আদি জন্মস্থল by দেবেশ রায়
নিসর্গের কবিতা, কবিতার নিসর্গ_এ দুয়ের ভেতর একটা ছল আছে_কে কাকে জায়গা ছাড়বে। ছল না বলে পরিপূরকতাও বলা যায় বটে, কিন্তু তাতে এমন একটা আভাস থেকেই যায়, যেন কোনোটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। পরিপূরকতায় এ দুইয়ের ভেতরকার দ্বন্দ্বটা চাপা দেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের নিসর্গের সঙ্গে মুখোমুখি হয়েছিলেন কবে। সন-তারিখের হিসাব একটা করা যায়, যদিও তার ভেতরে ফাঁক থাকার ভয় আছে, কারণ সেগুলোর উল্লেখ প্রধানত
রবীন্দ্রনাথই করে গেছেন, বড়জোর ঠাকুরবাড়ির আর কেউ। এই উল্লেখগুলো ঘটেছে পরে, অনেক পরে, অন্য প্রসঙ্গে। 'ছিন্নপত্রাবলী'র ও চিঠিপত্রের অন্যান্য খণ্ডে পূর্ববঙ্গে তাঁর জীবনযাপনের অনেক ঘটনা এখনো জানা যাচ্ছে। কিন্তু যেটা জানা প্রায় যায়ই না তা হলো, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মে এই নিসর্গের অভিঘাত কী ছিল? আরো একটা জরুরি কথা আছে। চিঠিপত্রের চিঠিগুলোতে রবীন্দ্রনাথ প্রধানত কোনো একটা বিষয়ে তাঁর মতামত জানিয়েছেন। এমনকি বাড়ির লোকজনের কাছেও তিনি ব্যক্তিগত কথা তুলছেনই না। এর একটা কারণ হয়তো তখনকার দিনে চিঠিপত্র লেখার বাঁধা গৎ, সম্বোধন ও সমাপ্তির মধ্যে কোনো ফাঁক ছিল না।
তাঁর স্মৃতিচারণায় যে আবেগে পেনেটি, হিমালয়, চন্দননগর এসেছে, শান্তিনিকেতনে বসবাসের জীবন তাঁর সব রকমের শিল্পচর্চায় বস্তু হিসেবে এসেছে, পূর্ববঙ্গতে কি তেমনটা ঘটেছে?
রবীন্দ্রনাথ প্রথম শিলাইদহ যান ১৮৭৫-এর ডিসেম্বরে, তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে ও বোটে। তিনি বোধ হয় দিন দশেক ছিলেন (প্রশান্তকুমার পাল, রবিজীবনী-১)। মাস দুইয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়বার শিলাইদহ গেলেন_এবার জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তখন জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব পেয়েছেন। তাঁর প্রথম সফরেই তিনি রবিকে সঙ্গে নিলেন। এইবারের কথা রবীন্দ্রনাথ একটু গল্প করেই বলেছেন বটে, কিন্তু তার বড় কারণ স্কুল-পালানো, কলেজ-পালানো ভবঘুরে বাউণ্ডুলে অথচ সমাজে প্রশংসিত ও কিছু কবিখ্যাতিরও অধিকারী রবীন্দ্রনাথ, মহর্ষির বিশাল পরগাছা পরিবারে খাপছাড়া এক অস্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। বিশেষ করে মহর্ষি ও জ্যোতি দাদা তাঁদের মতো করে চেষ্টা করেছিলেন তাঁর সামাজিক পুনর্বাসনের। দ্বিজেন্দ্রনাথও তাঁর মতো করে চেষ্টা করতেন। কিন্তু মহর্ষির পরিবার বলতে তাঁদের বোঝাত না। একটা অদৃশ্য মুরুবি্বয়ানা যে ছিলই, সেটা খুব একটা কষ্টকল্পনা নয়। সেসব কথা স্মৃতিকথায় আসেনি। এ রকম বাড়তি খবর সব স্মৃতিকথায় চাপা পড়ে গেছে। সব স্মৃতিকথাই তো গ্রাহ্য হয়েছে প্রিন্সের কাহিনী বলে নয়, মহর্ষির কাহিনী বলেও নয়, গ্রাহ্য হয়েছে একমাত্র রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে। মহর্ষির পরিবারও কলকাতার আর পাঁচটা বড়লোকের বাড়ির মতো নিকট বেকার আত্মীয়ে ঠাসা।
হিমালয় বা বোলপুর বা শিলাইদহ_কোনো জায়গায়ই রবীন্দ্রনাথ নিজেকে পাচ্ছিলেন না। অথচ ১৮৭৬ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ গৃহশিক্ষক রামেশ্বরের কাছে শব্দের মর্যাদা ছন্দে কী করে রাখা যায় তার নিবিড় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন 'কুমারসম্ভব' অনুবাদে ও 'ম্যাকবেথ' অনুবাদে। বাংলা ছন্দে যুক্তধ্বনির ওজন মাপতে, বিহারীলাল ও সুরেন্দ্রনাথের ছন্দ ব্যবহার আন্দাজ করতে, জয়দেবের গদ্যাক্ষরের পাঠ থেকে পদ্য ছন্দের পাঠোদ্ধারে রবীন্দ্রনাথ সব সময়ই ব্যস্ত ছিলেন, কিন্তু গোপনে। এর প্রতিটি চেষ্টায় তাঁর সাফল্য সুনিশ্চিত ও বিস্ময়কর। এই পুরো সময়ের কবিতা ও সংগীত রচনার ঘটনা আটকে আছে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বলা কাহিনীতে_'জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ'। যেকোনো কবির বা শব্দশিল্পীর আত্ম-আবিষ্কারের প্রক্রিয়া অনুসরণের একমাত্র উপায় তাঁর রচনার গড়নের পরিবর্তনের মধ্যে নিহিত। নইলে যেকোনো পাঠকেরই মনে হতে পারে, তেমন যে মনে হয়নি কখনো কারো তা-ও নয় যে 'মানসী, সোনারতরী, চিত্রা'র পর 'কল্পনা, ক্ষণিকা, চৈতালি' রবীন্দ্রনাথের কাব্যশক্তির যোগ্য পরিণতি নয়। কিন্তু যেকোনো কবির বা শব্দশিল্পীর সব রচনাই তাঁর ইতিমধ্যে আয়ত্ত গড়ন-কৌশলের নতুনতর প্রয়োগ। কবিতার গড়নের বাইরে কবিতার কোনো বিষয় হয় না। বিচারের একটা ভুল হয়, পরবর্তী কাব্যকে পূর্বতন কাব্যের সঙ্গে তুলনা করলে।
রবীন্দ্রনাথ প্রথম বিলাতবাস থেকে ফিরে এলেন তাঁর সম্পর্কে দুটি পারিবারিক আশঙ্কাকে কঠিন সত্য প্রমাণ করে। তিনি কোনো কাজের যোগ্য নন এবং তিনি গান ও কবিতা ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নন। নতুন নতুন গান ও কবিতায় তিনি তাঁর সামাজিক পরিসর পেয়ে গেলেন। বিলাত থেকে ফেরার পরের দশকটি রবীন্দ্রনাথের কাটল নিজের জন্য এই সামাজিক স্বীকৃতি রক্ষায়; এমনকি বসবাসের জন্য একটি পছন্দের জায়গা খুঁজে বের করার কঠিন কাজে। এই আশির দশকেই তাঁর বিয়ে, নতুন বৌঠানের মৃত্যু, তাঁর গাজীপুর গমন, তাঁর শান্তিনিকেতনে যাওয়া।
রবীন্দ্রনাথ তখনো শিলাইদহ আবিষ্কার করেননি। তখনো তাঁর বাংলায় পদ্মা নেই, পূর্ব বা উত্তরবঙ্গ নেই।... পৃথিবীর অনেক প্রখ্যাত জল... সমুদ্রের, উপসাগরের, মহাসাগরের, নদীর, উপনদীর জল তিনি দেখে ফিরলেন... তখনো দেখা হয়নি তাঁর ধাত্রীভূমি, তাঁর সৌন্দর্য-রচনাভূমি, তাঁর সোনারতরীর খেয়াঘাট, তাঁর ভেনাসতুল্য বিজয়িনীর উত্থান, তাঁর বনবাস, সেই বনবাসকে তাঁর বাসভূমি করে নেওয়ার দুশ্চর জীবন। যতক্ষণ না তিনি শিলাইদহের সঙ্গে বসবাসের বিনিময় ঘটিয়েছেন।
এর ভেতর কোনো উদ্ভাসনের নাটক নেই, যেমন উদ্ভাসনের কথা রবীন্দ্রনাথ 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ' সম্পর্কে বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ প্রবেশ কাব্যগতভাবে হয়তো তুলনীয় দান্তের নরক প্রবেশের ঘটনার সঙ্গে। যেন দান্তে তাঁর পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী জীবনের মধ্যবয়সে নরকের দ্বারে প্রবেশ করলেন। কোনো নাটক নেই।
রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে প্রধানত কী লিখলেন, তার তালিকা রচনা করা খানিকটা হয়েছে। সম্পূর্ণ কি না সে কথা বলার যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু কতগুলো কথা তাঁর রচনা থেকেই স্পষ্ট যে তাঁর কবিতা 'কল্পনা'য় 'সোনারতরী, চিত্রা'র তুলনায় বিপরীত হতাশাবোধ সঞ্চারিত হচ্ছে। যে কারণে 'চৈত্রালি'তে এ রকম চরণ হামেশা পাওয়া যায়, 'চলে যায় মোর বীণাপাণি', 'কী বলিতে গিয়ে প্রাণ ফেটে হল শতখান', 'তবু নিরবধি আরো পেতে চায় মন'। 'চৈতালি'তে একটু আকস্মিকভাবেই রবীন্দ্রনাথ একটু সনেটের দিকে ঝুঁকেছিলেন। 'সোনারতরী, চিত্রা'র ছন্দকুশলতার পর নিজেকে ফিরিয়ে আনা কেন? সনেট বা পয়ারের চরণ বিন্যাসে রবীন্দ্রনাথের যে পর্যটন 'চৈতালি'তে শুরু হলো, তেমন কিছু ইতিপূর্বে প্রকাশিত তাঁর কাব্যগুলোতে ছিল না।
অর্ধ মগ্ন তরী-'পরে
মাছরাঙা বসি, তীরে দুটি গরু চরে
শস্যহীন মাঠে। শান্ত নেত্রে মুখ তুলে
মহিষ রয়েছে জলে ডুবি। নদীকূলে
জনহীন নৌকা বাঁধা।
কিন্তু এই কবিতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ অন্য এক বসবাসের কথা বলেছেন।
'...মধ্যাহ্নের
অব্যক্ত করুণ একতান, অরণ্যের
স্নিগ্ধচ্ছায়া, গ্রামের সুষুপ্ত শান্তি রাশি,
মাঝখানে বসে আছি আমি পরবাসী।
প্রবাস-বিরহদুঃখ মনে নাহি বাজে;
আমি মিলে গেছি যেন সকলের মাঝে;
ফিরিয়া এসেছি যেন আদি জন্মস্থলে
বহুকাল পরে...'
এই কবিতাটির সঙ্গে 'ছিন্ন পত্রাবলী'র একটি চিঠির কথা মনে পড়ে। এই যে আদি জন্মে ফেরার কথা রবীন্দ্রনাথ বললেন, সেই প্রত্যাবর্তন এখন থেকে ঘটতেই থাকবে। নিম্নবঙ্গের অকল্পনীয় বিস্তারের নদীবক্ষে, প্রান্তরে, খাল-বিলে, অজস্র রঙের জলে, স্রোতের নানা বিভঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ পূর্ব বাংলার এই নিসর্গের অস্থিরতাকে জন্মের অস্থিরতার উপমায় বুঝতে চেয়েছিলেন, যেন এই মৃত্তিকা-দেশের গড়ন বা জন্ম চলছে, এখনো শেষ হয়নি। রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণভাবে নাগরিক। সংগঠিত ও বিন্যস্ত নগরজীবন তাঁর স্বাভাবিক বাসভূমি। এমনকি গঙ্গাও প্রথম দেখেছিলেন পেনেটির বাগানবাড়ি থেকে। এই নদীবাস, এই স্রোতবাস তাঁর কাছে আদি জন্মে প্রত্যাবর্তনের স্থায়ী উপমা তৈরি করে দিল। এ উপমা কোনো অলংকার নয়, এ উপমা হলো একটি স্থায়ী প্রসঙ্গদেশ। এরপর থেকে রবীন্দ্রনাথে নদীর নানা ব্যবহার, নানা ধরনের খেয়া পারাপার, খেয়া পার হতে পারা-না পারা, অপেক্ষা, প্রতীক্ষা, প্রস্থান, প্রত্যাবর্তন, ফিরে না আসা, ওপার দেখা না যাওয়া_এসব কথা ঘুরেফিরে আসবে এবং শেষ পর্যন্ত 'গীতাঞ্জলি', 'গীতিমাল্য' ও 'গীতালি'র হ্রস্বতর রচনাগুলোর প্রবাহ তৈরি করবে। কারো মনে হতে পারে, শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি থেকেও এই প্রসঙ্গদেশ রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কার করেছিলেন। হয়তো এই দুয়ের মধ্যে মিলও আছে। তবু শান্তিনিকেতনের নিসর্গে কবি দর্শকের আসন থেকে খুব একটা সরেন না। পদ্মার কবিতাতে তিনি দর্শক নন। ওই নদী-জীবনের, প্রান্তরের, সবুজের, জলের ও স্রোতের এক প্রাণী।
[শিলালিপি ৫ মে ২০১১]
তাঁর স্মৃতিচারণায় যে আবেগে পেনেটি, হিমালয়, চন্দননগর এসেছে, শান্তিনিকেতনে বসবাসের জীবন তাঁর সব রকমের শিল্পচর্চায় বস্তু হিসেবে এসেছে, পূর্ববঙ্গতে কি তেমনটা ঘটেছে?
রবীন্দ্রনাথ প্রথম শিলাইদহ যান ১৮৭৫-এর ডিসেম্বরে, তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে ও বোটে। তিনি বোধ হয় দিন দশেক ছিলেন (প্রশান্তকুমার পাল, রবিজীবনী-১)। মাস দুইয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়বার শিলাইদহ গেলেন_এবার জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তখন জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব পেয়েছেন। তাঁর প্রথম সফরেই তিনি রবিকে সঙ্গে নিলেন। এইবারের কথা রবীন্দ্রনাথ একটু গল্প করেই বলেছেন বটে, কিন্তু তার বড় কারণ স্কুল-পালানো, কলেজ-পালানো ভবঘুরে বাউণ্ডুলে অথচ সমাজে প্রশংসিত ও কিছু কবিখ্যাতিরও অধিকারী রবীন্দ্রনাথ, মহর্ষির বিশাল পরগাছা পরিবারে খাপছাড়া এক অস্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। বিশেষ করে মহর্ষি ও জ্যোতি দাদা তাঁদের মতো করে চেষ্টা করেছিলেন তাঁর সামাজিক পুনর্বাসনের। দ্বিজেন্দ্রনাথও তাঁর মতো করে চেষ্টা করতেন। কিন্তু মহর্ষির পরিবার বলতে তাঁদের বোঝাত না। একটা অদৃশ্য মুরুবি্বয়ানা যে ছিলই, সেটা খুব একটা কষ্টকল্পনা নয়। সেসব কথা স্মৃতিকথায় আসেনি। এ রকম বাড়তি খবর সব স্মৃতিকথায় চাপা পড়ে গেছে। সব স্মৃতিকথাই তো গ্রাহ্য হয়েছে প্রিন্সের কাহিনী বলে নয়, মহর্ষির কাহিনী বলেও নয়, গ্রাহ্য হয়েছে একমাত্র রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে। মহর্ষির পরিবারও কলকাতার আর পাঁচটা বড়লোকের বাড়ির মতো নিকট বেকার আত্মীয়ে ঠাসা।
হিমালয় বা বোলপুর বা শিলাইদহ_কোনো জায়গায়ই রবীন্দ্রনাথ নিজেকে পাচ্ছিলেন না। অথচ ১৮৭৬ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ গৃহশিক্ষক রামেশ্বরের কাছে শব্দের মর্যাদা ছন্দে কী করে রাখা যায় তার নিবিড় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন 'কুমারসম্ভব' অনুবাদে ও 'ম্যাকবেথ' অনুবাদে। বাংলা ছন্দে যুক্তধ্বনির ওজন মাপতে, বিহারীলাল ও সুরেন্দ্রনাথের ছন্দ ব্যবহার আন্দাজ করতে, জয়দেবের গদ্যাক্ষরের পাঠ থেকে পদ্য ছন্দের পাঠোদ্ধারে রবীন্দ্রনাথ সব সময়ই ব্যস্ত ছিলেন, কিন্তু গোপনে। এর প্রতিটি চেষ্টায় তাঁর সাফল্য সুনিশ্চিত ও বিস্ময়কর। এই পুরো সময়ের কবিতা ও সংগীত রচনার ঘটনা আটকে আছে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বলা কাহিনীতে_'জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ'। যেকোনো কবির বা শব্দশিল্পীর আত্ম-আবিষ্কারের প্রক্রিয়া অনুসরণের একমাত্র উপায় তাঁর রচনার গড়নের পরিবর্তনের মধ্যে নিহিত। নইলে যেকোনো পাঠকেরই মনে হতে পারে, তেমন যে মনে হয়নি কখনো কারো তা-ও নয় যে 'মানসী, সোনারতরী, চিত্রা'র পর 'কল্পনা, ক্ষণিকা, চৈতালি' রবীন্দ্রনাথের কাব্যশক্তির যোগ্য পরিণতি নয়। কিন্তু যেকোনো কবির বা শব্দশিল্পীর সব রচনাই তাঁর ইতিমধ্যে আয়ত্ত গড়ন-কৌশলের নতুনতর প্রয়োগ। কবিতার গড়নের বাইরে কবিতার কোনো বিষয় হয় না। বিচারের একটা ভুল হয়, পরবর্তী কাব্যকে পূর্বতন কাব্যের সঙ্গে তুলনা করলে।
রবীন্দ্রনাথ প্রথম বিলাতবাস থেকে ফিরে এলেন তাঁর সম্পর্কে দুটি পারিবারিক আশঙ্কাকে কঠিন সত্য প্রমাণ করে। তিনি কোনো কাজের যোগ্য নন এবং তিনি গান ও কবিতা ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নন। নতুন নতুন গান ও কবিতায় তিনি তাঁর সামাজিক পরিসর পেয়ে গেলেন। বিলাত থেকে ফেরার পরের দশকটি রবীন্দ্রনাথের কাটল নিজের জন্য এই সামাজিক স্বীকৃতি রক্ষায়; এমনকি বসবাসের জন্য একটি পছন্দের জায়গা খুঁজে বের করার কঠিন কাজে। এই আশির দশকেই তাঁর বিয়ে, নতুন বৌঠানের মৃত্যু, তাঁর গাজীপুর গমন, তাঁর শান্তিনিকেতনে যাওয়া।
রবীন্দ্রনাথ তখনো শিলাইদহ আবিষ্কার করেননি। তখনো তাঁর বাংলায় পদ্মা নেই, পূর্ব বা উত্তরবঙ্গ নেই।... পৃথিবীর অনেক প্রখ্যাত জল... সমুদ্রের, উপসাগরের, মহাসাগরের, নদীর, উপনদীর জল তিনি দেখে ফিরলেন... তখনো দেখা হয়নি তাঁর ধাত্রীভূমি, তাঁর সৌন্দর্য-রচনাভূমি, তাঁর সোনারতরীর খেয়াঘাট, তাঁর ভেনাসতুল্য বিজয়িনীর উত্থান, তাঁর বনবাস, সেই বনবাসকে তাঁর বাসভূমি করে নেওয়ার দুশ্চর জীবন। যতক্ষণ না তিনি শিলাইদহের সঙ্গে বসবাসের বিনিময় ঘটিয়েছেন।
এর ভেতর কোনো উদ্ভাসনের নাটক নেই, যেমন উদ্ভাসনের কথা রবীন্দ্রনাথ 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ' সম্পর্কে বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ প্রবেশ কাব্যগতভাবে হয়তো তুলনীয় দান্তের নরক প্রবেশের ঘটনার সঙ্গে। যেন দান্তে তাঁর পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী জীবনের মধ্যবয়সে নরকের দ্বারে প্রবেশ করলেন। কোনো নাটক নেই।
রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে প্রধানত কী লিখলেন, তার তালিকা রচনা করা খানিকটা হয়েছে। সম্পূর্ণ কি না সে কথা বলার যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু কতগুলো কথা তাঁর রচনা থেকেই স্পষ্ট যে তাঁর কবিতা 'কল্পনা'য় 'সোনারতরী, চিত্রা'র তুলনায় বিপরীত হতাশাবোধ সঞ্চারিত হচ্ছে। যে কারণে 'চৈত্রালি'তে এ রকম চরণ হামেশা পাওয়া যায়, 'চলে যায় মোর বীণাপাণি', 'কী বলিতে গিয়ে প্রাণ ফেটে হল শতখান', 'তবু নিরবধি আরো পেতে চায় মন'। 'চৈতালি'তে একটু আকস্মিকভাবেই রবীন্দ্রনাথ একটু সনেটের দিকে ঝুঁকেছিলেন। 'সোনারতরী, চিত্রা'র ছন্দকুশলতার পর নিজেকে ফিরিয়ে আনা কেন? সনেট বা পয়ারের চরণ বিন্যাসে রবীন্দ্রনাথের যে পর্যটন 'চৈতালি'তে শুরু হলো, তেমন কিছু ইতিপূর্বে প্রকাশিত তাঁর কাব্যগুলোতে ছিল না।
অর্ধ মগ্ন তরী-'পরে
মাছরাঙা বসি, তীরে দুটি গরু চরে
শস্যহীন মাঠে। শান্ত নেত্রে মুখ তুলে
মহিষ রয়েছে জলে ডুবি। নদীকূলে
জনহীন নৌকা বাঁধা।
কিন্তু এই কবিতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ অন্য এক বসবাসের কথা বলেছেন।
'...মধ্যাহ্নের
অব্যক্ত করুণ একতান, অরণ্যের
স্নিগ্ধচ্ছায়া, গ্রামের সুষুপ্ত শান্তি রাশি,
মাঝখানে বসে আছি আমি পরবাসী।
প্রবাস-বিরহদুঃখ মনে নাহি বাজে;
আমি মিলে গেছি যেন সকলের মাঝে;
ফিরিয়া এসেছি যেন আদি জন্মস্থলে
বহুকাল পরে...'
এই কবিতাটির সঙ্গে 'ছিন্ন পত্রাবলী'র একটি চিঠির কথা মনে পড়ে। এই যে আদি জন্মে ফেরার কথা রবীন্দ্রনাথ বললেন, সেই প্রত্যাবর্তন এখন থেকে ঘটতেই থাকবে। নিম্নবঙ্গের অকল্পনীয় বিস্তারের নদীবক্ষে, প্রান্তরে, খাল-বিলে, অজস্র রঙের জলে, স্রোতের নানা বিভঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ পূর্ব বাংলার এই নিসর্গের অস্থিরতাকে জন্মের অস্থিরতার উপমায় বুঝতে চেয়েছিলেন, যেন এই মৃত্তিকা-দেশের গড়ন বা জন্ম চলছে, এখনো শেষ হয়নি। রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণভাবে নাগরিক। সংগঠিত ও বিন্যস্ত নগরজীবন তাঁর স্বাভাবিক বাসভূমি। এমনকি গঙ্গাও প্রথম দেখেছিলেন পেনেটির বাগানবাড়ি থেকে। এই নদীবাস, এই স্রোতবাস তাঁর কাছে আদি জন্মে প্রত্যাবর্তনের স্থায়ী উপমা তৈরি করে দিল। এ উপমা কোনো অলংকার নয়, এ উপমা হলো একটি স্থায়ী প্রসঙ্গদেশ। এরপর থেকে রবীন্দ্রনাথে নদীর নানা ব্যবহার, নানা ধরনের খেয়া পারাপার, খেয়া পার হতে পারা-না পারা, অপেক্ষা, প্রতীক্ষা, প্রস্থান, প্রত্যাবর্তন, ফিরে না আসা, ওপার দেখা না যাওয়া_এসব কথা ঘুরেফিরে আসবে এবং শেষ পর্যন্ত 'গীতাঞ্জলি', 'গীতিমাল্য' ও 'গীতালি'র হ্রস্বতর রচনাগুলোর প্রবাহ তৈরি করবে। কারো মনে হতে পারে, শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি থেকেও এই প্রসঙ্গদেশ রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কার করেছিলেন। হয়তো এই দুয়ের মধ্যে মিলও আছে। তবু শান্তিনিকেতনের নিসর্গে কবি দর্শকের আসন থেকে খুব একটা সরেন না। পদ্মার কবিতাতে তিনি দর্শক নন। ওই নদী-জীবনের, প্রান্তরের, সবুজের, জলের ও স্রোতের এক প্রাণী।
[শিলালিপি ৫ মে ২০১১]
No comments