‘রবীন্দ্র-উৎসব: সুরের ধারা’র আলোচনা অনুষ্ঠানে অমর্ত্য সেন-বাংলাদেশের অগ্রগতি আশ্চর্যজনক

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, গত ১৫ বছরে ভারতের চেয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আশ্চর্যজনক অগ্রগতি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রেখেছে মেয়েদের কথা বলার সুযোগ তৈরি হওয়ার বিষয়টি। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কালের প্রগতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে সুরের ধারার রবীন্দ্র-উৎসবের আলোচনা পর্বের প্রধান বক্তা হিসেবে অমর্ত্য সেন ওই মন্তব্য


করেন। রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সুরের ধারা প্রথম আলো ও চ্যানেল আইয়ের সহযোগিতায় তিন দিনের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও দর্শনের অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথের গান ‘গানের ভেতর দিয়ে দেখি ভুবনখানি’ উদ্ধৃত করে বলেন, ‘গানের ভেতর দিয়ে যে জিনিসটা প্রকাশ করা যায়, আর কোনোভাবেই তা সম্ভব নয়। পৃথিবীতে আজ যেসব বড় জিনিস হয়েছে, তার কোনোটাই হতো না, যদি না গান থাকত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গানের অবদান আছে। আমার ধারণা, কোনো ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন ও বিপ্লব গান ছাড়া সম্ভব নয়।’
কল্যাণ অর্থনীতি ও সামাজিক অর্থনীতি তত্ত্বের জন্য ’৯৮ সালে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ বলেন, রবীন্দ্রনাথ যখন সমাজ-ভাবনা নিয়ে লিখেছিলেন, তাঁকে শরৎচন্দ্রসহ অনেকের কড়া সমালোচনা শুনতে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ যে এতে দুঃখ পাননি, তা কিন্তু নয়। একটা সময় অনেকে নজরুলের বিরোধিতা করে কবিতা লিখেছিলেন। আর কবিতা লিখেই নজরুল এর জবাব দিয়েছিলেন। ‘আমরা মনে করি, এর মধ্য দিয়ে চিন্তার প্রসারতার একটা খোরাক আছে।’
বাংলাদেশের সমাজজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক মুগ্ধতা প্রকাশ করে অমর্ত্য সেন বলেন, শুধু সরকারই নয়, নাগরিক সমাজের আন্দোলনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে বাঙালি মেয়েরা শুধু নিজেদের জীবনের স্বাধীনতাই নয়; অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অবদান রাখছে।
কল্যাণ অর্থনীতি ও সামাজিক অর্থনীতি তত্ত্বের জন্য নোবেল বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, আজ থেকে ১৫ বছর আগে সমাজজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে ছিল। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক বিভিন্ন সূচকে ভারতের চেয়ে অনেকখানি এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। আশ্চর্যজনক এ পরিবর্তনে মেয়েদের কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া বড় অবদান রেখেছে।
অমর্ত্য সেন বলেন, মেয়েদের শিক্ষার প্রসার আর কথা বলার ক্ষমতার ওপর রবীন্দ্রনাথ জোর দিয়েছেন। তাঁর প্রবন্ধ, ছোটগল্প ও উপন্যাসে এর প্রতিফলন ঘটেছে। আর বাংলাদেশের আজকের উন্নতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নতির সঙ্গে নিশ্চয় তাঁর চিন্তাধারার প্রভাব রয়েছে।
কবি শঙ্খ ঘোষ বলেন, সুরের ধারা সংগঠনটি গান শেখানো ছাড়াও মানবিক কর্মকাণ্ড বিকাশের সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশের আরও অনেক গান শেখানোর প্রতিষ্ঠান এ কাজটি করছে। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেকটা এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। গান যদি সমস্ত জীবনের সঙ্গে যুক্ত না হয়, তবে তা শুধু বিনোদন বলে গণ্য হয়।
শঙ্খ ঘোষ আরও বলেন, স্বতঃস্ফূর্ততা খুব জরুরি। একসময় শান্তিনিকেতনে যে স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল, এখন তা নেই। বাংলাদেশে এসে অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ততা চোখে পড়ল। স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে জীবনকে যুক্ত করার সাধনা এক করলে শুধু গান নয়, রবীন্দ্রনাথের মধ্য দিয়ে তাকে পাব। আর সর্বাঙ্গীণ রবীন্দ্রনাথকে জানতে পারলে সেই গান আরও বড় গান হয়ে উঠতে পারে।
১৫ থেকে ১৬ বছর আগের এক ২৫ বৈশাখে দেওয়া নিজের বক্তব্যের উল্লেখ করে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সভাপতির বক্তব্যে বলেন, ‘হঠাৎ একদিন যদি বাংলা উধাও হয়ে যায়, কিংবা উবে যায়, তখন আমরা রবীন্দ্র রচনাবলী নিয়ে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে হাজির হব। তখন সে কথাটা বাগাড়ম্বর মনে হয়েছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম বার্ষিকী বাংলাদেশে তো বটেই, পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যেভাবে উদ্যাপিত হচ্ছে, তখন মনে হয় কথাটা বাগাড়ম্বর ছিল না।’ তিনি বলেন, রবিবাবুর গান কালক্রমে রসোত্তীর্ণ হয়ে রবীন্দ্রসংগীত হয়। রবীন্দ্রনাথের অবদান তাঁর মেলাবার বা সম্মিলিত হওয়ার প্রতিভা গানের ভেতর দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রত্যেকের দায়িত্ব নিজের স্বাধীনতা রক্ষার পাশাপাশি প্রতিবেশী নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা করা।’
সংগীত পর্ব: প্রথম দিনের অধিবেশনে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী ফাহমিদা খাতুন, শ্রীকান্ত আচার্য্য, অদিতি মহসিন, অনিরুদ্ধ সেনগুপ্ত ও প্রতীক এন্দু। অদিতি মহসিন গেয়ে শোনান ‘শুধু তোমার বাণী নয় গো’। হারমোনিয়াম, গিটার এবং কিবোর্ডের অনুষঙ্গে ভরাট কণ্ঠে বেশ কয়েকটি গান শোনান শ্রীকান্ত আচার্য্য। তিনি গাইলেন ‘আজি বরিষণ মুখরিত, ‘শ্রাবণও রাতি’, ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’, ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’সহ নানা গান। শিল্পী জানালেন, ‘আজি বরিষণ মুখরিত’ গানটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতির উদ্দেশে। দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন রবিঠাকুরের অনেক গানের স্বরলিপিকার।
একই মঞ্চে বেশ কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করেন কলকাতার আবৃত্তিকার ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বললেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংশয় ছিল, ১০০ বছর পরে কেউ তাঁকে মনে রাখবে কি না। সেই সংশয় প্রকাশ পেয়েছে ‘১৪০০ সাল’ কবিতায়। এরপর ব্রততী আবৃত্তি করে শোনান কবিতাটি ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে...’।
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের ভেতরের মিলনায়তনে রাতে নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকা পরিবেশন করেন জলপাইগুড়ি থেকে আসা শিল্পীরা।

No comments

Powered by Blogger.