বারি’র সৈকতে অশ্রুসিক্ত সাহার by কাজী জহিরুল ইসলাম
রোমের ফুমিচিনো বিমানবন্দর। কিউতে দাঁড়িয়েছি ব্রিন্ডিসির প্লেনে ওঠবো বলে। বাইরে ঝকঝকে রোদ। ইউরোপের বড় শত্রু বৈরী প্রকৃতি। প্রকৃতিকে জয় করে ইউরোপীয়দের ঘড়ি ধরে কাজ করা, খাওয়া, ঘুমানোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিদ্রোহী প্রকৃতি মাঝে মাঝেই খুব চড়াও হয়ে ওঠে। তখন সময়নিষ্ঠ প্লেনগুলো ঘোষিত শিডিউল ভেঙে ঝিমুতে থাকে। আজ সেই অবস্থা নেই। পরিষ্কার আকাশ। কাজেই প্লেন সঠিক সময়ে ছাড়বে, এই আশা করাই যায়।
কিন্তু আমাদের আশার গুড়েবালি। উনিশ বছরের উর্বশী ইতালীয় সুন্দরী, আলিটালিয়ার গ্রাউন্ড সল্টাফ জানালো, অনিবার্য কারণবশত ত্রিশ মিনিট বিলম্ব হবে। কথা রেখেছে মেয়েটি। ত্রিশ মিনিট পরেই আমাদের গেট খুলে দিল।এই ত্রিশ মিনিট কিউতে দাঁড়িয়ে যখন অপেক্ষার সরু গলিটি পার হচ্ছিলাম তখন হঠাত্ কিউ’র একেবারে সামনে চেনা চেনা কাকে যেন দেখতে পেলাম। ভদ্রমহিলার মুখ নেকাবে আবৃত পেছন থেকে, শরীরের গঠন দেখে মনে হচ্ছে আমার পুরনো সহকর্মী ফিলিস্তিনি নাগরিক সাহার হানজুরি। কিউ ছেড়ে এগিয়ে গেলাম, এক রকম হাত দিয়েই ওর নেকাব সরিয়ে মুখটা দেখার চেষ্টা করলাম। প্রথমে ও ঘাবড়ে গিয়েছিল, পরে আমাকে দেখতে পেয়ে আনন্দে চিত্কার করে উঠল। জহির, তুমি এখানে? কী আনন্দময় আশ্চর্য ঘটনা। কী করছো? আমি ওর হাতের নীল পাসপোর্টের (জাতিসংঘের পাসপোর্ট) দিকে ইঙ্গিত করে বললাম, এখনও আছ তাহলে? টের পেলাম ওর ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আর কোথায় যাব বলো? তোমাদের বাংলাদেশেও তো যেতে পারলাম না। তখনি মনে পড়ল, আমাদের এক বাংলাদেশী সহকর্মীর সঙ্গে ওর বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম ওদের বিয়ে হবে। কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তির কাছে ওদের প্রেম পরাজিত হলো। ওরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ভদ্রলোক তার অভিবাসী দেশ অসেল্ট্রলিয়ায় ফিরে গেলেন।
আমার এই দীর্ঘ প্রবাস জীবনে সাহারের মতো বস্ল গৃহহারা, দেশহারা মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। আমি এদের দুটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করেছি। প্রথমত, এরা কাউকে আঁকড়ে ধরে আশ্রয় পেতে চায়। দ্বিতীয়ত, এরা কাউকে বিশ্বাস করে না। আর এই অবিশ্বাস থেকে জন্ম নেয় নানান রকম স্বার্থপরতা। সাহারের দ্বিতীয় গুণ বা দোষটি আমাদের চোখে পড়েনি কখনও। কিন্তু ও-যে কাউকে আঁকড়ে ধরে আশ্রয় পেতে চায় এটা একাধিকবার আমরা উপলব্ধি করেছি। আমাকে পেয়ে সাহারের এই আনন্দিত হওয়া ওর সেই আশ্রয় প্রার্থনারই ইঙ্গিত বহন করে। আমি কিউতে পেছনে ফিরে যেতে উদ্যত হলে ও আমাকে টেনে ধরে ওর সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। আমি ইতস্তত করছিলাম। উন্নত দেশে এসব কেউ করে না। সবাই নিয়ম মেনে চলে। আর চলে বলেই তো ওরা উন্নত।
প্লেনে গিয়ে আমরা কে কোথায় বসেছি আর ট্রেস রাখতে পারিনি। ধাতব ডানায় ভর দিয়ে আলিটালিয়া নেমে এলো ইতালির বন্দর শহর ব্রিন্ডিসিতে। আতিকুজ্জামান আমাকে নিতে এসেছেন। তার খুব তাড়া। কিছুক্ষণ পরেই একটি ডিনারে যাবেন। আমি আর সাহস পেলাম না তাকে বলি, সাহারের জন্য অপেক্ষা করুন। হোটেল রেজিনাতে ব্যাগ রেখে বেরিয়ে পড়লাম। রাতের খাবার খেতে হবে। উপযুক্ত একটি রেসল্টুরেন্ট খোঁজা দরকার। মোড় ঘুরতেই একটি ফোনের বুথ। ওখানে সাহার। একের পর এক ফোন কার্ড, ক্রেডিট কার্ড পাঞ্চ করছে। কিছুতেই কিছু কাজ হচ্ছে না। আমাকে দেখে প্রথমেই খুব রেগে গেল। তুমি কেমন মানুষ, আমাকে রেখে চলে এলে? আমি কৈফিয়তের জন্য মুখ খুলেছি ও আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, চুপ কর। এখন আমাকে বলো কীভাবে আমার স্বামীকে সুদানে ফোন করব?
সাহার এরই মধ্যে বিয়ে করেছে। একটি ফুটফুটে মেয়েও হয়েছে। ওর স্বামী আলজেরিয়ান। ভদ্রলোক আলবেনিয়াতে ব্যবসা করতেন। তিরানার এক কিশোরীকে বিয়ে করেছিলেন, দুটি ছেলেও আছে। কিন্তু সংসার টেকেনি। ওই মেয়েটির কাছ থেকে পালাতেই এসেছিলেন কসোভোতে নতুন করে জীবন ও জীবিকা নির্ধারণ করতে। সাহারের সঙ্গে ওখানেই ধাক্কা লাগে। ভদ্রলোক পেয়ে যান নতুন জীবন ও জীবিকার সন্ব্দান। আর সাহার পায় প্রত্যাশিত আশ্রয়।
রুমে ফিরে আমি ওকে আমার ল্যাপটপটি দিয়ে দিই, আর পিসি থেকে ফোন করার জন্য একটি ১০০ ডলারের ক্রেডিট কার্ড কিনে দিই। পরদিন আমরা ইতালির আরেক বন্দর শহর বারিতে বেড়াতে যাই। স্বামী, সন্তান, জাতিসংঘের চাকরি সব মিলিয়ে সাহার খুশি, ভীষণ খুশি। কিন্তু মাঝে মাঝেই ও উদাসীন হয়ে পড়ে। আমি দেখি ওর সব আনন্দের দ্যুতি ছাপিয়ে এক বিষণম্নতার কৃষ্ণ মেঘ মুখের ওপর নেকাবের মতো ঝুলে পড়ে। সেই মেঘের আড়ালে অশ্রুসজল দুটি আরব্য চোখ। সেই চোখের আয়নায় পুড়ছে ফিলিস্তিন। কতদিন সাহার ওর মাকে দেখে না, ভাইকে দেখে না। মোস্তফাকে সেই এত্তুটুকুন গাজায় রেখে এসেছে। ও এখন কিশোর। জানো, ওই যে ওদের মতো, ও-ও ইসরাইলি মিলিটারিদের ঢিল ছোঁড়ে। এক মুহূর্তের জন্য ও যেন ওর ছোট ভাইটিকে দেখতে পায়। উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ওর গোলগাল মুখটি। আবার পরক্ষণের ঝড়াহত প্রদীপের মতো নিভে যায়। ইসরাইলিদের গুলিতেই মরবে, শহীদ হয়ে যাবে মোস্তফা, আমার ভাই। সাহারের দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়। বারির সৈকতে তখন লাফিয়ে ওঠে অড্রিয়াটিক।
লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা
No comments