স্মরণ-আব্বাসউদ্দীন আহমদ
গানের জগতে তাঁর ছিল না কোনো ওস্তাদ। শিল্পী জীবনের শুরুতে কোনো তালিম নেননি। কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই তাঁর সুরের সঙ্গেই বসবাস। সব সময় আটকে থাকতেন সুরের মায়াজালে। পথ চলতেন গানের তালে তালে। তাঁর সকাল হতো গানের আলোয়। তিনি আব্বাসউদ্দীন আহমদ। তবে আব্বাসউদ্দীন নামেই বেশি পরিচিত। আমরা তাঁকে চিনি পল্লী গানের শিল্পী হিসেবে। মাটির গান, মেঠো গান, রাখালিয়া সুরের জন্য তাঁর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। বাংলার পল্লী গানকে তিনি পেঁৗছে
দিয়েছেন সাত সমুদ্র, তেরো নদীর ওপারে। অবশ্য বাংলাদেশের পল্লী গানে তাঁর সাফল্য বেশি হলেও দেশাত্মবোধক, নজরুলসংগীত, বিচ্ছেদি ও আধুনিক গানসহ নানা ধরনের গানও করতেন তিনি। নিজের অনন্য প্রতিভার কারণে তিনি পেঁৗছে গিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, ইন্দু বালা, জগত ঘটক, কাজী মোতাহার হোসেন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁসহ আরো অনেক গুণী শিল্পীর কাছাকাছি। সংগীতের প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি এবং ধর্মান্ধতার দেয়াল ভাঙার জন্য তিনি প্রচুর কাজ করেছেন। আজ ৩০ ডিসেম্বর এই মহান শিল্পীর মৃত্যুবার্ষিকী। আব্বাসউদ্দীন আহমদ ১৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর তৎকালীন ভারতের কুচবিহারের তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জাফর আলী আহমদ ছিলেন আইনজীবী। বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলেকেও নিজের পেশায় প্রতিষ্ঠিত করার। কিন্তু ছেলের মাথায় সারা দিন সুরের খেলা। পরে সন্তানের গানে একসময় নিজেও মুগ্ধ হন। আব্বাসউদ্দীনের শিক্ষাজীবন শুরু হয় বলরামপুর স্কুলে। ১৯১৯ সালে তুফানগঞ্জ স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করেন। আইএ পাস করেন ১৯২১ সালে কুচবিহার কলেজ থেকে। ১৯৩১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতায় থাকেন। প্রথম চাকরি নেন ডিপিআই অফিসে। পরে কৃষি অফিসে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে বাংলা সরকারের রেকর্ডিং এঙ্পার্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। এখানে এসে তৎকালীন সরকারের তথ্য প্রচার বিভাগের অতিরিক্ত সংগীত সংগঠকের দায়িত্ব পান। চলি্লশের দশকে তাঁর গান পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে জনতার সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তার লক্ষ্য ছিল ধর্মান্ধতার দেয়াল ভেঙে গানের প্রতি সবার আগ্রহ সৃষ্টি করা। এ উদ্দেশ্যে ১৯৫৫ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সংগীত সম্মেলনে যোগ দিতে ম্যানিলায় যান। ১৯৫৬ সালে অংশ নেন জার্মানির আন্তর্জাতিক লোকসংগীত সম্মেলনে। ১৯৫৭ সালে রেঙ্গুনে অনুষ্ঠিত বাংলা সাংস্কৃতিক সম্মেলনে যোগ দেন। এরপর একে একে তাঁর রেকর্ড বের হতে থাকে। যেগুলো তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়। কাজী নজরুলের 'ও মোর রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ' গানটি তিনিই প্রথম গান। এ সময়ে তিনি কিছুদিন ওস্তাদ জমির উদ্দিন খাঁর কাছে উচ্চাঙ্গসংগীত শেখেন। আব্বাসউদ্দীন শুধু গান নয়, অভিনয়ও করেছেন বাংলা চলচ্চিত্রে। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলো হলো 'বিষ্ণুমায়া' (১৯৩২), 'মহানিশা' (১৯৩৬), 'একটি কথা' ও 'ঠিকাদার' (১৯৪০)। বাংলা সিনেমায় তিনি গানও গেয়েছেন। আব্বাসউদ্দীন রচিত একমাত্র গ্রন্থ 'আমার শিল্পী জীবনের কথা'। এতে রয়েছে সেই সময়ের সংগীত জগতের চালচিত্র। পাকিস্তান সরকার ১৯৬০ সালে তাঁকে মরণোত্তর প্রাইড অব পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ড দেয়। সংগীতে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি এ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৯ সালে মরণোত্তর শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার পান। ১৯৮১ সালে তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ১৯৫৯ সালের এই দিনে এই মহান শিল্পী মারা যান। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন গানের মাঝে, আমাদের প্রাণের মাঝে।
সূত্র : উইকি পিডিয়া, তামান্না আসলাম অলি
No comments