আবাদি জমি কমছেঃ অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ড রোধ করুন
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাওয়া একটি উদ্বেগজনক সংবাদ। কিন্তু এটিই এখন বাস্তবতা। দেশে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ব্যাপকহারে কমে যাচ্ছে। হ্রাস পাচ্ছে খাদ্যশস্য উৎপাদন ফলে সঙ্কুচিত হচ্ছে কৃষক তথা কৃষি শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট নির্মাণের ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা এবং দালানকোঠা, কলকারখানা নির্মাণসহ নানা কারণে চাষের আওতার বাইরে চলে যাচ্ছে হাজার হাজার হেক্টর কৃষি জমি।
এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা মুখ্য হলেও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা প্রাধান্য পাওয়ায় সমস্যা আরও বেশি প্রকট হয়ে উঠছে। অথচ বার বার বলা সত্ত্বেও বিশেষত সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসন করে আবাদি জমি উদ্ধার করার কাজে সরকারি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
বাংলাদেশে প্রতি বছর লোকসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২৫ লাখেরও বেশি। এই বাড়তি জনসংখ্যার জন্য বাড়তি খাদ্যশস্য উত্পাদনের প্রয়োজন। শুধু তা-ই নয়, তাদের বসতবাড়ি তৈরির জন্যও বিপুল পরিমাণ জায়গার দরকার হয়। এতে স্বাভাবিকভাবেই আবাদি জমি কমে আসে। জানা গেছে, গত দু’ বছরে জমি কমেছে ১ লাখ ৩৯ হাজার হেক্টর, ফসলের উত্পাদন কমেছে বছরে ৬ লাখ টন। এছাড়া বাজার-হাট, স্কুল-কলেজ, বাণিজ্যকেন্দ্র, অফিস-আদালত, শিল্প-কারখানার জন্যও কমে যাচ্ছে আবাদি জমির আয়তন। জমির এই সংকোচনের ফলে ক্রমেই ব্যক্তি মালিকানাধীন বনাঞ্চলসহ খাস জমি এবং খাস বনভূমি পর্যন্ত উজাড় হয়ে যাচ্ছে। এতে সার্বিক পরিবেশে সৃষ্টি হচ্ছে ক্ষতিকর অভিঘাত। অর্থাত্ একটি সঙ্কট আরেকটি সঙ্কটের পথ তৈরি করে দিচ্ছে। এমনকি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শুকনো মৌসুমে কৃষকরা নদীর দুই তীরে এবং জেগে ওঠা চরে চাষ করে উত্পাদন ঘাটতি পূরণ করার চেষ্টা করছেন। এ অবস্থায় যদি অপরিকল্পিত নির্মাণের কারণে জলাবদ্ধতায় আবাদযোগ্য জমি কমতে থাকে তাহলে তার পরিণতি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ রাখে না।
প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, বর্তমান সরকার জলাবদ্ধতা নিরসন করে আবাদি জমি উদ্ধারে কিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বিগত জরুরি সরকারের কৃষি ও সেচ কর্মসূচির অব্যবহৃত থোক বরাদ্দের অর্থ থেকে কৃষি মন্ত্রণালয় ৩৫টি কর্মসূচির অনুমোদন দিয়েছে। এ খাতে খরচ হবে ৩০৩ কোটি টাকা। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে জলাবদ্ধ এলাকায় ছোট ছোট খাল কাটা এবং সেচ সুবিধা বাড়ানোর প্রস্তাবনা। জলাবদ্ধতা নিরসনে গৃহীত কর্মসূচির মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলে ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন, হাওরে ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন এবং ভূ-উপরিস্থ পানি সমৃদ্ধ অঞ্চলে ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সর্বোচ্চ দুই কিলোমিটার খাল খননের জন্য এরই মধ্যে টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে বলেও জানা গেছে। টেন্ডারবাজির খপ্পরে না পড়লে পরিকল্পনাটি ভালো, তাতে সন্দেহ নেই। তবে এই কর্মসূচির পাশাপাশি অপরিকল্পিত সড়ক ও ব্রিজ নির্মাণ রোধ করার ব্যবস্থা না নিলে কৃষি জমি কমে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে।
দেখা গেছে, এ যাবত কৃষি জমি কমে যাওয়ায় ঘাটতি বস্ললাংশে মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে উচ্চফলনশীল জাতের খাদ্যশস্যের চাষ ও সারের ব্যবহারে। কিন্তু সব কিছুরই একটা সীমা আছে। ইতোমধ্যে হাইব্রিড শস্যের ফলন এবং অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহারে জমিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সার্বিক পরিকল্পনায় এসব দিককেও উপেক্ষা করা যাবে না। একই জমিতে দো-ফসলি, তিন-ফসলি উত্পাদনের নতুন নতুন উদ্ভাবনকেও কাজে লাগাতে হবে। এছাড়া জমির সর্বোচ্চ ব্যবহারের লক্ষ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমানো এবং ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বসতবাড়িতে যথাসম্ভব গুচ্ছগ্রামে রূপায়িত করার বিষয়টিও বিবেচনাযোগ্য।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত ‘নেপোয় যেন দৈ না মারে।’ এক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে ভালো কাজের বাস্তবায়নও হামেশা বাধাগ্রস্ত হয়। কাজেই পানি ঢালার আগে পাত্রের ছিদ্র বন্ব্দ করা অত্যাবশ্যক। এজন্য গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চাই শক্তিশালী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা।
No comments