৪ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী অবৈধ! by এহসানুল হক
অবৈধভাবে সরকারি চাকরি করছেন প্রায় চার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। সরকারের বিভিন্ন সমাপ্ত প্রকল্পের এই লোকবলকে বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে রাজস্ব খাতে। 'অসাধু বাণিজ্যের' মাধ্যমে শুধু স্থায়ী সরকারি চাকরি বাগানোই নয়, মোটা অঙ্কের টাকাও হাতানো হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কমপক্ষে পাঁচ বছরের মাথায় রাজস্ব বাজেটের অধীনে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। এই মধ্যবর্তী সময়কে নিয়মিত চাকরি বা চাকরিকাল গণনা করে তাঁদের বকেয়া বেতনও ধরা হয়েছে। আর এই বকেয়া বেতন বাবদ সরকারের রাজস্ব খাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে প্রায় ১৬৮ কোটি টাকা।
এভাবে 'চতুর অনিয়মের' মাধ্যমে সরকারের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন স্তরের স্থায়ী পদে চাকরি ও উপরি বাগানোর ঘটনা বর্তমান মহাজোট সরকার আমলে জনপ্রশাসনের সবচেয়ে বড় ধরনের দুর্নীতি বলে আলোচিত হচ্ছে। অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, নিয়ম মেনে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ না দেওয়ায় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে জায়গা করে নিয়েছেন অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা। আর পদ সৃষ্টি করে নিয়োগ দেওয়ার বিধান থাকলেও তা না করায় জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের নির্ধারিত অর্গানোগ্রামেও। এমনকি রাজস্ব খাতে নিয়োগ-সংক্রান্ত সব প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য নীতিনির্ধারণকারী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের (সাবেক সংস্থাপন) মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানোর বিধান থাকলেও তা পাশ কাটিয়ে সেই প্রস্তাব সরাসরি অনুমোদন করিয়ে নেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, উন্নয়ন প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে লোকবল স্থানান্তরের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধিমালা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের। ২০০৫ সালের জুন মাসে এ-সংক্রান্ত বিধিমালা (এসআরও নম্বর ১৮২) জারি করা হয়। এতে বলা হয়েছে, ১৯৭২ সালের ৯ এপ্রিল থেকে ১৯৯৭ সলের ৩০ জুনের মধ্যে শুরু হওয়া সরকার অনুমোদিত উন্নয়ন বাজেটভুক্ত প্রকল্পের জনবল রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করা যাবে।
সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে লোক নিয়োগের ব্যাপারে তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয় ১৯৯৭ সালে একটি পরিপত্র জারি করে, যেটি অদ্যাবধি কার্যকর রয়েছে। ওই পরিপত্রে বলা হয়েছে, '১ জুলাই ১৯৯৭ থেকে শুরু হওয়া প্রকল্পে জনবল সাকুল্য বেতন ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিধান রয়েছে। শর্ত অনুযায়ী প্রকল্পের জনবলের অনকূলে দেওয়া নিয়োগপত্রই প্রকল্প শেষে অব্যাহতিপত্র অর্থাৎ প্রকল্প শেষে জনবল আর কর্মরত নেই বলে গণ্য হবে।' এ পরিপত্রের ফলে ১ জুলাই ১৯৯৭ থেকে শুরু হওয়া কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের লোকবলকে রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তরের সুযোগ নেই।
এ ছাড়া ১৯৯৭ সালের ১ জুলাইয়ের পর থেকে শুরু হওয়া উন্নয়ন প্রকল্পের লোকবলকে রাজস্ব বাজেটে সরাসরি স্থানান্তর না করার বিষয়ে ২০০৫ সালে আরেকটি বিধিমালা (এসআরও নম্বর ১৮৩) জারি করা হয়। এ বিধিমালা মতে, শুধু প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নতুন চাকরি হিসেবেই রাজস্ব বাজেটের চাকরিতে ঢুকতে পারবেন উন্নয়ন বাজেটের কর্মীরা। এ ক্ষেত্রে সরকারি চাকরির বয়সসীমাও শিথিলের সুযোগ থাকবে সমাপ্ত প্রকল্পের প্রার্থীদের।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত আড়াই বছরে এসব বিধিমালা বা পরিপত্রের বিধান অনুসরণ না করেই ১৯৯৭ সালের ১ জুলাইয়ের পর থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী সময়ে শেষ হওয়া উন্নয়ন প্রকল্পের তিন হাজার ৯৪০ জনকে রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনেই বিভিন্ন প্রকল্পের লোকবলের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রকল্পগুলোর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর থেকে রাজস্ব বাজেটে নিয়োগ পাওয়া পর্যন্ত সময়কে চাকরিকাল দেখানো হয়েছে। এতে কাজ না করেও অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বকেয়া বেতন বাবদ সরকারকে গচ্চা দিতে হচ্ছে ১৬৭ কোটি ৪১ লাখ ৪০ হাজার ৫০৮ টাকা। ইতিমধ্যেই মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি প্রকল্পের লোকবলকে রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তর করায় বকেয়া বেতন বাবদ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেওয়া হয়েছে প্রায় ২৮ কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, এসব ক্ষেত্রে নিয়মের তোয়াক্কা না করে সাবেক সংস্থাপন মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদন পেতে সরাসরি প্রস্তাব দেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। 'সংশ্লিষ্ট সব পরিপত্রের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বিশেষ বিবেচনায়' অনুমোদন দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয় সেসব প্রস্তাবে। জানা গেছে, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সংশ্লিষ্টদের 'ম্যানেজ' করার মাধ্যমে নির্বিঘ্নে অনুমোদন পেয়ে যায় মন্ত্রণালয়গুলো। নিয়োগের আগে পদ সৃষ্টির বিধান থাকলেও নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয় আগেই। এ নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অর্গানোগ্রামে সৃষ্টি হয়েছে নানা জটিলতা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একরকম বাধ্য হয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন সচিব মো. ইকবাল মাহমুদ গত রবিবার সকালে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি বলব, এসব নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে।' জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব না পাঠানো এবং পদ সৃষ্টি না করে নিয়োগের সিদ্ধান্তের বিষয়ে তিনি বলেন, 'এ ব্যাপারে আমি কিছু বলব না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে জিজ্ঞেস করুন।' উল্লেখ্য, রবিবার সন্ধ্যায় ইকবাল মাহমুদকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব পদে বদলি করা হয়।
এ প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। পরিপত্রের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নিয়োগের কথা স্বীকার করে গত রবিবার দুপুরে সচিবালয়ে তাঁর দপ্তরে বসে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শুধু আমার মন্ত্রণালয়ই নয়, একই ধরনের নিয়োগ অন্য মন্ত্রণালয়েও হয়েছে। সমাপ্ত প্রকল্পের সংশ্লিষ্টদের রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তর করা জরুরি ছিল বলেই এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।' পাশাপাশি সংসদীয় স্থায়ী কমিটিরও এ ব্যাপারে সুপারিশ ছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে না পাঠিয়ে সরাসরি নিজ মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব পাঠানোর কারণ জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, যেহেতু উন্নয়ন প্রকল্প থেকে রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তরের বিষয়ে বিধিনিষেধ আছে, তাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব পাঠানোর ক্ষেত্রে সেটি বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এ জটিলতা এড়ানোর জন্যই নিজ মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। সরকারের বৈধ অনুমোদনের পরই লোকবল স্থানান্তর করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
পদ সৃষ্টি না করে লোকবল নিয়োগের প্রশ্নে সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, এতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। অর্গানোগ্রাম পুনর্গঠন করে বিদ্যমান সমস্যা নিরসন করা হয়েছে।
প্রতিমন্ত্রী ড. শিরীন আরো বলেন, সমাপ্ত প্রকল্পের লোকবল রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তরের জন্য তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কাছেও স্মারকলিপি দিয়েছিলেন। তাঁরা বেকার অবস্থায় রাস্তায় নেমে ছিলেন। বিষয়টিও বিবেচনায় আনা হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সালের ১ জুলাইয়ের পর থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী সময়ে শেষ হওয়া উন্নয়ন প্রকল্পের লোকবলের সংখ্যা প্রায় ৪৭ হাজার। এর মধ্যে বিধিবিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে স্থায়ী চাকরি পেয়েছেন প্রায় চার হাজার জন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আকবর আলি খান কালের কণ্ঠকে বলেন, অবশ্যই স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়োগ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে পরিপত্র বা বিধিবিধানের ব্যত্যয় না ঘটিয়ে প্রয়োজনে তা পরিবর্তন করা বাঞ্ছনীয়।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ 'খাদ্য নিরাপত্তাহীন দরিদ্র মহিলাদের উন্নয়ন' নামের সমাপ্ত প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর হয়েছেন এমন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে জানান, তিনি তাঁর বকেয়া বেতন পেয়েছেন। চাকরি পেতে কোনো টাকা খরচ হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'দয়া করে এসব বিষয় নিয়ে কোনো কিছু লেখালিখি করবেন না। পেটে লাথি দেবেন না। ভাই, অনেক পথঘাট পেরিয়ে রাজস্ব বাজেটে ঢুকেছি। চাকরি হারালে পথে বসব। আর বাংলাদেশে এ ধরনের কাজ কি সহজে পাওয়া যায়? টাকা খরচ হওয়াটা কি স্বাভাবিক না?' ক্ষমতাসীন দলের চ্যানেল এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ম্যানেজ করতে যেটা প্রয়োজন, সেটাই করা হয়েছে বলে জানান তিনি। যাঁরা তা করতে পারেননি, তাঁদের ভাগ্যে রাজস্ব বাজেটের চাকরি জোটেনি।
এ কর্মকর্তার মতো প্রায় একই সুরে কথা বললেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিভিন্ন সমাপ্ত প্রকল্প থেকে রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তর হওয়া একাাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এক প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা প্রায় সবাই একমত পোষণ করে বলেন, এ বিষয় নিয়ে আলোচনা উঠলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হবে। যাঁদের চাকরি হয়নি, তাঁরা আবার নতুন করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবেন। এতে তাঁদের চাকারি হারানোরও আশঙ্কা থাকবে। তবে কেউ কেউ মনে করেন, তাঁদের চাকরি এখন সম্পূর্ণ বৈধ। যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে, সেটি সরকারের; তাঁদের নয়। তাঁদের চাকরির ওপর যদি হাত দেওয়া হয়, তাহলে প্রয়োজনে তাঁরা আদালতের শরণাপন্ন হবেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, উন্নয়ন প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে লোকবল স্থানান্তরের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধিমালা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের। ২০০৫ সালের জুন মাসে এ-সংক্রান্ত বিধিমালা (এসআরও নম্বর ১৮২) জারি করা হয়। এতে বলা হয়েছে, ১৯৭২ সালের ৯ এপ্রিল থেকে ১৯৯৭ সলের ৩০ জুনের মধ্যে শুরু হওয়া সরকার অনুমোদিত উন্নয়ন বাজেটভুক্ত প্রকল্পের জনবল রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করা যাবে।
সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে লোক নিয়োগের ব্যাপারে তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয় ১৯৯৭ সালে একটি পরিপত্র জারি করে, যেটি অদ্যাবধি কার্যকর রয়েছে। ওই পরিপত্রে বলা হয়েছে, '১ জুলাই ১৯৯৭ থেকে শুরু হওয়া প্রকল্পে জনবল সাকুল্য বেতন ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিধান রয়েছে। শর্ত অনুযায়ী প্রকল্পের জনবলের অনকূলে দেওয়া নিয়োগপত্রই প্রকল্প শেষে অব্যাহতিপত্র অর্থাৎ প্রকল্প শেষে জনবল আর কর্মরত নেই বলে গণ্য হবে।' এ পরিপত্রের ফলে ১ জুলাই ১৯৯৭ থেকে শুরু হওয়া কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের লোকবলকে রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তরের সুযোগ নেই।
এ ছাড়া ১৯৯৭ সালের ১ জুলাইয়ের পর থেকে শুরু হওয়া উন্নয়ন প্রকল্পের লোকবলকে রাজস্ব বাজেটে সরাসরি স্থানান্তর না করার বিষয়ে ২০০৫ সালে আরেকটি বিধিমালা (এসআরও নম্বর ১৮৩) জারি করা হয়। এ বিধিমালা মতে, শুধু প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নতুন চাকরি হিসেবেই রাজস্ব বাজেটের চাকরিতে ঢুকতে পারবেন উন্নয়ন বাজেটের কর্মীরা। এ ক্ষেত্রে সরকারি চাকরির বয়সসীমাও শিথিলের সুযোগ থাকবে সমাপ্ত প্রকল্পের প্রার্থীদের।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত আড়াই বছরে এসব বিধিমালা বা পরিপত্রের বিধান অনুসরণ না করেই ১৯৯৭ সালের ১ জুলাইয়ের পর থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী সময়ে শেষ হওয়া উন্নয়ন প্রকল্পের তিন হাজার ৯৪০ জনকে রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনেই বিভিন্ন প্রকল্পের লোকবলের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রকল্পগুলোর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর থেকে রাজস্ব বাজেটে নিয়োগ পাওয়া পর্যন্ত সময়কে চাকরিকাল দেখানো হয়েছে। এতে কাজ না করেও অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বকেয়া বেতন বাবদ সরকারকে গচ্চা দিতে হচ্ছে ১৬৭ কোটি ৪১ লাখ ৪০ হাজার ৫০৮ টাকা। ইতিমধ্যেই মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি প্রকল্পের লোকবলকে রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তর করায় বকেয়া বেতন বাবদ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেওয়া হয়েছে প্রায় ২৮ কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, এসব ক্ষেত্রে নিয়মের তোয়াক্কা না করে সাবেক সংস্থাপন মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদন পেতে সরাসরি প্রস্তাব দেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। 'সংশ্লিষ্ট সব পরিপত্রের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বিশেষ বিবেচনায়' অনুমোদন দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয় সেসব প্রস্তাবে। জানা গেছে, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সংশ্লিষ্টদের 'ম্যানেজ' করার মাধ্যমে নির্বিঘ্নে অনুমোদন পেয়ে যায় মন্ত্রণালয়গুলো। নিয়োগের আগে পদ সৃষ্টির বিধান থাকলেও নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয় আগেই। এ নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অর্গানোগ্রামে সৃষ্টি হয়েছে নানা জটিলতা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একরকম বাধ্য হয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন সচিব মো. ইকবাল মাহমুদ গত রবিবার সকালে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি বলব, এসব নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে।' জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব না পাঠানো এবং পদ সৃষ্টি না করে নিয়োগের সিদ্ধান্তের বিষয়ে তিনি বলেন, 'এ ব্যাপারে আমি কিছু বলব না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে জিজ্ঞেস করুন।' উল্লেখ্য, রবিবার সন্ধ্যায় ইকবাল মাহমুদকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব পদে বদলি করা হয়।
এ প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। পরিপত্রের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নিয়োগের কথা স্বীকার করে গত রবিবার দুপুরে সচিবালয়ে তাঁর দপ্তরে বসে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শুধু আমার মন্ত্রণালয়ই নয়, একই ধরনের নিয়োগ অন্য মন্ত্রণালয়েও হয়েছে। সমাপ্ত প্রকল্পের সংশ্লিষ্টদের রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তর করা জরুরি ছিল বলেই এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।' পাশাপাশি সংসদীয় স্থায়ী কমিটিরও এ ব্যাপারে সুপারিশ ছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে না পাঠিয়ে সরাসরি নিজ মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব পাঠানোর কারণ জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, যেহেতু উন্নয়ন প্রকল্প থেকে রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তরের বিষয়ে বিধিনিষেধ আছে, তাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব পাঠানোর ক্ষেত্রে সেটি বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এ জটিলতা এড়ানোর জন্যই নিজ মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। সরকারের বৈধ অনুমোদনের পরই লোকবল স্থানান্তর করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
পদ সৃষ্টি না করে লোকবল নিয়োগের প্রশ্নে সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, এতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। অর্গানোগ্রাম পুনর্গঠন করে বিদ্যমান সমস্যা নিরসন করা হয়েছে।
প্রতিমন্ত্রী ড. শিরীন আরো বলেন, সমাপ্ত প্রকল্পের লোকবল রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তরের জন্য তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কাছেও স্মারকলিপি দিয়েছিলেন। তাঁরা বেকার অবস্থায় রাস্তায় নেমে ছিলেন। বিষয়টিও বিবেচনায় আনা হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সালের ১ জুলাইয়ের পর থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী সময়ে শেষ হওয়া উন্নয়ন প্রকল্পের লোকবলের সংখ্যা প্রায় ৪৭ হাজার। এর মধ্যে বিধিবিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে স্থায়ী চাকরি পেয়েছেন প্রায় চার হাজার জন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আকবর আলি খান কালের কণ্ঠকে বলেন, অবশ্যই স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়োগ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে পরিপত্র বা বিধিবিধানের ব্যত্যয় না ঘটিয়ে প্রয়োজনে তা পরিবর্তন করা বাঞ্ছনীয়।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ 'খাদ্য নিরাপত্তাহীন দরিদ্র মহিলাদের উন্নয়ন' নামের সমাপ্ত প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর হয়েছেন এমন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে জানান, তিনি তাঁর বকেয়া বেতন পেয়েছেন। চাকরি পেতে কোনো টাকা খরচ হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'দয়া করে এসব বিষয় নিয়ে কোনো কিছু লেখালিখি করবেন না। পেটে লাথি দেবেন না। ভাই, অনেক পথঘাট পেরিয়ে রাজস্ব বাজেটে ঢুকেছি। চাকরি হারালে পথে বসব। আর বাংলাদেশে এ ধরনের কাজ কি সহজে পাওয়া যায়? টাকা খরচ হওয়াটা কি স্বাভাবিক না?' ক্ষমতাসীন দলের চ্যানেল এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ম্যানেজ করতে যেটা প্রয়োজন, সেটাই করা হয়েছে বলে জানান তিনি। যাঁরা তা করতে পারেননি, তাঁদের ভাগ্যে রাজস্ব বাজেটের চাকরি জোটেনি।
এ কর্মকর্তার মতো প্রায় একই সুরে কথা বললেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিভিন্ন সমাপ্ত প্রকল্প থেকে রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তর হওয়া একাাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এক প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা প্রায় সবাই একমত পোষণ করে বলেন, এ বিষয় নিয়ে আলোচনা উঠলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হবে। যাঁদের চাকরি হয়নি, তাঁরা আবার নতুন করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবেন। এতে তাঁদের চাকারি হারানোরও আশঙ্কা থাকবে। তবে কেউ কেউ মনে করেন, তাঁদের চাকরি এখন সম্পূর্ণ বৈধ। যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে, সেটি সরকারের; তাঁদের নয়। তাঁদের চাকরির ওপর যদি হাত দেওয়া হয়, তাহলে প্রয়োজনে তাঁরা আদালতের শরণাপন্ন হবেন।
No comments