ধর্ম দ্রব্যমূল্য সহনীয় ও স্থিতিশীল রাখুন by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের অপার মহিমা নিয়ে বছর ঘুরে মাহে রমজান প্রায় সমাগত। অথচ এ পবিত্র মাসের আগমনকে পুঁজি করে একশ্রেণীর কালোবাজারি অসাধু ব্যবসায়ী বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য ও দ্রব্যসামগ্রীর কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে।
ফলে বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঘটে। এতে রোজাদার সাধারণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষকে নিদারুণ ভোগান্তি পোহাতে হয়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশে খাদ্যপণ্য মজুত ও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নিয়মিত লাভের পরিবর্তে ক্রেতাসাধারণকে ঠকিয়ে এবং সংকটের আবহ সৃষ্টি করে অধিক মুনাফা হাতিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা অমানবিক। ইসলাম এ ধরনের জঘন্য কাজকে কোনোভাবেই সমর্থন করে না। এ ধরনের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড থেকে ধর্মপ্রাণ ব্যবসায়ীদের সব সময় বিরত থাকা উচিত। কেননা, পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তাআলা বেচাকেনাকে বৈধ ও সুদকে অবৈধ করেছেন।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-২৭৫)
ইসলামের দৃষ্টিতে দ্রব্যমূল্য বাজারে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চাহিদা ও জোগানের আলোকে নির্ধারিত হবে। তবে বাজার-প্রক্রিয়াকে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যেন ব্যাহত করতে না পারে, সে জন্য সরকার তদারকির ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে পারবে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ক্রয়-বিক্রয়ে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা, বাজার নিয়ন্ত্রণ ও মজুতদারি সম্পর্কে ইসলামি দৃষ্টিকোণ রয়েছে। খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীরা অস্বাভাবিকভাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি করতে পারে না। যদি এমনটি কেউ করে থাকে তবে ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মসাৎকারী হিসেবে সাব্যস্ত হবে। এভাবে মাহে রমজানে যখন অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিমভাবে সংকট সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্যস্ফীতি ঘটাতে চায়, তখন ইসলামি আইনবিদ বা ফকিহদের মতে, সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করতে পারবে। সরকার কর্তৃক ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ-প্রক্রিয়াকে আরবিতে ‘তাসয়ির’ বলা হয়। এ ক্ষেত্রে ভোক্তা ও উৎপাদক কোনো শ্রেণীরই ক্ষতিসাধন করা যাবে না, উভয় শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হবে। ইসলামের এ ব্যবস্থা থেকে ধারণা নিয়ে সরকার পাইকারি ও খুচরা বাজারে দ্রব্যমূল্যের তালিকা ঝোলানো বাধ্যতামূলক করতে পারে। হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘ব্যবসায়ী যদি সীমাতিরিক্ত মূল্য গ্রহণ করে এ সুযোগে যে ক্রেতা পণ্যের প্রকৃত মূল্য জানে না, তাহলে এই অতিরিক্ত পরিমাণের মূল্য সুদ পর্যায়ে গণ্য হবে।’
মাহে রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের চাহিদা ক্রমেই বেড়ে যায়। একশ্রেণীর সুযোগসন্ধানী কালোবাজারি, মজুতদার, মুনাফাখোর ও অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্যদ্রব্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। পণ্য মজুত রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়। এমন পরিস্থিতি দেশের সীমিত আয়ের মানুষের জনজীবনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ব্যবসায়ীদের বিবেকহীন ও অনভিপ্রেত কর্মকাণ্ডের কারণে দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী হয়ে পড়ে। মানুষের অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে বাজারপ্রক্রিয়াকে রক্ষার জন্য ইসলাম মজুতদারি, মুনাফাখুরি, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা ও দালালির মতো কার্যক্রমকে অবৈধ ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘মজুতদার খুবই নিকৃষ্টতম ব্যক্তি। যদি জিনিসপত্রের দাম হ্রাস পায় তবে তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে। আর যদি দর বেড়ে যায় তবে আনন্দিত হয়।’ (মিশকাত)
মজুতদারি পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কখনো কখনো পণ্যদ্রব্যের দাম তাদের ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে দেয়। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কেউ যদি মুসলমানদের থেকে নিজেদের খাদ্যশস্য আটকিয়ে রাখে, তবে আল্লাহ তাআলা তার ওপর মহামারি ও দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন।’ (ইবনে মাজা ও বায়হাকি)
রমজান মাসে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী অবৈধ ব্যবসায় মেতে ওঠেন। নিম্ন আয়ের মানুষের অর্থনৈতিক দৈন্য ও দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে যারা মজুতদারি, কালোবাজারি করে, তারা মানুষ নামের অমানুষ। সেসব ভণ্ড প্রতারক ব্যবসায়ী রোজা এলে লোক দেখানো সিয়াম সাধনায় রত থেকে মানবতাবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুদামজাত করে বাজারে কৃত্রিমভাবে সংকট সৃষ্টি করে এবং পরে অধিক হারে মুনাফা লুটে নেয়, তাদের মূল লক্ষ্য হলো ব্যবসা। অবৈধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে তারা সাধারণ মানুষকে অবর্ণনীয় কষ্ট দেয়। অথচ পণ্যসামগ্রী মজুত করে মূল্যবৃদ্ধি বা অধিক মুনাফা করা ইসলামে নিষিদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পণ্য আমদানি করে বাজার দামে বিক্রয় করে, তার উপার্জনে আল্লাহর রহমত রয়েছে। আর যে ব্যক্তি আমদানি করে চড়া দামে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে পণ্য মজুত করে রাখে, তার প্রতি আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন।’
ব্যবসা-বাণিজ্যে মূল্যপ্রবাহকে কেউ যেন ঊর্ধ্বমুখী করে না তোলে, সে ক্ষেত্রে ইসলামে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি মুসলমানদের লেনদেনে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ ঘটালে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা আগুনের হাড়ের ওপর তাকে বসিয়ে শাস্তি দেবেন।’
ব্যবসায়ীদের নৈতিকতা, ইসলামসম্মত সেবামূলক ভূমিকা মাহে রমজানে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ও সহনীয় পর্যায়ে রাখতে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এ জন্য সমাজের প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মানুষকে সৎ মনোভাবাপন্ন, নির্লোভ, মহৎপ্রাণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা উচিত। মজুতদারি, ধোঁকাবাজি, সুদি লেনদেনসহ সব ধরনের ইসলামি আদর্শবিবর্জিত কার্যাবলি রোধ করা প্রয়োজন। সুতরাং আসুন, মাহে রমজানে ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধিবিধান মেনে চলি। মুনাফাখুরি, মজুতদারি, ফাটকাবাজারি, কালোবাজারি ও সুদসহ অবৈধ পন্থায় লেনদেনে অর্থ উপার্জন থেকে বিরত থাকি।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: চেয়ারম্যান, ইসলামিক স্টাডিজ ও দাওয়াহ বিভাগ, ধর্ম বিজ্ঞান অনুষদ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.