যুদ্ধদিনের সাথী বিপুল ভট্টাচার্য by ফকির আলমগীর
১৯৭১
সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন
প্রচারিত হতো উদ্দীপনামূলক গান। সেসব গান একদিকে যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের মনে
সাহস জোগাত, তাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিত, তেমনি অন্যদের
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় করত উদ্দীপ্ত। যুদ্ধদিনের সেসব গান আজও কারও কণ্ঠে
বেজে উঠলে সবাইকে মনে করিয়ে দেয় সেসব দিনের কথা। বিশেষ করে আমাকে মনে করিয়ে
দেয় যুদ্ধদিনের স্মৃতি। সেদিনের সেই সাথীদের কথা ও যুদ্ধদিনের গানের অনেক
গল্প। নতুন প্রজšে§র কাছে তুলে ধরতে ইচ্ছে করছে তেমনি এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু
যুদ্ধদিনের সাথী, নন্দিত কণ্ঠশিল্পী বিপুল ভট্টাচার্যের কথা। এক অবিস্মরণীয়
কণ্ঠযোদ্ধার বিদায়ের কথা। ইতিমধ্যে দেশবাসী জেনে গেছেন তার মরণব্যাধি
ক্যান্সারের কাছে পরাজয়ের কথা। আমরা জানি, ভারতের বোম্বের টাটা মেমোরিয়াল
হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ব্যয়বহুল চিকিৎসা অসমাপ্ত রেখে দেশে ফিরে আসার কথা।
অথচ তিনি কারও কাছে কিছু চাননি, শুধু বিনয়ের সঙ্গে বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে
শুভানুধ্যায়ী, শুভাকাক্সক্ষী ও দেশবাসীর কাছে আমার একটাই চাওয়া- আপনারা
শুধু আমার জন্য দোয়া করবেন। সুস্থ হয়ে আবার যেন গাইতে পারি।’ আমাদের সবার
শুভ কামনা ছিল তার জন্য। সুস্থ হয়ে আবার যেন গাইতে পারেন স্বাধীন বাংলা
বেতার কেন্দ্রের এই দরদি কণ্ঠশিল্পী। কিন্তু সেই চাওয়া আর পূরণ হল না। তবে
এই সাহসী মুক্তিযোদ্ধা কণ্ঠশিল্পীর প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে না কোনোদিন।
মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার সাংস্কৃতিক
লড়াইয়ে তার দরাজ কণ্ঠের গান বিশেষভাবে প্রয়োজন ছিল। এই শিল্পী একদিন দেশের
ডাকে কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন জাগরণের গান, মুক্তির গান। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যোগ
দিয়েছিলেন মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থায়। একজন কণ্ঠসৈনিক হিসেবে ঘুরে
বেড়িয়েছেন শরণার্থীদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে। গান গেয়ে তাদের উজ্জীবিত
করেছিলেন। বলতে গেলে মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার শিল্পীদের ঘরবাড়ি,
জীবনই হয়ে উঠে ছিল ট্রাক। নানা সমস্যা, কষ্টের কথা ভুলে গিয়ে ভ্রাম্যমাণ
ট্রাকে ঘুরে ঘুরে অন্য সাথীদের সঙ্গে বিপুল ভট্টাচার্য সেদিন মুক্তাঞ্চলে
জাগরণী গান গেয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন সেসব গানে।
এখানে উল্লেখযোগ্য, আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সাংস্কৃতিক আন্দোলন
পরস্পর হাত ধরাধরি করে চলেছে। বিশ্বের দরবারে স্বাধীন দেশের আÍপ্রকাশকে
বেগবান করছে মুক্তিযুদ্ধের গান। মুক্তিযুদ্ধের গান বলতে সাধারণত আমরা
স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পরিবেশিত গানগুলোকে বুঝলেও এর পরিধির
ব্যাপকতা এবং এর পটভূমি কিন্তু সুবিশাল ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যেকার ভাষা
আন্দোলন, স্বাধীনতার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতির মধ্যে থেকেই এই গান
উৎসারিত। তাই সার্বিক পর্যালোচনায় মুক্তিযুদ্ধের গানকে তিনটি ধারায় বিভক্ত
করা যায়।
১. স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের গান, ২. মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার গান, ৩. বিশ্বখ্যাত শিল্পী সমাজের গান। আর বিপুল ভট্টাচার্যের কৃতিত্ব তিনি স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র এবং মুক্তি সংগ্রামী শিল্প সংস্থার শিল্পী ছিলেন। মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী মাহমুদুর রহমান বেনু, মোশাদ আলী, শাহীন সামাদ, ডালিয়া নওশিন, ডা. লায়লা প্রমুখ শিল্পীর সঙ্গে বিপুল ভট্টাচার্য বিভিন্ন শহর, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ও শরণার্থী শিবিরে জাগরণী গান পরিবেশন করেছেন। পরবর্তী পর্যায়ে মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার কার্যক্রম থেকেই বেরিয়ে আসে মুক্তির গান শীর্ষক মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল। আর সেই কার্যক্রমের অন্যতম নায়ক কণ্ঠসৈনিক বিপুল ভট্টাচার্য।
১৯৫৩ সালের ২৫ জুলাই কিশোরগঞ্জে নেয়া এই নন্দিত কণ্ঠশিল্পী সারাটা জীবন সঙ্গীতে নিবেদিত থেকেছেন। গেয়েছেন স্বাধিকার আন্দোলনের গান, ভাষা আন্দোলনের গান, মুক্তির গান। ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় পল্লীগীতিতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদক লাভ করেন। সেই থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আমাদের পরিচয়টাও সেই সময় থেকে। তারপর একত্রে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অংশগ্রহণ। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেদিনের কত স্মৃতি, কত গানের, কত অনুষ্ঠানের স্মৃতি, যা লিখে শেষ করা যাবে না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পরিবেশিত জাগরণী গানগুলো মুক্তিসেনারা সারাদেশে স্বাধীনতাকামী মানুষের মধ্যে প্রেরণা সঞ্চারে এক অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে এবং সেই কারণে মুক্তিযুদ্ধের গান এবং কণ্ঠদানকারী শিল্পীরা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। যেসব গানে বিপুল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন সেগুলো হচ্ছে- ‘মানুষ হ মানুষ হ’, ‘এই না বাংলাদেশের গান গাইতে রে’, ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি’, ‘বিপ্লবেরই রক্তে রাঙা জনতার সংগ্রাম চলবে’, ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন’, ‘সোনা সোনা সোনা লোকে বলে’, ‘, ‘বেরিকেড বেয়নেট বেড়াজাল’, ‘মুক্তির একই পথ সংগ্রাম’, ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর’ ইত্যাদি।
ফকির আলমগীর : শব্দসৈনিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
১. স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের গান, ২. মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার গান, ৩. বিশ্বখ্যাত শিল্পী সমাজের গান। আর বিপুল ভট্টাচার্যের কৃতিত্ব তিনি স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র এবং মুক্তি সংগ্রামী শিল্প সংস্থার শিল্পী ছিলেন। মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী মাহমুদুর রহমান বেনু, মোশাদ আলী, শাহীন সামাদ, ডালিয়া নওশিন, ডা. লায়লা প্রমুখ শিল্পীর সঙ্গে বিপুল ভট্টাচার্য বিভিন্ন শহর, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ও শরণার্থী শিবিরে জাগরণী গান পরিবেশন করেছেন। পরবর্তী পর্যায়ে মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার কার্যক্রম থেকেই বেরিয়ে আসে মুক্তির গান শীর্ষক মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল। আর সেই কার্যক্রমের অন্যতম নায়ক কণ্ঠসৈনিক বিপুল ভট্টাচার্য।
১৯৫৩ সালের ২৫ জুলাই কিশোরগঞ্জে নেয়া এই নন্দিত কণ্ঠশিল্পী সারাটা জীবন সঙ্গীতে নিবেদিত থেকেছেন। গেয়েছেন স্বাধিকার আন্দোলনের গান, ভাষা আন্দোলনের গান, মুক্তির গান। ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় পল্লীগীতিতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদক লাভ করেন। সেই থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আমাদের পরিচয়টাও সেই সময় থেকে। তারপর একত্রে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অংশগ্রহণ। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেদিনের কত স্মৃতি, কত গানের, কত অনুষ্ঠানের স্মৃতি, যা লিখে শেষ করা যাবে না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পরিবেশিত জাগরণী গানগুলো মুক্তিসেনারা সারাদেশে স্বাধীনতাকামী মানুষের মধ্যে প্রেরণা সঞ্চারে এক অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে এবং সেই কারণে মুক্তিযুদ্ধের গান এবং কণ্ঠদানকারী শিল্পীরা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। যেসব গানে বিপুল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন সেগুলো হচ্ছে- ‘মানুষ হ মানুষ হ’, ‘এই না বাংলাদেশের গান গাইতে রে’, ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি’, ‘বিপ্লবেরই রক্তে রাঙা জনতার সংগ্রাম চলবে’, ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন’, ‘সোনা সোনা সোনা লোকে বলে’, ‘, ‘বেরিকেড বেয়নেট বেড়াজাল’, ‘মুক্তির একই পথ সংগ্রাম’, ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর’ ইত্যাদি।
ফকির আলমগীর : শব্দসৈনিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
No comments