বিমানবাহিনীর আপত্তিতে ঘুরছে মেট্রো রেলপথ by আনোয়ার হোসেন
বিমানবাহিনীর আপত্তির কারণে বিজয় সরণির পরিবর্তে খামারবাড়ির সামনে দিয়ে মেট্রো রেলপথ নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। নতুন এ পথের বিষয়টি জাপানি ঋণদানকারী সংস্থা জাইকাকেও জানিয়েছে ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ড (ডিটিসিবি)। বিমানবাহিনীর আপত্তির কারণে মেট্রোরেলের পথ নিয়ে জটিলতা তৈরি হওয়ায় জাইকার অর্থায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। সংস্থাটি ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মেট্রোরেলের পথ ঠিক করে তা জানানোর সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে। জাইকা বলেছিল, এ সময়ের মধ্যে পথ ঠিক করতে না পারলে এ অর্থবছরে ঋণ বরাদ্দ দেওয়া যাবে না। গত বৃহস্পতিবার জাইকাকে চিঠি দিয়ে নতুন পথের কথা জানায় ডিটিসিবি।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিমানবাহিনীর আপত্তি আমলে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিজয় সরণি পথটি পরিহার করে খামারবাড়ি এলাকা দিয়ে বিকল্প পথ ধরে মেট্রোরেল প্রকল্প এগিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ পাওয়ার পর শেষ মুহূর্তে জাইকাকে বিকল্প পথ জানিয়ে দেওয়া হয়।
তবে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্রসহ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বিকল্প পথে মেট্রোরেল হলে এর কিছু অংশ সংসদ ভবন এলাকায় পড়বে। এতে লুই আই কানের করা সংসদ ভবন এলাকার নকশা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। খামারবাড়ির অন্তত দুটি বহুতল ভবনও ভাঙা পড়তে পারে।
এদিকে পরিবেশ আন্দোলনের নেতা ও নগর পরিকল্পনাবিদেরাও সংসদ ভবন এলাকা দিয়ে মেট্রোরেল করার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কেউ কেউ লুই কানের নকশা ক্ষতিগ্রস্ত করে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের জন্য বাড়ি করার সময় হওয়া মামলার কথাও স্মরণ করিয়ে দেন।
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংসদ ভবনের জমি বাদ দিয়ে রাস্তার ওপর দিয়ে পথটি নেওয়ার চেষ্টা চলছে। আর খামারবাড়ির ভবন দু-একটা ভাঙা পড়তে পারে। তবে আমরা তা এড়ানোর চেষ্টা করছি।’ বিকল্প পথের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রকল্প, জনগণ ও দেশের স্বার্থে এ পথ বেছে নেওয়া হয়েছে। পথ ঠিক করতে না পারলে জাইকার ঋণপ্রাপ্তি পিছিয়ে যেত।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, উত্তরা থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত প্রায় ২২ কিলোমিটার মেট্রোরেল করতে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৭০ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা। জাইকা এ ব্যয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। জাইকা এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করে গত জুলাই মাসে। তবে পথ পরিবর্তনের কারণে প্রকল্পের ব্যয় বাড়তে পারে বলে যোগাযোগমন্ত্রী জানিয়েছেন।
প্রস্তাবিত মেট্রোরেল প্রকল্পের কার্যক্রম সমন্বয় করছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিটিসিবি। সংস্থার নির্বাহী পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সালেহউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বিকল্প পথের বিষয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জাইকার কাছে পাঠানো হয়েছে। এরপর জাইকার একটি দল এলাকা পরিদর্শনে আসবে। আশা করা হচ্ছে, আগামী বছরের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে ঋণচুক্তি করা যাবে।
এ মেট্রোরেলের প্রথম পর্যায়ে উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে মিরপুরের পল্লবী, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, টিএসসি, প্রেসক্লাব হয়ে মতিঝিল শাপলা চত্বর পর্যন্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিজয় সরণি দিয়ে মেট্রোরেল হলে তেজগাঁও পুরোনো বিমানবন্দর ঝুঁকিতে পড়বে—এ আশঙ্কা করে আপত্তি জানায় বিমানবাহিনী। গত মাসে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল ও বিমানবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরেও এ বিষয়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, বিজয় সরণি দিয়ে মেট্রোরেল হলে তেজগাঁও বিমানবন্দরের জন্য বাড়তি কোনো ঝুঁকি হবে না। কারণ এ বিমানবন্দরে কোনো যাত্রীবাহী বিমান ওঠানামা করে না। বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান, কিছু হেলিকপ্টার ওঠানামা করে এখানে। কিন্তু বিমানবাহিনীর অনমনীয়তার কারণে প্রধানমন্ত্রী বিকল্প পথে প্রকল্প বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন।
সরকারের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) এবং জাইকার সমীক্ষায় বিজয় সরণি দিয়ে মেট্রোরেল করার কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারটি তেজগাঁও বিমানবন্দরের রানওয়ে বরাবর (ফানেল)। নভোথিয়েটার যে উচ্চতায়, মেট্রোরেল তারও কম উচ্চতায় হবে। সে ক্ষেত্রে নভোথিয়েটার সমস্যা না হলে মেট্রোরেল সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এ ছাড়া তেজগাঁও বিমানবন্দরে যেসব বিমান ও হেলিকপ্টার ওঠানামা করে, সেগুলোর উড্ডয়নসীমা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মেট্রোরেল কোনো সমস্যা করবে না।
জাইকার সমীক্ষা অনুযায়ী, মাটি থেকে প্রস্তাবিত মেট্রোরেল পর্যন্ত ফাঁকা জায়গা থাকবে সাড়ে ১২ মিটার। সব মিলিয়ে মেট্রোরেলের উচ্চতা হবে প্রায় ১৯ মিটার। মেট্রোরেল নির্মাণের পর এর মাধ্যমে ঘণ্টায় গড়ে ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে।
বারবার পথ পরিবর্তন: আগেও যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভারের জন্য মেট্রোরেলের প্রস্তাবিত পথ পরিবর্তন করা হয়েছিল। এসটিপি ও জাইকার প্রতিবেদনে মেট্রোরেলকে ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট লাইন-৬ (এমআরটি-৬) হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছিল, উত্তরা থেকে মেট্রোরেল পল্লবী, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, শাহবাগ, টিএসসি, বকশীবাজার, গুলিস্তান, টিকাটুলী হয়ে সায়েদাবাদ যাবে। কিন্তু গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে বলে গত ফেব্রুয়ারিতে এ পথ পরিবর্তন করে দোয়েল চত্বর, প্রেসক্লাব হয়ে মতিঝিল করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
গত ৮ মার্চ মন্ত্রিসভা মেট্রোরেলের পথ ও বাস্তবায়ন এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ক প্রস্তাব অনুমোদন করে। কিন্তু বিমানবাহিনীর আপত্তির কারণে আবারও পথ পরিবর্তন করতে হচ্ছে।
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বলেন, বারবার পথ পরিবর্তনের কারণে মেট্রোরেলের ব্যয় বেড়ে যেতে পারে। এ অঙ্ক অনেক বড় হতে পারে।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিজয় সরণির বিকল্প পথে মেট্রোরেল হলে সংসদ ভবন এলাকার খোলা মাঠের ৫৫ মিটার পর্যন্ত জায়গা ব্যবহার করতে হবে। পাশাপাশি খামারবাড়ির কোনায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ দুটি ১২ তলা ভবন ভাঙা পড়তে পারে। এ ছাড়া উত্তরা থেকে ফার্মগেট হয়ে সায়েদাবাদ পর্যন্ত প্রস্তাবিত উড়ালসড়কের নামার স্থান নিয়েও সমস্যা হবে। উড়ালসড়ক থেকে নামার জায়গা ফার্মগেট পার্কের কাছে রাখার কথা। সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগে ইতালি-থাই কোম্পানি উড়ালসড়ক নির্মাণের কাজ পেয়েছে।
আরও ভবন ভাঙতে হবে!: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিমানবাহিনী মেট্রোরেলের পথ নিয়ে আপত্তি দেওয়ায় তেজগাঁও বিমানবন্দরের আশপাশে অন্তত ২৬১টি বহুতল ভবন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান সংস্থার (আইকাও) নিয়মানুযায়ী, বিমানবন্দরের চারদিকে অন্তত চার কিলোমিটার এলাকায় ৪৫ মিটারের বেশি উঁচু স্থাপনা থাকতে পারবে না। সে হিসাবে এই ২৬১টি ভবনও প্রায় পরিত্যক্ত এ বিমানবন্দরের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। কিন্তু সেগুলো তো ভাঙা হচ্ছে না বা সম্ভবও নয়। কিন্তু তাতে এ বন্দরের চলমান কাজের তো ক্ষতি হচ্ছে না।
২০০৯ সালের জুলাই মাসে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সার্ভে অব বাংলাদেশসহ সরকারি কয়েকটি সংস্থা সমীক্ষা করে ২৬১টি ভবনকে নির্ধারিত উড্ডয়নসীমার বেশি উচ্চতাসম্পন্ন বলে মত দেওয়া হয়। এর মধ্যে বিমানবাহিনী ও সেনাবাহিনীর স্থাপনাসহ বিভিন্ন বেসরকারি ভবন রয়েছে।
অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ৪৫ মিটার উচ্চতাসীমা মানা হলে তেজগাঁও বিমানবন্দরের আশপাশে প্রায় সাড়ে ১২ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ১৩-১৪ তলার বেশি উচ্চতার ভবন করা যাবে না। সে ক্ষেত্রে রাজধানী ঢাকার বেড়ে ওঠা স্থবির হয়ে যেতে পারে।
স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, যত ফাঁকা জায়গা থাকবে, তত বেশি বহুতল ভবন করা যাবে। কিন্তু বিমানবন্দরের কারণে ফাঁকা জায়গা থাকা সত্ত্বেও বহুতল ভবন করা যাচ্ছে না। ফলে এক শহরে দুই ধরনের ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এটা একটা সুষ্ঠু, সুন্দর নগর ব্যবস্থার অন্তরায়। এ বিমানবন্দরটি বিমানবাহিনীর নয়, বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষের। এটা পরিত্যক্ত। বিমানবাহিনীকে ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছে। ঢাকাকে রাজধানী হিসেবে রাখতে হলে এ বিমানবন্দর সরিয়ে ৭০-৮০ কিলোমিটার দূরে নিয়ে যেতে হবে।
অনিশ্চয়তা কাটেনি: কাজ শুরু হলে তিন বছরে মেট্রোরেল চালু হওয়ার কথা। কিন্তু নতুন এ পথ নিয়েও শঙ্কা রয়ে গেল। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, এ পথের জন্য এখন সংসদ সচিবালয়ের অনুমতি নিতে হবে। আবার লুই কানের নকশা ক্ষতিগ্রস্ত হলে যে কেউ এ নিয়ে আদালতে যেতে পারেন। ফলে প্রকল্পটি আবার অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। তাঁদের মতে, বিজয় সরণির পথটিই ছিল সব দিক দিয়ে উপযুক্ত।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, বিকল্প যে পথের কথা বলা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের প্রতীক সংসদ ভবনের এলাকার সৌন্দর্য নষ্ট হবে। ফার্মগেট পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই বিজয় সরণির পথটিই ঠিক ছিল।
তবে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্রসহ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বিকল্প পথে মেট্রোরেল হলে এর কিছু অংশ সংসদ ভবন এলাকায় পড়বে। এতে লুই আই কানের করা সংসদ ভবন এলাকার নকশা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। খামারবাড়ির অন্তত দুটি বহুতল ভবনও ভাঙা পড়তে পারে।
এদিকে পরিবেশ আন্দোলনের নেতা ও নগর পরিকল্পনাবিদেরাও সংসদ ভবন এলাকা দিয়ে মেট্রোরেল করার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কেউ কেউ লুই কানের নকশা ক্ষতিগ্রস্ত করে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের জন্য বাড়ি করার সময় হওয়া মামলার কথাও স্মরণ করিয়ে দেন।
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংসদ ভবনের জমি বাদ দিয়ে রাস্তার ওপর দিয়ে পথটি নেওয়ার চেষ্টা চলছে। আর খামারবাড়ির ভবন দু-একটা ভাঙা পড়তে পারে। তবে আমরা তা এড়ানোর চেষ্টা করছি।’ বিকল্প পথের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রকল্প, জনগণ ও দেশের স্বার্থে এ পথ বেছে নেওয়া হয়েছে। পথ ঠিক করতে না পারলে জাইকার ঋণপ্রাপ্তি পিছিয়ে যেত।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, উত্তরা থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত প্রায় ২২ কিলোমিটার মেট্রোরেল করতে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৭০ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা। জাইকা এ ব্যয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। জাইকা এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করে গত জুলাই মাসে। তবে পথ পরিবর্তনের কারণে প্রকল্পের ব্যয় বাড়তে পারে বলে যোগাযোগমন্ত্রী জানিয়েছেন।
প্রস্তাবিত মেট্রোরেল প্রকল্পের কার্যক্রম সমন্বয় করছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিটিসিবি। সংস্থার নির্বাহী পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সালেহউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বিকল্প পথের বিষয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জাইকার কাছে পাঠানো হয়েছে। এরপর জাইকার একটি দল এলাকা পরিদর্শনে আসবে। আশা করা হচ্ছে, আগামী বছরের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে ঋণচুক্তি করা যাবে।
এ মেট্রোরেলের প্রথম পর্যায়ে উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে মিরপুরের পল্লবী, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, টিএসসি, প্রেসক্লাব হয়ে মতিঝিল শাপলা চত্বর পর্যন্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিজয় সরণি দিয়ে মেট্রোরেল হলে তেজগাঁও পুরোনো বিমানবন্দর ঝুঁকিতে পড়বে—এ আশঙ্কা করে আপত্তি জানায় বিমানবাহিনী। গত মাসে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল ও বিমানবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরেও এ বিষয়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, বিজয় সরণি দিয়ে মেট্রোরেল হলে তেজগাঁও বিমানবন্দরের জন্য বাড়তি কোনো ঝুঁকি হবে না। কারণ এ বিমানবন্দরে কোনো যাত্রীবাহী বিমান ওঠানামা করে না। বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান, কিছু হেলিকপ্টার ওঠানামা করে এখানে। কিন্তু বিমানবাহিনীর অনমনীয়তার কারণে প্রধানমন্ত্রী বিকল্প পথে প্রকল্প বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন।
সরকারের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) এবং জাইকার সমীক্ষায় বিজয় সরণি দিয়ে মেট্রোরেল করার কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারটি তেজগাঁও বিমানবন্দরের রানওয়ে বরাবর (ফানেল)। নভোথিয়েটার যে উচ্চতায়, মেট্রোরেল তারও কম উচ্চতায় হবে। সে ক্ষেত্রে নভোথিয়েটার সমস্যা না হলে মেট্রোরেল সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এ ছাড়া তেজগাঁও বিমানবন্দরে যেসব বিমান ও হেলিকপ্টার ওঠানামা করে, সেগুলোর উড্ডয়নসীমা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মেট্রোরেল কোনো সমস্যা করবে না।
জাইকার সমীক্ষা অনুযায়ী, মাটি থেকে প্রস্তাবিত মেট্রোরেল পর্যন্ত ফাঁকা জায়গা থাকবে সাড়ে ১২ মিটার। সব মিলিয়ে মেট্রোরেলের উচ্চতা হবে প্রায় ১৯ মিটার। মেট্রোরেল নির্মাণের পর এর মাধ্যমে ঘণ্টায় গড়ে ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে।
বারবার পথ পরিবর্তন: আগেও যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভারের জন্য মেট্রোরেলের প্রস্তাবিত পথ পরিবর্তন করা হয়েছিল। এসটিপি ও জাইকার প্রতিবেদনে মেট্রোরেলকে ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট লাইন-৬ (এমআরটি-৬) হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছিল, উত্তরা থেকে মেট্রোরেল পল্লবী, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, শাহবাগ, টিএসসি, বকশীবাজার, গুলিস্তান, টিকাটুলী হয়ে সায়েদাবাদ যাবে। কিন্তু গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে বলে গত ফেব্রুয়ারিতে এ পথ পরিবর্তন করে দোয়েল চত্বর, প্রেসক্লাব হয়ে মতিঝিল করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
গত ৮ মার্চ মন্ত্রিসভা মেট্রোরেলের পথ ও বাস্তবায়ন এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ক প্রস্তাব অনুমোদন করে। কিন্তু বিমানবাহিনীর আপত্তির কারণে আবারও পথ পরিবর্তন করতে হচ্ছে।
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বলেন, বারবার পথ পরিবর্তনের কারণে মেট্রোরেলের ব্যয় বেড়ে যেতে পারে। এ অঙ্ক অনেক বড় হতে পারে।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিজয় সরণির বিকল্প পথে মেট্রোরেল হলে সংসদ ভবন এলাকার খোলা মাঠের ৫৫ মিটার পর্যন্ত জায়গা ব্যবহার করতে হবে। পাশাপাশি খামারবাড়ির কোনায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ দুটি ১২ তলা ভবন ভাঙা পড়তে পারে। এ ছাড়া উত্তরা থেকে ফার্মগেট হয়ে সায়েদাবাদ পর্যন্ত প্রস্তাবিত উড়ালসড়কের নামার স্থান নিয়েও সমস্যা হবে। উড়ালসড়ক থেকে নামার জায়গা ফার্মগেট পার্কের কাছে রাখার কথা। সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগে ইতালি-থাই কোম্পানি উড়ালসড়ক নির্মাণের কাজ পেয়েছে।
আরও ভবন ভাঙতে হবে!: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিমানবাহিনী মেট্রোরেলের পথ নিয়ে আপত্তি দেওয়ায় তেজগাঁও বিমানবন্দরের আশপাশে অন্তত ২৬১টি বহুতল ভবন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান সংস্থার (আইকাও) নিয়মানুযায়ী, বিমানবন্দরের চারদিকে অন্তত চার কিলোমিটার এলাকায় ৪৫ মিটারের বেশি উঁচু স্থাপনা থাকতে পারবে না। সে হিসাবে এই ২৬১টি ভবনও প্রায় পরিত্যক্ত এ বিমানবন্দরের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। কিন্তু সেগুলো তো ভাঙা হচ্ছে না বা সম্ভবও নয়। কিন্তু তাতে এ বন্দরের চলমান কাজের তো ক্ষতি হচ্ছে না।
২০০৯ সালের জুলাই মাসে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সার্ভে অব বাংলাদেশসহ সরকারি কয়েকটি সংস্থা সমীক্ষা করে ২৬১টি ভবনকে নির্ধারিত উড্ডয়নসীমার বেশি উচ্চতাসম্পন্ন বলে মত দেওয়া হয়। এর মধ্যে বিমানবাহিনী ও সেনাবাহিনীর স্থাপনাসহ বিভিন্ন বেসরকারি ভবন রয়েছে।
অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ৪৫ মিটার উচ্চতাসীমা মানা হলে তেজগাঁও বিমানবন্দরের আশপাশে প্রায় সাড়ে ১২ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ১৩-১৪ তলার বেশি উচ্চতার ভবন করা যাবে না। সে ক্ষেত্রে রাজধানী ঢাকার বেড়ে ওঠা স্থবির হয়ে যেতে পারে।
স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, যত ফাঁকা জায়গা থাকবে, তত বেশি বহুতল ভবন করা যাবে। কিন্তু বিমানবন্দরের কারণে ফাঁকা জায়গা থাকা সত্ত্বেও বহুতল ভবন করা যাচ্ছে না। ফলে এক শহরে দুই ধরনের ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এটা একটা সুষ্ঠু, সুন্দর নগর ব্যবস্থার অন্তরায়। এ বিমানবন্দরটি বিমানবাহিনীর নয়, বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষের। এটা পরিত্যক্ত। বিমানবাহিনীকে ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছে। ঢাকাকে রাজধানী হিসেবে রাখতে হলে এ বিমানবন্দর সরিয়ে ৭০-৮০ কিলোমিটার দূরে নিয়ে যেতে হবে।
অনিশ্চয়তা কাটেনি: কাজ শুরু হলে তিন বছরে মেট্রোরেল চালু হওয়ার কথা। কিন্তু নতুন এ পথ নিয়েও শঙ্কা রয়ে গেল। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, এ পথের জন্য এখন সংসদ সচিবালয়ের অনুমতি নিতে হবে। আবার লুই কানের নকশা ক্ষতিগ্রস্ত হলে যে কেউ এ নিয়ে আদালতে যেতে পারেন। ফলে প্রকল্পটি আবার অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। তাঁদের মতে, বিজয় সরণির পথটিই ছিল সব দিক দিয়ে উপযুক্ত।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, বিকল্প যে পথের কথা বলা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের প্রতীক সংসদ ভবনের এলাকার সৌন্দর্য নষ্ট হবে। ফার্মগেট পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই বিজয় সরণির পথটিই ঠিক ছিল।
No comments