মনের কোণে হীরে-মুক্তো-গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় পরিবারতন্ত্রের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ by ড. সা'দত হুসাইন
সম্প্রতি ফরিদপুর অঞ্চলের এক বর্ষীয়ান
নেতা তাঁর পুত্র এবং পুত্রবধূকে একটি (রাজনৈতিক) সভায় এলাকার জনগণ তথা
ভোটারদের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাঁদের জন্য সবার দোয়া চেয়েছেন।
উচ্চশিক্ষিত প্রবাসী পুত্র ও পুত্রবধূকে এলাকার উন্নয়ন এবং জনসাধারণের
(ভোটার) কল্যাণের লক্ষ্যে তিনি দেশে ফিরিয়ে এনেছেন। ব্যক্তিমালিকানাধীন
কম্পানির অবসর প্রয়াসী চেয়ারম্যান বা প্রধান নির্বাহী যেভাবে দায়িত্ব
হস্তান্তরের লক্ষ্যে তাঁর উত্তরাধিকারী সন্তানকে (দের) আনুষ্ঠানিকভাবে
কম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, বর্ষীয়ান নেতা
একইভাবে তাঁর ছেলে এবং ছেলের বউকে নির্বাচনী এলাকার কর্মী ও ভোটারদের সঙ্গে
আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তাঁর অবর্তমানে যেন এলাকা নষ্ট না
হয়, সে জন্যই তিনি ছেলে-বউকে রাজনীতিতে এনেছেন বলে জানালেন।
এ নেতা অনেকের তুলনায় তাঁর পদ্ধতির ব্যাপারে কিছুটা স্বচ্ছতার পরিচয় দিয়েছেন। উত্তরাধিকারীর হাতে নির্বাচনী এলাকার দায়িত্ব তথা রাজনৈতিক নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার ঘটনা এখন বহুল প্রচলিত সাধারণ রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে-বিদেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় উত্তরাধিকারীর অধিষ্ঠানও বিপুলভাবে লক্ষণীয়। এ প্রথা রাজতন্ত্রে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত; এ নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করেনি, এখনো করে না। দেবত্বকল্পে সিক্ত নেতাদের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর বিভিন্ন দেশের লোক ভোটাভুটি ছাড়াই অনেকটা মেনে নিয়েছে। আলোচনা, সমালোচনা এবং গবেষণার বিষয় হচ্ছে যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়ও বাংলাদেশসহ অনেক দেশে পূর্বপুরুষের ক্ষমতায় উত্তরাধিকারীর অধিষ্ঠান এত বিপুল সংখ্যায় ঘটেছে যে একে স্রেফ অপছন্দনীয় বা নিন্দনীয় বলে উড়িয়ে দেওয়া হালকা মানসিকতার পরিচায়ক হবে। যে ঘটনা দেশে দেশে, যুগে যুগে অর্থাৎ স্থান-কাল আচ্ছাদন করে ঘটে থাকে, সে কাজের ক্রিয়া-পদ্ধতি (Dynamics), অনুষ্ঠান-আয়োজন যথার্থই গবেষণার দাবি রাখে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরাধিকারতন্ত্র বা পরিবারতন্ত্রের উৎস এবং অবস্থানের ওপর এ নিবন্ধে সংক্ষেপে কিছুটা আলোকপাত করা হলো।
বাংলাদেশ দিয়ে শুরু করছি। নব্বইয়ের দশকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তিত হওয়ার পর মোট ছয়জন ব্যক্তি মহামান্য রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চারজন হচ্ছেন রাজনীতিবিদ। এই চার রাজনীতিবিদ রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্যে পার্লামেন্টে নিজেদের যে চারটি আসন ছেড়ে দিয়েছিলেন, তার প্রত্যেকটিতে তাঁর পুত্রসন্তানকে মনোনয়ন দেওয়া নিশ্চিত করেছিলেন এবং তাঁরা প্রত্যেকেই পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। সর্বশেষ নির্বাচিত সংসদ সদস্য হচ্ছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের পুত্র রেজওয়ান আহমেদ তৌফিক। তাঁদের মধ্যে দু-একজনকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পেশা থেকে রাজনীতিতে টেনে আনতে হয়েছে।
দুই বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা তথা দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে একজনের পুত্রসন্তান তাঁর নিজ দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা হিসেবে অধিষ্ঠিত। অন্যজনের পুত্রসন্তান দলীয় কোনো পদে অধিষ্ঠিত না হলেও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে মোটামুটি সম্পৃক্ত। দুই নেত্রীর নিকটাত্মীয়দের অনেকেই সংসদ সদস্য আছেন বা ছিলেন; তাঁরা দল, সরকার অথবা বেসরকারি খাতের গুরুত্বপূর্ণ পদে সমাসীন। জাতীয় পার্টিপ্রধানেরও কয়েকজন নিকটাত্মীয় সংসদ সদস্য রয়েছেন। নব্বইয়ের দশক থেকে যত সংসদ সদস্য প্রয়াত হয়েছেন, তার প্রায় সব কটি শূন্য আসনে, নগণ্যসংখ্যক ব্যতিক্রম বাদে, প্রয়াত সংসদ সদস্যের সন্তান বা স্ত্রী মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মামলা-মোকদ্দমার কারণে শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। তাঁদের স্থলে তাঁদের স্ত্রী-পুত্রদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা প্রায় সবাই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। উল্লেখযোগ্য চারজন হচ্ছেন ফরিদপুরের ভাঙ্গায় আওয়ামী লীগের কাজী জাফরুল্লার স্ত্রী নিলুফার জাফরুল্লাহ, কক্সবাজারের চকরিয়া-পেকুয়া থেকে বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমেদের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ, সিরাজগঞ্জ সদরে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর স্ত্রী রুমানা মাহমুদ এবং সিরাজগঞ্জে মোহাম্মদ নাসিমের পুত্র, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর পৌত্র তানবির শাকিল জয়। এঁদের কেউই রাজনীতিতে সুপরিচিত বা প্রতিষ্ঠিত ছিলেন না। বাব-দাদা এবং স্বামীর নামে নির্বাচন করে তাঁরা জয়ী হয়েছেন।
নবম জাতীয় সংসদে পিতা বা ভাইয়ের শূন্য আসনে মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হয়ে সংসদে এসেছেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের ছেলে নাজমুল হাসান পাপন, বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলে রেজওয়ান আহমেদ তৌফিক, মরহুম আবদুর রাজ্জাকের ছেলে নাহিম রাজ্জাক এবং মরহুম আখতারুজ্জামানের ছেলে সাইফুজ্জামান জাভেদ। মরহুম তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে সোহেল তাজের পদত্যাগজনিত শূন্য আসনে শাসক দলের মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন সোহেল তাজের বোন সিমিন হোসেন রিমি। সংসদের শূন্য আসনগুলো প্রভাবশালী পরিবারের মধ্যেই ভাগ-বাটোয়ারা করে দেওয়া হয়েছে। ভোটাররাও তাঁদের ভোটের মাধ্যমে এই ভাগ-বাটোয়ারার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন।
পরিবারতন্ত্র, স্বজনতন্ত্র- যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, পৃথিবীর অনেক দেশে, বিশেষ করে এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে তা প্রায়শ লক্ষ করা যায়। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, এমনকি সমাজতান্ত্রিক উত্তর কোরিয়ায় এরূপ দৃষ্টান্ত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে কেনেডি পরিবার, বুশ পরিবার এবং আল গোর পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে উঁচু স্তরের রাজনৈতিক পদগুলোতে নির্বাচিত অথবা মনোনীত ব্যক্তি হিসেবে সমাসীন হয়েছেন। স্থান-কালের ব্যাপ্ত পরিসরে যে ঘটনা ঘটে, যে দৃষ্টান্তের সৃষ্টি হয়, তাকে নিছক ব্যতিক্রম কিংবা মন্দ দৃষ্টান্ত বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ব্যাকরণগত শুদ্ধতা কিংবা আদর্শিক ভিত্তি না থাকলেও বাস্তবতার নিরিখে তা যৌক্তিক মনে হতে পারে। বাজার অর্থনীতি তথা পুঁজিবাদী সমাজে সম্পদের উত্তরাধিকারী হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রধান দুটি স্তম্ভ হচ্ছে : (১) ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তির ওপর বংশানুক্রমে মালিকের অবারিত অধিকার এবং (২) সম্পদের মালিকানা, ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য সব বিষয়ে সম্পাদিত চুক্তির নির্বিঘ্ন পূর্ণ বাস্তবায়ন (Enforcement of contract)। যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও এ ব্যবস্থায় একজন অপদার্থ ব্যক্তি শুধু উত্তরাধিকারের বদৌলতে সমাজে বা এলাকায় বড় মাপের প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। পিতা-প্রপিতার সম্পদ এবং প্রভাবের কারণে ছোট্ট শিশুটিও পাড়ায়-মহল্লায় এবং পরিচিতজনের মধ্যে লক্ষণীয় স্নেহ, সম্মান ও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। বয়স্ক ব্যক্তিরাও তাঁকে গণ্যমান্য হিসেবে বিবেচনা করে।
স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মতো রাজনৈতিক নেতার প্রভাব-প্রতিপত্তি পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে উত্তরাধিকারীদের কাছে হস্তান্তর যোগ্য বিবেচিত হচ্ছে। নেতার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আত্মীয়স্বজন এবং আশপাশের লোকজন 'ফ্যামিলি এন্টারপ্রাইজ' হিসেবে দেখে থাকে। এ কর্মকাণ্ড থেকে তাঁরা নানাবিধ সুবিধা গ্রহণ করেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে ভালো আয় হলেও এর জন্য ব্যয়ের পরিমাণটাও খুব কম নয়। নেতা এবং তার পরিবার নগদ ব্যয়ের বৃহদাংশ নির্বাহ করে। এ জন্য পরিবারভিত্তিক একটি সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তুলতে হয়। পরিবারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীন জনবল-ধনবলের পাশাপাশি একটি পারিবারিক 'কেটারিং সার্ভিস' থাকতে হয়। দিনের প্রায় যেকোনো সময়ে অন্তত ডজনখানেক লোককে আপ্যায়ন করার জন্য পরিবার নিবদ্ধ (Embedded) এই কেটারিং বা 'ক্যাফেটেরিয়া' সার্ভিসের সংগতি থাকতে হয়। মহানগরীর নিজস্ব ফ্ল্যাটে এরূপ আয়োজন সম্ভব না হলে কোনো কোনো নেতা ভিন্নভাবে তাঁর কেনা বা ভাড়াটিয়া ফ্ল্যাটে রাজনৈতিক আস্তানা তৈরির ব্যবস্থা করেন। এমনিভাবে নানারূপ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাঁর যে প্রভাব-প্রতিপত্তি গড়ে ওঠে, তাকে পারিবারিক ঐতিহ্য বা সম্পদ হিসেবে গণ্য করতে তিনি এবং তাঁর আত্মীয়স্বজন অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। কোনো কোনো সময় নেতার জীবিত অবস্থায় তার উত্তরাধিকারী রাজনৈতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় জড়িয়ে পড়েন। তা না হলে নেতার প্রয়াণের অব্যবহিত পর আত্মীয়স্বজন এবং আশপাশের লোকজন উত্তরাধিকারীকে এ সম্পদ গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন; প্রয়োজনে চাপ সৃষ্টি করেন। ফলে উত্তরাধিকারী রাজনৈতিক নেতার আসনে অধিষ্ঠিত হন।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় বর্তমানে পুরো পরিবারকে একটি অবিভাজ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা ইউনিট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেসব পরিবারের মূল (core) সদস্যরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে বিভক্ত, সেসব পরিবারকে বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে ধরা হয়। প্রথমদিকে ব্যাপারটি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারিনি। আমার বেশ খটকা লেগেছিল। আমার সতীর্থ এবং বন্ধু-বান্ধবদের স্থির বিশ্বাস ছিল, পিতা-মাতা বা অভিভাবকদের ভালো-মন্দ কাজকর্মের সঙ্গে সন্তানদের জড়াতে নেই। বিশেষ করে তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে সন্তানরা কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নয়। সন্তানদের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে বিবেচনা করতে হবে। পরবর্তীকালে অভিজ্ঞতা থেকে দেখতে পেয়েছি যে রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ মানুষের ধারণা যথেষ্ট বাস্তবসম্মত। আদর্শিকভাবে পরিবারপ্রধানের সঙ্গে কদাচ পরিবারের দু-একজন সদস্যের মতপার্থক্য থাকলেও পরিবারপ্রধানের প্রভাব-প্রতিপত্তির বদৌলতে বর্তমান সময়ে সুযোগ-সুবিধা ভোগের দিক থেকে তারাও বাদ পড়ে না। নিজ দল ক্ষমতার বাইরে থাকা অবস্থায় পরিবারপ্রধান দমন-পীড়নের শিকার হলে পরিবারের সদস্যরা, এমনকি তাঁর আত্মীয়স্বজন, প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হন। সেদিক থেকে রাজনীতিবিদদের সন্তানরা রাজনীতির চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে বড় হয়ে ওঠে; দেশীয় রাজনীতির বাস্তবতায় কিছুটা রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তাদের এমনিতেই হয়ে যায়।
রাজনৈতিক নেতার সন্তানের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় রাজনীতিতে অংশগ্রহণকে পরিবারতন্ত্র বলা হয় না। পিতা-মাতার পেশায় সন্তান আসতেই পারে। পরিবারতন্ত্র বলতে অনভিজ্ঞ-অনুপযোগী সন্তানকে বিনা নোটিশে কিংবা স্বল্প সময়ের নোটিশে রাজনীতিতে নিয়ে এসে সরাসরি সরকার বা দলের সুউচ্চ পদে অধিষ্ঠান করিয়ে দেওয়াকে বোঝায়। যে সন্তান কিশোর বা তরুণ বয়স থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পর্যায়ক্রমে দল বা সরকারের ঊর্ধ্বতন স্তরে উপনীত হন, তাঁর ব্যাপারে পরিবারতন্ত্রের স্লোগান ওঠানো হয় না। ভারতে জওহরলাল নেহরু, সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, পাকিস্তানে ওয়ালি খান, ইউসুফ রাজা গিলানি, বাংলাদেশে মোহাম্মদ নাসিম, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর ব্যাপারে পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ আসেনি, কারণ তাঁরা রাজনীতির স্বাভাবিক পথ ধরে ওপরে উঠেছেন। তাঁদের পারিবারিক ঐতিহ্য এবং রাজনীতিতে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দলীয় কর্মকাণ্ডে সহায়ক ভূমিকা পালন করে, রাজনীতিকে সমৃদ্ধ করে। পক্ষান্তরে অনভিজ্ঞ, অযোগ্য সন্তানকে রাজনীতিতে টেনে এনে সুউচ্চ পদে বসিয়ে দিলে রাজনৈতিক কর্মী এবং সাধারণ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ভাগ্যগুণে এদের মধ্যে বিরল দু-একজন রাজনীতির উচ্চ মার্গে গ্রহণযোগ্য প্রতীয়মান হলেও অধিকাংশই দল এবং সরকারের জন্য ভারী দায় হিসেবে চেপে বসেন। এতে দল এবং দেশের সমুদয় ক্ষতি হয়।
মুক্তবাজার অর্থনীতি তথা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় যত দিন সম্পদের উত্তরাধিকারব্যবস্থা নিশ্চিত থাকবে, তত দিন ব্যক্তি তাঁর রাজনৈতিক সম্পদ সন্তানদের মধ্যে স্থানান্তরের প্রচেষ্টা চালাবেন। তিনি বা তাঁর পরিবার কতদূর সফল হবেন, তা নির্ভর করবে রাজনৈতিক সম্পদের ওপর তাঁর মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণ কত সুদৃঢ় তার ওপর। উপমহাদেশ এবং এশিয়ার এতদঞ্চলে অদূর ভবিষ্যতে উত্তরাধিকারতন্ত্র তথা পরিবারতন্ত্রের বিলোপ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। বরং এ অঞ্চলে সম্পদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারতন্ত্র আরো দৃঢ়ভাবে গেড়ে বসার আশঙ্কা রয়েছে। রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের সন্তানদের নিজের নির্বাচনী এলাকার রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়াস পাচ্ছেন। উপজেলা পর্যায়ে সম্পদ প্রবাহের পরিমাণ এত বেড়েছে যে এখন বিদেশে অবস্থানরত সন্তান-সন্ততিরাও উপজেলায় এসে রাজনীতিতে যোগদানে উৎসাহিত হচ্ছেন। তাঁরা নিজেরা আশা করছেন, অথবা তাঁদেরকে নিশ্চিত করা হচ্ছে যে উপজেলায় রাজনীতি করলে তাঁরা আর্থিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। গত কয়েক দশকে রাজনীতি ধীরে ধীরে সত্যিকার অর্থে অর্থকরী উদ্যোগ (Enterprise) তথা ব্যবসায়ে রূপান্তরিত হয়েছে। বংশপরম্পরায় এ ব্যবসা চালিয়ে যেতে শিক্ষিত, অশিক্ষিত, উচ্চ শিক্ষিত- কারোই বোধহয় আর আপত্তি থাকবে না। ধারণা করা অমূলক হবে না যে অন্তত আগামী দু-এক দশক ধরে পরিবারতন্ত্র গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে টিকে থাকবে।
লেখক : পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ও
সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব
এ নেতা অনেকের তুলনায় তাঁর পদ্ধতির ব্যাপারে কিছুটা স্বচ্ছতার পরিচয় দিয়েছেন। উত্তরাধিকারীর হাতে নির্বাচনী এলাকার দায়িত্ব তথা রাজনৈতিক নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার ঘটনা এখন বহুল প্রচলিত সাধারণ রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে-বিদেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় উত্তরাধিকারীর অধিষ্ঠানও বিপুলভাবে লক্ষণীয়। এ প্রথা রাজতন্ত্রে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত; এ নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করেনি, এখনো করে না। দেবত্বকল্পে সিক্ত নেতাদের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর বিভিন্ন দেশের লোক ভোটাভুটি ছাড়াই অনেকটা মেনে নিয়েছে। আলোচনা, সমালোচনা এবং গবেষণার বিষয় হচ্ছে যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়ও বাংলাদেশসহ অনেক দেশে পূর্বপুরুষের ক্ষমতায় উত্তরাধিকারীর অধিষ্ঠান এত বিপুল সংখ্যায় ঘটেছে যে একে স্রেফ অপছন্দনীয় বা নিন্দনীয় বলে উড়িয়ে দেওয়া হালকা মানসিকতার পরিচায়ক হবে। যে ঘটনা দেশে দেশে, যুগে যুগে অর্থাৎ স্থান-কাল আচ্ছাদন করে ঘটে থাকে, সে কাজের ক্রিয়া-পদ্ধতি (Dynamics), অনুষ্ঠান-আয়োজন যথার্থই গবেষণার দাবি রাখে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরাধিকারতন্ত্র বা পরিবারতন্ত্রের উৎস এবং অবস্থানের ওপর এ নিবন্ধে সংক্ষেপে কিছুটা আলোকপাত করা হলো।
বাংলাদেশ দিয়ে শুরু করছি। নব্বইয়ের দশকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তিত হওয়ার পর মোট ছয়জন ব্যক্তি মহামান্য রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চারজন হচ্ছেন রাজনীতিবিদ। এই চার রাজনীতিবিদ রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্যে পার্লামেন্টে নিজেদের যে চারটি আসন ছেড়ে দিয়েছিলেন, তার প্রত্যেকটিতে তাঁর পুত্রসন্তানকে মনোনয়ন দেওয়া নিশ্চিত করেছিলেন এবং তাঁরা প্রত্যেকেই পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। সর্বশেষ নির্বাচিত সংসদ সদস্য হচ্ছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের পুত্র রেজওয়ান আহমেদ তৌফিক। তাঁদের মধ্যে দু-একজনকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পেশা থেকে রাজনীতিতে টেনে আনতে হয়েছে।
দুই বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা তথা দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে একজনের পুত্রসন্তান তাঁর নিজ দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা হিসেবে অধিষ্ঠিত। অন্যজনের পুত্রসন্তান দলীয় কোনো পদে অধিষ্ঠিত না হলেও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে মোটামুটি সম্পৃক্ত। দুই নেত্রীর নিকটাত্মীয়দের অনেকেই সংসদ সদস্য আছেন বা ছিলেন; তাঁরা দল, সরকার অথবা বেসরকারি খাতের গুরুত্বপূর্ণ পদে সমাসীন। জাতীয় পার্টিপ্রধানেরও কয়েকজন নিকটাত্মীয় সংসদ সদস্য রয়েছেন। নব্বইয়ের দশক থেকে যত সংসদ সদস্য প্রয়াত হয়েছেন, তার প্রায় সব কটি শূন্য আসনে, নগণ্যসংখ্যক ব্যতিক্রম বাদে, প্রয়াত সংসদ সদস্যের সন্তান বা স্ত্রী মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মামলা-মোকদ্দমার কারণে শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। তাঁদের স্থলে তাঁদের স্ত্রী-পুত্রদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা প্রায় সবাই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। উল্লেখযোগ্য চারজন হচ্ছেন ফরিদপুরের ভাঙ্গায় আওয়ামী লীগের কাজী জাফরুল্লার স্ত্রী নিলুফার জাফরুল্লাহ, কক্সবাজারের চকরিয়া-পেকুয়া থেকে বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমেদের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ, সিরাজগঞ্জ সদরে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর স্ত্রী রুমানা মাহমুদ এবং সিরাজগঞ্জে মোহাম্মদ নাসিমের পুত্র, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর পৌত্র তানবির শাকিল জয়। এঁদের কেউই রাজনীতিতে সুপরিচিত বা প্রতিষ্ঠিত ছিলেন না। বাব-দাদা এবং স্বামীর নামে নির্বাচন করে তাঁরা জয়ী হয়েছেন।
নবম জাতীয় সংসদে পিতা বা ভাইয়ের শূন্য আসনে মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হয়ে সংসদে এসেছেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের ছেলে নাজমুল হাসান পাপন, বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলে রেজওয়ান আহমেদ তৌফিক, মরহুম আবদুর রাজ্জাকের ছেলে নাহিম রাজ্জাক এবং মরহুম আখতারুজ্জামানের ছেলে সাইফুজ্জামান জাভেদ। মরহুম তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে সোহেল তাজের পদত্যাগজনিত শূন্য আসনে শাসক দলের মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন সোহেল তাজের বোন সিমিন হোসেন রিমি। সংসদের শূন্য আসনগুলো প্রভাবশালী পরিবারের মধ্যেই ভাগ-বাটোয়ারা করে দেওয়া হয়েছে। ভোটাররাও তাঁদের ভোটের মাধ্যমে এই ভাগ-বাটোয়ারার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন।
পরিবারতন্ত্র, স্বজনতন্ত্র- যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, পৃথিবীর অনেক দেশে, বিশেষ করে এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে তা প্রায়শ লক্ষ করা যায়। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, এমনকি সমাজতান্ত্রিক উত্তর কোরিয়ায় এরূপ দৃষ্টান্ত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে কেনেডি পরিবার, বুশ পরিবার এবং আল গোর পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে উঁচু স্তরের রাজনৈতিক পদগুলোতে নির্বাচিত অথবা মনোনীত ব্যক্তি হিসেবে সমাসীন হয়েছেন। স্থান-কালের ব্যাপ্ত পরিসরে যে ঘটনা ঘটে, যে দৃষ্টান্তের সৃষ্টি হয়, তাকে নিছক ব্যতিক্রম কিংবা মন্দ দৃষ্টান্ত বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ব্যাকরণগত শুদ্ধতা কিংবা আদর্শিক ভিত্তি না থাকলেও বাস্তবতার নিরিখে তা যৌক্তিক মনে হতে পারে। বাজার অর্থনীতি তথা পুঁজিবাদী সমাজে সম্পদের উত্তরাধিকারী হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রধান দুটি স্তম্ভ হচ্ছে : (১) ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তির ওপর বংশানুক্রমে মালিকের অবারিত অধিকার এবং (২) সম্পদের মালিকানা, ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য সব বিষয়ে সম্পাদিত চুক্তির নির্বিঘ্ন পূর্ণ বাস্তবায়ন (Enforcement of contract)। যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও এ ব্যবস্থায় একজন অপদার্থ ব্যক্তি শুধু উত্তরাধিকারের বদৌলতে সমাজে বা এলাকায় বড় মাপের প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। পিতা-প্রপিতার সম্পদ এবং প্রভাবের কারণে ছোট্ট শিশুটিও পাড়ায়-মহল্লায় এবং পরিচিতজনের মধ্যে লক্ষণীয় স্নেহ, সম্মান ও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। বয়স্ক ব্যক্তিরাও তাঁকে গণ্যমান্য হিসেবে বিবেচনা করে।
স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মতো রাজনৈতিক নেতার প্রভাব-প্রতিপত্তি পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে উত্তরাধিকারীদের কাছে হস্তান্তর যোগ্য বিবেচিত হচ্ছে। নেতার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আত্মীয়স্বজন এবং আশপাশের লোকজন 'ফ্যামিলি এন্টারপ্রাইজ' হিসেবে দেখে থাকে। এ কর্মকাণ্ড থেকে তাঁরা নানাবিধ সুবিধা গ্রহণ করেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে ভালো আয় হলেও এর জন্য ব্যয়ের পরিমাণটাও খুব কম নয়। নেতা এবং তার পরিবার নগদ ব্যয়ের বৃহদাংশ নির্বাহ করে। এ জন্য পরিবারভিত্তিক একটি সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তুলতে হয়। পরিবারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীন জনবল-ধনবলের পাশাপাশি একটি পারিবারিক 'কেটারিং সার্ভিস' থাকতে হয়। দিনের প্রায় যেকোনো সময়ে অন্তত ডজনখানেক লোককে আপ্যায়ন করার জন্য পরিবার নিবদ্ধ (Embedded) এই কেটারিং বা 'ক্যাফেটেরিয়া' সার্ভিসের সংগতি থাকতে হয়। মহানগরীর নিজস্ব ফ্ল্যাটে এরূপ আয়োজন সম্ভব না হলে কোনো কোনো নেতা ভিন্নভাবে তাঁর কেনা বা ভাড়াটিয়া ফ্ল্যাটে রাজনৈতিক আস্তানা তৈরির ব্যবস্থা করেন। এমনিভাবে নানারূপ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাঁর যে প্রভাব-প্রতিপত্তি গড়ে ওঠে, তাকে পারিবারিক ঐতিহ্য বা সম্পদ হিসেবে গণ্য করতে তিনি এবং তাঁর আত্মীয়স্বজন অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। কোনো কোনো সময় নেতার জীবিত অবস্থায় তার উত্তরাধিকারী রাজনৈতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় জড়িয়ে পড়েন। তা না হলে নেতার প্রয়াণের অব্যবহিত পর আত্মীয়স্বজন এবং আশপাশের লোকজন উত্তরাধিকারীকে এ সম্পদ গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন; প্রয়োজনে চাপ সৃষ্টি করেন। ফলে উত্তরাধিকারী রাজনৈতিক নেতার আসনে অধিষ্ঠিত হন।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় বর্তমানে পুরো পরিবারকে একটি অবিভাজ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা ইউনিট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেসব পরিবারের মূল (core) সদস্যরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে বিভক্ত, সেসব পরিবারকে বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে ধরা হয়। প্রথমদিকে ব্যাপারটি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারিনি। আমার বেশ খটকা লেগেছিল। আমার সতীর্থ এবং বন্ধু-বান্ধবদের স্থির বিশ্বাস ছিল, পিতা-মাতা বা অভিভাবকদের ভালো-মন্দ কাজকর্মের সঙ্গে সন্তানদের জড়াতে নেই। বিশেষ করে তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে সন্তানরা কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নয়। সন্তানদের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে বিবেচনা করতে হবে। পরবর্তীকালে অভিজ্ঞতা থেকে দেখতে পেয়েছি যে রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ মানুষের ধারণা যথেষ্ট বাস্তবসম্মত। আদর্শিকভাবে পরিবারপ্রধানের সঙ্গে কদাচ পরিবারের দু-একজন সদস্যের মতপার্থক্য থাকলেও পরিবারপ্রধানের প্রভাব-প্রতিপত্তির বদৌলতে বর্তমান সময়ে সুযোগ-সুবিধা ভোগের দিক থেকে তারাও বাদ পড়ে না। নিজ দল ক্ষমতার বাইরে থাকা অবস্থায় পরিবারপ্রধান দমন-পীড়নের শিকার হলে পরিবারের সদস্যরা, এমনকি তাঁর আত্মীয়স্বজন, প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হন। সেদিক থেকে রাজনীতিবিদদের সন্তানরা রাজনীতির চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে বড় হয়ে ওঠে; দেশীয় রাজনীতির বাস্তবতায় কিছুটা রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তাদের এমনিতেই হয়ে যায়।
রাজনৈতিক নেতার সন্তানের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় রাজনীতিতে অংশগ্রহণকে পরিবারতন্ত্র বলা হয় না। পিতা-মাতার পেশায় সন্তান আসতেই পারে। পরিবারতন্ত্র বলতে অনভিজ্ঞ-অনুপযোগী সন্তানকে বিনা নোটিশে কিংবা স্বল্প সময়ের নোটিশে রাজনীতিতে নিয়ে এসে সরাসরি সরকার বা দলের সুউচ্চ পদে অধিষ্ঠান করিয়ে দেওয়াকে বোঝায়। যে সন্তান কিশোর বা তরুণ বয়স থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পর্যায়ক্রমে দল বা সরকারের ঊর্ধ্বতন স্তরে উপনীত হন, তাঁর ব্যাপারে পরিবারতন্ত্রের স্লোগান ওঠানো হয় না। ভারতে জওহরলাল নেহরু, সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, পাকিস্তানে ওয়ালি খান, ইউসুফ রাজা গিলানি, বাংলাদেশে মোহাম্মদ নাসিম, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর ব্যাপারে পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ আসেনি, কারণ তাঁরা রাজনীতির স্বাভাবিক পথ ধরে ওপরে উঠেছেন। তাঁদের পারিবারিক ঐতিহ্য এবং রাজনীতিতে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দলীয় কর্মকাণ্ডে সহায়ক ভূমিকা পালন করে, রাজনীতিকে সমৃদ্ধ করে। পক্ষান্তরে অনভিজ্ঞ, অযোগ্য সন্তানকে রাজনীতিতে টেনে এনে সুউচ্চ পদে বসিয়ে দিলে রাজনৈতিক কর্মী এবং সাধারণ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ভাগ্যগুণে এদের মধ্যে বিরল দু-একজন রাজনীতির উচ্চ মার্গে গ্রহণযোগ্য প্রতীয়মান হলেও অধিকাংশই দল এবং সরকারের জন্য ভারী দায় হিসেবে চেপে বসেন। এতে দল এবং দেশের সমুদয় ক্ষতি হয়।
মুক্তবাজার অর্থনীতি তথা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় যত দিন সম্পদের উত্তরাধিকারব্যবস্থা নিশ্চিত থাকবে, তত দিন ব্যক্তি তাঁর রাজনৈতিক সম্পদ সন্তানদের মধ্যে স্থানান্তরের প্রচেষ্টা চালাবেন। তিনি বা তাঁর পরিবার কতদূর সফল হবেন, তা নির্ভর করবে রাজনৈতিক সম্পদের ওপর তাঁর মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণ কত সুদৃঢ় তার ওপর। উপমহাদেশ এবং এশিয়ার এতদঞ্চলে অদূর ভবিষ্যতে উত্তরাধিকারতন্ত্র তথা পরিবারতন্ত্রের বিলোপ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। বরং এ অঞ্চলে সম্পদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারতন্ত্র আরো দৃঢ়ভাবে গেড়ে বসার আশঙ্কা রয়েছে। রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের সন্তানদের নিজের নির্বাচনী এলাকার রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়াস পাচ্ছেন। উপজেলা পর্যায়ে সম্পদ প্রবাহের পরিমাণ এত বেড়েছে যে এখন বিদেশে অবস্থানরত সন্তান-সন্ততিরাও উপজেলায় এসে রাজনীতিতে যোগদানে উৎসাহিত হচ্ছেন। তাঁরা নিজেরা আশা করছেন, অথবা তাঁদেরকে নিশ্চিত করা হচ্ছে যে উপজেলায় রাজনীতি করলে তাঁরা আর্থিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। গত কয়েক দশকে রাজনীতি ধীরে ধীরে সত্যিকার অর্থে অর্থকরী উদ্যোগ (Enterprise) তথা ব্যবসায়ে রূপান্তরিত হয়েছে। বংশপরম্পরায় এ ব্যবসা চালিয়ে যেতে শিক্ষিত, অশিক্ষিত, উচ্চ শিক্ষিত- কারোই বোধহয় আর আপত্তি থাকবে না। ধারণা করা অমূলক হবে না যে অন্তত আগামী দু-এক দশক ধরে পরিবারতন্ত্র গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে টিকে থাকবে।
লেখক : পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ও
সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব
No comments