অর্থনীতির নিয়ম মানছে না দ্রব্যমূল্য by মুহাম্মদ রুহুল আমীন
কৃচ্ছ্র সাধনের মাস রমজানের শুরু থেকেই
নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের দাম প্রায় ২০০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়ে প্রায় ১৬
কোটি ভোক্তার কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক
পেশিশক্তি ও আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে গঠিত সিন্ডিকেট জাতির ওপর যে
অবর্ণনীয় জুলুম চালিয়ে আসছে, তা থেকে মুক্তির জন্য খাদ্যদ্রব্যের
মূল্যবৃদ্ধির রাজনৈতিক অর্থনীতি অনুধাবন করা প্রয়োজন। বাজার অর্থনীতিতে
কোনো দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয় এবং ব্যাস্টিক
অর্থনৈতিক তাত্ত্বিকরা যেভাবে তা ব্যাখ্যা করেন- সেসব কোনো তত্ত্বের আলোকেই
বাংলাদেশের শ্বাসরুদ্ধকর বাজারমূল্যের ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। বিশ্বের
খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদরা চাহিদা ও জোগানের সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের যে সম্পর্ক
নির্ণয় করেছেন, তাও রমজান মাসে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রযোজ্য হচ্ছে
না। কোনো দ্রব্যের দাম বাড়লে তার সরবরাহ কমে যায়। কারণ ক্রেতারা ওই দ্রব্য
ক্রয়ে অনিচ্ছুক হয়ে ওঠে। সেই অনিচ্ছুক ভোক্তাদের ক্রয়-ইচ্ছা বাড়ানোর জন্য
অনেক সময় দ্রব্যমূল্য হ্রাস করা হয় বিশেষ সরকারি নীতির মাধ্যমে।
রমজান মাসে বাংলাদেশে কী হয়? দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বী উল্লম্ফন। অথচ স্বাভাবিকভাবে এ সময় পণ্যের সরবরাহ কমে যাওয়ার কথা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বেসরকারি বাণিজ্য সংস্থাগুলো একাধিকবার নিশ্চিত করে বলেছে, এ বছর সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে নিত্যপণ্যের বিরাট মজুদ রয়েছে। জনগণের চাহিদার তুলনায় জিনিসপত্রের পাহাড় সমান মজুদ গড়ে তোলা হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি খাতে। টিসিবি জানিয়েছে, এ বছর রমজান মাসে কোনো নিত্যপণ্যের সরবরাহ ঘাটতি থাকবে না। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমানে আমাদের সরকারি ও বেসরকারি খাতে ২,০৩,৫৩৫ মেট্রিক টন পরিমাণ ভোজ্যতেল মজুদ রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ মজুদের সঙ্গে আরও ১,০৭,৮৫৭ মেট্রিক টন পাইপলাইনে আছে। এমনিভাবে পেঁয়াজ, রসুন, চিনি, আদা, ধনেপাতা, লেবু, কাঁচামরিচ, শাকসবজিরও বিপুল সরবরাহ রয়েছে। অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী এসব দ্রব্যের মূল্য নিশ্চয়ই কমে গেছে, ফলে সরবরাহ বেড়েছে। কিন্তু বাস্তবে চিত্রটা সম্পূর্ণ উল্টো। এসব দ্রব্যের মূল্য বেড়েছে অকল্পনীয়ভাবে, আবার সরবরাহও বেড়েছে অনেকটা আনুপাতিক হারে। ব্যাস্টিক অর্থনীতিবিদরা নিশ্চয়ই হাঁটুতে মাথা গুঁজবেন তত্ত্ব-বিভ্রাটের দুশ্চিন্তায়!
নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে ব্যবসায়ী ও সরকারি মহল থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত তুলে ধরা হয় এবং ভোক্তাদের ঠকানো হয়। বাণিজ্য ও আর্থিক বাজার-সংক্রান্ত প্রধান ওয়েবসাইট ব্ল–মবার্গের তথ্য থেকে জানা যায়, ৮ জুলাই (২০১২) থেকে ১ জানুয়ারি (২০১৩) সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ১১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দামও একই সময়ে ২০ ভাগ কমেছে। এভাবে অন্যান্য দ্রব্যমূল্যও আন্তর্জাতিক বাজারে হ্রাস পেয়েছে। তা সত্ত্বেও ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্পর্কের কারণে বাংলাদেশে তা দ্বিগুণ-তিনগুণ বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
মূল্যবৃদ্ধির আরেকটি কারণ হিসেবে জনগণের ব্যাপক ভোগের বিষয়টি সামনে আনা হয়। অর্থাৎ রমজান মাসে মানুষ বেশি খায়। সেজন্য দ্রব্যমূল্য বাড়ে। এ ব্যাখ্যাও অর্থনীতি তত্ত্বের আলোকে ভুল। কারণ জনগণের ব্যাপক ভোগের কারণে যে চাহিদা বৃদ্ধির উপাদান তৈরি হয়, তা এমন এক অর্থনৈতিক পরিবেশ তৈরি করে যেখানে প্রচুর উৎপাদান ও বিক্রি হয়। এভাবে উৎপাদন-বিক্রি-লাভের একটি চক্র তৈরি হয়। যা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর। এমন অবস্থায় ক্রেতারা খুব কম দামে বেশি বেশি দ্রব্য ক্রয় করে থাকে। দুর্ভাগ্যবশত পবিত্র রমজানে বাংলাদেশের ক্রেতারা অর্থনীতির এ স্বাভাবিক সুবিধাটুকু থেকেও বঞ্চিত হয় কেবল ব্যবসায়ী-রাজনীতিকদের তথা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের দুষ্টচক্রের কারণে।
এখন রমজানে শ্বাসরুদ্ধকর বাজারমূল্যের দিকে একটু তাকানো যাক। ১২ জুলাই ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকায় প্রকাশিত বারগ্রাফে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ১ জুলাই ও ১১ জুলাইয়ের দ্রব্যমূল্যের তুলনামূলক বিবরণে দেখা যায়, ১ জুলাই বেগুন, রসুন, আদা, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ ইত্যাদির দাম ছিল কেজিপ্রতি যথাক্রমে ৩৫, ৫০, ৫৫, ৩৬ ও ৩০ টাকা। মাত্র ১০ দিন পর ১১ জুলাই ওই দ্রব্যগুলোর মূল্য দাঁড়ায় যথাক্রমে ৮০, ৮৫, ৮৫, ৫৫ ও ২০০ টাকা। ১ জুলাই এক হালি লেবু এবং একমুঠো ধনেপাতার দাম ছিল যথাক্রমে ১০ ও ৪০ টাকা, যা ১১ জুলাই বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ ও ২১৫ টাকায়। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের দাম এক সপ্তাহে বৃদ্ধির হার প্রায় ১৮৯ শতাংশ। চাল, মাছ, মাংস, ডিম, ডাল, ইত্যাদির দামও অনেক বেড়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় বাইরে চলে গেছে। কোনো কোনো নিত্যপণ্যের দাম তিনগুণ আবার কোনোটির দ্বিগুণ বেড়েছে, যা ক্রেতাদের মাঝে ক্ষোভ ও হতাশার জš§ দিচ্ছে।
পবিত্র রমজানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ব্যাপারে সরকার এবং ব্যবসায়ী মহলের দায়িত্ব, দায়বদ্ধতা ও অবদান কতটুকু তা বিশ্লেষণ করা যাক। রমজানের আগে মাসব্যাপী বাজার পর্যবেক্ষণ ও বাজার নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত সরকারের হাঁকডাকে সাধারণ মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ব্যবসায়ীদের ঘন ঘন মিটিং, মন্ত্রী-এমপিদের বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের মনে গভীর হতাশা সৃষ্টি হয়েছে আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্যের কারণে। ২ জুলাই বাণিজ্য সচিবসহ সরকারি কর্মকর্তাদের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। ২ জুলাই এফবিসিসিআই সভাপতির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ইডঊঙইঅ-এর সভাপতি মোহাম্মদ গোলাম মাওলা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে ঘোষণা দেন : ‘পানির দরে ভোজ্যতেল বিক্রি করা হবে এবং লবণের দরে চিনি ভোক্তাদের হাতে তুলে দেয়া হবে।’ সরকার সমর্থিত ও আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ এফবিসিসিআই সভাপতি বৈঠকে প্রতিশ্র“তি দেন, সরকার ও ব্যবসায়ীরা এক জোট হয়ে এ বছর রমজানে মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। ওই বৈঠক থেকে বাণিজ্য সচিব ব্যবসায়ীদের দোকানে দোকানে মূল্য তালিকা ঝুলিয়ে দেয়ার নিয়মও বেঁধে দেন। অধিকন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ১৪টি পর্যবেক্ষণ দল গঠন করে রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করে।
এত ঢাকঢোল পিটানোর পরও কেন নিত্যপণ্যের এমন মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে পারল? পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার খবরে জানা যায়, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী ও খুচরা বিক্রেতাদের সবাই পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। গোলাম মাওলা সাহেবকে কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি আমদানিকারকদের ওপর দোষ চাপিয়ে কিছুটা স্বস্তির ঢেকুর গিলেছেন। তিনি একটি দৈনিকের প্রতিবেদককে কর্কশ ভাষায় বলেছেন, ‘আমদানিকারকদের জিজ্ঞেস করুন, তারাই সঠিক উত্তর দিতে পারবেন।’ প্রশ্ন হল, পানির দরে ভোজ্যতেল ও লবণের দরে চিনি বিক্রির তার প্রতিশ্র“তি কী কারণে চুরমার হয়ে গেল?
আগেই বলেছি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির একটি বড় কারণ রাজনৈতিক অর্থনীতি। অসাধু ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের যোগসাজশে একটি কায়েমী স্বার্থান্ধ চক্র গড়ে উঠেছে, যার কারণে সরকারি-বেসরকারি সব উদ্যোগ সত্ত্বেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাত্ত্বিকভাবে রাজনৈতিক অর্থনীতি বলতে আমরা রাজনীতি ও অর্থনীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে বুঝে থাকি। অন্য কথায়, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া ছাড়া অর্থনৈতিক দুষ্কর্ম পরিচালিত হতে পারে না। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ন্যক্কারজনক ও ঘৃণ্য অপতৎপরতায় লিপ্ত হতে পারছে। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া ছাড়া কখনোই আমদানিকারক, ব্যবসায়ী, মধস্বত্বভোগী বা খুচরা বিক্রেতারা কোনো ফন্দি বাস্তবায়ন করতে পারে না। কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি কাজী ফারুক দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, রাজনৈতিক বাটপারদের সহযোগিতায়, সমর্থনে ও যোগসাজশে ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের বর্ধিত চাহিদাকে পুঁজি করে অবৈধভাবে পকেট ভারি করে।
সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে রমজানে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে রাজনৈতিক অর্থনীতির সংশ্লিষ্টতা ও দায়-দায়িত্বের বিষয়টি খুবই স্পষ্ট। আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, চিনি, ডালের মূল্য হ্রাস এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে বর্তমানে বাংলাদেশী টাকার মূূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে যে পরিমাণে আমদানি খরচ কমে যাওয়ায় কথা, তার কোনো লক্ষণ বাজারে দেখা যায় না। কেন? বাণিজ্য মন্ত্র্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ব্যবসায়ীবৃন্দ- এদের মধ্যকার প্রতিনিয়ত যোগাযোগ ও সমন্বয়ে, যা খুবই প্রয়োজন, তা হয় না কেন? সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, সচিব, নীতিনির্ধারক সবাই ব্যাপারটি জানেন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে যে অবৈধ অর্থ অর্জিত হচ্ছে, সে অর্থ কে কতটুকু ভাগ করে নিচ্ছে, তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত হওয়া দরকার। আমরা সরকারকে অনুরোধ করব, অবিলম্বে রাজনৈতিক অর্থনীতির ষড়যন্ত্র চক্রের কবল থেকে রমজানের বাজারকে মুক্ত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হোক। কয়েক মাস পর সাধারণ নির্বাচন। এ স্পর্শকাতর সময়ে দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন মূল্যবৃদ্ধি সরকারের প্রতি ব্যাপক গণঅনাস্থা সৃষ্টি করবে। ঈদ ও রমজানকে উৎসব হিসেবে বিবেচনা করে নিত্যপণ্যে বিশেষ ছাড় দিয়ে সরকার সাধারণ মানুষকে আস্থায় আনতে পারে, যারা এরই মধ্যে নানা ইস্যুতে সরকারের প্রতি বিরাগভাজন হয়েছেন। পরপর পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর আবার যেন এমন কোনো ইস্যু তৈরি না হয়, যা সরকারকে জনগণ থেকে অনেক দূরে ঠেলে দেবে।
মুহাম্মদ রুহুল আমীন : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রমজান মাসে বাংলাদেশে কী হয়? দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বী উল্লম্ফন। অথচ স্বাভাবিকভাবে এ সময় পণ্যের সরবরাহ কমে যাওয়ার কথা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বেসরকারি বাণিজ্য সংস্থাগুলো একাধিকবার নিশ্চিত করে বলেছে, এ বছর সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে নিত্যপণ্যের বিরাট মজুদ রয়েছে। জনগণের চাহিদার তুলনায় জিনিসপত্রের পাহাড় সমান মজুদ গড়ে তোলা হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি খাতে। টিসিবি জানিয়েছে, এ বছর রমজান মাসে কোনো নিত্যপণ্যের সরবরাহ ঘাটতি থাকবে না। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমানে আমাদের সরকারি ও বেসরকারি খাতে ২,০৩,৫৩৫ মেট্রিক টন পরিমাণ ভোজ্যতেল মজুদ রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ মজুদের সঙ্গে আরও ১,০৭,৮৫৭ মেট্রিক টন পাইপলাইনে আছে। এমনিভাবে পেঁয়াজ, রসুন, চিনি, আদা, ধনেপাতা, লেবু, কাঁচামরিচ, শাকসবজিরও বিপুল সরবরাহ রয়েছে। অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী এসব দ্রব্যের মূল্য নিশ্চয়ই কমে গেছে, ফলে সরবরাহ বেড়েছে। কিন্তু বাস্তবে চিত্রটা সম্পূর্ণ উল্টো। এসব দ্রব্যের মূল্য বেড়েছে অকল্পনীয়ভাবে, আবার সরবরাহও বেড়েছে অনেকটা আনুপাতিক হারে। ব্যাস্টিক অর্থনীতিবিদরা নিশ্চয়ই হাঁটুতে মাথা গুঁজবেন তত্ত্ব-বিভ্রাটের দুশ্চিন্তায়!
নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে ব্যবসায়ী ও সরকারি মহল থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত তুলে ধরা হয় এবং ভোক্তাদের ঠকানো হয়। বাণিজ্য ও আর্থিক বাজার-সংক্রান্ত প্রধান ওয়েবসাইট ব্ল–মবার্গের তথ্য থেকে জানা যায়, ৮ জুলাই (২০১২) থেকে ১ জানুয়ারি (২০১৩) সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ১১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দামও একই সময়ে ২০ ভাগ কমেছে। এভাবে অন্যান্য দ্রব্যমূল্যও আন্তর্জাতিক বাজারে হ্রাস পেয়েছে। তা সত্ত্বেও ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্পর্কের কারণে বাংলাদেশে তা দ্বিগুণ-তিনগুণ বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
মূল্যবৃদ্ধির আরেকটি কারণ হিসেবে জনগণের ব্যাপক ভোগের বিষয়টি সামনে আনা হয়। অর্থাৎ রমজান মাসে মানুষ বেশি খায়। সেজন্য দ্রব্যমূল্য বাড়ে। এ ব্যাখ্যাও অর্থনীতি তত্ত্বের আলোকে ভুল। কারণ জনগণের ব্যাপক ভোগের কারণে যে চাহিদা বৃদ্ধির উপাদান তৈরি হয়, তা এমন এক অর্থনৈতিক পরিবেশ তৈরি করে যেখানে প্রচুর উৎপাদান ও বিক্রি হয়। এভাবে উৎপাদন-বিক্রি-লাভের একটি চক্র তৈরি হয়। যা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর। এমন অবস্থায় ক্রেতারা খুব কম দামে বেশি বেশি দ্রব্য ক্রয় করে থাকে। দুর্ভাগ্যবশত পবিত্র রমজানে বাংলাদেশের ক্রেতারা অর্থনীতির এ স্বাভাবিক সুবিধাটুকু থেকেও বঞ্চিত হয় কেবল ব্যবসায়ী-রাজনীতিকদের তথা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের দুষ্টচক্রের কারণে।
এখন রমজানে শ্বাসরুদ্ধকর বাজারমূল্যের দিকে একটু তাকানো যাক। ১২ জুলাই ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকায় প্রকাশিত বারগ্রাফে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ১ জুলাই ও ১১ জুলাইয়ের দ্রব্যমূল্যের তুলনামূলক বিবরণে দেখা যায়, ১ জুলাই বেগুন, রসুন, আদা, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ ইত্যাদির দাম ছিল কেজিপ্রতি যথাক্রমে ৩৫, ৫০, ৫৫, ৩৬ ও ৩০ টাকা। মাত্র ১০ দিন পর ১১ জুলাই ওই দ্রব্যগুলোর মূল্য দাঁড়ায় যথাক্রমে ৮০, ৮৫, ৮৫, ৫৫ ও ২০০ টাকা। ১ জুলাই এক হালি লেবু এবং একমুঠো ধনেপাতার দাম ছিল যথাক্রমে ১০ ও ৪০ টাকা, যা ১১ জুলাই বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ ও ২১৫ টাকায়। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের দাম এক সপ্তাহে বৃদ্ধির হার প্রায় ১৮৯ শতাংশ। চাল, মাছ, মাংস, ডিম, ডাল, ইত্যাদির দামও অনেক বেড়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় বাইরে চলে গেছে। কোনো কোনো নিত্যপণ্যের দাম তিনগুণ আবার কোনোটির দ্বিগুণ বেড়েছে, যা ক্রেতাদের মাঝে ক্ষোভ ও হতাশার জš§ দিচ্ছে।
পবিত্র রমজানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ব্যাপারে সরকার এবং ব্যবসায়ী মহলের দায়িত্ব, দায়বদ্ধতা ও অবদান কতটুকু তা বিশ্লেষণ করা যাক। রমজানের আগে মাসব্যাপী বাজার পর্যবেক্ষণ ও বাজার নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত সরকারের হাঁকডাকে সাধারণ মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ব্যবসায়ীদের ঘন ঘন মিটিং, মন্ত্রী-এমপিদের বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের মনে গভীর হতাশা সৃষ্টি হয়েছে আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্যের কারণে। ২ জুলাই বাণিজ্য সচিবসহ সরকারি কর্মকর্তাদের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। ২ জুলাই এফবিসিসিআই সভাপতির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ইডঊঙইঅ-এর সভাপতি মোহাম্মদ গোলাম মাওলা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে ঘোষণা দেন : ‘পানির দরে ভোজ্যতেল বিক্রি করা হবে এবং লবণের দরে চিনি ভোক্তাদের হাতে তুলে দেয়া হবে।’ সরকার সমর্থিত ও আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ এফবিসিসিআই সভাপতি বৈঠকে প্রতিশ্র“তি দেন, সরকার ও ব্যবসায়ীরা এক জোট হয়ে এ বছর রমজানে মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। ওই বৈঠক থেকে বাণিজ্য সচিব ব্যবসায়ীদের দোকানে দোকানে মূল্য তালিকা ঝুলিয়ে দেয়ার নিয়মও বেঁধে দেন। অধিকন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ১৪টি পর্যবেক্ষণ দল গঠন করে রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করে।
এত ঢাকঢোল পিটানোর পরও কেন নিত্যপণ্যের এমন মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে পারল? পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার খবরে জানা যায়, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী ও খুচরা বিক্রেতাদের সবাই পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। গোলাম মাওলা সাহেবকে কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি আমদানিকারকদের ওপর দোষ চাপিয়ে কিছুটা স্বস্তির ঢেকুর গিলেছেন। তিনি একটি দৈনিকের প্রতিবেদককে কর্কশ ভাষায় বলেছেন, ‘আমদানিকারকদের জিজ্ঞেস করুন, তারাই সঠিক উত্তর দিতে পারবেন।’ প্রশ্ন হল, পানির দরে ভোজ্যতেল ও লবণের দরে চিনি বিক্রির তার প্রতিশ্র“তি কী কারণে চুরমার হয়ে গেল?
আগেই বলেছি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির একটি বড় কারণ রাজনৈতিক অর্থনীতি। অসাধু ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের যোগসাজশে একটি কায়েমী স্বার্থান্ধ চক্র গড়ে উঠেছে, যার কারণে সরকারি-বেসরকারি সব উদ্যোগ সত্ত্বেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাত্ত্বিকভাবে রাজনৈতিক অর্থনীতি বলতে আমরা রাজনীতি ও অর্থনীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে বুঝে থাকি। অন্য কথায়, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া ছাড়া অর্থনৈতিক দুষ্কর্ম পরিচালিত হতে পারে না। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ন্যক্কারজনক ও ঘৃণ্য অপতৎপরতায় লিপ্ত হতে পারছে। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া ছাড়া কখনোই আমদানিকারক, ব্যবসায়ী, মধস্বত্বভোগী বা খুচরা বিক্রেতারা কোনো ফন্দি বাস্তবায়ন করতে পারে না। কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি কাজী ফারুক দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, রাজনৈতিক বাটপারদের সহযোগিতায়, সমর্থনে ও যোগসাজশে ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের বর্ধিত চাহিদাকে পুঁজি করে অবৈধভাবে পকেট ভারি করে।
সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে রমজানে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে রাজনৈতিক অর্থনীতির সংশ্লিষ্টতা ও দায়-দায়িত্বের বিষয়টি খুবই স্পষ্ট। আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, চিনি, ডালের মূল্য হ্রাস এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে বর্তমানে বাংলাদেশী টাকার মূূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে যে পরিমাণে আমদানি খরচ কমে যাওয়ায় কথা, তার কোনো লক্ষণ বাজারে দেখা যায় না। কেন? বাণিজ্য মন্ত্র্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ব্যবসায়ীবৃন্দ- এদের মধ্যকার প্রতিনিয়ত যোগাযোগ ও সমন্বয়ে, যা খুবই প্রয়োজন, তা হয় না কেন? সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, সচিব, নীতিনির্ধারক সবাই ব্যাপারটি জানেন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে যে অবৈধ অর্থ অর্জিত হচ্ছে, সে অর্থ কে কতটুকু ভাগ করে নিচ্ছে, তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত হওয়া দরকার। আমরা সরকারকে অনুরোধ করব, অবিলম্বে রাজনৈতিক অর্থনীতির ষড়যন্ত্র চক্রের কবল থেকে রমজানের বাজারকে মুক্ত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হোক। কয়েক মাস পর সাধারণ নির্বাচন। এ স্পর্শকাতর সময়ে দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন মূল্যবৃদ্ধি সরকারের প্রতি ব্যাপক গণঅনাস্থা সৃষ্টি করবে। ঈদ ও রমজানকে উৎসব হিসেবে বিবেচনা করে নিত্যপণ্যে বিশেষ ছাড় দিয়ে সরকার সাধারণ মানুষকে আস্থায় আনতে পারে, যারা এরই মধ্যে নানা ইস্যুতে সরকারের প্রতি বিরাগভাজন হয়েছেন। পরপর পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর আবার যেন এমন কোনো ইস্যু তৈরি না হয়, যা সরকারকে জনগণ থেকে অনেক দূরে ঠেলে দেবে।
মুহাম্মদ রুহুল আমীন : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments