মিরসরাইয়ে এবার শোকে ঢাকা পূজা
মিরসরাই ট্র্যাজেডির শিকার সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীসহ ১১ জনের পরিবারে নেই পূজার আনন্দ। গত রবিবার থেকে সর্ববৃহৎ ধর্মীয় অনুষ্ঠান দুর্গাপূজা শুরু হলেও ওই পরিবারের সবার মনের মধ্যে চাপা ব্যথা। তাই মিরসরাইয়ের মঘাদিয়া ও মায়ানী ইউনিয়নের ছয় গ্রামে আবারও দেখা দিল মাতম। নিহত স্কুলছাত্ররা হলো প্রফেসর কামাল উদ্দিন চৌধুরী কলেজের একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী সাজু চন্দ্র দাশ; আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আনন্দ দাশ, নবম শ্রেণীর সূর্য চন্দ্র নাথ, অষ্টম শ্রেণীর ধ্রুব নাথ, লিটন দাশ, উজ্জ্বল চন্দ্র নাথ, রূপন চন্দ্র নাথ, টিটু জলদাশ, কাজল চন্দ্র নাথ ও জুয়েল বড়ুয়া। ঘটনার দিন রাতে ছেলেকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে মৃত্যু হয়েছে ভেবে মারা যান হরনাথ। উপজেলার ১১ নম্বর মঘাদিয়া ইউনিয়নের মাস্টারপাড়া, সরকার টোলা, দরগাহপাড়া এবং ১৩ নম্বর মায়ানী ইউনিয়নের মধ্যম মায়ানী ও পূর্ব মায়ানী গ্রামে ওদের বাড়ি।
গত রবিবার ষষ্ঠী ও গতকাল সোমবার সপ্তমী সম্পন্ন করেছেন পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দারাও। কিন্তু ধ্রুব, সাজু, লিটনদের ঘরে এর কোনো ছোঁয়া ছিল না। আনন্দ দাশদের মতো শিক্ষার্থীদের ঘরে ঘরে আনন্দ ঢাকা পড়েছে শোকের আবহে।
গত বছরের এই দিনে পূজা উদ্যাপনকালে আনন্দঘন একটি মুহূর্তে সবার প্রিয় ধ্রুব নাথকে নিয়ে ছবির ফ্রেমে বন্দি হয়েছিলেন বাবা ধীরেন্দ্র কুমার নাথসহ স্বজনরা। সেই ছবি এ পরিবারের জন্য এখন কেবলই স্মৃতি হয়ে রইল। বছর ঘুরে এখন সেই একটি ছবিই চোখের সামনে নিয়ে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা স্মরণ করছেন তাঁরা। মিরসরাইয়ের আবুতোরাব বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ধ্রুব নাথ ছিল সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র। তার মামা ডা. সমীর চন্দ্র নাথ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের পরিবারে এবার পূজা উদ্যাপিত হচ্ছে বটে, কিন্তু কোনো আনন্দ নেই। ধ্রুবকে ছাড়া আমাদের পূজা হতে পারে না। ও ছিল সবার নয়নের মধ্যমণি।'
মঘাদিয়া ইউনিয়নের সরকারটোলা এলাকার বাসিন্দা কেশব চন্দ্র দাশের ঘরেও চলছে নীরব অশ্রুপাত। মিরসরাই ট্র্যাজেডিতে হারানো ছেলে লিটন চন্দ্র দাশের ছবি হাতে কাঁদছেন মা মণি বালা দাশ।
স্মরণকালের যে সড়ক দুর্ঘটনায় কেঁদেছিল সারা দেশ, সেই দুর্ঘটনার নাম মিরসরাই ট্র্যাজেডি। গত ১১ জুলাই মিরসরাইয়ের আবুতোরাব-বড়তাকিয়া সড়কের দক্ষিণ সৈদালী এলাকার ওই দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই ৩৭ ছাত্রসহ ৩৯ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। এরপর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় আরো চার শিক্ষার্থী। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আটজন ঘটনাস্থলে এবং দুই ছাত্র হাসপাতালে মারা যায়। ছেলের শোকে হরনাথ মারা যান দুর্ঘটনার দিন রাতেই।
হরনাথের পরিবারেও চলছে নীরব শোক। ঘটনার দুই মাসেরও বেশি সময় পরে দুর্গাপূজা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে তাঁদের শোকগাথা। হরনাথের ছেলে অজয় চন্দ্র দাশ জানায়, 'সেদিন আমার মৃত্যু হয়েছে ভেবে বাবা মারা গেছেন স্ট্রোক করে। গত বছরও এই দিনে বাবা জীবিত ছিলেন। এবার তিনি নেই, আমাদের পূজা নেই। নেই পূজার আনন্দও।' হরনাথ মঘাদিয়া ইউনিয়নের দাশপাড়া গ্রামের মৃত কৃষ্ণ চন্দ্র দাশের ছেলে। হরনাথের ঘরে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী ও চার সন্তান।
দুর্গাপূজা আসার পরও এলাকা আনন্দের পরিবর্তে নতুন করে যেন শোকে স্তব্ধ হয়ে উঠেছে উল্লেখ করে মায়ানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কবির নিজামী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কাজল নাথ মারা গেছে হাসপাতালে। তার পরিবারের শোক একটু বেশি। অন্য বাড়িগুলোতেও পূজার আনন্দের বদলে শোক আর বেদনা বিরাজ করছে। বুধবার (আগামীকাল) আমি হিন্দু সম্প্রদায়ের নিহত শিক্ষার্থীদের বাড়িতে যাব।' এই ইউনিয়নে অবস্থিত পাঁচটি মণ্ডপেই শোকের আবহ বিরাজ করছে বলে জানান চেয়ারম্যান।
আবু তোরাব বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাফর সাদেক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'হিন্দু সম্প্রদায়ের ৯ জন শিক্ষার্থী আমার বিদ্যালয়ের ছাত্র। এদের মধ্যে সাতজনই অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। অন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে যেকোনো উপলক্ষ সামনে এলে। তখনই ফের শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা।'
No comments