পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ by হাসান আজিজুল হক
পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কিছু বলতে হবে। কিছু বলা যাবে এবং একইভাবে কিছুই বলা হবে না_এ রকম একটা উপায়ের কথা আমি ভাবছিলাম। তার মানে আজ পর্যন্ত যা কিছু রবীন্দ্রনাথের এই বাংলাদেশে থাকা নিয়ে বলা হয়েছে, তার পরিমাপ করাই কঠিন। নতুন কথা বলার তো প্রশ্নই ওঠে না। সে জন্য ভাবছিলাম লিখতেই যদি কিছু হয়, তাহলে আগে ঠিক করে নিতে হবে, তেমন কোনো কথা কী আছে, যা এ পর্যন্ত বলা হয়নি। ভেবে দেখছি তেমন কিছু আমি অন্তত খুঁজে বের করতে
পারছি না। সে ক্ষেত্রে একমাত্র উপায় হচ্ছে আবোল-তাবোল বলা। তার অর্থ দাঁড়াবে প্রচুর বলা, আর তার ভেতর দিয়ে কিছুই না বলা। 'হ-য-ব-র-ল'তে গেছো দাদা কোথায় থাকেন সেটার একটা ভালো উপায় বলা হয়েছে। প্রথমে দেখতে হবে গেছো দাদা এখন কোথায় নেই। তারপর দেখতে হবে দাদা কোথায় থাকতে পারেন। তারপর খানিকক্ষণ চুপ করে থাকতে হবে। তারপর একটা আঁক কষে বলতে হবে, এই মনে করো তুমি। তারপর খানিকক্ষণ পর একটা আঁক কষে বলতে হবে, এই মনে করো গেছো দাদা বউদি রান্না করছে। এই উপায়টা ধরলে রবীন্দ্রনাথ কখন কোথায় ছিলেন, কখন কোথায় ছিলেন না, তারপর কোথায় থাকতে পারতেন, তারপর পদ্মার চরের এক কিনারায় বোটে বসে আছেন। মোটামুটিভাবে গল্প শেষ। কাজেই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা না করে আমি বরং কবে শিলাইদহ গিয়েছিলাম, কবে শাহজাদপুর গিয়েছিলাম, পতিসরে গিয়ে কী করেছিলাম_এ নিয়ে কিছু কথা বলি।
শিলাইদহে প্রথম যেতে আমার খুবই কষ্ট হয়েছিল। কুষ্টিয়া শহরের গায়ে বইছে গড়াই নদ। বইছে যে স্রোতটুকু সেখানে পেঁৗছতে এক কিলোমিটার যেতে হলো যষ্ঠি (জ্যৈষ্ঠ) মাসের আগুনতপ্ত বালুর ওপর দিয়ে। স্রোতের কাছে বালু, যেখানটায় ভেজা সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। পারাপারের নৌকাটা কখন ওপারের যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে এপারে আসে। এলোমেলো গরম হাওয়া বইছে, তাতে ভূতের আকার নিচ্ছে ঘূর্ণির ভেতরের বালু। পরের মুহূর্তেই অদৃশ্য সেই বালুমুক্তি। দুপুরটাকে রাত দুপুরের মতো নির্জন নিঃশব্দ ছমছমে লাগছে। ওপারের গ্রামটা দেখা যায়। হতচ্ছাড়া চেহারা সেই গাঁয়ের। শিলাইদহের ভূমিকা কী? রবীন্দ্রনাথ যে শিলাইদহে ছিলেন, সেখানে যেভাবে পেঁৗছেছিলেন সে কত দিন আগে ১০০ বছরেরও বেশি। এই একই রকম ছিল কি তখন?
খেয়াপারের নৌকো এপারে এলে বন্ধুবান্ধবসহ পাঁচ-সাতজন তাতে উঠলাম। নৌকোয় আর বসে নেই, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুলছি। ওপারে নৌকো থেকে নেমে আবার বালুচর, তারপর মাটি ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া পাড়ে উঠে, পাড়ের দুই পাশের বাড়িগুলোর দিকে চেয়ে দেখি আর রবীন্দ্রনাথ খুঁজি। মনে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ এখানে নেই। কয়েকটা ঘোড়ার গাড়ি অপেক্ষা করছে। ঘোড়াগুলোর অবস্থা যাচ্ছেতাই। গাড়িগুলোর অবস্থাও যাচ্ছেতাই। গাড়োয়ানদের অবস্থা আরো যাচ্ছেতাই। ঘোড়ার চোখেও পিঁচুটি। গাড়োয়ানের চোখেও পিঁচুটি। গড়াইয়ের ওই পাড় ধরেই শিলাইদহ যেতে হবে। একটু পরই পাড় ছেড়ে উঁচু গ্রাম্য রাস্তা। দুই পাশে গ্রাম আরেকটু সবুজ। আরেকটু কম ধুলমাখা। গাছপালা, লতাপাতায় ছায়া রোদে যেন হাঁপাচ্ছে। দু-একটি বাড়ি চোখে পড়ছে। সরু পথ ধরে দৃষ্টি গিয়ে পেঁৗছাচ্ছে ধবধবে নিকোনো সাদা উঠোনে। হঠাৎ মনে হলো_রবীন্দ্রনাথ এখানে কী? এই বাড়িটা কী দুঃখীরামের। বড় বউ-ছোট বউয়ের প্রচণ্ড কলহ কানে আসছে কী? দুঃখীরামরা দুই ভাই বেগার খাটত।
দুই ভাই বেগার খাটতে গিয়েছিল। তারা নিজেরা গিয়েছিল বলা যাবে না, জমিদারের পেয়াদা এসে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাদের। সারা দিন খাটুনি গিয়েছে_একটু খাবারও জোটেনি। সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরে দুঃখীরাম তার বউকে বলছে_খেতে দে। দুঃখীরামের বউ জবাবে বলছে_তুই কি চাল আনিয়া দিয়া গিয়েছিলি। দুঃখীরাম তার পরও বলছে_চাল নাই কেন। বউ বলল_আমি কি রোজগার করিয়া আনিব। কথার ইঙ্গিতটুকু বুঝতে পেরে দুঃখীরামের মাথায় চড়ে গেল রক্ত। হাতের দা-খানা বরাবর মাথায় দিল বসিয়ে। এবং রবীন্দ্রনাথের ভাষায়_'মৃত্যু হইতে বিলম্ব হইলো না।' এই হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব কে নেবে? দুঃখীরাম বাড়ির কর্তা_সে তো দায়িত্ব নিতে পারে না। ছোটবউ চন্দরার স্বামী ছিল। সেই-বা কী করে দায়িত্ব নিতে পারে। কাজেই খুনের দায়টা নিতে হবে ছোটবউ চন্দরাকে। গল্পটা এখন একবার পড়েই দেখুন না, মনে কি হবে রবীন্দ্রনাথ এদের কাউকেই চিনতেন না? দূর থেকে এদের দেখেছেন এবং কল্পনা করে গল্প ফেঁদেছেন। চন্দরার মৃত্যুদণ্ড হলো। তাকে একবার জিজ্ঞেস করা হলো_'কাহাকে কি দেখিতে ইচ্ছা করে।' চন্দরা তার মাকে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করল। তোমার স্বামীকে দেখিতে ইচ্ছা করে না? কী জবাব এই প্রশ্নের? জবাবটা নিয়ে ভাবতে থাকুন। চন্দরার জবাব ছিল 'মরণ'!
এই যে, আরো অনেকটা এগিয়ে এসেছি। দুর্বল বৃদ্ধ ঘোড়াটি আর গাড়ি টানতে পারে না। জনপদে শুধুই রবীন্দ্রনাথ। একটির পর একটি গল্প মনে পড়ছে। এখানেই কোথাও সম্পত্তি সমর্পণ হয়েছিল। পৌত্রকে মাটির তলায় অনেক ঘড়াভর্তি মোহরগুলোকে যক্ষ হিসেবে রক্ষণ করার জন্য পিতামহ পৌত্রকেই মাটির তলায় রেখে চলে গেল। তারপর যাকেই সামনে পায় জিজ্ঞাসা করে_কান্নার শব্দ শুনিতে পাইতেছ কি? রামকানাইয়ের মতো নির্বোধ মানুষের গল্প যদি কোথাও লেখা হতো অসুবিধা কী?
এসব দেখতে দেখতে শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে পেঁৗছে যাই। সেই শক্তসমর্থ গড়নের লাল দোতলা বাড়িটি। ছাদে উঠে ওপাশের পর্দা পর্যন্ত দেখা যায়। এখন মর্জি হয়েছে কর্তৃপক্ষের বাড়িটা আরো সুন্দর দেখানোর জন্য_তার রং বদলে ফেলা হয়েছে। কী রং হয়েছে, আমি দেখিনি। এর মধ্যে আর যাইনি। যাবার ইচ্ছাও অনেকটা মরে এসেছে। তার চেয়ে বরং পুরনো বাড়িটাই দেখি। অতটুকু বাড়ি কিন্তু ছবিটি কী বিশাল। চারিদিকে নিচু ঢেউখেলানো পাঁচিল। আরো খানিকটা এগিয়ে গেলে ঘাটঅলা পুকুর। দুপাশে দুটি বকুলগাছ। বাঁধা ঘাটে প্রচুর শুকনো বকুল ফুল। সেখানে বসে কোন গানটা মনে মনে গুনগুন করে গাইব?
দারুণ অগি্ন বাসেরে...
কোন কবিতাটি মনে পড়বে
বেলা দ্বিপ্রহর
রৌদ্রতাপ ঝাঁ ঝাঁ করে
এখানে আমরা এসেছি বন্ধুবান্ধব নিয়ে পিকনিক করতে। রান্নাবান্না শেষ হয়ে গেলে সবাই খেতে বসেছি। আশপাশের গ্রামগুলো থেকে ন্যাংটো অনাহারক্লিষ্ট শিশুরা আর তাদের মলিন ছিন্ন শাড়ি পরা মায়েরা আমাদের ঘিরে ধরেছে। রবীন্দ্রনাথ কি তাদের বাঁচাবেন? মহাজনের শোষণ থেকে? তাঁর নোবেল পুরস্কারের টাকা থেকে? খাওয়া শেষ হয়ে গেলে সবচেয়ে সুন্দরী টকটকে ফর্সা মহিলাটি উঠে ছুটে কুঠিবাড়ির দিকে গেলেন বমি করে সব তাঁর উগরে দেওয়ার জন্য।
হায় রবীন্দ্রনাথ! হায় রবীন্দ্রনাথের পূর্ববাংলা! তবু সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ে, তবু গান আসে মনে_'গোধূলি লগন মেখে রেখেছিল কারা।' এরপর রাত এগোতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ কুঠিবাড়ি থেকে ফিরে কাছারিবাড়ি পেরিয়ে পদ্মার আদিগন্ত বালি সমুদ্রের কিনারায় গিয়ে বসেন। রাত বাড়তে থাকে। অন্ধকার আকাশে তারাগুলো ঝকঝকে নিষ্ঠুর ছোরার মতো আলো ছুড়ছে। রাত বাড়ায় একটা পাখি ডেকে উঠল। রবীন্দ্রনাথ শুনতে পেলেন, ও কে, ও কে, ও কে গো?
[শিলালিপি ৫ মে ২০১১]
No comments