ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কাম্য নয় by ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন
মানবজাতির ইতিহাসে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি
কখনোই কোনো কল্যাণ বয়ে আনেনি, বরং পৃথিবীতে যখনই কোনো সম্প্রদায় ধর্ম নিয়ে
বাড়াবাড়ি করেছে, তখনই তাদের পতন ত্বরান্বিত হয়েছে। ধর্মের ব্যাপারে সীমা
লঙ্ঘন করে মানব ইতিহাসে অনেক জাতি-গোষ্ঠী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।
ধর্মের নামে অনাচার, ধর্মকে অবলম্বন করে ফায়দা হাসিল, ধর্মের মর্মবাণীর
অপব্যাখ্যা, ধর্মের প্রকৃত বিধানকে এড়িয়ে চলা, ধর্মের নামে গোঁড়ামি ও
অন্ধত্ব, ধর্মের সহজ-সরল ও সাবলীল রূপকে রুক্ষ-শুষ্কভাবে উপস্থাপন, ধর্ম
পালনের আড়ালে ধর্মব্যবসা ও ধর্মের আশ্রয়ে অমানবিকতা আর অধর্মের চর্চার
মাধ্যমে বিশ্বসমাজ থেকে বহু ধর্মের বিলুপ্তি ঘটেছে, অনেক ধর্ম তার ইমেজ
হারিয়েছে, আবার অনেক ধর্ম তার আপন কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে মহাকালের
ঘূর্ণাবর্তে তলিয়ে গেছে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি হলে ধর্ম তার শাশ্বত ও চিরন্তন
অবস্থানকে হারিয়ে ফেলে এবং মানব সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতা ও উপযোগিতা হ্রাস
পায়। পৃথিবীতে প্রবর্তিত সব ধর্মের একটি অভিন্ন ও অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য
হচ্ছে মানবকল্যাণ। মানুষ ও মানবতার অকল্যাণ কোনো ধর্মেরই লক্ষ্য বা মূলনীতি
হতে পারে না। ধর্ম নিয়ে ইতিহাসের শিক্ষাকে পাশ কাটিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে
ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি পরিলক্ষিত হচ্ছে- যা কোনো ধর্মপ্রাণ মানুষের কাজ
হতে পারে না। তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হবে নেতিবাচক আর তা আমাদের
সমাজ-সভ্যতার জন্যও মারাত্মক কুফল বয়ে আনবে।
ধর্ম মানুষকে পুণ্যবান ও ধার্মিক করে। উদার ও সহনশীলতার শিক্ষা দেয় ধর্ম। ধর্মপালন মানুষকে সত্যিকার মানুষে পরিণত করে। ধর্মের মূল বাণীসমূহ পবিত্র, উন্নত ও মানবিক জীবন যাপনে মানুষকে সহায়তা করে। সমাজ-সভ্যতা ও পরিবেশ থেকে যাবতীয় অন্ধকার, কুসংস্কার ও অজ্ঞতা দূর করে সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের আলোকবর্তিকা প্রজ্বলিত করে ধর্ম। ধর্ম মানবজীবনে সব সময়ই ইতিবাচক ফল বয়ে আনে; ধর্মের কোনো নেতিবাচক দিক নেই। কেননা সব ঐশী ধর্মই এসেছে এমন এক মহান সত্তার পক্ষ থেকে, যিনি তাবৎ পৃথিবী ও এর মধ্যকার সব কিছুরই স্রষ্টা। সৃষ্টি কিসের মাধ্যমে ভালো থাকবে, কিভাবে সমৃদ্ধ হবে, কোন পন্থায় জীবনযাপন করলে শান্তি আসবে, মুক্তি মিলবে- সে সম্পর্কে তিনি সম্যক অবহিত। তাই তো পৃথিবীতে ধর্মের আগমন; ধর্মের মধ্যেই ভালো-মন্দের, পাপ-পুণ্যের বিচার-বিবেচনা নিহিত রয়েছে। মানুষ ও মানবতার প্রকৃত শান্তি ও সার্বিক মুক্তি ধর্ম পালনের মাধ্যমেই অর্জিত হয়। পৃথিবীর মানুষকে এমন একটি বার্তা পৌঁছে দিতেই ইতিহাসের এক অমোঘ অন্ধকারের কৃষ্ণযুগে মরুর বুকে আর্তনাদরত মানবতার মুক্তিসনদ নিয়ে প্রবর্তিত হয়েছিল ইসলাম ধর্মের; দেড় হাজার বছর ধরে যা বিশ্ব দরবারে কল্যাণমূলক জীবন-বিধান হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আছে।
জাতি হিসেবে আমরা গর্বিত এ জন্য যে বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি এতদঞ্চলের জনমানুষের হৃদয়কে সর্বদা আপ্লুত করে। এ দেশের সব ধর্মাবলম্বী মানুষ আবহমানকাল থেকে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করছে। ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্ট- এ দেশের প্রধান চারটি ধর্ম। জনসংখ্যার অনুপাতে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলমানের সংখ্যা সর্বাধিক, তথা ৯০ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত এই বাংলাদেশ। ইসলামের উদারনীতি ও অসাম্প্রদায়িক আদর্শের কারণেই এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান এবং হাজার বছর ধরে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এখানে সবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বিদ্যমান। যদিও এ দেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই বলে অন্য ধর্মাবলম্বীরা যেন কোনো অবস্থায়ই তাদের ন্যায্য, ন্যায়সংগত, ধর্মীয় ও সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, সে বিষয়টি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণকেই নিশ্চিত করতে হবে। ইসলামের ইতিহাসে সংখ্যালঘু সম্পদ্রায়ের ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন বা নির্যাতনের কোনো স্থান তো নেই-ই; বরং তাদের সব মৌলিক ও মানবিক অধিকারপ্রাপ্তির বিষয়টি সুদৃঢ়ভাবে স্বীকৃত রয়েছে।
জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। হজরত শাহজালাল ইয়ামেনি, হজরত শাহ সুলতান রুমি, হজরত শাহ পরান, হজরত খান জাহান আলী ও হজরত শাহ মখদুমসহ অসংখ্য ওলি-আউলিয়া, সুফি-সাধক ও গাউস-কুতুবের পদভারে ধন্য এই দেশ। পীর-আউলিয়া আর সুফি-সাধকদের নির্মোহ চরিত্র, নির্লোভচিত্ত আর তপস্যাময় জীবনের অলৌকিকত্বে এ দেশের জনমানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় ইসলাম এক কালজয়ী ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইসলামের প্রচার-প্রসারে তাঁদের অবর্ণনীয় ত্যাগ-তিতিক্ষা, কষ্ট-যাতনা ও দুর্ভোগের কাহিনী আমাদের জাতীয় ও ধর্র্মীয় ইতিহাসের এক অনবদ্য দলিল হয়ে আছে। উত্তরাধিকারসূত্রে খোদার নিয়ামত হিসেবে প্রাপ্ত এই মহান ধর্মের মৌলিকত্ব ও পবিত্রতা রক্ষা করা আমাদের অন্যতম দায়িত্ব। আমাদের আচরণে-ব্যবহারে, বক্তৃতা-বিবৃতিতে, কার্যসম্পাদনে বা কর্মসূচি প্রণয়নে প্রাণপ্রিয় এ ধর্ম যেন আঘাতপ্রাপ্ত না হয়, বিতর্কিত বা অবমাননার শিকার না হয়। ধর্ম পালন হৃদয়ের ব্যাপার, বিশ্বাস ও ভক্তির বিষয়; এতে যেন জোরজবরদস্তি না থাকে। একইভাবে ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়িও হলো সমাজের জন্য ক্ষতিকর, বিপর্যয়কর; তাই এটি সন্দেহাতীত সত্য যে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি সে তো ধর্মেরই অবমাননা।
লেখক : শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
bahauddindu¦yahoo.com
ধর্ম মানুষকে পুণ্যবান ও ধার্মিক করে। উদার ও সহনশীলতার শিক্ষা দেয় ধর্ম। ধর্মপালন মানুষকে সত্যিকার মানুষে পরিণত করে। ধর্মের মূল বাণীসমূহ পবিত্র, উন্নত ও মানবিক জীবন যাপনে মানুষকে সহায়তা করে। সমাজ-সভ্যতা ও পরিবেশ থেকে যাবতীয় অন্ধকার, কুসংস্কার ও অজ্ঞতা দূর করে সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের আলোকবর্তিকা প্রজ্বলিত করে ধর্ম। ধর্ম মানবজীবনে সব সময়ই ইতিবাচক ফল বয়ে আনে; ধর্মের কোনো নেতিবাচক দিক নেই। কেননা সব ঐশী ধর্মই এসেছে এমন এক মহান সত্তার পক্ষ থেকে, যিনি তাবৎ পৃথিবী ও এর মধ্যকার সব কিছুরই স্রষ্টা। সৃষ্টি কিসের মাধ্যমে ভালো থাকবে, কিভাবে সমৃদ্ধ হবে, কোন পন্থায় জীবনযাপন করলে শান্তি আসবে, মুক্তি মিলবে- সে সম্পর্কে তিনি সম্যক অবহিত। তাই তো পৃথিবীতে ধর্মের আগমন; ধর্মের মধ্যেই ভালো-মন্দের, পাপ-পুণ্যের বিচার-বিবেচনা নিহিত রয়েছে। মানুষ ও মানবতার প্রকৃত শান্তি ও সার্বিক মুক্তি ধর্ম পালনের মাধ্যমেই অর্জিত হয়। পৃথিবীর মানুষকে এমন একটি বার্তা পৌঁছে দিতেই ইতিহাসের এক অমোঘ অন্ধকারের কৃষ্ণযুগে মরুর বুকে আর্তনাদরত মানবতার মুক্তিসনদ নিয়ে প্রবর্তিত হয়েছিল ইসলাম ধর্মের; দেড় হাজার বছর ধরে যা বিশ্ব দরবারে কল্যাণমূলক জীবন-বিধান হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আছে।
জাতি হিসেবে আমরা গর্বিত এ জন্য যে বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি এতদঞ্চলের জনমানুষের হৃদয়কে সর্বদা আপ্লুত করে। এ দেশের সব ধর্মাবলম্বী মানুষ আবহমানকাল থেকে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করছে। ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্ট- এ দেশের প্রধান চারটি ধর্ম। জনসংখ্যার অনুপাতে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলমানের সংখ্যা সর্বাধিক, তথা ৯০ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত এই বাংলাদেশ। ইসলামের উদারনীতি ও অসাম্প্রদায়িক আদর্শের কারণেই এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান এবং হাজার বছর ধরে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এখানে সবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বিদ্যমান। যদিও এ দেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই বলে অন্য ধর্মাবলম্বীরা যেন কোনো অবস্থায়ই তাদের ন্যায্য, ন্যায়সংগত, ধর্মীয় ও সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, সে বিষয়টি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণকেই নিশ্চিত করতে হবে। ইসলামের ইতিহাসে সংখ্যালঘু সম্পদ্রায়ের ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন বা নির্যাতনের কোনো স্থান তো নেই-ই; বরং তাদের সব মৌলিক ও মানবিক অধিকারপ্রাপ্তির বিষয়টি সুদৃঢ়ভাবে স্বীকৃত রয়েছে।
জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। হজরত শাহজালাল ইয়ামেনি, হজরত শাহ সুলতান রুমি, হজরত শাহ পরান, হজরত খান জাহান আলী ও হজরত শাহ মখদুমসহ অসংখ্য ওলি-আউলিয়া, সুফি-সাধক ও গাউস-কুতুবের পদভারে ধন্য এই দেশ। পীর-আউলিয়া আর সুফি-সাধকদের নির্মোহ চরিত্র, নির্লোভচিত্ত আর তপস্যাময় জীবনের অলৌকিকত্বে এ দেশের জনমানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় ইসলাম এক কালজয়ী ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইসলামের প্রচার-প্রসারে তাঁদের অবর্ণনীয় ত্যাগ-তিতিক্ষা, কষ্ট-যাতনা ও দুর্ভোগের কাহিনী আমাদের জাতীয় ও ধর্র্মীয় ইতিহাসের এক অনবদ্য দলিল হয়ে আছে। উত্তরাধিকারসূত্রে খোদার নিয়ামত হিসেবে প্রাপ্ত এই মহান ধর্মের মৌলিকত্ব ও পবিত্রতা রক্ষা করা আমাদের অন্যতম দায়িত্ব। আমাদের আচরণে-ব্যবহারে, বক্তৃতা-বিবৃতিতে, কার্যসম্পাদনে বা কর্মসূচি প্রণয়নে প্রাণপ্রিয় এ ধর্ম যেন আঘাতপ্রাপ্ত না হয়, বিতর্কিত বা অবমাননার শিকার না হয়। ধর্ম পালন হৃদয়ের ব্যাপার, বিশ্বাস ও ভক্তির বিষয়; এতে যেন জোরজবরদস্তি না থাকে। একইভাবে ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়িও হলো সমাজের জন্য ক্ষতিকর, বিপর্যয়কর; তাই এটি সন্দেহাতীত সত্য যে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি সে তো ধর্মেরই অবমাননা।
লেখক : শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
bahauddindu¦yahoo.com
No comments