জনশক্তি রফতানি খাতে বিপর্যয়ঃ কূটনৈতিক তত্পরতা জোরদার করুন
বিগত তিন দশকে তিলে তিলে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের রফতানি আয়ের প্রধান উত্স জনশক্তি রফতানি খাতটি এখন মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। ভয়াবহ সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার। বিশ্বমন্দাসহ বিভিন্ন কারণে চাকরি হারিয়ে ফেরত আসছে হাজার হাজার শ্রমিক। অন্যদিকে জনশক্তি রফতানি কার্যক্রমে সরকারি নিয়ন্ত্রণ না থাকায় প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ভুয়া-জাল ভিসা নিয়ে বিদেশে গিয়ে জেল-জরিমানাসহ নানা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন অনেকে। বিভিন্ন অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন তারা।
বিদেশে বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট হচ্ছে, পাশাপাশি তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে এই সম্ভাবনাময় খাতটির ওপর। এদিকে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক ফেরত আসার পাশাপাশি বড় বড় শ্রমবাজার ক্রমাগত হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। অথচ সরকারি তত্পরতার অভাবে নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ব্দানের কাজ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। জনশক্তি রফতানির সঙ্গে জড়িত সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা এবং বাংলাদেশী দূতাবাসগুলো ঠুঁটো জগন্নাথের ভূমিকা নেয়ায় এ বিপর্যয় ক্রমাগত উত্সন্নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।এ পর্যন্ত বিশ্বের অন্তত ১০টি দেশে জনশক্তি রফতানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছেন প্রায় ২৫ লাখ বাংলাদেশী। গত এক বছরে জনশক্তি রফতানি শতকরা প্রায় ৫৫ ভাগ কমলেও এ বছরও এখাতে আয়ের পরিমাণ ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে জানা গেছে। কিন্তু এই বিপুল সম্ভাবনাময় খাতটির ওপর এখন পড়েছে অক্টোপাসের থাবা। প্রাপ্ত তথ্য মতে, প্রধান প্রধান শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও মালয়েশিয়া থেকে গত দেড় বছরে ফেরত এসেছে প্রায় তিন লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক। অন্য বছরের তুলনায় এ সংখ্যা দশগুণের বেশি। বিশ্বমন্দা এর প্রধান কারণ হলেও একমাত্র কারণ নয়। বিশ্বমন্দার অজুহাতে সংশ্লিষ্ট দেশ ভিসা নবায়ন না করায় অনেককে ফেরত আসতে হয়েছে। অন্যদিকে ভুয়া ভিসা এবং একশ্রেণীর শ্রমিকের আপত্তিকর কর্মকাণ্ডের অভিযোগে তাদের ফেরত পাঠাচ্ছে বিভিন্ন দেশ। অথচ বিদেশে এসব দেখভালের দায়িত্ব বাংলাদেশ দূতাবাসের। কিন্তু সেখানকার কর্মকর্তারা প্রটোকল অনুযায়ী রুটিন ওয়ার্ক নিয়েই ব্যস্ত রয়েছেন। ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে—‘সারারাত সাপ মেরে সকাল বেলায় দড়ি।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, দূতাবাসের এই ব্যর্থতার দায় বহন করতে হচ্ছে গোটা জনশক্তি রফতানি খাতকে। দেশের ভেতরের অবস্থাও তথৈবচ। বিদেশে লোক পাঠানোর নামে অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এবং তাদের দালালরা প্রতারণা করে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। সংশ্লিষ্ট একাধিক মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে কোনো দায় নিচ্ছে না, অর্থাত্ তারা আদৌ কোনো কার্যকর তদারকির ভূমিকায় নেই। ভুয়া জাল ভিসা নিয়ে নাজেহাল লোকজন আশ্রয়-প্রশ্রয়ের জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না দেশে এবং বিদেশে। জনশক্তি রফতানির এই চালচিত্র নিয়ে একটি সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে আমার দেশ-এ গত ৩১ অক্টোবর থেকে। এ অবস্থায় জনশক্তি রফতানি বাড়াতে সরকারের কার্যকর কূটনৈতিক তত্পরতা শূন্যের কোটায় বলা চলে। এ সুযোগে গোটা খাতটি অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত হতে হতে এমন পর্যায়ে গেছে যে, সুযোগ সন্ব্দানী প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো তার যথেচ্ছ সদ্ব্যবহার করে লাভবান হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রেগুলেটরি বডি হিসেবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়েরও এখন কাজ নেই খৈ ভাজ অবস্থা। উল্লেখ্য, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী সৌদি আরব এবং পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী মালয়েশিয়া সফর করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি।
এ বিপর্যয় ঠেকাতে এখনই সরকারকে তত্পর হতে হবে। বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর কর্মকাণ্ড চাঙ্গা করার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোয় তদারকি বাড়াতে হবে সমন্বিতভাবে। সর্বোপরি লাগাতার কূটনৈতিক তত্পরতা চালাতে হবে যাতে বর্তমান শ্রমবাজার হাতছাড়া না হয় এবং নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ব্দান করে রফতানি খাতের আগের প্রবাহ ফিরিয়ে আনা যায়। দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে নিয়ে সরকার এ কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করলে তা থেকে ভালো ফলাফল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকার এখনই যদি কার্যকর ভূমিকা না নেয় তা হবে নিজের পায়ে কুড়াল মারার শামিল।
No comments