১০ জুলাই শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রা। রথের অতীত, বর্তমান উঠে এসেছে এই লেখায় রথের কথকতা by ইকবাল মতিন
রথযাত্রা আর্যজাতির একটি প্রাচীন
ধর্মোৎসব। কিন্তু এখন রথযাত্রা বললে সাধারণত জগন্নাথদেবের রথযাত্রাকেই
বোঝায়। কিন্তু একসময় ভারতবর্ষে সৌর, শক্তি, শৈব, বৈষ্ণব, জৈন, বৌদ্ধ সব
ধর্ম-সম্প্র্রদায়ের মধ্যে স্ব স্ব উপাস্যদেবের উৎসববিশেষে রথযাত্রা
অনুষ্ঠিত হতো।
প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থ ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ এবং
পদ্মপুরাণ-এও এ রথযাত্রার উল্লেখ পাওয়া যায়। পুরুষোত্তম মাহাতো জগন্নাথ,
বলরাম ও সুভদ্রার রথ কেমন হবে, সে সম্পর্কে বলা আছে। বিষ্ণুধর্মোত্তরে একই
রথে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা—এই মূর্তিত্রয়ের স্থাপন নির্দেশ থাকলেও
পুরুষোত্তম মাহাতো ও নীলাদ্রি মহোদয়ের পদ্ধতি অনুসারে পুরীধামে আজ অবধি
তিনজনের জন্য তিনটি বৃহৎ রথ প্রস্তুত হয়ে থাকে।
রথযাত্রার প্রচলন ঠিক কোন সময়ে হয়, তা এখনো স্থিরনিশ্চিত হয়নি। কারও কারও মতে, বুদ্ধদেবের জন্মোৎসব উপলক্ষে বৌদ্ধরা যে রথযাত্রা উৎসব করত, তা থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের রথযাত্রার উৎপত্তি। আবার অনেকে বিশ্বাস করেন, ভারতে প্রতিমাপূজা প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে রথযাত্রার উৎসব প্রচলিত হয়।
উৎকলখণ্ড এবং দেউলতোলা নামক উড়িষ্যার প্রাচীন পুঁথিতে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিহাস প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে সত্যযুগে অবন্তীনগরী রাজ্যে ইন্দ্র নামে সূর্যবংশীয় এক পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ভগবান বিষ্ণুর এই জগন্নাথরূপী মূর্তির রথযাত্রা শুরু করার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে রাজা ইন্দ্র পুরীর এই জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ ও রথযাত্রার প্রচলন করেন। একসময়ে ইউরোপেও যে রথযাত্রা প্রচলিত ছিল, তারও প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বৌদ্ধযুগেও জগন্নাথদেবের রথযাত্রার অনুরূপ রথে বুদ্ধদেবের মূর্তি স্থাপন করে রথযাত্রার প্রচলন ছিল। বিখ্যাত চীনা পর্যটক ফা হিয়ান খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকে তৎকালীন মধ্য এশিয়ার খোটান নামক স্থানে যে বুদ্ধ রথযাত্রার বর্ণনা দিয়েছেন, তা অনেকাংশে পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ত্রিশ ফুট উঁচু চার চাকার একটি রথকে বিভিন্ন রত্ন, অলংকার ও বস্ত্রে সুন্দরভাবে সাজানো হতো। রথটির চারপাশে থাকত নানা দেবদেবীর মূর্তি। মাঝখানে স্থাপন করা হতো বুদ্ধদেবের মূর্তি। এরপর সে দেশের রাজা তাঁর মুকুট খুলে রেখে খালি পায়ে রথের সামনে এসে নতমস্তকে বুদ্ধদেবের উদ্দেশে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার পর মহাসমারোহে রথযাত্রা শুরু হতো। পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রায় আজও আমরা দেখে থাকি যে প্রতিবছর রথযাত্রার উদ্বোধন করেন সেখানকার রাজা। রাজত্ব না থাকলেও বংশপরম্পরাক্রমে পুরীর রাজপরিবারের নিয়মানুযায়ী যিনি রাজা উপাধিপ্রাপ্ত হন, তিনি জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাদেবীর পরপর তিনটি রথের সামনে এসে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান ও সোনার ঝাড়ু দিয়ে রথের সম্মুখভাগ ঝাঁট দেওয়ার পরই পুরীর রথের রশিতে টান পড়ে। শুরু হয় জগন্নাথদেবের রথযাত্রা।
এখনো ভাদ্র মাসের প্রথমেই ইউরোপের অন্তর্গত সিসিলি দ্বীপে রথযাত্রার অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। ওই বিলাতি রথযাত্রা মেরির উদ্দেশে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তবে সূর্য-রথই যে সব রথের প্রথম, তা পুরাণে বলা আছে।
পূর্বে ভারতীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে কার্তিক মাসে শ্রীকৃষ্ণের রথযাত্রার অনুষ্ঠান হতো। বৌদ্ধ প্রভাবকালে তা বিলুপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। হিন্দুধর্মের পুনরুদ্ভবকালে উৎকলবাসীর মনোরঞ্জনের জন্য সেই সময়েই জগন্নাথদেবের রথযাত্রা প্রচলিত হলো। এই জগন্নাথদেবের রথযাত্রা ক্রমে সর্বত্র প্রচলিত হলে শ্রীকৃষ্ণের রথযাত্রার বিষয় অনেকেই ভুলে গেল। তবে হিমালয়ের কোনো কোনো স্থানে দেবীর রথযাত্রার কথা এখনো শোনা যায়। নেপালে কি বৌদ্ধ, কি শৈব সর্বসাধারণের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রকার রথযাত্রা প্রচলিত আছে।
পুরীর রথের কথা তো আমরা সবাই জানি। সেখানে সমুদ্রকেও ছাপিয়ে ওঠে রথের মেলার জনসমুদ্র। মেদিনীপুর জেলার প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত মহিষাদলের রাজপরিবারের বিখ্যাত কাঠের রথ, বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের অতীত গৌরবের সাক্ষী পাথরের রথ। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের প্রতিষ্ঠাত্রী রানি রাসমণি ১৮৩৮ সালে এক লাখ ২২ হাজার টাকা খরচ করে তৈরি করেছিলেন রুপার রথ। মেদিনীপুর জেলার রামগড়ের রাজারা রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ নিয়ে টানতেন পিতলের রথ। কাঁঠালপাড়ার ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের পারিবারিক রথ ছিল টিনের। কাঠের কাঠামোয় পাঁচটি স্বর্ণচূড়ামণ্ডিত রথ আছে মধ্য কলকাতার সুরি লেনে মল্লিক পরিবারের। স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রথ ছিল মানিকগঞ্জের ধামরাইয়ে। রথটির উচ্চতা ছিল ১৮ মিটার। দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহা ওই রথটির দেখাশোনা এবং ব্যয়ভার বহন করতেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনারা রথটিকে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এখনো বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রথযাত্রা এবং সে উপলক্ষে মেলা বসে। রাজশাহীতেও রথবাড়ী থেকে প্রতিবছর রথযাত্রার অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। রথযাত্রা শুধু ধর্মীয় উৎসবই নয়, এর সঙ্গে সামাজিক বন্ধনেরও একটা শিক্ষা রয়েছে। সহস্র মানুষের সমবেত শক্তিতে অচল রথ সচল হয়, এই সত্যটা রথযাত্রার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
রথযাত্রার প্রচলন ঠিক কোন সময়ে হয়, তা এখনো স্থিরনিশ্চিত হয়নি। কারও কারও মতে, বুদ্ধদেবের জন্মোৎসব উপলক্ষে বৌদ্ধরা যে রথযাত্রা উৎসব করত, তা থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের রথযাত্রার উৎপত্তি। আবার অনেকে বিশ্বাস করেন, ভারতে প্রতিমাপূজা প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে রথযাত্রার উৎসব প্রচলিত হয়।
উৎকলখণ্ড এবং দেউলতোলা নামক উড়িষ্যার প্রাচীন পুঁথিতে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিহাস প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে সত্যযুগে অবন্তীনগরী রাজ্যে ইন্দ্র নামে সূর্যবংশীয় এক পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ভগবান বিষ্ণুর এই জগন্নাথরূপী মূর্তির রথযাত্রা শুরু করার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে রাজা ইন্দ্র পুরীর এই জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ ও রথযাত্রার প্রচলন করেন। একসময়ে ইউরোপেও যে রথযাত্রা প্রচলিত ছিল, তারও প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বৌদ্ধযুগেও জগন্নাথদেবের রথযাত্রার অনুরূপ রথে বুদ্ধদেবের মূর্তি স্থাপন করে রথযাত্রার প্রচলন ছিল। বিখ্যাত চীনা পর্যটক ফা হিয়ান খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকে তৎকালীন মধ্য এশিয়ার খোটান নামক স্থানে যে বুদ্ধ রথযাত্রার বর্ণনা দিয়েছেন, তা অনেকাংশে পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ত্রিশ ফুট উঁচু চার চাকার একটি রথকে বিভিন্ন রত্ন, অলংকার ও বস্ত্রে সুন্দরভাবে সাজানো হতো। রথটির চারপাশে থাকত নানা দেবদেবীর মূর্তি। মাঝখানে স্থাপন করা হতো বুদ্ধদেবের মূর্তি। এরপর সে দেশের রাজা তাঁর মুকুট খুলে রেখে খালি পায়ে রথের সামনে এসে নতমস্তকে বুদ্ধদেবের উদ্দেশে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার পর মহাসমারোহে রথযাত্রা শুরু হতো। পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রায় আজও আমরা দেখে থাকি যে প্রতিবছর রথযাত্রার উদ্বোধন করেন সেখানকার রাজা। রাজত্ব না থাকলেও বংশপরম্পরাক্রমে পুরীর রাজপরিবারের নিয়মানুযায়ী যিনি রাজা উপাধিপ্রাপ্ত হন, তিনি জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাদেবীর পরপর তিনটি রথের সামনে এসে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান ও সোনার ঝাড়ু দিয়ে রথের সম্মুখভাগ ঝাঁট দেওয়ার পরই পুরীর রথের রশিতে টান পড়ে। শুরু হয় জগন্নাথদেবের রথযাত্রা।
এখনো ভাদ্র মাসের প্রথমেই ইউরোপের অন্তর্গত সিসিলি দ্বীপে রথযাত্রার অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। ওই বিলাতি রথযাত্রা মেরির উদ্দেশে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তবে সূর্য-রথই যে সব রথের প্রথম, তা পুরাণে বলা আছে।
পূর্বে ভারতীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে কার্তিক মাসে শ্রীকৃষ্ণের রথযাত্রার অনুষ্ঠান হতো। বৌদ্ধ প্রভাবকালে তা বিলুপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। হিন্দুধর্মের পুনরুদ্ভবকালে উৎকলবাসীর মনোরঞ্জনের জন্য সেই সময়েই জগন্নাথদেবের রথযাত্রা প্রচলিত হলো। এই জগন্নাথদেবের রথযাত্রা ক্রমে সর্বত্র প্রচলিত হলে শ্রীকৃষ্ণের রথযাত্রার বিষয় অনেকেই ভুলে গেল। তবে হিমালয়ের কোনো কোনো স্থানে দেবীর রথযাত্রার কথা এখনো শোনা যায়। নেপালে কি বৌদ্ধ, কি শৈব সর্বসাধারণের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রকার রথযাত্রা প্রচলিত আছে।
পুরীর রথের কথা তো আমরা সবাই জানি। সেখানে সমুদ্রকেও ছাপিয়ে ওঠে রথের মেলার জনসমুদ্র। মেদিনীপুর জেলার প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত মহিষাদলের রাজপরিবারের বিখ্যাত কাঠের রথ, বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের অতীত গৌরবের সাক্ষী পাথরের রথ। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের প্রতিষ্ঠাত্রী রানি রাসমণি ১৮৩৮ সালে এক লাখ ২২ হাজার টাকা খরচ করে তৈরি করেছিলেন রুপার রথ। মেদিনীপুর জেলার রামগড়ের রাজারা রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ নিয়ে টানতেন পিতলের রথ। কাঁঠালপাড়ার ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের পারিবারিক রথ ছিল টিনের। কাঠের কাঠামোয় পাঁচটি স্বর্ণচূড়ামণ্ডিত রথ আছে মধ্য কলকাতার সুরি লেনে মল্লিক পরিবারের। স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রথ ছিল মানিকগঞ্জের ধামরাইয়ে। রথটির উচ্চতা ছিল ১৮ মিটার। দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহা ওই রথটির দেখাশোনা এবং ব্যয়ভার বহন করতেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনারা রথটিকে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এখনো বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রথযাত্রা এবং সে উপলক্ষে মেলা বসে। রাজশাহীতেও রথবাড়ী থেকে প্রতিবছর রথযাত্রার অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। রথযাত্রা শুধু ধর্মীয় উৎসবই নয়, এর সঙ্গে সামাজিক বন্ধনেরও একটা শিক্ষা রয়েছে। সহস্র মানুষের সমবেত শক্তিতে অচল রথ সচল হয়, এই সত্যটা রথযাত্রার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
No comments