এক পায়ে নূপুর by আউয়াল চৌধুরী
শিহাব দ্বিধায় পড়ে যায়। তার ঘুম কি ভেঙেছে
রিনিঝিনি শব্দে? নাকি অজানা এক শিহরণ ঘুমের গভীর থেকে তুলে তাকে দাঁড়
করিয়ে দিয়েছে অদ্ভুত আঁধারের মুখোমুখি? শিহাব বুঝতে পারে না।
ঘটনার বিহ্বলতায় তার ভেতরে ঘোর তৈরি হয়। চারপাশে তখনো ছড়িয়ে আছে অদ্ভুত আঁধার।
আবার সেই রিনিঝিনি শব্দ। শিহাব বুঝতে পারে না এ কিসের শব্দ? মৃদু। অথচ প্রবহমান তরঙ্গের মতো। গাঁও-গেরামের শেষ মাথায় বিলের জলে পুবালি বাতাস হঠাৎ এসে ছুঁয়ে দিলে জলের বুকে যে রকম তরঙ্গ তৈরি হয়, অনেকটা সে রকম। খানিক দোল দিয়েই মিলিয়ে যায়। শিহাব মুখ ঘোরায় এদিক-ওদিক। শব্দটা আর শোনা যায় না। শিহাব যখন দিশেহারা হয়ে যায়, তখন আবার শোনা যায় সেই শব্দ। রিনিঝিনি তরঙ্গ ক্রমাগত দোল খায় বাতাসে। শিহাব এবার টের পায় রিনিঝিনি এই শব্দ নূপুরের। খেয়ালি কোনো বালিকা নূপুর পায়ে ছোটাছুটি করছে আশপাশে কোথাও।
শিহাব বুঝতে পারে না, সে কি স্বপ্ন দেখছে? নাকি অতিবাস্তব কোনো দৃশ্যের মুখোমুখি হয়েছে সে? শুধু অনুভব করতে পারে, তার চারপাশে অদ্ভুত আঁধার। যে আঁধারে নিজের শরীরটাকেও দেখা যায় না। ভয় ভয় লাগে তার। কোথায় সে? জায়গাটা ঠাওর করার চেষ্টা করে। পারে না। ওপরে তাকায়। মাথার ওপর আকাশ। সে আকাশে চাঁদ নেই। নেই কোনো নক্ষত্র। ঘন কালো মেঘ। হঠাৎ বাতাস এসে এলোমেলো করে দেয় শিহাবের চুল। সেই বাতাসে আবারও ভেসে আসে নূপুরের রিনিঝিনি। এবার আর দূরে নয়। আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে কাছে। মনে হয় সেই বালিকা এখন তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। শিহাব অবাক হয়ে দেখে। তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এক জোড়া পা। পায়ে নূপুর। পা থেকে আস্তে আস্তে ঊর্ধ্বমুখী হয় শিহাবের চোখ। না। বালিকার মুখ দেখা যায় না। ধোঁয়ার মতো একচিলতে আলো এসে পড়েছে শুধু সেই পায়ে। সে কি শুধুই বালিকা? তরুণী অথবা মাঝবয়সীও তো হতে পারে? আজকাল বয়সী নারীও তো শখ করে পায়ে নূপুর জড়ায়। কিন্তু শিহাবের মনে হয়, যার পায়ে এই নূপুর সে শুধুই বালিকা। অমন খেয়ালে তো শুধু বালিকাই ছুটে বেড়ায়। আবারও তার পায়ের দিকে চোখ যায় শিহাবের। পায়ে রুপার চিকন নূপুর। গোছার খানিকটা ওপরে শাড়ির কিছুটা অংশ নজরে আসে। গাঁও-গেরামের মেয়েরা অল্প বয়সেই শাড়ি পরে। মেয়েটা কি গাঁও-গেরাম থেকে উঠে এসেছে? নাকি সে নিজেই চলে এসেছে কোনো গাঁয়ে? কিছুই ঠাওর করতে পারে না শিহাব?
হঠাৎ ভাঙা চুড়ির মতো মেয়েটির হাসির শব্দ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। শিহাব কেঁপে ওঠে। অদ্ভুত এক শিহরণ তার মেরুদণ্ডের ওপর থেকে গড়িয়ে নিচে নামে। মেয়েটি কি অশরীরী কেউ?
তুমি কি ভয় পাইছ?
কথায় গ্রাম্য টান। কিন্তু নূপুরের মতোই রিনিঝিনি মেয়েটির গলা। মিষ্টি। তালপাকা দুপুরে একপশলা হাওয়ার মতোই মিষ্টি।
ভয় তো পাবই। শিহাব খসখসে গলায় উত্তর দেয়, মাঝরাতে হঠাৎ করে নূপুরের শব্দ পেলে ভয়ই তো পাওয়ার কথা।
ভয় পাও কেন গো! আমি জিন-ভূত কেউ না।
তাহলে কে তুমি? তুমি কি পরি?
আবারও রিনিঝিনি হাসি!
আমি পরি নাগো! মানুষ। তবে শিশুকালে মায়ে কইত, মাইয়া আমার মাশাল্লা! দেখতে পরির লাহান। দুধে আলতায় শইল্লের রং!
মেয়েটির কথায় কেন জানি শিহাবের ভয় কেটে যায়। এখনো মেয়েটির পা দেখা যায় শুধু। ফরসা পায়ে চিকন নূপুর। পায়ের চারপাশে গোলাপি আভা। নাকি আলতার রং সেই আভা তৈরি করেছে তার পায়ে। এখনো অস্পষ্ট ধোঁয়াটে আলো শুয়ে আছে পায়ের কাছে। শাড়ির কিছুটা অংশ দেখা যায়। শাড়ির রং বোঝা যায় না? ছাপা? নাকি ডুরে? বোঝা যায় না সেটিও। মেয়েটা কি দুই হাতে শাড়ি খানিকটা টেনে ওপরে তুলে রেখেছে? নাকি শাড়ি পরার ঢংটাই অমন। পায়ের গোছা থেকে খানিকটা উঁচু করে পরা। যাতে পায়ের নূপুর দেখা যায় সহজেই। চোখ তুলতেই ছায়ার মতো মেয়েটির শরীরের কাঠামো এবার নজরে আসে। অনুভব করা যায় ছায়ার মতো মুখ। সেই মুখ নূপুরের মতোই সুন্দর মনে হয়।
সত্যি কইরা একখান কথা কও তো?
কী কথা?
তুমি ভয় পাও নাই?
না। পাই নাই।
আমি যহন খুব ছোড। বাপজান একদিন আমার জন্য এক জোড়া নূপুর নিয়া এল। রুপার নূপুর। সেই নূপুর দেইখা আমার মায়ের সে কী রাগ!
রাগ কেন?
অভাবের সংসার ছিল গো! অভাবের সংসারে এসব আহ্লাদ মানায়? মুখ ফুলাইয়া মায়ে কইছিল, পেডে ভাত জোটে না। নূপুর আনছে মাইয়ার লেইগা। রুপার নূপুর! শুইনা আমার বাপজান মিটমিটাইয়া হাসে। হাসে আর কী কয় জানো?
কী কয়?
গরিব মাইনষের কি শখ-আহ্লাদ নাই? দশটা না পাঁচটা না, আমার একটা মাইয়া! বাপজানের কথা শুইনা আমার কী যে আনন্দ! সেই আনন্দে নূপুর পায়ে দিয়া সারা উঠান দৌড়াই। নূপুরের ঝুমঝুম শব্দ হয়। নিজের কানেই কী যে মিঠা লাগে সেই শব্দ!
তোমার পায়ে কি সেই রুপার নূপুর?
নাগো! না। এই নূপুর বাপজানের সেই রুপার নূপুর না। অভাবের সংসারে কি রুপা থাকে? উপাস থাকলে চক্ষের সামনে নূপুর হইয়া যায় সাদা ভাত। ফকফইক্যা সাদা ভাত। সেই ভাতের লোকমা পেডে গেলে আত্মা শান্তি! আমি যহন ডাঙর হইলাম ভাতের লেইগা এলাম তুমরার এই শহরে। পেটে যহন দানা পড়ল তহন আবার চোখ গেল সেই নূপুরে। ছোটকালের শখ! এত সহজে কি তারে ভোলা যায়? কাইল সন্ধ্যা রাতে কাম থেইকা ফেরনের সুময় আমরার গলির মুখে চোখ গেল সেই নূপুরে। তুমি আমার কথা শুনছ তো?
শুনছি।
মাঝেমধ্যে জবাব দিয়ো। না হইলে কেমনে বুঝব যে তুমি আছ? চাইর পাশে কী যে আন্ধার!
অন্ধকারে তোমার ভয় লাগে না?
লাগে তো! কিন্তু মানুষ যুদি মানুষের সঙ্গে থাকে, আন্ধারেও ডর-ভয় লাগে না।
মেয়েটির কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হঠাৎ করে একঝলক হাওয়া যেন কোথা থেকে ছুটে আসে। ছুঁয়ে যায় দুজনকেই। আঁধারে খানিকটা আলোর আভা ছড়িয়ে পড়ে। সেই আভায় মেয়েটির মুখের দিকে তাকায় শিহাব। এখনো অবয়ব টের পাওয়া যায় না। এখনো ছায়ার মতো। শুধু তার খোলা চুলের আভাস পাওয়া যায়। হাওয়ায় সেই চুল হয়তো লুটিয়ে পড়েছিল মুখে। মেয়েটি তার মুখের একপাশ থেকে চুল সরিয়ে ডাকে,
শুনছ?
শুনছি।
আমার শেষ কথা কী আছিল কও তো?
গলির মুখে তোমার চোখ গেল সেই নূপুরে।
গলির মুখে একটা ফেরিঅলা প্রত্যেক দিন চাইর চাক্কার ভ্যানে দুকান সাজাইয়া বসে। কত কী যে আছে সেইখানে। চুড়ি ফিতা পাউডার। আমার এক সই খুব সাজুনি। হাতে পয়সা জমলেই চুড়ি-ফিতা কিনে। আলতা কিনে পায়ে লাগায়। আমার সাধ থাকলেও আহ্লাদ নাই। ভাতের লেইগা আসছি এই শহরে। আহ্লাদ চাপা দিয়া দুইটা পয়সা জমাইয়া মায়ের কাছে পাডাই। বাপজান নাই। মায়ের অসুখ। আমি পয়সা না পাডাইলে মায়ে যে উপাস থাকব। উপাস কী জিনিস সেইটা তো আমি জানিই! কিন্তু কাইল আমার চোখ গেল নূপুরে। চিকন নূপুরে ছোড ছোড ঘণ্টা। রুমঝুম কইরা বাজে। আমি ফেরিঅলারে জিগাই, নূপুর কি রুপার? শুইনা ফেরিঅলা দাঁত কেলাইয়া সে কী হাসি! ভ্যানগাড়িতে রুপার নূপুর? ইমিটিশন গো! ইমিটিশন! হোক ইমিটিশন। তার পরেও তো রুমঝুম শব্দ হয়। নগদ ৮০ টাকায় কিইনা নিলাম। অনেকগুলান টাকা। বড় কষ্টের টাকা গো! কষ্টের! মিহি সুতায় বড় ধার! সেই ধারে অঙ্গ কাটে। এই মিহি সুতা কি শিমুল তুলার? আমাগো বাড়ির সামনে একটা শিমুলগাছ আছিল। কী যে লাল সেই শিমুল ফুল। রক্তের লাহান।
মেয়েটির শেষ কথায় শিহাবের ভেতরটা শিরশির করে ওঠে! হঠাৎ মনে হয় মেয়েটি তার চেনা। তার সঙ্গে দেখা হয়েছে কোথাও। কিন্তু কোথায়, তা মনে করতে পারে না।
তুমি কি শুনছ আমার কথা?
শুনছি।
আইজ সকালেই পায়ে নূপুর পরছি। ডাঙর হওয়ার পর এই পরথম। বাপজানের কথা তহন খুব মনে পড়ছে। সেই শিশুকালে উপাসের সংসারে মাইয়্যার লেইগা আহ্লাদের রুপার নূপুর!
বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মেয়েটি। আঁধারে সেই নিঃশ্বাসের পতন শিহাবকে নাড়া দেয়। আশপাশে শুকনো পাতার ওড়াউড়ি টের পায়। খানিকটা হাওয়া কি ছুটে এসেছিল? না কি নিঃশ্বাসের পতন উড়িয়ে নিয়ে গেছে শুকনো পাতার সারি? এতই কি প্রবল সেই নিঃশ্বাস?
জানো? মেয়েটির গলা এখন করুণ শোনায়। কান্নার মতো। শীতের সকালে দূর্বাঘাসের ডগায় যেমন জমে থাকে শিশির, মেয়েটির গলায় কি তেমন শিশির জমেছে? ভেজা গলায় মেয়েটি বলে, সেই নূপুর আইজ সকালে পায়ে দিছি। খুব শখ আছিল নূপুর পায়ে ইকটুখানি ছোটাছুটি করি। সেই শিশুকালের মতোন। কিন্তু পারি নাই।
শিশিরের মতো ভেজা এই উচ্চারণ কি বালিকার অভিমান? নাকি অভিযোগ? নাকি তীব্র ঘৃণা গড়িয়ে নামছে তার ঠোঁটের কোনা বেয়ে? শিহাবের বুকের ভেতরটা আবারও শিরশির করে ওঠে! অদ্ভুত এক কাঁপন জাগে শরীরে। চোখ চলে যায় মেয়েটির পায়ে। এখনো ধোঁয়াটে আলোয় এক জোড়া পা। পায়ে নূপুর। হঠাৎ শিহাব খেয়াল করে মেয়েটির এক পায়ে নূপুর। অন্য পা খালি। এতক্ষণ নজরে আসেনি। আশ্চর্য! এক পায়ে কেউ নূপুর পরে? নাকি অন্য পা থেকে খসে গেছে নূপুর? অথবা ছিনিয়ে নিয়েছে কেউ? পায়ের চারপাশে লালচে আভা। শিহাব অবাক হয়ে দেখে সেই লালচে আভা আলতার নয়। রক্তের! রক্ত জমে আছে পায়ের পাতার চার পাশে। এখন আর চিনতে ভুল হয় না তার।
চারপাশে ধ্বংসস্তূপ! মাকড়সার জালের মতো ঝুলে আছে মিহি সুতো। সেই সুতোয় শিমুলের লাল নেই। কিন্তু লাল জমাট হয়ে আছে শত শত স্পন্দনহীন দেহে। ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে উঁকি দিয়েছিল এই পা। জমাট রক্তের চিকন চিহ্ন। পায়ে নূপুর। বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে শিহাব তখন দিশেহারা। এই স্থিরচিত্র পাথর হয়ে আছে তার চোখে। তার ক্যামেরায়। কাল সকালে কাগজের প্রথম পাতায় এই ছবি প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো ঝুলে থাকবে সবার চোখের সামনে।
আবার সেই রিনিঝিনি শব্দ! মেয়েটি সরে যাচ্ছে দূরে। আজ সকালে সেই বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে ইচ্ছা থাকলেও শিহাব চিৎকার করতে পারেনি। দিশেহারা মানুষের মতো শুধু তাকিয়েছিল চারপাশে। কিন্তু এই মধ্যরাতে শিহাবের গলা চিরে চিৎকার বেরিয়ে আসে,
যেয়ো না। শোনো!
মেয়েটি শোনে না। হারিয়ে যেতে থাকে দূরে। শিহাব আর্তনাদের মতো বলে,
আমাকে ক্ষমা করে দাও। তুমি আমাদের ক্ষমা করে দাও। আমরা তোমাদের অবারিত সবুজ প্রান্তর থেকে ছিনিয়ে এনেছি। বিলের বুকে কাঁপন তোলা বাও বাতাস আমরা কেড়ে নিয়েছি। তোমাদের লোকমায় সাদা ফকফকে ভাত আমরা তুলে দিতে পারিনি। বাপজানের আহ্লাদে জড়ানো নূপুর তোমাদের পা থেকে আমরাই কেড়ে নিয়েছি। আমাদের লোভ, আমাদের পাপ তোমাদের টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেছে বধ্যভূমির কালো আঁধারে! আমরাই হত্যা করেছি তোমাদের। আমাদের ক্ষমা করে দিয়ো।
শিহাবের গলা কান্নার মতো শোনায়। তবু থামে না মেয়েটি। আঁধারে হারিয়ে যায়। শুধু তার একটি পা পদাঘাতের চিহ্ন হয়ে মুখের ওপর ঝুলে থাকে। অদ্ভুত আঁধারে দিশেহারার মতো ছোটাছুটি করতে থাকে শিহাব। কোথায় ছুটছে সে? কালো চাদরে ঢাকা সেই খোলা মাঠে, সেই ধ্বংসস্তূপের ভেতর, নাকি চার দেয়ালের ঘেরাটোপে? বুঝতে পারে না।
আবার সেই রিনিঝিনি শব্দ। শিহাব বুঝতে পারে না এ কিসের শব্দ? মৃদু। অথচ প্রবহমান তরঙ্গের মতো। গাঁও-গেরামের শেষ মাথায় বিলের জলে পুবালি বাতাস হঠাৎ এসে ছুঁয়ে দিলে জলের বুকে যে রকম তরঙ্গ তৈরি হয়, অনেকটা সে রকম। খানিক দোল দিয়েই মিলিয়ে যায়। শিহাব মুখ ঘোরায় এদিক-ওদিক। শব্দটা আর শোনা যায় না। শিহাব যখন দিশেহারা হয়ে যায়, তখন আবার শোনা যায় সেই শব্দ। রিনিঝিনি তরঙ্গ ক্রমাগত দোল খায় বাতাসে। শিহাব এবার টের পায় রিনিঝিনি এই শব্দ নূপুরের। খেয়ালি কোনো বালিকা নূপুর পায়ে ছোটাছুটি করছে আশপাশে কোথাও।
শিহাব বুঝতে পারে না, সে কি স্বপ্ন দেখছে? নাকি অতিবাস্তব কোনো দৃশ্যের মুখোমুখি হয়েছে সে? শুধু অনুভব করতে পারে, তার চারপাশে অদ্ভুত আঁধার। যে আঁধারে নিজের শরীরটাকেও দেখা যায় না। ভয় ভয় লাগে তার। কোথায় সে? জায়গাটা ঠাওর করার চেষ্টা করে। পারে না। ওপরে তাকায়। মাথার ওপর আকাশ। সে আকাশে চাঁদ নেই। নেই কোনো নক্ষত্র। ঘন কালো মেঘ। হঠাৎ বাতাস এসে এলোমেলো করে দেয় শিহাবের চুল। সেই বাতাসে আবারও ভেসে আসে নূপুরের রিনিঝিনি। এবার আর দূরে নয়। আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে কাছে। মনে হয় সেই বালিকা এখন তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। শিহাব অবাক হয়ে দেখে। তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এক জোড়া পা। পায়ে নূপুর। পা থেকে আস্তে আস্তে ঊর্ধ্বমুখী হয় শিহাবের চোখ। না। বালিকার মুখ দেখা যায় না। ধোঁয়ার মতো একচিলতে আলো এসে পড়েছে শুধু সেই পায়ে। সে কি শুধুই বালিকা? তরুণী অথবা মাঝবয়সীও তো হতে পারে? আজকাল বয়সী নারীও তো শখ করে পায়ে নূপুর জড়ায়। কিন্তু শিহাবের মনে হয়, যার পায়ে এই নূপুর সে শুধুই বালিকা। অমন খেয়ালে তো শুধু বালিকাই ছুটে বেড়ায়। আবারও তার পায়ের দিকে চোখ যায় শিহাবের। পায়ে রুপার চিকন নূপুর। গোছার খানিকটা ওপরে শাড়ির কিছুটা অংশ নজরে আসে। গাঁও-গেরামের মেয়েরা অল্প বয়সেই শাড়ি পরে। মেয়েটা কি গাঁও-গেরাম থেকে উঠে এসেছে? নাকি সে নিজেই চলে এসেছে কোনো গাঁয়ে? কিছুই ঠাওর করতে পারে না শিহাব?
হঠাৎ ভাঙা চুড়ির মতো মেয়েটির হাসির শব্দ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। শিহাব কেঁপে ওঠে। অদ্ভুত এক শিহরণ তার মেরুদণ্ডের ওপর থেকে গড়িয়ে নিচে নামে। মেয়েটি কি অশরীরী কেউ?
তুমি কি ভয় পাইছ?
কথায় গ্রাম্য টান। কিন্তু নূপুরের মতোই রিনিঝিনি মেয়েটির গলা। মিষ্টি। তালপাকা দুপুরে একপশলা হাওয়ার মতোই মিষ্টি।
ভয় তো পাবই। শিহাব খসখসে গলায় উত্তর দেয়, মাঝরাতে হঠাৎ করে নূপুরের শব্দ পেলে ভয়ই তো পাওয়ার কথা।
ভয় পাও কেন গো! আমি জিন-ভূত কেউ না।
তাহলে কে তুমি? তুমি কি পরি?
আবারও রিনিঝিনি হাসি!
আমি পরি নাগো! মানুষ। তবে শিশুকালে মায়ে কইত, মাইয়া আমার মাশাল্লা! দেখতে পরির লাহান। দুধে আলতায় শইল্লের রং!
মেয়েটির কথায় কেন জানি শিহাবের ভয় কেটে যায়। এখনো মেয়েটির পা দেখা যায় শুধু। ফরসা পায়ে চিকন নূপুর। পায়ের চারপাশে গোলাপি আভা। নাকি আলতার রং সেই আভা তৈরি করেছে তার পায়ে। এখনো অস্পষ্ট ধোঁয়াটে আলো শুয়ে আছে পায়ের কাছে। শাড়ির কিছুটা অংশ দেখা যায়। শাড়ির রং বোঝা যায় না? ছাপা? নাকি ডুরে? বোঝা যায় না সেটিও। মেয়েটা কি দুই হাতে শাড়ি খানিকটা টেনে ওপরে তুলে রেখেছে? নাকি শাড়ি পরার ঢংটাই অমন। পায়ের গোছা থেকে খানিকটা উঁচু করে পরা। যাতে পায়ের নূপুর দেখা যায় সহজেই। চোখ তুলতেই ছায়ার মতো মেয়েটির শরীরের কাঠামো এবার নজরে আসে। অনুভব করা যায় ছায়ার মতো মুখ। সেই মুখ নূপুরের মতোই সুন্দর মনে হয়।
সত্যি কইরা একখান কথা কও তো?
কী কথা?
তুমি ভয় পাও নাই?
না। পাই নাই।
আমি যহন খুব ছোড। বাপজান একদিন আমার জন্য এক জোড়া নূপুর নিয়া এল। রুপার নূপুর। সেই নূপুর দেইখা আমার মায়ের সে কী রাগ!
রাগ কেন?
অভাবের সংসার ছিল গো! অভাবের সংসারে এসব আহ্লাদ মানায়? মুখ ফুলাইয়া মায়ে কইছিল, পেডে ভাত জোটে না। নূপুর আনছে মাইয়ার লেইগা। রুপার নূপুর! শুইনা আমার বাপজান মিটমিটাইয়া হাসে। হাসে আর কী কয় জানো?
কী কয়?
গরিব মাইনষের কি শখ-আহ্লাদ নাই? দশটা না পাঁচটা না, আমার একটা মাইয়া! বাপজানের কথা শুইনা আমার কী যে আনন্দ! সেই আনন্দে নূপুর পায়ে দিয়া সারা উঠান দৌড়াই। নূপুরের ঝুমঝুম শব্দ হয়। নিজের কানেই কী যে মিঠা লাগে সেই শব্দ!
তোমার পায়ে কি সেই রুপার নূপুর?
নাগো! না। এই নূপুর বাপজানের সেই রুপার নূপুর না। অভাবের সংসারে কি রুপা থাকে? উপাস থাকলে চক্ষের সামনে নূপুর হইয়া যায় সাদা ভাত। ফকফইক্যা সাদা ভাত। সেই ভাতের লোকমা পেডে গেলে আত্মা শান্তি! আমি যহন ডাঙর হইলাম ভাতের লেইগা এলাম তুমরার এই শহরে। পেটে যহন দানা পড়ল তহন আবার চোখ গেল সেই নূপুরে। ছোটকালের শখ! এত সহজে কি তারে ভোলা যায়? কাইল সন্ধ্যা রাতে কাম থেইকা ফেরনের সুময় আমরার গলির মুখে চোখ গেল সেই নূপুরে। তুমি আমার কথা শুনছ তো?
শুনছি।
মাঝেমধ্যে জবাব দিয়ো। না হইলে কেমনে বুঝব যে তুমি আছ? চাইর পাশে কী যে আন্ধার!
অন্ধকারে তোমার ভয় লাগে না?
লাগে তো! কিন্তু মানুষ যুদি মানুষের সঙ্গে থাকে, আন্ধারেও ডর-ভয় লাগে না।
মেয়েটির কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হঠাৎ করে একঝলক হাওয়া যেন কোথা থেকে ছুটে আসে। ছুঁয়ে যায় দুজনকেই। আঁধারে খানিকটা আলোর আভা ছড়িয়ে পড়ে। সেই আভায় মেয়েটির মুখের দিকে তাকায় শিহাব। এখনো অবয়ব টের পাওয়া যায় না। এখনো ছায়ার মতো। শুধু তার খোলা চুলের আভাস পাওয়া যায়। হাওয়ায় সেই চুল হয়তো লুটিয়ে পড়েছিল মুখে। মেয়েটি তার মুখের একপাশ থেকে চুল সরিয়ে ডাকে,
শুনছ?
শুনছি।
আমার শেষ কথা কী আছিল কও তো?
গলির মুখে তোমার চোখ গেল সেই নূপুরে।
গলির মুখে একটা ফেরিঅলা প্রত্যেক দিন চাইর চাক্কার ভ্যানে দুকান সাজাইয়া বসে। কত কী যে আছে সেইখানে। চুড়ি ফিতা পাউডার। আমার এক সই খুব সাজুনি। হাতে পয়সা জমলেই চুড়ি-ফিতা কিনে। আলতা কিনে পায়ে লাগায়। আমার সাধ থাকলেও আহ্লাদ নাই। ভাতের লেইগা আসছি এই শহরে। আহ্লাদ চাপা দিয়া দুইটা পয়সা জমাইয়া মায়ের কাছে পাডাই। বাপজান নাই। মায়ের অসুখ। আমি পয়সা না পাডাইলে মায়ে যে উপাস থাকব। উপাস কী জিনিস সেইটা তো আমি জানিই! কিন্তু কাইল আমার চোখ গেল নূপুরে। চিকন নূপুরে ছোড ছোড ঘণ্টা। রুমঝুম কইরা বাজে। আমি ফেরিঅলারে জিগাই, নূপুর কি রুপার? শুইনা ফেরিঅলা দাঁত কেলাইয়া সে কী হাসি! ভ্যানগাড়িতে রুপার নূপুর? ইমিটিশন গো! ইমিটিশন! হোক ইমিটিশন। তার পরেও তো রুমঝুম শব্দ হয়। নগদ ৮০ টাকায় কিইনা নিলাম। অনেকগুলান টাকা। বড় কষ্টের টাকা গো! কষ্টের! মিহি সুতায় বড় ধার! সেই ধারে অঙ্গ কাটে। এই মিহি সুতা কি শিমুল তুলার? আমাগো বাড়ির সামনে একটা শিমুলগাছ আছিল। কী যে লাল সেই শিমুল ফুল। রক্তের লাহান।
মেয়েটির শেষ কথায় শিহাবের ভেতরটা শিরশির করে ওঠে! হঠাৎ মনে হয় মেয়েটি তার চেনা। তার সঙ্গে দেখা হয়েছে কোথাও। কিন্তু কোথায়, তা মনে করতে পারে না।
তুমি কি শুনছ আমার কথা?
শুনছি।
আইজ সকালেই পায়ে নূপুর পরছি। ডাঙর হওয়ার পর এই পরথম। বাপজানের কথা তহন খুব মনে পড়ছে। সেই শিশুকালে উপাসের সংসারে মাইয়্যার লেইগা আহ্লাদের রুপার নূপুর!
বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মেয়েটি। আঁধারে সেই নিঃশ্বাসের পতন শিহাবকে নাড়া দেয়। আশপাশে শুকনো পাতার ওড়াউড়ি টের পায়। খানিকটা হাওয়া কি ছুটে এসেছিল? না কি নিঃশ্বাসের পতন উড়িয়ে নিয়ে গেছে শুকনো পাতার সারি? এতই কি প্রবল সেই নিঃশ্বাস?
জানো? মেয়েটির গলা এখন করুণ শোনায়। কান্নার মতো। শীতের সকালে দূর্বাঘাসের ডগায় যেমন জমে থাকে শিশির, মেয়েটির গলায় কি তেমন শিশির জমেছে? ভেজা গলায় মেয়েটি বলে, সেই নূপুর আইজ সকালে পায়ে দিছি। খুব শখ আছিল নূপুর পায়ে ইকটুখানি ছোটাছুটি করি। সেই শিশুকালের মতোন। কিন্তু পারি নাই।
শিশিরের মতো ভেজা এই উচ্চারণ কি বালিকার অভিমান? নাকি অভিযোগ? নাকি তীব্র ঘৃণা গড়িয়ে নামছে তার ঠোঁটের কোনা বেয়ে? শিহাবের বুকের ভেতরটা আবারও শিরশির করে ওঠে! অদ্ভুত এক কাঁপন জাগে শরীরে। চোখ চলে যায় মেয়েটির পায়ে। এখনো ধোঁয়াটে আলোয় এক জোড়া পা। পায়ে নূপুর। হঠাৎ শিহাব খেয়াল করে মেয়েটির এক পায়ে নূপুর। অন্য পা খালি। এতক্ষণ নজরে আসেনি। আশ্চর্য! এক পায়ে কেউ নূপুর পরে? নাকি অন্য পা থেকে খসে গেছে নূপুর? অথবা ছিনিয়ে নিয়েছে কেউ? পায়ের চারপাশে লালচে আভা। শিহাব অবাক হয়ে দেখে সেই লালচে আভা আলতার নয়। রক্তের! রক্ত জমে আছে পায়ের পাতার চার পাশে। এখন আর চিনতে ভুল হয় না তার।
চারপাশে ধ্বংসস্তূপ! মাকড়সার জালের মতো ঝুলে আছে মিহি সুতো। সেই সুতোয় শিমুলের লাল নেই। কিন্তু লাল জমাট হয়ে আছে শত শত স্পন্দনহীন দেহে। ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে উঁকি দিয়েছিল এই পা। জমাট রক্তের চিকন চিহ্ন। পায়ে নূপুর। বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে শিহাব তখন দিশেহারা। এই স্থিরচিত্র পাথর হয়ে আছে তার চোখে। তার ক্যামেরায়। কাল সকালে কাগজের প্রথম পাতায় এই ছবি প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো ঝুলে থাকবে সবার চোখের সামনে।
আবার সেই রিনিঝিনি শব্দ! মেয়েটি সরে যাচ্ছে দূরে। আজ সকালে সেই বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে ইচ্ছা থাকলেও শিহাব চিৎকার করতে পারেনি। দিশেহারা মানুষের মতো শুধু তাকিয়েছিল চারপাশে। কিন্তু এই মধ্যরাতে শিহাবের গলা চিরে চিৎকার বেরিয়ে আসে,
যেয়ো না। শোনো!
মেয়েটি শোনে না। হারিয়ে যেতে থাকে দূরে। শিহাব আর্তনাদের মতো বলে,
আমাকে ক্ষমা করে দাও। তুমি আমাদের ক্ষমা করে দাও। আমরা তোমাদের অবারিত সবুজ প্রান্তর থেকে ছিনিয়ে এনেছি। বিলের বুকে কাঁপন তোলা বাও বাতাস আমরা কেড়ে নিয়েছি। তোমাদের লোকমায় সাদা ফকফকে ভাত আমরা তুলে দিতে পারিনি। বাপজানের আহ্লাদে জড়ানো নূপুর তোমাদের পা থেকে আমরাই কেড়ে নিয়েছি। আমাদের লোভ, আমাদের পাপ তোমাদের টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেছে বধ্যভূমির কালো আঁধারে! আমরাই হত্যা করেছি তোমাদের। আমাদের ক্ষমা করে দিয়ো।
শিহাবের গলা কান্নার মতো শোনায়। তবু থামে না মেয়েটি। আঁধারে হারিয়ে যায়। শুধু তার একটি পা পদাঘাতের চিহ্ন হয়ে মুখের ওপর ঝুলে থাকে। অদ্ভুত আঁধারে দিশেহারার মতো ছোটাছুটি করতে থাকে শিহাব। কোথায় ছুটছে সে? কালো চাদরে ঢাকা সেই খোলা মাঠে, সেই ধ্বংসস্তূপের ভেতর, নাকি চার দেয়ালের ঘেরাটোপে? বুঝতে পারে না।
No comments