সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-গণতান্ত্রিক সমাজের পথে বাধা অসহিষুষ্ণতা by হারুন হাবীব

ধর্ম কখনোই গুটিকয়েক ধর্মবেত্তা বা তালেবানদের হাতে রক্ষিত হয়নি। যুগে যুগেই ধর্ম রক্ষিত হয়েছে সাধারণ মানুষের হাতে। কারণ ধর্ম মানুষের আদি বিশ্বাস, যা মানুষ শ্রদ্ধা করে এসেছে, লালন করে এসেছে নিজের আত্মার তাগিদে।
এটিও সত্যি যে, ধর্মজীবী কিছু মানুষের প্ররোচনায় যুগে যুগেই ধর্মকে কেন্দ্র করে কোন্দল হয়েছে, রক্তপাত হয়েছে, সাধারণ মানুষের অকল্যাণ ঘটেছে। একশ্রেণীর ধর্মজীবী এবং তাদের অনুসারীরা ধর্মকে যুগে যুগেই তাদের ক্ষমতার বাহন বানিয়েছে। এরা কখনও কখনও সফলও হয়েছে। কিন্তু সে সফলতা স্থায়ী হয়নি। ধর্ম মানুষের হৃদয় জয় করেছে ঠিকই, কিন্তু কখনোই কোনো আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা জয় করতে পারেনি। এটা ধর্মের পরাজয় নয়, পরাজয় ধর্মজীবী ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের।
প্রাচীন ইংল্যান্ডে অসহিষুষ্ণ পাদ্রিতন্ত্রের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হয়েছিল সহিষুষ্ণ সমাজ গঠনের স্বার্থে। এরা সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেছিল, তাদের হাতে গড়া ধর্ম ব্যাখ্যাকে তারা রাষ্ট্রের আইন বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষ তা হতে দেয়নি। তারা পাদ্রিতন্ত্রকে পরাজিত করে আধুনিক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন করতে সমর্থ হয়েছিল।
কথাগুলো বলছি এ কারণে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪২ বছর পর আমরা নতুন করে একশ্রেণীর ধমজীবীর চরম অসহিষুষ্ণ আচরণ লক্ষ্য করতে শুরু করেছি। এরা তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা বা আপন বিচার-বিবেচনাকে পুঁজি করে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিতে শুরু করেছে এবং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামো ও দীর্ঘ লালিত সামাজিক মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছে।
নারী সম্পর্কে হেফাজতের নেতা মাওলানা আহমদ শফীর সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্যে সব মহল থেকেই সরব প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। নারীদের প্রতি তীব্র কটাক্ষ ও অশালীন বক্তব্য ধর্মের নামে করা হলেও সেখানে ধর্ম আদৌ কোনো ভূমিকা রাখেনি। রেখেছে আহমদ শফীর অজ্ঞানতা ও চরম স্বৈরতান্ত্রিক ও অসহিষুষ্ণ মানসিকতা। আমার বিশ্বাস, নারীদের নিয়ে কোনো যুগেও এ রকম আপত্তিকর ভাষা ও অশ্লীল ইঙ্গিত আগে কোনো মানুষ আর কখনও করেননি।
পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকার ১৫ বছরের মেয়ে মালালা ইউসুফজাই আধুনিক শিক্ষায় নিজেকে শিক্ষিত করতে চেয়েছিল। এই বালিকা তার মতো অন্য মেয়েদের পড়ালেখার পথে চালাতে চেয়েছিল। মালালা যা চেয়েছিল তা কোনো অস্বাভাবিক কিছু নয়, ছিল আধুনিক সমাজে মেয়েদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা। কিন্তু অসহিষ্ণু তালেবানরা তাকে পড়ালেখা করতে দিতে রাজি নয়! মালালা তালেবানদের হুমকি কর্ণপাত করেনি। কাজেই তার ওপর গুলি চালালো তালেবানরা। জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে পাকিস্তানের মালালা আজও বেঁচে আছে। ইতিমধ্যেই সে সারাবিশ্বে সাহসী নারীর প্রতীক হয়ে উঠেছে।
পাকিস্তানের মতো সমাজেও যখন মালালা ইউসুফজাই বিপ্লব সাধন করতে এগিয়ে আসে, বাংলাদেশের নারীরা যখন পুরুষের সঙ্গে সমানতালে জীবন-জীবিকার সন্ধান করে, সফল হয়, ভাবতে বিস্ময়বোধ করি, তখন বাংলাদেশের একজন হেফাজত নেতা ফতোয়া দেন, নারীরা তেঁতুলের মতো, তাদের বাইরে যাওয়া চলবে না, লেখাপড়া বন্ধ করতে হবে, তারা শুধুই সন্তান উৎপাদন করবে, ঘর সামলাবে! ধিক এ মানসিকতা, ধিক এ ধর্মবেত্তার ফতোয়া। না, এ মানসিকতাকে কেবল মধ্যযুগীয় বা পশ্চাৎপদ চিন্তার বহিঃপ্রকাশ বলেই শেষ করা যাবে না, চরম সাম্প্রদায়িকতা ও কূপমণ্ডূকতার দৃষ্টান্তস্বরূপ এ বক্তব্যের বিরুদ্ধে সবাইকেই সরব ভূমিকা রাখতে হবে।
বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পাকিস্তানের সামরিক ও ধর্মতান্ত্রিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে একটি পবিত্র গণযুদ্ধ। এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য কেবল পাকিস্তান ভাগ করে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল সব পশ্চাৎপদ চিন্তার বিপরীতে প্রগতিশীল সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা। মহান এই জাতীয় যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত দেশে আহমদ শফীর মতো মানুষের এ ধরনের নারীবিরোধী, প্রগতিবিরোধী, পশ্চাৎপদ অবস্থান এবং প্রচার অনাকাঙ্ক্ষিতই কেবল নয়, লাখো শহীদের পবিত্র স্বপ্নের বিরুদ্ধে চরম ধৃষ্টতাও। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে, এই শ্রেণীর মানুষরা বা এদের তৈরি করা হেফাজত এ দেশে রাজনৈতিক প্রশ্রয়-সমর্থনপুষ্ট হচ্ছে। ফলে তারা তাদের অপতৎপরতা বাড়িয়ে চলেছে।
মাওলানা শফী তার ফতোয়া বা ওয়াজে বলেছেন, মেয়েদের কাজ ঘরে আসবাবপত্র হেফাজত করা, ছেলেসন্তানের দেখাশোনা করা। তারা বাইরে বের হবে না, শপিং করতে যাবে না। এমনকি মেয়েরা গার্মেন্টে চাকরি করবে না। প্রশ্ন করি, আর অন্যদের কথা বাদই দেই, এই যে বাংলাদেশে ৩০ লাখের ওপর নারী শ্রমিক আছে, কাজ না করলে তারা খাবে কী? কী করে তাদের ঘর-সংসার চলবে, সন্তানদের পড়ালেখা হবে, বাবা-মা, ভাইবোনদের দেখাশোনা চলবে? শফী সাহেব বা তার হেফাজত কি এ দায়িত্ব নেবেন?
এ ছাড়া জিভে জল আসা তেঁতুলের সঙ্গে মেয়েদের তুলনা করাসহ এমন ভাষায় এমন সব কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন মাওলানা শফী, যা কোনো বিবেকসম্পন্ন মানুষ, যার মধ্যে বিন্দুমাত্র সভ্যতা-ভব্যতাবোধ আছে, তার মুখে আনতে বাধবে। কিন্তু এসব কথা অবলীলায় একজন 'ধর্মীয় নেতা' বলে গেছেন প্রকাশ্যে!
ভাবতে সত্যিই অবাক হই, প্রশ্ন করতেই হয় যে, ধর্মকে, ইসলামকে এভাবে হেয় করার দৃষ্টান্ত সাম্প্রতিককালে আর কি হয়েছিল? শফীর বক্তব্য কেবল বাংলাদেশের নারীবিরোধী বা প্রগতিবিরোধীই নয়, এ বক্তব্য একই সঙ্গে অসুস্থ ও বিকারগ্রস্ত মানসিকতার প্রতিফলন। এর আগেও হেফাজত ঘোষিত ১৩ দফায়ও আমরা প্রায় একই মনোভাবের প্রকাশ দেখেছি। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা বাতিলের দাবিতেও হেফাজত নামের সংগঠনটিকে মাঠে দেখা গেছে। এরপর যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে নাস্তিকতার অভিযোগ তুলেছে তারা। তাদের ভাষায়, নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ যে নারীরা বাংলাদেশ সমাজের অর্ধেক, যারা ইসলাম ধর্মে যথেষ্টই অধিকার অর্জনকারী, তাদের তারা 'অবরোধবাসিনী' করবে! এ ধরনের মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে দেশের নারী ও প্রগতিশীল নাগরিক সমাজের সরব হওয়ার বিকল্প আছে কি?
যে কোনো সমাজের মতো বাংলাদেশেও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে বাস করে। এদের বিরুদ্ধে প্রগতিশীলদের লড়াই যে কোনো আধুনিক ও গণতান্ত্রিক সমাজের স্বাভাবিক ঘটনা। এ আন্দোলন যতই বেগবান হয়, ততই মঙ্গল। ধর্মান্ধ বা প্রতিক্রিয়াশীলরা যদি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পায়, তাহলে সে সমাজের দুর্ভাগ্যের সীমা থাকে না। আধুনিক রাষ্ট্রে নারী-পুরুষের সমঅধিকার থাকবে; কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিরোধিতার কারণে তা এখনও সর্বাংশে তা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্রশক্তি সাহসে এগিয়ে আসেনি। এলে সাধারণ মানুষ আরও বেশি সাহসী হয়ে উঠত, তারা প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হতো।
বাংলাদেশের নারীসমাজ যখন পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটছে, তারা যখন জাতীয় রাজনীতি ও অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে, আমাদের নারীরা যখন এভারেস্ট জয় করছে, খেলাধুলা ও পড়ালেখায় তারা যখন পুরুষদেরও ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তখন হেফাজত ও তার নেতা মাওলানা শফী শুধু নারী সমাজকেই নয়, সামাজিক অগ্রযাত্রার চাকা পেছনের দিকে টেনে বাঙালি জাতিকে পশ্চাৎপদতার অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে উদ্যত হয়েছেন! আমার বিশ্বাস, একজন 'ধর্মীয় নেতার' মুখে উচ্চারিত এসব বক্তব্য যে কোনো বিবেকসম্পন্ন এবং ধার্মিক মানুষকেই আহত করবে। পবিত্র ধর্মের দোহাই দিয়ে সমাজকে পশ্চাৎপদতার অন্ধকারে টেনে নেওয়ার এই অশ্লীল-অশোভন তৎপরতা কোনোভাবেই প্রশ্রয় পাওয়া উচিত নয়।
বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে এ ধরনের ফতোয়া বা ধর্মীয় রীতিনীতির অপব্যাখ্যা, আপত্তিকর অশালীন বক্তব্য অপরাধ বিবেচিত হয় কি-না তা অবশ্যই ভেবে দেখা উচিত। জাতীয় স্বার্থে সব রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের উচিত এ ধরনের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।
আমাদের আরও ভেবে দেখতে হবে, যে কোনো আধুনিক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালিত হয় তার সংবিধান ও জনপ্রতিনিধিদের হাতে তৈরি আইন দিয়ে, কোনো ধর্মীয় নেতার ফতোয়া দিয়ে নয়।
আরও একটি বিষয়। দেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ যাবৎ ছয়টি মামলার ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেছেন। এসব রায়ে দণ্ড ঘোষণা ছাড়াও জামায়াতে ইসলামী সংগঠন সম্পর্কে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এসব রায়ে জামায়াতকে একটি 'ক্রিমিনাল সংগঠন' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এখনও জামায়াতের নেতৃত্ব দিচ্ছেন একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধীরা। এও বলা হয়েছে, দলটি এখনও বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধিতার অবস্থান থেকে সরে আসেনি। এখনও তারা বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, সরকারি-বেসরকারি শীর্ষ পদে স্বাধীনতাবিরোধী কোনো ব্যক্তি যেন না বসতে পারে।
রায়ের পর্যবেক্ষণগুলোতে বলা হয়েছে, একাত্তরে গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী 'ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন' হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের ভূমিকা ছিল বীভৎস। মূলত জামায়াতের সদস্যরা রাজাকার বাহিনী, আলবদর, আলশামস, আল মুজাহিদ বাহিনী ও শান্তি কমিটির মতো সশস্ত্র আধা-সামরিক বাহিনী গঠন করে স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপর নৃশংসভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আদালতের এসব বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয় যে, জামায়াত সাংগঠনিকভাবে কেবল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান নেয়নি, তারা যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছিল।
পর্যবেক্ষণগুলোতে বলা হয়, স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও এই দলটি তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেনি। কোনো অনুশোচনা বা ৩০ লাখ শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখায়নি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই দলটির তরুণ কর্মীদের মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক মানসিকতা সৃষ্টি হচ্ছে, যা একটি জাতির জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়।
আদালতের এই পর্যবেক্ষণগুলো আমলে নিয়ে সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার ও নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত বলেও রায়গুলোতে বলা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব রায়ে জামায়াত ও স্বাধীনতাবিরোধীদের ব্যাপারে যে পর্যবেক্ষণ এসেছে তাতে দেশপ্রেমিক জনগণের উদ্বেগ-প্রত্যাশা প্রতিফলিত হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের উচিত এ পর্যবেক্ষণগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা।
hh11971@gmail.com


মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.