সেনাবাহিনী সতর্কভাবে এখানে ফোরাত নদীকে পাহারা দিচ্ছে, তৃষ্ণা মেটাতে যে নদীতে নামবে, তীরন্দাজের তীর তাকেই বিদ্ধ করবে মুহূর্তেই। (সংক্ষিপ্ত)
[শিলালিপি ১২ মে ২০১১]
No comments