ধর্ম-স্বদেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
স্বদেশপ্রেম মানবজীবনের একটি শ্রেষ্ঠতর গুণ। দেশপ্রেমের মূলে রয়েছে দেশের ভূখণ্ডকে ভালোবাসা; স্বদেশের তাহজিব, তামুদ্দুন তথা কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মাতৃভাষাকে ভালোবাসা; জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে দেশের মানুষকে ভালোবাসা—সর্বোপরি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। স্বদেশ ও মাতৃভূমিকে ভালোবাসা এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা ঈমানের অংশ। তাই আরবি প্রবাদ বাক্যে বলা হয়েছে, ‘হুব্বুল ওয়াতানি মিনাল ঈমান’ অর্থাৎ
‘দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।’ অনেক নবী-রাসুল নিজের জন্মস্থান ত্যাগ করে অন্য দেশে হিজরত করে আল্লাহর নির্দেশ পালন করেছেন। অতঃপর আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করে মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেছেন। মহানবী (সা.) জন্মভূমি মক্কাকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসতেন। ৬১৫ খ্রিষ্টাব্দে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সাহাবায়ে কিরামকে কাফেরদের নির্মম অত্যাচারে আবিসিনিয়ায় হিজরত তথা দেশত্যাগের অনুমতি দিলেও তিনি প্রাণপ্রিয় স্বদেশে অবস্থান করেন। পরিশেষে কাফেরদের গভীর ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের কারণে এবং আল্লাহর আদেশে নবী করিম (সা.) প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করতে মনস্থ করেছিলেন। ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদিনায় হিজরতকালে তিনি মক্কার দিকে বারবার ফিরে তাকান আর কাতর কণ্ঠে আফসোস করে বলেন, ‘হে আমার স্বদেশ! তুমি কতই না সুন্দর! আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার আপন জাতি যদি ষড়যন্ত্র না করত, আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।’
অতঃপর ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে বিজয়ীর বেশে মহানবী (সা.) যখন জন্মভূমি মক্কায় প্রবেশ করলেন, তখন মুসলমানদের ওপর যে অন্যায় ও অত্যাচার করা হয়েছিল, তা বিস্মৃত হলেন এবং স্বদেশবাসীর প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বিশ্বের ইতিহাসে অতুলনীয় দেশপ্রেম, উদারতা ও মহানুভবতার আদর্শ স্থাপন করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রক্তপাতহীন মক্কা বিজয় মানব ইতিহাসের এক চমকপ্রদ অধ্যায়। এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাকে সুস্পষ্ট বিজয় দিয়েছি।’ (সূরা আল-ফাত্হ, আয়াত: ১)
মানবসমাজে যাদের ওপর অত্যাচার করা হয়েছে এবং যারা আপন মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েছে, তারা স্বীয় মাতৃভূমি উদ্ধার ও স্বাধীনতা অর্জনের জন্য শত্রুদের বিরুদ্ধে সর্বতোভাবে যুদ্ধ করবে—এটা ইসলামের বিধান। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘এসব লোককে যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো, যারা (শত্রু কর্তৃক) আক্রান্ত হয়েছে, কেননা তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আর নিশ্চিত যে আল্লাহ তাদের জয়যুক্ত করতে পূর্ণ ক্ষমতাবান। তাদের মাতৃভূমি থেকে অন্যায়ভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে এ জন্য যে তারা বলে, আমাদের প্রভু আল্লাহ।’ (সূরা আল-হজ, আয়াত: ৩৯)
স্বদেশ শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে তা প্রতিহত করে বিজয় অর্জনের জন্য যুদ্ধ করা অপরিহার্য। ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি স্বদেশের মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষায় এগিয়ে এসেছিল। দখলদার হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে ঘরে ঘরে সবাই কঠিন প্রত্যয়ে দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁদের মর্যাদা অতি উচ্চে। তাঁরা দেশ ও জাতির গৌরব। ইসলামের দৃষ্টিতে তাঁরা শহীদ, শাহাদতের সর্বোচ্চ মর্যাদায় ভূষিত। আল্লাহ তাআলা তাঁদের চিরস্থায়ী শান্তিময় স্থান জান্নাতে আবাস দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের জান্নাতে প্রবেশের বিনিময়ে তাঁদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন।’ (সূরা আত-তাওবা, আয়াত-১১১)
দেশপ্রেম মানুষকে দায়িত্বসচেতন করে তোলে, স্বদেশের উন্নতি সাধনে সজাগ রাখে, দেশের জাতীয় সম্পদ সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ করে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে এবং দেশের সার্বিক তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত থাকবে, তাদের প্রতি বিশেষ পুরস্কারের আশ্বাসবাণী ও প্রতিশ্রুতি রয়েছে। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘যারা স্বদেশ রক্ষার উদ্দেশ্যে সীমান্ত পাহারায় বিনিদ্র রজনী যাপন করে, তাদের জন্য জান্নাত।’ একজন মুমিন ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘এক দিন এক রাতের প্রহরা ক্রমাগত এক মাসের নফল রোজা এবং সারা রাত ইবাদতে কাটিয়ে দেওয়া অপেক্ষাও উত্তম।’ (মুসলিম)
নির্যাতিত মানুষের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করাকে ইসলাম উৎসাহিত করেছে। পৃথিবীর মানচিত্রে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক যে ভূখণ্ডে আমরা বসবাস করছি, এর স্বাধীনতা অর্জন করতে লাখো শহীদের রক্ত ও অনেক আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, ১৬ ডিসেম্বর কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জনের মাধ্যমে তার সফল পরিসমাপ্তি ঘটে। এ মুক্তি আন্দোলনে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা দেশমাতৃকার শ্রেষ্ঠ সন্তান এবং জাতি তাঁদের কাছে চিরঋণী।
৩০ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা এ বাংলার মাটি থেকে দেশের শত্রু জঙ্গিবাদী বোমাবাজ, সন্ত্রাসী, চোরাকারবারি, চাঁদাবাজ, ঘুষখোর, অবৈধ মজুদদার, ভেজাল ব্যবসায়ী, দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারী, দেশের স্বার্থবিরোধী দুর্নীতিবাজদের মূলোৎপাটন করে আল্লাহ তাআলা একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী শোষণমুক্ত স্বাবলম্বী সোনার বাংলাদেশ গঠনের তাওফিক দান করুন। আমিন।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com
অতঃপর ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে বিজয়ীর বেশে মহানবী (সা.) যখন জন্মভূমি মক্কায় প্রবেশ করলেন, তখন মুসলমানদের ওপর যে অন্যায় ও অত্যাচার করা হয়েছিল, তা বিস্মৃত হলেন এবং স্বদেশবাসীর প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বিশ্বের ইতিহাসে অতুলনীয় দেশপ্রেম, উদারতা ও মহানুভবতার আদর্শ স্থাপন করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রক্তপাতহীন মক্কা বিজয় মানব ইতিহাসের এক চমকপ্রদ অধ্যায়। এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাকে সুস্পষ্ট বিজয় দিয়েছি।’ (সূরা আল-ফাত্হ, আয়াত: ১)
মানবসমাজে যাদের ওপর অত্যাচার করা হয়েছে এবং যারা আপন মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েছে, তারা স্বীয় মাতৃভূমি উদ্ধার ও স্বাধীনতা অর্জনের জন্য শত্রুদের বিরুদ্ধে সর্বতোভাবে যুদ্ধ করবে—এটা ইসলামের বিধান। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘এসব লোককে যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো, যারা (শত্রু কর্তৃক) আক্রান্ত হয়েছে, কেননা তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আর নিশ্চিত যে আল্লাহ তাদের জয়যুক্ত করতে পূর্ণ ক্ষমতাবান। তাদের মাতৃভূমি থেকে অন্যায়ভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে এ জন্য যে তারা বলে, আমাদের প্রভু আল্লাহ।’ (সূরা আল-হজ, আয়াত: ৩৯)
স্বদেশ শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে তা প্রতিহত করে বিজয় অর্জনের জন্য যুদ্ধ করা অপরিহার্য। ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি স্বদেশের মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষায় এগিয়ে এসেছিল। দখলদার হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে ঘরে ঘরে সবাই কঠিন প্রত্যয়ে দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁদের মর্যাদা অতি উচ্চে। তাঁরা দেশ ও জাতির গৌরব। ইসলামের দৃষ্টিতে তাঁরা শহীদ, শাহাদতের সর্বোচ্চ মর্যাদায় ভূষিত। আল্লাহ তাআলা তাঁদের চিরস্থায়ী শান্তিময় স্থান জান্নাতে আবাস দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের জান্নাতে প্রবেশের বিনিময়ে তাঁদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন।’ (সূরা আত-তাওবা, আয়াত-১১১)
দেশপ্রেম মানুষকে দায়িত্বসচেতন করে তোলে, স্বদেশের উন্নতি সাধনে সজাগ রাখে, দেশের জাতীয় সম্পদ সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ করে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে এবং দেশের সার্বিক তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত থাকবে, তাদের প্রতি বিশেষ পুরস্কারের আশ্বাসবাণী ও প্রতিশ্রুতি রয়েছে। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘যারা স্বদেশ রক্ষার উদ্দেশ্যে সীমান্ত পাহারায় বিনিদ্র রজনী যাপন করে, তাদের জন্য জান্নাত।’ একজন মুমিন ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘এক দিন এক রাতের প্রহরা ক্রমাগত এক মাসের নফল রোজা এবং সারা রাত ইবাদতে কাটিয়ে দেওয়া অপেক্ষাও উত্তম।’ (মুসলিম)
নির্যাতিত মানুষের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করাকে ইসলাম উৎসাহিত করেছে। পৃথিবীর মানচিত্রে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক যে ভূখণ্ডে আমরা বসবাস করছি, এর স্বাধীনতা অর্জন করতে লাখো শহীদের রক্ত ও অনেক আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, ১৬ ডিসেম্বর কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জনের মাধ্যমে তার সফল পরিসমাপ্তি ঘটে। এ মুক্তি আন্দোলনে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা দেশমাতৃকার শ্রেষ্ঠ সন্তান এবং জাতি তাঁদের কাছে চিরঋণী।
৩০ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা এ বাংলার মাটি থেকে দেশের শত্রু জঙ্গিবাদী বোমাবাজ, সন্ত্রাসী, চোরাকারবারি, চাঁদাবাজ, ঘুষখোর, অবৈধ মজুদদার, ভেজাল ব্যবসায়ী, দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারী, দেশের স্বার্থবিরোধী দুর্নীতিবাজদের মূলোৎপাটন করে আল্লাহ তাআলা একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী শোষণমুক্ত স্বাবলম্বী সোনার বাংলাদেশ গঠনের তাওফিক দান করুন। আমিন।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com
No comments