সময়চিত্র-অনেক বেশি দেওয়ার কথা ছিল by আসিফ নজরুল
সরকারের সমালোচনা করি বলে মাঝেমধ্যে কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী আতঙ্কিত হন। জানতে চান, ঝামেলা হচ্ছে না কোনো? তাঁদের বোঝাতে কষ্ট হয় যে আসলেই কোনো ঝামেলা হচ্ছে না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজে টক শো দেখেন। এ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি পত্রিকায় লিখেছেন। কোনো কোনো টক শোতে আমাদের বলে দেওয়া হয়, ভাই, প্রধানমন্ত্রী আর তাঁর পরিবারকে বাঁচিয়ে কথা বলবেন, অন্য কারও সমালোচনা করলে অসুবিধা নেই। কিন্তু আমি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বহু
সমালোচনা করেছি, কিছু সমালোচনা বেশ কড়া ভাষায়। অন্তত আমার এ জন্য কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি এখনো। নেই নেই গণতন্ত্র বলে আক্ষেপ করি আমরা, সেই ম্লান গণতন্ত্রও এটুকু সুরক্ষা দিতে পারে আমাদের অনেককে।
কিন্তু আমাদেরও ভালো কথা বলতে ইচ্ছে করে, তা করতে পারলে ভালোও লাগে। বর্তমান সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে ভয়েস অব আমেরিকা একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিল আমার। তার সংক্ষিপ্ত বিবরণী এখনো আছে তাদের ওয়েব পেইজে। আমারই অবাক লাগে, কত প্রশংসা করা সম্ভব হয়েছিল তখন সরকারের! শুরুটা কী চমৎকারই না ছিল তাদের! বিদেশনীতি আর অর্থনীতির বিভিন্ন বিপর্যয় নেমে আসেনি তখন, রাজনীতিতে হানাহানিও শুরু হয়নি। সরকার প্রথম সভায় সংসদীয় কমিটি করেছে, তার কয়েকটির প্রধান হিসেবে আবার বিরোধী দলের নেতাদের বসিয়েছে, বিরোধী দলের সমালোচনা করা হচ্ছে সংযতভাবে। বিরোধী দল নজিরবিহীনভাবে উদ্বোধনী অধিবেশনে অংশ নিয়েছে, বিরোধীদলীয় নেত্রী সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন কয়েকবার। কিছু ইতিবাচক দিক দেখে আশাবাদী হয়ে উঠেছিলাম আমরা, ভেবেছিলাম ওয়ান-ইলেভেন থেকে হয়তো কিছু উপলব্ধি এসেছে আমাদের নেতাদের।
এখন কি আর এভাবে ভাবতে পারি আমরা? সরকারের তিন বছর মেয়াদ পূর্ণ হতে চলেছে। সুশাসন আর রাজনীতির ক্ষেত্রে গত তিন বছরের মূল্যায়নে কেমন করে শুধু ভালো কথা লিখতে পারে এখন কেউ?
২.
আমার পক্ষে বিশ্বাস করা সম্ভব না যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কল্যাণ চান না দেশের। তবে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট তাঁর জীবনে যে ভয়ংকরতম দুঃসহ ঘটনা ঘটেছে তার প্রভাব থেকে তিনি হয়তো আজও মুক্ত হতে পারেননি। একই কথা অনেকটা প্রযোজ্য বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রেও। আমার ধারণা, তাঁদের পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি পর্যায়ে ব্যক্তিগত তিক্ততা আর রাজনৈতিক বৈরিতা কিছুতেই ভোলা সম্ভব হয় না। সুশাসন আর জনকল্যাণের চিন্তা আর সার্বিকভাবে করতে পারেন না, দেশ মানে তাঁদের কাছে শুধুই আওয়ামী লীগ কিংবা শুধুই বিএনপি। বিরোধী দল মানে প্রতিপক্ষ; প্রতিযোগী নয়, অংশীদার তো নয়ই। ক্ষমতা মানে তাই তাঁদের কাছে বিরোধী শিবিরকে দমন-পীড়ন আর নির্যাতনের প্রাধিকার। যা ঘটে বিএনপির আমলে, অনেকটা একই ঘটনা ঘটে আওয়ামী লীগের আমলে। বরং প্রতিযোগিতামূলক কুশাসনের মাত্রা বাড়ে, নাভিশ্বাস ওঠে মাঝখানে থাকা জনগণের।
তাই বলে ভালো কিছু একদম হয় না তা নয়। কিন্তু তা মোটেও যথেষ্ট নয়। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে পাঁচটি অগ্রাধিকারের একটি ছিল সুশাসন। আমরা যদি পর্যালোচনা করি তাহলে দেখব, এর খুব অল্প বাস্তবায়িত করতে পেরেছে সরকার। নির্বাচনী ইশতেহারের ঘোষণামতো সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদ থেকে দেশকে অনেকাংশে মুক্ত করেছে বর্তমান সরকার। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে, কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে খুঁড়িয়ে, জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের বিচার আরও ম্লানভাবে।
আওয়ামী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুসারে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা, দলীয়করণমুক্ত অরাজনৈতিক গণমুখী প্রশাসন গড়ে তোলা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন কঠোরভাবে বন্ধ করা’। এগুলো বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ ১৯৯০ সালের পর থেকে প্রতিটি সরকার এসব দায়িত্ব পালনে ক্রমাগত আরও বেশি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছিল। আওয়ামী লীগের আমলে একই নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত থেকেছে। বাড়তি বা নতুন উদ্বেগের বিষয় ছিল গুম ও গুপ্তহত্যার মতো নিকৃষ্টতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা, ঘোষণা দিয়ে ঢালাওভাবে দলের লোকদের বিভিন্ন চাকরিতে নিয়োগ, নির্বিচারে দলের লোকদের বিরুদ্ধে সব মামলা প্রত্যাহার, এমনকি ব্যাপকসংখ্যক দণ্ডিত অপরাধীকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমা প্রদর্শন। নরসিংদীর মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ডে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিএনপির একজন নেতাকে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, অথচ এজাহারভুক্ত একজন শীর্ষস্থানীয় আসামিকে (যিনি একজন মন্ত্রীর ভাই) পুলিশ আজও গ্রেপ্তার করতে পারেনি। দলের শাসন কতটা নগ্নভাবে জেঁকে বসেছে এটি তার একটি বড় প্রমাণ। এমন প্রমাণ আরও বহু ঘটনায় পাওয়া গেছে। অপরাধ বিচারে আগ্রহের চেয়ে অপরাধের দায় অনেক সময় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া বা দায় আড়াল করা হলে, চাকরি বা ব্যবসায় মেধা ও যোগ্যতা নয়, দলীয় পরিচয় মুখ্য বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠলে, বিনা বিচারে মানুষ খুন বা উধাও হয়ে গেলে সে রাষ্ট্রে আইনের শাসন বা মানবাধিকার আছে তা বলার কোনো সুযোগ নেই। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, এসব এমন একসময় ঘটছে যখন দেশে একটি কলরবময় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং তথ্য কমিশন রয়েছে, সরকার জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হয়েছে এবং দিনবদলের অঙ্গীকারের ভিত্তিতে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে।
সরকারের আরেকটি বড় অঙ্গীকার ছিল ‘বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা’। নিম্ন আদালতে কয়েক শ বিচারক আমারই একসময়ের ছাত্র বা সহপাঠী। আমার ধারণা, যেভাবে বর্তমানে দল, স্থানীয় প্রশাসন এমনকি মন্ত্রণালয় থেকে এই আদালতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয় তা বিএনপির আমলের চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। এই সরকারের প্রথম দিকে নিম্ন আদালতে নিয়োগ হয়েছিল ভালোভাবে, এখন সেখানেও বৈষম্যমূলক মুক্তিযোদ্ধা কোটাব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিম্ন আদালতকে আরও দলীয়করণের চিন্তা থেকে সম্ভবত সেখানে নিয়োগের পূর্বশর্ত হিসেবে দলাদলিতে বিভক্ত বারে আইনজীবী হিসেবে দুই বছর কাজ করার নিয়ম করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, উচ্চ আদালতে আগের মতোই অধিকাংশ নিয়োগ হয়েছে দলীয় বিবেচনায় কিংবা মন্ত্রী বা জেলা কোটার ভাগাভাগির ভিত্তিতে। নতুন যা, নজিরবিহীনভাবে শতাধিক সিনিয়র বিচারককে ডিঙিয়ে হাইকোর্টে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, প্রায় অর্ধশত সিনিয়য়কে ডিঙিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে আপিল বিভাগে। জনস্বার্থকর অনেক মামলায় উচ্চ আদালত প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছেন, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর মামলায় (যেমন ড. ইউনূসের অপসারণ, খালেদা জিয়ার বাড়ি, মাহমুদুর রহমান আদালত অবমাননা ইত্যাদি) তার বিভিন্ন রায়ের কঠোর সমালোচনা করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় অধিকাংশ আইনজীবী। উচ্চ আদালতের কয়েকজন বিচারকের আচরণ নিয়েও সমাজে বহু প্রশ্ন উত্থিত হয়েছে, কিন্তু তার প্রতিকার হয়নি।
উচ্চ আদালতের অন্যতম বিতর্কিত ভূমিকা ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত মামলার রায়ে। সারা দেশে একমাত্র জাতীয় পার্টি ছাড়া সব মহল এই সরকারব্যবস্থা রাখার পক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নিয়েছিল। ঠিক তখনি তড়িঘড়ি করে উচ্চ আদালত দুর্বোধ্য এবং পরস্পরবিরোধী এমন একটি আদেশ দিয়েছেন যার সুযোগে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার এই ব্যবস্থাকে বাতিল করতে পেরেছে। দেশে পরবর্তী দুই বছরে রাজনৈতিক হানাহানি, সংঘাত এমনকি অবশিষ্ট গণতন্ত্র হুমকির মধ্যে পড়তে পারে এ কারণে।
দেশের আইন ও বিচারব্যবস্থার অন্যতম প্রধান দায়িত্ব থাকে শাসন বিভাগকে জবাবদিহির মুখোমুখি করা। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারির মর্মান্তিক পিলখানা হত্যাকাণ্ড থেকে আজ পর্যন্ত সরকারের জন্য বিব্রতকর বিষয়গুলোতে এই দায়িত্ব কতটুকু পালন করা হয়েছে বা পালন করতে দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে আরও বহু প্রশ্ন ভবিষ্যতে উত্থাপিত হতে পারে।
৩.
প্রশাসন ও বিচার বিভাগ দলীয়করণ, ক্রসফায়ার, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ বহু ব্যর্থতার মূলে কাজ করেছে অপরাজনীতি। অথচ রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তন ছিল আওয়ামী লীগের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার। তাদের লিখিত অঙ্গীকার ছিল: রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলা হবে, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি নিষিদ্ধ হবে, একটি সর্বসম্মত আচরণ বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে এবং জাতীয় সংসদকে কার্যকর ও সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে। আগেই বলেছি, এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সূচনা ছিল অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। কিন্তু এরপর সংসদে কটূক্তি, রাজপথে নির্মম পুলিশি নির্যাতন ও মামলা-হামলার যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তা দেশে ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। বছরের শেষ দিকে বিরোধী দলকে নির্বিঘ্নে রোডমার্চ করতে দিয়ে সরকার প্রশংসিত হয়েছে, বিএনপিও নেতিবাচক কর্মসূচি কিছুটা পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতির সংলাপ ও সংসদে অংশ নেওয়ার কথা বলেছে। তবে এসব মানুষের উদ্বেগ মোচনের জন্য মোটেও যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন নিয়ে দুই দলের মৌলিক বিরোধ আগামী দিনে রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি না করলেই তা বিস্ময়কর হবে।
এক-এগারোর দুঃখজনক অভিজ্ঞতার পর মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আশা করেছিল। এটি হয়নি। আওয়ামী লীগের আমলে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড কিছুটা কমেছে, কিন্তু দমন-পীড়নের অন্যান্য আলামত কমেনি। অন্যদের সম্পর্কে দলের নেতাদের এমনকি প্রধান নেত্রীর কিছু মন্তব্য মানুষকে হতাশ করেছে, বিএনপি নেত্রীও আগের তুলনায় কখনো কখনো মারমুখী মন্তব্য করেছেন। আমার মনে হয় না বাংলাদেশের মানুষ এখন বিশ্বাস করে যে এই দুই নেত্রী আরও একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির আশঙ্কা দূরীকরণে যথেষ্ট সতর্ক আছেন।
৪.
চাইলে এই লেখা আরও ইতিবাচক করা সম্ভব। বিস্তারিতভাবে বলা সম্ভব যে আওয়ামী লীগের আমলে পার্লামেন্টারি কমিটি অনেক বেশি কার্যকর রয়েছে, অধিকাংশ নির্বাচন ঠিকমতো হয়েছে, শিক্ষা ও কৃষি প্রশাসনে গতিশীলতা এসেছে, বিভিন্ন বিধিবদ্ধ কমিশন গঠিত হয়েছে, এমনকি হয়তো দুর্নীতির প্রকোপও কমেছে। বিএনপির আমলের সঙ্গে তুলনা করে আরও কিছু ইতিবাচক উদাহরণও দেওয়া সম্ভব।
কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোটাররা খারাপ পূর্বসূরির চেয়ে সামান্য কম খারাপ সরকার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থেকে ভোট দেয়নি। আওয়ামী লীগও তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে তা বলেনি। একটি অসাধারণ মেনিফেস্টো রচনা করে তা ব্যাপকভাবে প্রচার করে আওয়ামী লীগ বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের মনে বরং নতুন আশাবাদের সৃষ্টি করেছিল।
এই সরকারের ইতিমধ্যেই তিন বছর পার হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আপনার মন্ত্রী ও সিনিয়র নেতাদের নিয়ে এই মেনিফেস্টো আরেকবার পড়ে দেখবেন কি?
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কিন্তু আমাদেরও ভালো কথা বলতে ইচ্ছে করে, তা করতে পারলে ভালোও লাগে। বর্তমান সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে ভয়েস অব আমেরিকা একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিল আমার। তার সংক্ষিপ্ত বিবরণী এখনো আছে তাদের ওয়েব পেইজে। আমারই অবাক লাগে, কত প্রশংসা করা সম্ভব হয়েছিল তখন সরকারের! শুরুটা কী চমৎকারই না ছিল তাদের! বিদেশনীতি আর অর্থনীতির বিভিন্ন বিপর্যয় নেমে আসেনি তখন, রাজনীতিতে হানাহানিও শুরু হয়নি। সরকার প্রথম সভায় সংসদীয় কমিটি করেছে, তার কয়েকটির প্রধান হিসেবে আবার বিরোধী দলের নেতাদের বসিয়েছে, বিরোধী দলের সমালোচনা করা হচ্ছে সংযতভাবে। বিরোধী দল নজিরবিহীনভাবে উদ্বোধনী অধিবেশনে অংশ নিয়েছে, বিরোধীদলীয় নেত্রী সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন কয়েকবার। কিছু ইতিবাচক দিক দেখে আশাবাদী হয়ে উঠেছিলাম আমরা, ভেবেছিলাম ওয়ান-ইলেভেন থেকে হয়তো কিছু উপলব্ধি এসেছে আমাদের নেতাদের।
এখন কি আর এভাবে ভাবতে পারি আমরা? সরকারের তিন বছর মেয়াদ পূর্ণ হতে চলেছে। সুশাসন আর রাজনীতির ক্ষেত্রে গত তিন বছরের মূল্যায়নে কেমন করে শুধু ভালো কথা লিখতে পারে এখন কেউ?
২.
আমার পক্ষে বিশ্বাস করা সম্ভব না যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কল্যাণ চান না দেশের। তবে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট তাঁর জীবনে যে ভয়ংকরতম দুঃসহ ঘটনা ঘটেছে তার প্রভাব থেকে তিনি হয়তো আজও মুক্ত হতে পারেননি। একই কথা অনেকটা প্রযোজ্য বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রেও। আমার ধারণা, তাঁদের পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি পর্যায়ে ব্যক্তিগত তিক্ততা আর রাজনৈতিক বৈরিতা কিছুতেই ভোলা সম্ভব হয় না। সুশাসন আর জনকল্যাণের চিন্তা আর সার্বিকভাবে করতে পারেন না, দেশ মানে তাঁদের কাছে শুধুই আওয়ামী লীগ কিংবা শুধুই বিএনপি। বিরোধী দল মানে প্রতিপক্ষ; প্রতিযোগী নয়, অংশীদার তো নয়ই। ক্ষমতা মানে তাই তাঁদের কাছে বিরোধী শিবিরকে দমন-পীড়ন আর নির্যাতনের প্রাধিকার। যা ঘটে বিএনপির আমলে, অনেকটা একই ঘটনা ঘটে আওয়ামী লীগের আমলে। বরং প্রতিযোগিতামূলক কুশাসনের মাত্রা বাড়ে, নাভিশ্বাস ওঠে মাঝখানে থাকা জনগণের।
তাই বলে ভালো কিছু একদম হয় না তা নয়। কিন্তু তা মোটেও যথেষ্ট নয়। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে পাঁচটি অগ্রাধিকারের একটি ছিল সুশাসন। আমরা যদি পর্যালোচনা করি তাহলে দেখব, এর খুব অল্প বাস্তবায়িত করতে পেরেছে সরকার। নির্বাচনী ইশতেহারের ঘোষণামতো সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদ থেকে দেশকে অনেকাংশে মুক্ত করেছে বর্তমান সরকার। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে, কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে খুঁড়িয়ে, জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের বিচার আরও ম্লানভাবে।
আওয়ামী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুসারে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা, দলীয়করণমুক্ত অরাজনৈতিক গণমুখী প্রশাসন গড়ে তোলা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন কঠোরভাবে বন্ধ করা’। এগুলো বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ ১৯৯০ সালের পর থেকে প্রতিটি সরকার এসব দায়িত্ব পালনে ক্রমাগত আরও বেশি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছিল। আওয়ামী লীগের আমলে একই নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত থেকেছে। বাড়তি বা নতুন উদ্বেগের বিষয় ছিল গুম ও গুপ্তহত্যার মতো নিকৃষ্টতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা, ঘোষণা দিয়ে ঢালাওভাবে দলের লোকদের বিভিন্ন চাকরিতে নিয়োগ, নির্বিচারে দলের লোকদের বিরুদ্ধে সব মামলা প্রত্যাহার, এমনকি ব্যাপকসংখ্যক দণ্ডিত অপরাধীকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমা প্রদর্শন। নরসিংদীর মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ডে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিএনপির একজন নেতাকে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, অথচ এজাহারভুক্ত একজন শীর্ষস্থানীয় আসামিকে (যিনি একজন মন্ত্রীর ভাই) পুলিশ আজও গ্রেপ্তার করতে পারেনি। দলের শাসন কতটা নগ্নভাবে জেঁকে বসেছে এটি তার একটি বড় প্রমাণ। এমন প্রমাণ আরও বহু ঘটনায় পাওয়া গেছে। অপরাধ বিচারে আগ্রহের চেয়ে অপরাধের দায় অনেক সময় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া বা দায় আড়াল করা হলে, চাকরি বা ব্যবসায় মেধা ও যোগ্যতা নয়, দলীয় পরিচয় মুখ্য বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠলে, বিনা বিচারে মানুষ খুন বা উধাও হয়ে গেলে সে রাষ্ট্রে আইনের শাসন বা মানবাধিকার আছে তা বলার কোনো সুযোগ নেই। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, এসব এমন একসময় ঘটছে যখন দেশে একটি কলরবময় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং তথ্য কমিশন রয়েছে, সরকার জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হয়েছে এবং দিনবদলের অঙ্গীকারের ভিত্তিতে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে।
সরকারের আরেকটি বড় অঙ্গীকার ছিল ‘বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা’। নিম্ন আদালতে কয়েক শ বিচারক আমারই একসময়ের ছাত্র বা সহপাঠী। আমার ধারণা, যেভাবে বর্তমানে দল, স্থানীয় প্রশাসন এমনকি মন্ত্রণালয় থেকে এই আদালতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয় তা বিএনপির আমলের চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। এই সরকারের প্রথম দিকে নিম্ন আদালতে নিয়োগ হয়েছিল ভালোভাবে, এখন সেখানেও বৈষম্যমূলক মুক্তিযোদ্ধা কোটাব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিম্ন আদালতকে আরও দলীয়করণের চিন্তা থেকে সম্ভবত সেখানে নিয়োগের পূর্বশর্ত হিসেবে দলাদলিতে বিভক্ত বারে আইনজীবী হিসেবে দুই বছর কাজ করার নিয়ম করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, উচ্চ আদালতে আগের মতোই অধিকাংশ নিয়োগ হয়েছে দলীয় বিবেচনায় কিংবা মন্ত্রী বা জেলা কোটার ভাগাভাগির ভিত্তিতে। নতুন যা, নজিরবিহীনভাবে শতাধিক সিনিয়র বিচারককে ডিঙিয়ে হাইকোর্টে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, প্রায় অর্ধশত সিনিয়য়কে ডিঙিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে আপিল বিভাগে। জনস্বার্থকর অনেক মামলায় উচ্চ আদালত প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছেন, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর মামলায় (যেমন ড. ইউনূসের অপসারণ, খালেদা জিয়ার বাড়ি, মাহমুদুর রহমান আদালত অবমাননা ইত্যাদি) তার বিভিন্ন রায়ের কঠোর সমালোচনা করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় অধিকাংশ আইনজীবী। উচ্চ আদালতের কয়েকজন বিচারকের আচরণ নিয়েও সমাজে বহু প্রশ্ন উত্থিত হয়েছে, কিন্তু তার প্রতিকার হয়নি।
উচ্চ আদালতের অন্যতম বিতর্কিত ভূমিকা ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত মামলার রায়ে। সারা দেশে একমাত্র জাতীয় পার্টি ছাড়া সব মহল এই সরকারব্যবস্থা রাখার পক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নিয়েছিল। ঠিক তখনি তড়িঘড়ি করে উচ্চ আদালত দুর্বোধ্য এবং পরস্পরবিরোধী এমন একটি আদেশ দিয়েছেন যার সুযোগে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার এই ব্যবস্থাকে বাতিল করতে পেরেছে। দেশে পরবর্তী দুই বছরে রাজনৈতিক হানাহানি, সংঘাত এমনকি অবশিষ্ট গণতন্ত্র হুমকির মধ্যে পড়তে পারে এ কারণে।
দেশের আইন ও বিচারব্যবস্থার অন্যতম প্রধান দায়িত্ব থাকে শাসন বিভাগকে জবাবদিহির মুখোমুখি করা। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারির মর্মান্তিক পিলখানা হত্যাকাণ্ড থেকে আজ পর্যন্ত সরকারের জন্য বিব্রতকর বিষয়গুলোতে এই দায়িত্ব কতটুকু পালন করা হয়েছে বা পালন করতে দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে আরও বহু প্রশ্ন ভবিষ্যতে উত্থাপিত হতে পারে।
৩.
প্রশাসন ও বিচার বিভাগ দলীয়করণ, ক্রসফায়ার, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ বহু ব্যর্থতার মূলে কাজ করেছে অপরাজনীতি। অথচ রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তন ছিল আওয়ামী লীগের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার। তাদের লিখিত অঙ্গীকার ছিল: রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলা হবে, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি নিষিদ্ধ হবে, একটি সর্বসম্মত আচরণ বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে এবং জাতীয় সংসদকে কার্যকর ও সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে। আগেই বলেছি, এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সূচনা ছিল অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। কিন্তু এরপর সংসদে কটূক্তি, রাজপথে নির্মম পুলিশি নির্যাতন ও মামলা-হামলার যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তা দেশে ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। বছরের শেষ দিকে বিরোধী দলকে নির্বিঘ্নে রোডমার্চ করতে দিয়ে সরকার প্রশংসিত হয়েছে, বিএনপিও নেতিবাচক কর্মসূচি কিছুটা পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতির সংলাপ ও সংসদে অংশ নেওয়ার কথা বলেছে। তবে এসব মানুষের উদ্বেগ মোচনের জন্য মোটেও যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন নিয়ে দুই দলের মৌলিক বিরোধ আগামী দিনে রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি না করলেই তা বিস্ময়কর হবে।
এক-এগারোর দুঃখজনক অভিজ্ঞতার পর মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আশা করেছিল। এটি হয়নি। আওয়ামী লীগের আমলে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড কিছুটা কমেছে, কিন্তু দমন-পীড়নের অন্যান্য আলামত কমেনি। অন্যদের সম্পর্কে দলের নেতাদের এমনকি প্রধান নেত্রীর কিছু মন্তব্য মানুষকে হতাশ করেছে, বিএনপি নেত্রীও আগের তুলনায় কখনো কখনো মারমুখী মন্তব্য করেছেন। আমার মনে হয় না বাংলাদেশের মানুষ এখন বিশ্বাস করে যে এই দুই নেত্রী আরও একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির আশঙ্কা দূরীকরণে যথেষ্ট সতর্ক আছেন।
৪.
চাইলে এই লেখা আরও ইতিবাচক করা সম্ভব। বিস্তারিতভাবে বলা সম্ভব যে আওয়ামী লীগের আমলে পার্লামেন্টারি কমিটি অনেক বেশি কার্যকর রয়েছে, অধিকাংশ নির্বাচন ঠিকমতো হয়েছে, শিক্ষা ও কৃষি প্রশাসনে গতিশীলতা এসেছে, বিভিন্ন বিধিবদ্ধ কমিশন গঠিত হয়েছে, এমনকি হয়তো দুর্নীতির প্রকোপও কমেছে। বিএনপির আমলের সঙ্গে তুলনা করে আরও কিছু ইতিবাচক উদাহরণও দেওয়া সম্ভব।
কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোটাররা খারাপ পূর্বসূরির চেয়ে সামান্য কম খারাপ সরকার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থেকে ভোট দেয়নি। আওয়ামী লীগও তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে তা বলেনি। একটি অসাধারণ মেনিফেস্টো রচনা করে তা ব্যাপকভাবে প্রচার করে আওয়ামী লীগ বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের মনে বরং নতুন আশাবাদের সৃষ্টি করেছিল।
এই সরকারের ইতিমধ্যেই তিন বছর পার হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আপনার মন্ত্রী ও সিনিয়র নেতাদের নিয়ে এই মেনিফেস্টো আরেকবার পড়ে দেখবেন কি?
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments