চলে গেলেন আল-মাজী by মনজুর আহমদ
নিউইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশীদের হৃদয় জয় করেছিলেন আল-মাজী। তার মৃত্যুর খবরে শোকার্ত তার পরিচিতজনরা। খবর পেতে দেরি হয়নি কারও। সবাই জেনেছেন কেউ সরাসরি ঢাকা থেকে, কেউ পত্রপত্রিকায়। সবাই জেনেছেন, তবুও সবাই অন্যকে জানাতে উদগ্রীব হয়েছেন টেলিফোনে কিংবা দেখা হলে প্রথমেই বলেছেন, খবর পেয়েছেন আল-মাজী মারা গেছেন!
নিউইয়র্কে এই ব্যাপক পরিচিতি আল-মাজী পেয়েছিলেন তার আপন বৈশিষ্ট্যে। সহজ-সরল অমায়িক ব্যবহারে তিনি সহজেই সবার কাছে পৌঁছে যেতে পেরেছিলেন। তার কর্মতত্পরতায় সবাইকে ঘনিষ্ঠ করে নিতে পেরেছিলেন।আলোকচিত্র জগতের এক দক্ষ শিল্পী শামসুল ইসলাম আল-মাজী যখন বাংলাদেশে খ্যাতির আকাশে জ্বলজ্বল করছিলেন তখনই হঠাত্ একদিন দেশ ত্যাগ করে চলে এসেছিলেন নিউইয়র্কে। কেন এসেছিলেন জানতাম না, কীভাবে এসেছিলেন তাও জানতাম না। তার দেশ ছাড়ার আগে এটুকুই শুধু কানে আসছিল—আল-মাজী আমেরিকায় যাচ্ছেন। আল-মাজী দু’বার আমেরিকায় এসেছেন। প্রথমবার আশির দশকের শেষদিকে। সেবার কয়েক বছর এখানে কাটিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ছিলেন। ফিরে গিয়ে সেই কাজেই যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন আবার আমেরিকায় আসার জন্য। এ দফায় ভিসা পাওয়া নিয়ে তার একটু দুশ্চিন্তা ছিল। কিন্তু তেমন একটা ঝামেলা হয়নি বলেই শুনেছি। তার এই দফা নিউইয়র্ক রওনা হওয়ার রাতে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল এলিফ্যান্ট রোডে। একটা গাড়িতে স্ত্রী এবং আরও এক-দু’জনের সঙ্গে বাসার দিকে যাচ্ছিলেন। আমি ছিলাম রিকশায়। গাড়ি থেকেই মুখ বাড়িয়ে বললেন, মনজু ভাই আমি আজ রাতেই নিউইয়র্ক রওনা হচ্ছি। আমি ওকে শুভেচ্ছা জানিয়ে হাত নেড়েছিলাম।
আল-মাজী আমাদের দৈনিক বাংলার বিনোদন প্রকাশনা সাপ্তাহিক বিচিত্রার আলোকচিত্রী ছিলেন। তিনিই বিচিত্রার প্রথম আলোকচিত্রী। তার পরিচিতি ও খ্যাতি বিচিত্রা থেকেই। বিচিত্রায় প্রকাশিত একটি আলোকচিত্রের জন্য তিনি সত্তরের দশকে প্রথম একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভের গৌরব অর্জন করেন।
এই কৃতী আলোকচিত্র শিল্পীর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা শুধুই পেশাগত ছিল না, ছিল ব্যক্তিগত বন্ব্দুত্বের এবং বলা যায় পারিবারিক। আল-মাজী বিয়ে করেছিলেন সিরাজগঞ্জে। যতদূর মনে পড়ছে সিরাজগঞ্জে আল-মাজীদের নানাবাড়ি। মাজীর এক মামা আমানুল হক ছিলেন খ্যাতিমান আলোকচিত্রশিল্পী, যিনি বিস্তর পরিচিতি পেয়েছিলেন সত্যজিত্ রায়ের সঙ্গে কাজ করে, পেয়েছিলেন কলকাতার নতুন সাহিত্য পত্রিকার প্রচ্ছদে নিয়মিত তার তোলা ছবি প্রকাশের মধ্য দিয়ে। মাজী আমাকে তার বাসায় নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তার নবপরিণীতাকে দেখার জন্য। আমি সস্ত্রীক গিয়েছিলাম তাদের আজিমপুরের বাসায়। সেখানে পরিচয় হয়েছিল তার বাবা-মা, ছোট ভাই শরিফুল ইসলাম আল-মাজী, ছোট বোন লাবণ্য প্রমুখের সঙ্গে। ছোট ভাই-বোন দু’জনই ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন। শরিফ আল-মাজী চার বছর পড়ার পর লেখাপড়ায় ইস্তফা দিয়ে সাংবাদিকতায় ঢুকেছিলেন। লাবণ্য ডাক্তার হয়ে বেরিয়েছিলেন। শরিফের স্ত্রীও ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা ডাক্তার। আল-মাজী আমার বাসায় কয়েকবার এসেছেন। একবার এলেন অফিস থেকে এসাইনমেন্ট পেয়ে আমার স্ত্রীর ছবি তুলতে। আমার স্ত্রী রেখা আহমদ তখন অভিনয়ে বেশ নাম করেছেন। বিচিত্রা তখন একই মলাটে আনন্দ বিচিত্রা প্রকাশ করতে শুরু করেছে। পেছনের প্রচ্ছদকে তারা তখন পরিণত করেছিল আনন্দ বিচিত্রার প্রচ্ছদে। এই প্রচ্ছদ জুড়ে রেখার ছবি ছাপা হয়েছিল। ভেতরে ছাপা হয়েছিল ওর পরিচিতির সঙ্গে আরও কিছু ছবি। এসব ছবি তুলতেই আল-মাজী এসেছিলেন আমার বাসায়। ছবি তোলা নিয়ে অনেক মজার মজার রসিকতা করেছিলেন সেদিনের উদ্যমী তরুণ শামসুল ইসলাম আল-মাজী।
সেই আল-মাজী চলে এলেন আমেরিকায়। কেন এলেন তা আমার জানা নেই। স্ত্রী-সন্তানদের রেখে তার এভাবে চলে আসার কোনো অর্থ আমি খুঁজে পাইনি। তবে একবার এখান থেকে ফিরে যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার আসার পেছনে নিশ্চয় তার অনেক হিসাব-নিকাশ ছিল বলেই আমার মনে হয়েছিল। আর কোনোকিছু বিবেচনা না করেই যদি তিনি এসে থাকেন সেক্ষেত্রে বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না।
নিউইয়র্কে মাজীর অবস্থা দেখে আমি সত্যি সত্যি বিস্মিতই হয়েছিলাম। মাজী আসার বেশ কয়েক বছর পর ২০০০ সালের নভেম্বরের শেষদিকে আমি নিউইয়র্কে এসে মাজীর যে অবস্থা দেখেছি তার সঙ্গে ঢাকায় দেখা টগবগে প্রাণবন্ত মাজীকে মেলাতে পারছিলাম না। এমনকি যে রাতে তিনি ঢাকা থেকে উড়াল দেন সে রাতেও তাকে যত উচ্ছল দেখেছিলাম সে মাজীকে নিউইয়র্কে পেলাম না। মাজীকে দেখলাম পারকিনসন্সে আক্রান্ত, হাঁটতে-চলতে স্বাভাবিক নন। সোজা কথায় অসুস্থ। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে তার এত পরিবর্তন মেনে নিতে পারছিলাম না। দেখলাম এই অসুস্থতার মধ্যেও আলোকচিত্রই তার পেশা, ছবি তুলেই তিনি জীবিকা নির্বাহ করছেন। প্রচণ্ড বরফপড়া সন্ব্দ্যাতেও তাকে দেখলাম এক রেসল্টুরেন্টে কোনো একটি অনুষ্ঠানের ছবি তুলতে গেছেন। কিন্তু নিউইয়র্কের মতো শহরে ছবি তুলে জীবিকা নির্বাহ করা যায় কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ ছিল। বুঝতে অসুবিধা হয়নি জীবনটা তার কষ্টেই কাটছে। তাকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হয়েছিল এভাবে এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে থেকে লাভ কি? কিন্তু প্রশ্ন করিনি। মনে হয়েছিল এ প্রশ্নে তিনি কষ্ট পাবেন। তার এই অবস্থায় তিনি আমার কথায় কষ্ট পান তা আমি চাইনি।
নিউইয়র্কে আমার গুছিয়ে নিতে সময় লাগছিল। বাসা নিয়ে সংসার গুছিয়ে আল-মাজীকে একদিন ডাকলাম আমার বাসায়। ভেবেছিলাম কথাবার্তার ফাঁকে ওকে বলব এখানে যদি কিছু না করার থাকে তাহলে ফিরে যান দেশে। ফিরে যান স্ত্রী-সন্তানদের কাছে। কিন্তু আল-মাজী কয়েকবার কথা দিয়েও আসতে পারেননি। একা আসা বোধহয় তার পক্ষে সহজ ছিল না। আমার বাসা সাবওয়ে সেল্টশন থেকে বেশ একটু দূরেই ছিল। এসেছিলেন এক ঈদের রাতে আরও কয়েকজনের সঙ্গে তাদের গাড়িতে। সেদিনও কিছু তাকে বলতে পারিনি। অন্যদের সামনে তাকে কিছু বলাটা শোভন মনে হয়নি। তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত্ হতো বেশিরভাগ সময় জ্যাকসন হাইটসেই। কখনই তাকে একা পাইনি। আলাউদ্দিনের টেবিলে তার সঙ্গে আড্ডায় কেউ না কেউ থাকতেনই। সবার সঙ্গেই বসতাম। সবাই মিলে চা-টা খাওয়া হতো।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাকে যেতেই হলো। তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখেছি এখানকার বাংলাদেশী এলিট মহলে। তারাই উদ্যোগ নিয়ে তাকে দেশে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। তার জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। দিনব্যাপী একটি কর্মসূচি নিয়েছিলেন তারা। যেখানে আল-মাজী সবার পোট্রেট তুলে দিয়েছিলেন। বিনিময়ে তারা যে যা পারেন অর্থ দিয়েছিলেন। নিউইয়র্ক ত্যাগের আগে তার সঙ্গে দেখা করতে আমরা কয়েকজন গিয়েছিলাম তার বাসায়। তিনি থাকতেন এসেল্টারিয়ায় তার শ্যালকের সঙ্গে। এতজনকে একসঙ্গে দেখতে পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন আল-মাজী। তবে এটাই আমাদের দু’জনের শেষ দেখা ছিল না। তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল জ্যাকসন হাইটসেই, সাবওয়ে সেল্টশনে। এক রাতে আমি আর আমার স্ত্রী ম্যানহাটান থেকে সাত নম্বর ট্রেন ধরে এসে নেমেছিলাম জ্যাকসন হাইটসে। আল-মাজী ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলেন সেই একই নম্বরের ট্রেন ধরে এসেল্টারিয়া যাওয়ার জন্য। মাঝপথেই দেখা। হাত মেলালাম। যতক্ষণ কথা বললাম আমার হাতটা আল-মাজী ধরেই রইলেন। সেই শেষ হাতে হাত রাখা, সেই শেষ দেখা।
No comments