দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন
জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গতকাল সোমবার অভিযোগ গঠন করে আদেশ দেন। সাঈদীর বিরুদ্ধে গণহত্যা, ধর্ষণ, হত্যা, লুটপাট, অগি্নসংযোগসহ ২০টি অভিযোগ এনেছেন ট্রাইব্যুনাল। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(সি), ৩(২)(জি) এবং ৩(২)(এইচ) ধারায় এ অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
একই সঙ্গে সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে আগামী ৩০ অক্টোবর। এ অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হলো সাঈদীর বিরুদ্ধে। ৪০ বছর আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সংঘটিত অপরাধে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই প্রথম বিচার শুরু হলো।
সাঈদী অবশ্য নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করে ট্রাইব্যুনালে বলেছেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগে নাটক মঞ্চায়ন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, 'আমি কোনো দিন রাজাকার ছিলাম না। ১৯৮০ সালে জামায়াতে ইসলামীর মজলিশে শুরার সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর আমার বিরুদ্ধে রাজাকার হিসেবে মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে। মূলত ভারতীয় রাজাকাররাই আমাকে রাজাকার বলছে।'
বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গতকাল অভিযোগ গঠন করে আদেশ দেন। আগামী ৩০ অক্টোবর রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে। একই সঙ্গে এ সময়ের মধ্যে সাঈদীর পক্ষে সাক্ষীদের একটি তালিকা ট্রাইব্যুনালে জমা দিতে সাঈদীর আইনজীবীদের নির্দেশ দেওয়া হয়।
আদেশের পর সাঈদীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম এ সময়কে অপ্রতুল দাবি করে সাংবাদিকদের বলেন, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠনের পর আসামিপক্ষকে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য কমপক্ষে ছয় মাস সময় দেওয়া হয়।
রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাঈদীর বিরুদ্ধে একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিন হাজারেরও বেশি নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা বা হত্যায় সহযোগিতা, ৯ জনেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ, বিভিন্ন বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অগি্নসংযোগ, লুটপাট, ভাঙচুর এবং এক শ থেকে দেড় শ হিন্দু লোককে ধর্মান্তরে বাধ্য করাসহ মোট ৩১টি অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উত্থাপন করা হলেও ট্রাইব্যুনাল ২০ অপরাধে অভিযোগ গঠন করেন।
অভিযোগ গঠনের পর ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মো. শাহিনুর ইসলাম প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, অভিযোগ গঠনের আদেশের মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার শুরু হলো। তিনি বলেন, 'ট্রাইব্যুনাল মনে করেন, কথিত সময়ে ও স্থানে ১৯৭৩ সালের আইনের ৩(২) ধারার অভিযোগগুলো সংঘটিত হয়েছে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি ওই সব অভিযোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে প্রাথমিকভাবে দেখা যায়। ট্রাইব্যুনাল আরো মনে করেন, কোনো প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য ছাড়া অভিযোগ গঠন পর্যায়ে শুধু ট্রাইব্যুনালের সামনে থাকা কাগজপত্র ও দলিলাদি পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়।'
রাষ্ট্রপক্ষে প্রধান প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু ও প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, সাঈদীর বিরুদ্ধে পিরোজপুরে ২০ অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
গতকাল সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন প্রশ্নে আদেশের জন্য দিন ধার্য ছিল। এ জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সকাল সাড়ে ৮টায় কড়া নিরাপত্তার মধ্যে সাঈদীকে পুরনো হাইকোর্ট ভবনে স্থাপিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হয়। সাড়ে ১০টায় বিচারকরা এজলাসে বসেন। এর কয়েক মিনিট আগেই সাঈদীকেও বিচারকক্ষে নেওয়া হয়।
ট্রাইব্যুনাল প্রথমে এর কর্মকাণ্ড নিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশ করায় নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক ও প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেন। এরপর সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষীদের নিরাপত্তা চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা একটি আবেদন উপস্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করে দেন। তবে আবেদনটি নথিতে থাকবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। এর আগে আবেদনটি পুরোপুরি খারিজের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী আপত্তি জানানোর পর ট্রাইব্যুনাল পরবর্তী আদেশ দেন। এরপর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ দেওয়া শুরু করেন।
অভিযোগ গঠন করার মতো যথেষ্ট উপাদান রয়েছে : শুরুতেই ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হওয়া, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি ও ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তান সরকারের নির্যাতন-নিপীড়ন, অগণতান্ত্রিক আচরণ তুলে ধরেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান। এর পরই রাষ্ট্রপক্ষ ও সাঈদীর আইনজীবীর বক্তব্যের মূল অংশ সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরেন। এরপর ট্রাইব্যুনাল নিজের যুক্তি তুলে ধরে অভিযোগ গঠন করে আদেশ দিয়ে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের দাখিল করা দলিল ও কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অভিযোগ গঠন করার মতো যথেষ্ট উপাদান রয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়, আসামিপক্ষ অভিযোগ থেকে অব্যাহতির সপক্ষে যথাযথ যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি বলে তাদের আবেদন আমলে নেওয়ার কারণ নেই।
সাঈদী রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন : ট্রাইব্যুনাল আরো বলেন, আসামিপক্ষ আন্তর্জাতিক আইন বা রীতিনীতি মেনে চলার যে যুক্তি দেখিয়েছে, তা মেনে চলা বাধ্যতামূলক নয়। সুনির্দিষ্ট ২০টি ঘটনা উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনাল বলেন, প্রতিবেদন অনুযায়ী সাঈদী রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগি্নসংযোগ, হিন্দুদের জোর করে ধর্মান্তর করানো, লুটতরাজসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব অপরাধ সংঘটিত হয় তৎকালীন বরিশাল জেলার পিরোজপুর মহকুমায়, যা বর্তমানে পিরোজপুর জেলা।
অভিযোগগুলো ইংরেজিতে পড়ার পর ট্রাইব্যুনাল সাঈদীর বক্তব্য জানতে চান। ওই সময় সাঈদীর আইনজীবী তাজুল ইসলাম দাঁড়িয়ে তা বাংলায় পড়ার আবেদন করে বলেন, ২০টি অভিযোগ আনা হয়েছে। তাই বোঝার জন্য তাঁকে সময় দিতে হবে। তাজুল ইসলামের এ আবেদনে ট্রাইব্যুনাল বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, 'এ কী বলছেন!' কয়েক মিনিট উভয়ের মধ্যে কথোপকথন চলার পর সাঈদীকে সামনে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর সাঈদীকে আসামির কাঠগড়া থেকে দুই পুলিশ সদস্য ধরে নিয়ে সাক্ষীর কাঠগড়ায় একটি চেয়ারে বসিয়ে দেন। এরপর ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ বাংলায় পড়া শুরু করেন। তবে সাঈদী বলেন, 'বাংলায় বলার প্রয়োজন নেই। আমি ইংরেজি বুঝেছি।'
এরপর ট্রাইব্যুনাল কাঠগড়ায় দাঁড়ানো সাঈদীকে বলেন, 'বলুন, আপনি দোষী কি না?'
সাঈদী বলেন, 'আমি আমার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে চাই।' এ পর্যায়ে আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই জানানোর পর তিনি কিছুক্ষণ বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ চান আদালতের কাছে। আবেদন গৃহীত হলে প্রায় আট মিনিট বক্তব্য দেন সাঈদী।
সব মিথ্যা, মিথ্যা এবং মিথ্যা : সাঈদী বলেন, 'এ আদালতে আমাকে প্রথম যেদিন আনা হয়, সেদিনই আমি বুঝেছি, আমি শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মিথ্যাচারের শিকার হয়েছি। সেদিন আমার নাম বিকৃত করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হচ্ছিল।' তিনি বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পর মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো অভিযোগ আসেনি। ১৯৮০ সালে জামায়াতের মজলিশে শুরার সদস্য হওয়ার পর এটা আসতে শুরু করে। যখনই এ ধরনের অভিযোগ এসেছে, আমি প্রতিবাদ করেছি, সংসদে বলেছি, মামলা দায়ের করেছি, যার অনেকগুলো এখনো বিচারাধীন।' তিনি বলেন, 'মানবতাবিরোধী অপরাধ করা তো দূরে থাক, বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে দেশে-বিদেশে মানবতা রক্ষায় কাজ করেছি।' তিনি আরো বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে চার সহস্রাধিক পৃষ্ঠার একটি মিথ্যা রচনা তৈরি করা হয়েছে। এর প্রতিটি লাইন মিথ্যা, প্রতিটি শব্দ মিথ্যা। এটি সব মিথ্যা, মিথ্যা এবং মিথ্যা।' তিনি বলেন, 'রাজাকারের কমান্ডার হওয়া তো দূরে থাক, তাদের সঙ্গে আমার কোনোই সম্পর্ক ছিল না। আমি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলাম না, রাজাকার ছিলাম না। পাক বাহিনীর সঙ্গে আমি এক মিনিটের জন্যও বৈঠক করিনি।'
ওই সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, 'অভিযোগ গঠন মানে আপনি অপরাধী, বিষয়টা এমন নয়।' এরপর ট্রাইব্যুনাল ২০টি অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযোগ গঠন করেন।
গতকাল প্রসিকিউশনের পক্ষে ট্রাইব্যুনালে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান, সৈয়দ হায়দার আলী, জেয়াদ আল মালুম, আলতাফ উদ্দিন, ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পী প্রমুখ।
সাঈদীর পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ও ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমীন।
মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সিনিয়র নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং বিএনপি নেতা সাবেক মন্ত্রী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এমপি ও আবদুল আলীম কারাগারে আটক আছেন।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে এক মামলায় সাঈদীকে গত বছর ২৯ জুন গ্রেপ্তার করা হয়। তবে গত বছর ২ নভেম্বর তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এরপর ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা তদন্তকালে এ বছরের ১২ মে ধানমণ্ডির সেফহোমে নিয়ে তাঁকে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করে। ৩১ মে সাঈদীর বিরুদ্ধে চার হাজার ৭৪ পৃষ্ঠার ১৫ খণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া হয়। গত ১১ জুলাই ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উত্থাপন করে। এরপর উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ১৪ জুলাই ট্রাইব্যুনাল সাঈদীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন। গত ২৩ আগস্ট সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন প্রশ্নে শুনানি শুরু হয়। কয়েক দফা মুলতবি শেষে ২৭ সেপ্টেম্বর শুনানি শেষ হয়।
সাঈদী অবশ্য নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করে ট্রাইব্যুনালে বলেছেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগে নাটক মঞ্চায়ন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, 'আমি কোনো দিন রাজাকার ছিলাম না। ১৯৮০ সালে জামায়াতে ইসলামীর মজলিশে শুরার সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর আমার বিরুদ্ধে রাজাকার হিসেবে মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে। মূলত ভারতীয় রাজাকাররাই আমাকে রাজাকার বলছে।'
বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গতকাল অভিযোগ গঠন করে আদেশ দেন। আগামী ৩০ অক্টোবর রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে। একই সঙ্গে এ সময়ের মধ্যে সাঈদীর পক্ষে সাক্ষীদের একটি তালিকা ট্রাইব্যুনালে জমা দিতে সাঈদীর আইনজীবীদের নির্দেশ দেওয়া হয়।
আদেশের পর সাঈদীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম এ সময়কে অপ্রতুল দাবি করে সাংবাদিকদের বলেন, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠনের পর আসামিপক্ষকে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য কমপক্ষে ছয় মাস সময় দেওয়া হয়।
রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাঈদীর বিরুদ্ধে একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিন হাজারেরও বেশি নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা বা হত্যায় সহযোগিতা, ৯ জনেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ, বিভিন্ন বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অগি্নসংযোগ, লুটপাট, ভাঙচুর এবং এক শ থেকে দেড় শ হিন্দু লোককে ধর্মান্তরে বাধ্য করাসহ মোট ৩১টি অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উত্থাপন করা হলেও ট্রাইব্যুনাল ২০ অপরাধে অভিযোগ গঠন করেন।
অভিযোগ গঠনের পর ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মো. শাহিনুর ইসলাম প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, অভিযোগ গঠনের আদেশের মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার শুরু হলো। তিনি বলেন, 'ট্রাইব্যুনাল মনে করেন, কথিত সময়ে ও স্থানে ১৯৭৩ সালের আইনের ৩(২) ধারার অভিযোগগুলো সংঘটিত হয়েছে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি ওই সব অভিযোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে প্রাথমিকভাবে দেখা যায়। ট্রাইব্যুনাল আরো মনে করেন, কোনো প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য ছাড়া অভিযোগ গঠন পর্যায়ে শুধু ট্রাইব্যুনালের সামনে থাকা কাগজপত্র ও দলিলাদি পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়।'
রাষ্ট্রপক্ষে প্রধান প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু ও প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, সাঈদীর বিরুদ্ধে পিরোজপুরে ২০ অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
গতকাল সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন প্রশ্নে আদেশের জন্য দিন ধার্য ছিল। এ জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সকাল সাড়ে ৮টায় কড়া নিরাপত্তার মধ্যে সাঈদীকে পুরনো হাইকোর্ট ভবনে স্থাপিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হয়। সাড়ে ১০টায় বিচারকরা এজলাসে বসেন। এর কয়েক মিনিট আগেই সাঈদীকেও বিচারকক্ষে নেওয়া হয়।
ট্রাইব্যুনাল প্রথমে এর কর্মকাণ্ড নিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশ করায় নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক ও প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেন। এরপর সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষীদের নিরাপত্তা চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা একটি আবেদন উপস্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করে দেন। তবে আবেদনটি নথিতে থাকবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। এর আগে আবেদনটি পুরোপুরি খারিজের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী আপত্তি জানানোর পর ট্রাইব্যুনাল পরবর্তী আদেশ দেন। এরপর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ দেওয়া শুরু করেন।
অভিযোগ গঠন করার মতো যথেষ্ট উপাদান রয়েছে : শুরুতেই ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হওয়া, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি ও ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তান সরকারের নির্যাতন-নিপীড়ন, অগণতান্ত্রিক আচরণ তুলে ধরেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান। এর পরই রাষ্ট্রপক্ষ ও সাঈদীর আইনজীবীর বক্তব্যের মূল অংশ সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরেন। এরপর ট্রাইব্যুনাল নিজের যুক্তি তুলে ধরে অভিযোগ গঠন করে আদেশ দিয়ে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের দাখিল করা দলিল ও কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অভিযোগ গঠন করার মতো যথেষ্ট উপাদান রয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়, আসামিপক্ষ অভিযোগ থেকে অব্যাহতির সপক্ষে যথাযথ যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি বলে তাদের আবেদন আমলে নেওয়ার কারণ নেই।
সাঈদী রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন : ট্রাইব্যুনাল আরো বলেন, আসামিপক্ষ আন্তর্জাতিক আইন বা রীতিনীতি মেনে চলার যে যুক্তি দেখিয়েছে, তা মেনে চলা বাধ্যতামূলক নয়। সুনির্দিষ্ট ২০টি ঘটনা উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনাল বলেন, প্রতিবেদন অনুযায়ী সাঈদী রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগি্নসংযোগ, হিন্দুদের জোর করে ধর্মান্তর করানো, লুটতরাজসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব অপরাধ সংঘটিত হয় তৎকালীন বরিশাল জেলার পিরোজপুর মহকুমায়, যা বর্তমানে পিরোজপুর জেলা।
অভিযোগগুলো ইংরেজিতে পড়ার পর ট্রাইব্যুনাল সাঈদীর বক্তব্য জানতে চান। ওই সময় সাঈদীর আইনজীবী তাজুল ইসলাম দাঁড়িয়ে তা বাংলায় পড়ার আবেদন করে বলেন, ২০টি অভিযোগ আনা হয়েছে। তাই বোঝার জন্য তাঁকে সময় দিতে হবে। তাজুল ইসলামের এ আবেদনে ট্রাইব্যুনাল বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, 'এ কী বলছেন!' কয়েক মিনিট উভয়ের মধ্যে কথোপকথন চলার পর সাঈদীকে সামনে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর সাঈদীকে আসামির কাঠগড়া থেকে দুই পুলিশ সদস্য ধরে নিয়ে সাক্ষীর কাঠগড়ায় একটি চেয়ারে বসিয়ে দেন। এরপর ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ বাংলায় পড়া শুরু করেন। তবে সাঈদী বলেন, 'বাংলায় বলার প্রয়োজন নেই। আমি ইংরেজি বুঝেছি।'
এরপর ট্রাইব্যুনাল কাঠগড়ায় দাঁড়ানো সাঈদীকে বলেন, 'বলুন, আপনি দোষী কি না?'
সাঈদী বলেন, 'আমি আমার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে চাই।' এ পর্যায়ে আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই জানানোর পর তিনি কিছুক্ষণ বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ চান আদালতের কাছে। আবেদন গৃহীত হলে প্রায় আট মিনিট বক্তব্য দেন সাঈদী।
সব মিথ্যা, মিথ্যা এবং মিথ্যা : সাঈদী বলেন, 'এ আদালতে আমাকে প্রথম যেদিন আনা হয়, সেদিনই আমি বুঝেছি, আমি শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মিথ্যাচারের শিকার হয়েছি। সেদিন আমার নাম বিকৃত করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হচ্ছিল।' তিনি বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পর মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো অভিযোগ আসেনি। ১৯৮০ সালে জামায়াতের মজলিশে শুরার সদস্য হওয়ার পর এটা আসতে শুরু করে। যখনই এ ধরনের অভিযোগ এসেছে, আমি প্রতিবাদ করেছি, সংসদে বলেছি, মামলা দায়ের করেছি, যার অনেকগুলো এখনো বিচারাধীন।' তিনি বলেন, 'মানবতাবিরোধী অপরাধ করা তো দূরে থাক, বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে দেশে-বিদেশে মানবতা রক্ষায় কাজ করেছি।' তিনি আরো বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে চার সহস্রাধিক পৃষ্ঠার একটি মিথ্যা রচনা তৈরি করা হয়েছে। এর প্রতিটি লাইন মিথ্যা, প্রতিটি শব্দ মিথ্যা। এটি সব মিথ্যা, মিথ্যা এবং মিথ্যা।' তিনি বলেন, 'রাজাকারের কমান্ডার হওয়া তো দূরে থাক, তাদের সঙ্গে আমার কোনোই সম্পর্ক ছিল না। আমি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলাম না, রাজাকার ছিলাম না। পাক বাহিনীর সঙ্গে আমি এক মিনিটের জন্যও বৈঠক করিনি।'
ওই সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, 'অভিযোগ গঠন মানে আপনি অপরাধী, বিষয়টা এমন নয়।' এরপর ট্রাইব্যুনাল ২০টি অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযোগ গঠন করেন।
গতকাল প্রসিকিউশনের পক্ষে ট্রাইব্যুনালে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান, সৈয়দ হায়দার আলী, জেয়াদ আল মালুম, আলতাফ উদ্দিন, ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পী প্রমুখ।
সাঈদীর পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ও ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমীন।
মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সিনিয়র নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং বিএনপি নেতা সাবেক মন্ত্রী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এমপি ও আবদুল আলীম কারাগারে আটক আছেন।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে এক মামলায় সাঈদীকে গত বছর ২৯ জুন গ্রেপ্তার করা হয়। তবে গত বছর ২ নভেম্বর তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এরপর ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা তদন্তকালে এ বছরের ১২ মে ধানমণ্ডির সেফহোমে নিয়ে তাঁকে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করে। ৩১ মে সাঈদীর বিরুদ্ধে চার হাজার ৭৪ পৃষ্ঠার ১৫ খণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া হয়। গত ১১ জুলাই ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উত্থাপন করে। এরপর উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ১৪ জুলাই ট্রাইব্যুনাল সাঈদীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন। গত ২৩ আগস্ট সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন প্রশ্নে শুনানি শুরু হয়। কয়েক দফা মুলতবি শেষে ২৭ সেপ্টেম্বর শুনানি শেষ হয়।
No comments