জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই by আন্দালিব রাশদী
এই তো সেদিনই না গুনগুন করে মান্না দের
মতো দরদ মিশিয়ে গলা কাঁপিয়ে হূদয়ের সব আবেগ ঢেলে ভালোবাসার মেয়েটিকে বললেন,
‘জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই/ পাছে ভালোবেসে ফেলো তাই দূরে দূরে
রই’, তারপর যায় যখন
কণ্ঠ থেকে ঝরে ‘আমার এ পথে শুধু/ আছে মরুভূমি ধু ধু/ আমি কীভাবে বাঁচাব তোমার মাধবী ওই’। কার না বুক ফেটে যায়।
সেদিনের এই গানের বয়স অর্ধশতকেরও বেশি। প্রতি মিনিটে ৭৮ ঘূর্ণনের রেকর্ডে দুই পিঠে দুটি গান, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় গীতিকার, সুরকার মান্না দে আর গায়ক? মান্না দে ছাড়া এমন অন্তর্ভেদী বেদনার গান আর কে গাইতে পারবেন? অপর পিঠের গানটি: ‘আমার না যদি থাকে সুর/ তোমার আছে তুমি তা দেবে/ তোমার গন্ধহারা ফুল/ আমার কাছে সুরভী নেবে/ এরই নাম প্রেম! এরই নাম প্রেম!’
মান্না দে এই গান গেয়েছেন ১৯৬০ সালে। তারও আগে, এখন থেকে ৬০ বছর আগে ১৯৫৩ সালে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখাতে মান্না দে নিজে সুর দিয়ে এবং গেয়ে যে গানকে অমর করে তুলেছেন তা-ই তো: ‘কত দূরে আর নিয়ে যাবে বল কোথায় পথের প্রান্ত।’ তিন বছর পর গৌরীপ্রসন্নের লেখায় সুর দিয়ে এবং অননুকরণীয় কণ্ঠে গেয়ে যে গান পৌঁছে দিয়েছেন সব প্রেমিক-প্রেমিকার অন্তরে সেই গানের শুরুটা: ‘তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়/ তারি মাঝে প্রেম যেন গড়ে খেলাঘর।’
১৯৫৬ সালে রেকর্ড করা এ গানের উল্টো পিঠের গানটি যে কত প্রেমিকের অশ্রু ঝরিয়েছে: ‘তুমি আর ডেকো না, পিছু ডেকো না/ আমি চলে যাই, শুধু বলে যাই, তোমার হূদয়ে মোর স্মৃতি রেখো না।’
বিশ শতকের শেষ অর্ধাংশে নারী ও পুরুষ-নির্বিশেষে যাদের যৌবনের উদ্গম ঘটেছে, তাদের যৌবনের অপর নাম মান্না দে না হয়েই পারে না। যদি না হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে তিনি রক্ত-মাংসের গড়া নন, তিনি পাথর-মানব। অন্তত ৫০ বছর ধরে প্রেমেরও অপর নাম মান্না দে।
১৯৫০-এর দশকের আরও কয়েকটি অন্তরছোঁয়া মান্না দের সুর করা ও গাওয়া গান: বঙ্কিম ঘোষের লেখা ‘এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি/ মাঝখানে নদী ওই বয়ে চলে যায়’। অনিল বিশ্বাসের লেখা ‘চাঁদের আশায় নিভায়ে দিলাম যে দীপ আপন হাতে/ অন্ধ পরাণ খুঁজিছে তাহারে জীবনেরই আঙিনাতে’। শ্যামল গুপ্তের লেখা ‘আমি আজ আকাশের মতো একেলা’, প্রণব রায়ের ‘এ জীবনে যত ব্যথা পেয়েছি’।
১৯৬০-এর দশকে এসে তো প্রেমের গানের প্লাবন বইয়ে দিলেন ‘সেই তো আবার কাছে এলে/ এত দিন দূরে থেকে/ বলো না কী সুখ তুমি পেলে’, ‘আবার হবে তো দেখা/ এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো’, ‘হূদয়ের গান শিখে তো গায় গো সবাই’ এবং ‘এই তো সেদিন তুমি আমারে বোঝালে/ আমার অবুঝ বেদনা’। ১৯৭০-এর দশকে গেয়েছেন ‘ক ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালোবাসবে’, ‘তুমি অনেক যত্ন করে আমায় দুঃখ দিতে চেয়েছ’, ‘যদি কাগজে লেখো নাম’, ‘আমার একদিকে শুধু তুমি পৃথিবী অন্যদিকে’, ‘স্বপনে বাজে গো বাঁশি’, ‘আমি ফুল না হয়ে কাঁটা হয়েই বেশ ছিলাম’।
মান্না দে থামলেন না। ১৯৮০-এর দশকে গাইলেন ‘তুমি নয় নাই কাছে আসলে’, ‘কত দিন দেখিনি তোমায়’, ‘খুব জানতে ইচ্ছে করে, তুমি কি সেই আগের মতোই আছ’, ‘আমি সারা রাত শুধু’... শেষ নেই মান্না দের গানের। আমরা কেবল কয়েকটি প্রেমের গানের উদাহরণ দিয়েছি।
১ মে ১৯১৯ প্রবোধ চন্দ্র দে, পরে শিল্পী মান্না দে নামে খ্যাত, কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। ৯৪তম জয়ন্তীর পর এক মাস কাটতেই ৮ জুন ২০১৩ তাঁকে বেঙ্গালুরু হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে আনা হয়—বহুভাষী এই শিল্পী মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন।
শুরুতেই বাড়িতে পেয়েছিলেন কাকা সংগীতাচার্য অন্ধ শিল্পী কৃষ্ণচন্দ্র দেকে; হাতেখড়ি থেকে ধ্রুপদ শিক্ষা সব তাঁর হাতে। কৃষ্ণচন্দ্রের সার্বক্ষণিক সঙ্গী মান্না দেরও প্রিয়জন সৈয়দ সাহেব। জীবনের জলসাঘর-এ আত্মজীবনীতে তিনি লিখছেন, ‘ভাবি আজ ওই সব সৈয়দ সাহেবরা আর আমার কাকার মতো মানুষরা সব গেলেন কোথায়? এখন তো, প্রায় কোনও মানুষই খুঁজে পাই না আমাদের চারদিকে, সবাইকে মনে হয় অভিনেতা।’
নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে ঘটা করে যখন মান্না দের সংগীতজীবনের ৬০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান করা হলো, তিনি কাকারই গাওয়া বিখ্যাত সেই গান দিয়ে গাইতে শুরু করলেন, ‘স্বপন যদি মধুর এমন হোক সে মিছে কল্পনা, জাগিয়ো না আমায় জাগিয়ো না’।
কাকার বেঁধে দেওয়া রেওয়াজ-রীতি আর নিজের নিয়মনিষ্ঠা—মান্না দে কখনো শিল্পীদের কথিত উচ্ছৃঙ্খল, বেপরোয়া ও খামখেয়ালির জীবনের স্বাদ নেননি। ‘...রেওয়াজের অভ্যেসটা এমনভাবে আমার রক্তের মধ্যে, মস্তিষ্কের মধ্যে এবং জীবনযাত্রার মধ্যে ছড়িয়ে গেছে যে আমি যে দেশে যে অবস্থাতেই থাকি না কেন—এ আমায় করতেই হয়। না করে থাকতে পারি না। গানই আমার অক্সিজেন।’
কিন্তু এই রেওয়াজের সময়টাতে তিনি আধুনিক গান করেন না। তিনি ধ্রুপদ নিয়ে থাকেন, মন দিয়ে সরগম করেন, রাগ-রাগিণীর চর্চা চলে তখন। বিখ্যাত কুস্তিগীর গোবর বাবু ছিলেন কাকার বন্ধু। সুগঠিত দেহের যুবক প্রবোধ দেকে দেখে তাঁর মনে হলো এ দেহ কুস্তির জন্য। সুতরাং, তাঁকে নিয়ে নিলেন ১৯ গোয়াবাগান স্ট্রিটে নিজের আখড়ায়। তাঁর অনুশীলননিষ্ঠা গোবর বাবুকে মুগ্ধ করে। নিখিল বাংলা কুস্তি প্রতিযোগিতায় তাঁর অনুপ্রেরণায় নাম লিখিয়ে একের পর এক আর সব কুস্তিগীরকে ধরাশায়ী করতে করতে প্রবোধ ফাইনাল রাউন্ডে উঠে এলেন।
কিন্তু প্রবোধ দে ফাইনালে লড়েননি। একসময় কুস্তি ছেড়ে দেন।
এর চেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত আর হয় না। নিখিল বাংলার সেরা কুস্তিগীর প্রবোধ দে তখন যদি মধ্যভারতীয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে নেমে যেতেন, সংগীতের অসাধারণ মেধাবী মানুষ মান্না দের আর অভ্যুদয় ঘটত না।
১৯৩৭ সালে অল বেঙ্গল মিউজিক কম্পিটিশনে সব বিভাগে নাম দেন এবং সব বিভাগেই প্রথম স্থান অধিকার করেন। তাঁর সঙ্গে একটি প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান পাওয়া শিল্পী হলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য।
১৯৪২ সালে মান্না দে চলে এলেন বোম্বে। লক্ষ্মী প্রোডাকশনের ব্যানারে ছবি তৈরি হতে যাচ্ছে তমান্না, সংগীত পরিচালক কৃষ্ণচন্দ্র দে। তাঁরই সহকারীর চাকরি পেলেন মান্না দে। এ ছবির একটি ডুয়েট গান ‘জাগো আঈ উষা’র উপযুক্ত নারী শিল্পী মিললেও কোনো পুরুষ কণ্ঠেই সংগীত পরিচালক সন্তুষ্ট হচ্ছিলেন না। মান্না দেকেই হতে হলো ফুটফুটে মিষ্টি গলার মেয়েটির ডুয়েট পার্টনার। প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে তিনি প্রথম আত্মপ্রকাশ করলেন। আর মিষ্টি গলার সেই ফুটফুটে মেয়েটি হয়ে উঠলেন হিন্দি চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নায়িকা (এবং গায়িকাও) সুরাইয়া।
কিশোর কুমার, মোহাম্মদ রফি, মুকেশ এবং মান্না দেকে করা হয়েছে ভারতীয় চলচ্চিত্রশিল্পের সেরা পুরুষ চতুষ্টয়, কিন্তু ধ্রুপদ ঐশ্বর্যে তিনি চারজনের মধ্যে সবচেয়ে ঐশ্বর্যশালী।
সেদিনের এই গানের বয়স অর্ধশতকেরও বেশি। প্রতি মিনিটে ৭৮ ঘূর্ণনের রেকর্ডে দুই পিঠে দুটি গান, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় গীতিকার, সুরকার মান্না দে আর গায়ক? মান্না দে ছাড়া এমন অন্তর্ভেদী বেদনার গান আর কে গাইতে পারবেন? অপর পিঠের গানটি: ‘আমার না যদি থাকে সুর/ তোমার আছে তুমি তা দেবে/ তোমার গন্ধহারা ফুল/ আমার কাছে সুরভী নেবে/ এরই নাম প্রেম! এরই নাম প্রেম!’
মান্না দে এই গান গেয়েছেন ১৯৬০ সালে। তারও আগে, এখন থেকে ৬০ বছর আগে ১৯৫৩ সালে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখাতে মান্না দে নিজে সুর দিয়ে এবং গেয়ে যে গানকে অমর করে তুলেছেন তা-ই তো: ‘কত দূরে আর নিয়ে যাবে বল কোথায় পথের প্রান্ত।’ তিন বছর পর গৌরীপ্রসন্নের লেখায় সুর দিয়ে এবং অননুকরণীয় কণ্ঠে গেয়ে যে গান পৌঁছে দিয়েছেন সব প্রেমিক-প্রেমিকার অন্তরে সেই গানের শুরুটা: ‘তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়/ তারি মাঝে প্রেম যেন গড়ে খেলাঘর।’
১৯৫৬ সালে রেকর্ড করা এ গানের উল্টো পিঠের গানটি যে কত প্রেমিকের অশ্রু ঝরিয়েছে: ‘তুমি আর ডেকো না, পিছু ডেকো না/ আমি চলে যাই, শুধু বলে যাই, তোমার হূদয়ে মোর স্মৃতি রেখো না।’
বিশ শতকের শেষ অর্ধাংশে নারী ও পুরুষ-নির্বিশেষে যাদের যৌবনের উদ্গম ঘটেছে, তাদের যৌবনের অপর নাম মান্না দে না হয়েই পারে না। যদি না হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে তিনি রক্ত-মাংসের গড়া নন, তিনি পাথর-মানব। অন্তত ৫০ বছর ধরে প্রেমেরও অপর নাম মান্না দে।
১৯৫০-এর দশকের আরও কয়েকটি অন্তরছোঁয়া মান্না দের সুর করা ও গাওয়া গান: বঙ্কিম ঘোষের লেখা ‘এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি/ মাঝখানে নদী ওই বয়ে চলে যায়’। অনিল বিশ্বাসের লেখা ‘চাঁদের আশায় নিভায়ে দিলাম যে দীপ আপন হাতে/ অন্ধ পরাণ খুঁজিছে তাহারে জীবনেরই আঙিনাতে’। শ্যামল গুপ্তের লেখা ‘আমি আজ আকাশের মতো একেলা’, প্রণব রায়ের ‘এ জীবনে যত ব্যথা পেয়েছি’।
১৯৬০-এর দশকে এসে তো প্রেমের গানের প্লাবন বইয়ে দিলেন ‘সেই তো আবার কাছে এলে/ এত দিন দূরে থেকে/ বলো না কী সুখ তুমি পেলে’, ‘আবার হবে তো দেখা/ এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো’, ‘হূদয়ের গান শিখে তো গায় গো সবাই’ এবং ‘এই তো সেদিন তুমি আমারে বোঝালে/ আমার অবুঝ বেদনা’। ১৯৭০-এর দশকে গেয়েছেন ‘ক ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালোবাসবে’, ‘তুমি অনেক যত্ন করে আমায় দুঃখ দিতে চেয়েছ’, ‘যদি কাগজে লেখো নাম’, ‘আমার একদিকে শুধু তুমি পৃথিবী অন্যদিকে’, ‘স্বপনে বাজে গো বাঁশি’, ‘আমি ফুল না হয়ে কাঁটা হয়েই বেশ ছিলাম’।
মান্না দে থামলেন না। ১৯৮০-এর দশকে গাইলেন ‘তুমি নয় নাই কাছে আসলে’, ‘কত দিন দেখিনি তোমায়’, ‘খুব জানতে ইচ্ছে করে, তুমি কি সেই আগের মতোই আছ’, ‘আমি সারা রাত শুধু’... শেষ নেই মান্না দের গানের। আমরা কেবল কয়েকটি প্রেমের গানের উদাহরণ দিয়েছি।
১ মে ১৯১৯ প্রবোধ চন্দ্র দে, পরে শিল্পী মান্না দে নামে খ্যাত, কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। ৯৪তম জয়ন্তীর পর এক মাস কাটতেই ৮ জুন ২০১৩ তাঁকে বেঙ্গালুরু হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে আনা হয়—বহুভাষী এই শিল্পী মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন।
শুরুতেই বাড়িতে পেয়েছিলেন কাকা সংগীতাচার্য অন্ধ শিল্পী কৃষ্ণচন্দ্র দেকে; হাতেখড়ি থেকে ধ্রুপদ শিক্ষা সব তাঁর হাতে। কৃষ্ণচন্দ্রের সার্বক্ষণিক সঙ্গী মান্না দেরও প্রিয়জন সৈয়দ সাহেব। জীবনের জলসাঘর-এ আত্মজীবনীতে তিনি লিখছেন, ‘ভাবি আজ ওই সব সৈয়দ সাহেবরা আর আমার কাকার মতো মানুষরা সব গেলেন কোথায়? এখন তো, প্রায় কোনও মানুষই খুঁজে পাই না আমাদের চারদিকে, সবাইকে মনে হয় অভিনেতা।’
নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে ঘটা করে যখন মান্না দের সংগীতজীবনের ৬০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান করা হলো, তিনি কাকারই গাওয়া বিখ্যাত সেই গান দিয়ে গাইতে শুরু করলেন, ‘স্বপন যদি মধুর এমন হোক সে মিছে কল্পনা, জাগিয়ো না আমায় জাগিয়ো না’।
কাকার বেঁধে দেওয়া রেওয়াজ-রীতি আর নিজের নিয়মনিষ্ঠা—মান্না দে কখনো শিল্পীদের কথিত উচ্ছৃঙ্খল, বেপরোয়া ও খামখেয়ালির জীবনের স্বাদ নেননি। ‘...রেওয়াজের অভ্যেসটা এমনভাবে আমার রক্তের মধ্যে, মস্তিষ্কের মধ্যে এবং জীবনযাত্রার মধ্যে ছড়িয়ে গেছে যে আমি যে দেশে যে অবস্থাতেই থাকি না কেন—এ আমায় করতেই হয়। না করে থাকতে পারি না। গানই আমার অক্সিজেন।’
কিন্তু এই রেওয়াজের সময়টাতে তিনি আধুনিক গান করেন না। তিনি ধ্রুপদ নিয়ে থাকেন, মন দিয়ে সরগম করেন, রাগ-রাগিণীর চর্চা চলে তখন। বিখ্যাত কুস্তিগীর গোবর বাবু ছিলেন কাকার বন্ধু। সুগঠিত দেহের যুবক প্রবোধ দেকে দেখে তাঁর মনে হলো এ দেহ কুস্তির জন্য। সুতরাং, তাঁকে নিয়ে নিলেন ১৯ গোয়াবাগান স্ট্রিটে নিজের আখড়ায়। তাঁর অনুশীলননিষ্ঠা গোবর বাবুকে মুগ্ধ করে। নিখিল বাংলা কুস্তি প্রতিযোগিতায় তাঁর অনুপ্রেরণায় নাম লিখিয়ে একের পর এক আর সব কুস্তিগীরকে ধরাশায়ী করতে করতে প্রবোধ ফাইনাল রাউন্ডে উঠে এলেন।
কিন্তু প্রবোধ দে ফাইনালে লড়েননি। একসময় কুস্তি ছেড়ে দেন।
এর চেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত আর হয় না। নিখিল বাংলার সেরা কুস্তিগীর প্রবোধ দে তখন যদি মধ্যভারতীয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে নেমে যেতেন, সংগীতের অসাধারণ মেধাবী মানুষ মান্না দের আর অভ্যুদয় ঘটত না।
১৯৩৭ সালে অল বেঙ্গল মিউজিক কম্পিটিশনে সব বিভাগে নাম দেন এবং সব বিভাগেই প্রথম স্থান অধিকার করেন। তাঁর সঙ্গে একটি প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান পাওয়া শিল্পী হলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য।
১৯৪২ সালে মান্না দে চলে এলেন বোম্বে। লক্ষ্মী প্রোডাকশনের ব্যানারে ছবি তৈরি হতে যাচ্ছে তমান্না, সংগীত পরিচালক কৃষ্ণচন্দ্র দে। তাঁরই সহকারীর চাকরি পেলেন মান্না দে। এ ছবির একটি ডুয়েট গান ‘জাগো আঈ উষা’র উপযুক্ত নারী শিল্পী মিললেও কোনো পুরুষ কণ্ঠেই সংগীত পরিচালক সন্তুষ্ট হচ্ছিলেন না। মান্না দেকেই হতে হলো ফুটফুটে মিষ্টি গলার মেয়েটির ডুয়েট পার্টনার। প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে তিনি প্রথম আত্মপ্রকাশ করলেন। আর মিষ্টি গলার সেই ফুটফুটে মেয়েটি হয়ে উঠলেন হিন্দি চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নায়িকা (এবং গায়িকাও) সুরাইয়া।
কিশোর কুমার, মোহাম্মদ রফি, মুকেশ এবং মান্না দেকে করা হয়েছে ভারতীয় চলচ্চিত্রশিল্পের সেরা পুরুষ চতুষ্টয়, কিন্তু ধ্রুপদ ঐশ্বর্যে তিনি চারজনের মধ্যে সবচেয়ে ঐশ্বর্যশালী।
No comments