মধ্যপ্রাচ্য মিসরের জনগণ কি গণতন্ত্র চায় না? by মশিউল আলম
মিসরে যা ঘটে গেল, তা সামরিক অভ্যুত্থান,
এতে কোনো সন্দেহ নেই। গণতান্ত্রিক পথে যাত্রা শুরু করার এক বছরের মাথায়
মিসরের জনগণ এ রকম মারাত্মক হোঁচট খাবে, এটা বোধ হয় তারা নিজেরাও কল্পনা
করেনি।
তাদের এই পদস্খলনের মাশুল যে খুব চড়া হবে, সেটাও
সম্ভবত উপলব্ধি করতে পারছে না তারা। আড়াই বছর আগে যে গণ-অভ্যুত্থানে তারা
স্বৈরশাসক হোসনি মোবারককে বিতাড়িত করেছে, তার পেছনের প্রধান আকাঙ্ক্ষা ছিল
গণতন্ত্র। কিন্তু আজ তারা তাদেরই নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্টকে অপসারণের
জন্য সামরিক বাহিনীকে ডেকে আনল। এটা সেই সামরিক বাহিনী, ছয় দশক ধরে যারা
মিসরে সীমাহীন ক্ষমতা, প্রভাব, প্রতিপত্তি ভোগ করে এসেছে। স্বৈরশাসক হোসনি
মোবারককে শক্তি-সমর্থন জুগিয়েছে এই সামরিক বাহিনীই। আবার ২০১১ সালের
শুরুতে কায়রোর তাহরির স্কয়ার থেকে যে ‘আরব বসন্ত’ সারা মিসরে ছড়িয়ে
পড়েছিল মোবারককে উৎখাত করার সংকল্প নিয়ে, সেই গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষে
দাঁড়িয়েছিল এই সামরিক বাহিনীই। মোবারকের পতনের সঙ্গে সঙ্গে মিসরে
গণতন্ত্র আসেনি, সামরিক বাহিনী তার প্রভাব-প্রতিপত্তি ছাড়েনি। বরং
জেনারেলরাই চালিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু তাঁরা দেশ চালাতে
ব্যর্থ হলে নির্বাচন না দিয়ে উপায় ছিল না। মোহাম্মদ মুরসিকে তখন মিসরের
৫২ শতাংশ ভোটার সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছিল।
কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই কী ঘটে গেল যে মিসরের জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্টকে বিতাড়িত করার জন্য লাখে লাখে রাস্তায় নেমে পড়ল? আর সেই সুযোগে আবার বেরিয়ে এল সামরিক বাহিনী? মিসরের জনগণ কি আসলে গণতন্ত্র চায় না?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি কয়েক দিন ধরে। কারণ, মুরসির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার এক বছর পূর্তির কয়েক দিন আগে থেকে কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়াসহ মিসরের বিভিন্ন শহরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে খবর পাওয়া যাচ্ছিল যে বিক্ষোভকারীরা মুরসি ও মুসলিম ব্রাদারহুডকে (ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি) উৎখাত করতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ চাইছে। এমনকি, যে উদারপন্থী গণতন্ত্রী যুবসমাজ গণতন্ত্র, বাক্স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের দাবিতে তাহরির স্কয়ারে আরব বসন্তের সূচনা করেছিল, তারাও নাকি ইন্টারনেটের সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কে সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতা নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছিল। মিসরের বেসরকারি গণমাধ্যমেও একই রকমের আহ্বান প্রচারিত হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থাগুলোর সূত্রে জানা গেছে।
সরকারবিরোধীদের প্রবল বিক্ষোভ ও সহিংসতার প্রেক্ষাপটে গত বুধবার সামরিক বাহিনী মুরসিকে উৎখাত করার পর নিউইর্য়ক টাইমস পত্রিকার এডিটোরিয়াল বোর্ড এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে মন্তব্য করেছে: ‘২০১১ সালের যে বিপ্লব স্বৈরশাসক হোসনি মোবারককে উৎখাত করেছিল, মিসরের জনগণ যদি এভাবে গণতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে সেই বিপ্লবের অবসান হতে দেয়, তবে তা হবে দুঃখজনক।’
নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করার জন্য সামরিক বাহিনীকে ডেকে আনার এই ঘটনা গণতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করারই শামিল বটে। কিন্তু এভাবে মিসরীয়দের মুরসিবিরোধী বিক্ষোভ, আলোচনার পথে না গিয়ে সরকারকে উৎখাত করতে চরম অবস্থানে চলে যাওয়ার অন্তর্নিহিত সব কারণ বোঝা কঠিন। মিসরে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা আছে, কিন্তু গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা নেই। বস্তুত মুসলিম ব্রাদারহুড ছাড়া প্রকৃত অর্থে আর কোনো রাজনৈতিক দলই দেশটিতে নেই। মুসলিম ব্রাদারহুডের ইতিহাসেও গণতান্ত্রিক রীতিনীতির অনুশীলন ছিল না। তাই মুসলিম ব্রাদারহুড বা তাদের আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক দল ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি ক্ষমতায় গিয়ে অন্য সব রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে মিলিতভাবে দেশ পরিচালনার কথা ভাববে—এ রকম একেবারেই ঘটেনি। মোবারকের স্বৈরশাসন-কবলিত মিসরে নিষিদ্ধ মুসলিম ব্রাদারহুড গণতন্ত্র চেয়েছে। আর যখন গণতন্ত্র পেয়েছে, তখন ভেবেছে এককভাবে, নিজেদের ইচ্ছামতো দেশ চালানোর লাইসেন্স তারা পেয়ে গেছে। মিসরকে তারা ‘পূর্ণাঙ্গ ইসলামি রাষ্ট্রে’ পরিণত করতে চায়; দেশটিতে যে আরও ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ আছে, ভিন্ন ধর্মের নাগরিকেরা আছে, তারা সেটা চায় কি না, মুসলিম ব্রাদারহুডের তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। তারা নিজেদের ইচ্ছামতো সংবিধান রচনা করবে, তাতে অন্যদের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগই রাখবে না।
কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুড ধর্মের ভিত্তিতে যে মিসর গড়ে তুলতে চায়, দেশটির শিক্ষিত সচেতন জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ সেটা চায় না। এই জনগোষ্ঠীই গণতন্ত্র, মুক্তি, বাক্স্বাধীনতা, নাগরিক-মানবিক স্বাধীনতার দাবিতে তাহরির স্কয়ারে আরব বসন্ত শুরু করেছিল। তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ নারী। কয়েক দিন ধরে তাহরির স্কয়ারে যে বিপুল জনসমাবেশের ছবি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি, সেখানে নারীদের ব্যাপক উপস্থিতি দুই বছর আগের তাহরির স্কয়ারের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। আড়াই বছর আগে তাহরির স্কয়ারে যে নারীরা ফুল, রুটি ও পানির বোতল হাতে সামরিক স্বৈরশাসনবিরোধী গণজাগরণে যোগ দিয়েছিলেন, এখন তাঁরাই মুরসি ও ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে সেখানে সমবেত হয়েছেন। মিসরীয় আরব বসন্তের সেই সক্রিয় অংশটি নির্বাচনের পরে দেখতে পেল, মুসলিম ব্রাদারহুডের মুরসি সরকার নারীকে ধর্মের নামে গৃহকোণে বন্দী করার আয়োজনে মেতেছে। ব্রাদারহুডের নেতারা বলতে লাগলেন, মেয়েরা, ঘরে ফিরে যাও। রাজনীতি তোমাদের কাজ নয়। ওটা করবে তোমাদের ভাই, স্বামী ও বাবারা। তোমরা পর্দা করো, গৃহকর্মে মনোযোগী হও। তাহরির স্কয়ারের সেই নারীরা একসময় আফসোসের সঙ্গে বলা শুরু করলেন, এ কেমন দিন আনলাম আমরা? এর চেয়ে মোবারকের আমলেই তো বেশি স্বাধীন ছিলাম।
তারপর আছে ফেসবুক-টুইটার প্রজন্ম, অর্থাৎ মিসরীয় শিক্ষিত যুবসমাজ। স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি, গণতন্ত্র, কর্মসংস্থান, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের স্বপ্নে-আকাঙ্ক্ষায় তারাই সূচনা করেছিল আরব বসন্তের। কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুডের সরকার তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। তারা বলছে, নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি শাসক হিসেবে অদক্ষ ও ব্যর্থ। তাঁর আমলে অর্থনীতির কোনো উন্নয়ন ঘটেনি, যুবসমাজের কর্মসংস্থান বাড়েনি, জনসাধারণের জীবনযাত্রায় একটুও অর্থনৈতিক স্বস্তি আসেনি। উল্টো বিদ্যুৎ-সংকট বেড়েছে, ক্রমাগত বেড়ে চলেছে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে: রাজধানী কায়রোসহ অন্যান্য শহরের রাস্তাঘাটে নিরাপত্তাহীনতা, যানজট ও আবর্জনা বেড়েছে। অথচ মিসরের জনসাধারণের প্রত্যাশা ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলে জনগণের নির্বাচিত সরকারের দ্বারা এই সব ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটবে।
স্বৈরশাসনবিরোধী বিপুল গণবিক্ষোভের মধ্যে মিসরের জনমনে যে বিরাট আশা-প্রত্যাশা জেগেছিল, মুরসির নির্বাচিত সরকারের পক্ষে তার সামান্য অংশও পূরণ করা সম্ভব হয়নি। জনগণের এই বিরাট আশাভঙ্গই মিসরের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংকটের অন্তর্নিহিত কারণগুলোর মধ্যে প্রধান বলে মনে হয়।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই রাজনৈতিক সংকটের যে একটা রাজনৈতিক সমাধান হতে পারত, মিসরীয় রাজনীতির কোনো অংশে তেমন দৃষ্টিভঙ্গির দেখা মেলে না। গণবিক্ষোভের চাপে মুরসি সরকার যখন একটা জাতীয় ঐকমত্যের সরকার ও সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনের জন্য একটা নিরপেক্ষ কমিটি গঠনের বিষয়ে আন্দোলনরত বিরোধী পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিলেন, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কারণ, ইতিমধ্যে সামরিক বাহিনী দৃশ্যপটে ঢুকে পড়ে সরকারকে আলটিমেটাম দিয়ে বসেছে। প্রেসিডেন্ট মুরসি বিরোধী পক্ষের সঙ্গে আলোচনার কথা আগে ভাবলে সামরিক বাহিনীর হাতে এত তাড়াতাড়ি আলটিমেটাম ঘোষণার সুযোগ আসত না।
অন্যদিকে, উদার-গণতন্ত্রী হিসেবে নিজেদের প্রচার করে যেসব রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও দল, তাদের উদারপন্থা ও গণতন্ত্র-মনস্কতার দৈন্য হলো এই যে, নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করতে সামরিক হস্তক্ষেপ আহ্বান করা যে খাল কেটে কুমির আনা, এটা তারা বুঝতেই পারছে না। মুসলিম ব্রাদারহুড যে ইসলামপন্থা মিসরে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সেটার বিপরীতে কোনো ‘সেক্যুলার’ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়া ছাড়া আর কোনো গণতান্ত্রিক পন্থা নেই। সামরিক বাহিনী মিসরে গণতন্ত্র এনে দেবে না। বরং গণতন্ত্র যেন শিকড় গাড়তে না পারে, তা যেন সব সময়ই ভঙ্গুর ও নাজুক অবস্থায় থাকে, তারা সেটাই চাইবে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই কী ঘটে গেল যে মিসরের জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্টকে বিতাড়িত করার জন্য লাখে লাখে রাস্তায় নেমে পড়ল? আর সেই সুযোগে আবার বেরিয়ে এল সামরিক বাহিনী? মিসরের জনগণ কি আসলে গণতন্ত্র চায় না?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি কয়েক দিন ধরে। কারণ, মুরসির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার এক বছর পূর্তির কয়েক দিন আগে থেকে কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়াসহ মিসরের বিভিন্ন শহরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে খবর পাওয়া যাচ্ছিল যে বিক্ষোভকারীরা মুরসি ও মুসলিম ব্রাদারহুডকে (ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি) উৎখাত করতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ চাইছে। এমনকি, যে উদারপন্থী গণতন্ত্রী যুবসমাজ গণতন্ত্র, বাক্স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের দাবিতে তাহরির স্কয়ারে আরব বসন্তের সূচনা করেছিল, তারাও নাকি ইন্টারনেটের সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কে সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতা নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছিল। মিসরের বেসরকারি গণমাধ্যমেও একই রকমের আহ্বান প্রচারিত হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থাগুলোর সূত্রে জানা গেছে।
সরকারবিরোধীদের প্রবল বিক্ষোভ ও সহিংসতার প্রেক্ষাপটে গত বুধবার সামরিক বাহিনী মুরসিকে উৎখাত করার পর নিউইর্য়ক টাইমস পত্রিকার এডিটোরিয়াল বোর্ড এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে মন্তব্য করেছে: ‘২০১১ সালের যে বিপ্লব স্বৈরশাসক হোসনি মোবারককে উৎখাত করেছিল, মিসরের জনগণ যদি এভাবে গণতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে সেই বিপ্লবের অবসান হতে দেয়, তবে তা হবে দুঃখজনক।’
নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করার জন্য সামরিক বাহিনীকে ডেকে আনার এই ঘটনা গণতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করারই শামিল বটে। কিন্তু এভাবে মিসরীয়দের মুরসিবিরোধী বিক্ষোভ, আলোচনার পথে না গিয়ে সরকারকে উৎখাত করতে চরম অবস্থানে চলে যাওয়ার অন্তর্নিহিত সব কারণ বোঝা কঠিন। মিসরে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা আছে, কিন্তু গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা নেই। বস্তুত মুসলিম ব্রাদারহুড ছাড়া প্রকৃত অর্থে আর কোনো রাজনৈতিক দলই দেশটিতে নেই। মুসলিম ব্রাদারহুডের ইতিহাসেও গণতান্ত্রিক রীতিনীতির অনুশীলন ছিল না। তাই মুসলিম ব্রাদারহুড বা তাদের আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক দল ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি ক্ষমতায় গিয়ে অন্য সব রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে মিলিতভাবে দেশ পরিচালনার কথা ভাববে—এ রকম একেবারেই ঘটেনি। মোবারকের স্বৈরশাসন-কবলিত মিসরে নিষিদ্ধ মুসলিম ব্রাদারহুড গণতন্ত্র চেয়েছে। আর যখন গণতন্ত্র পেয়েছে, তখন ভেবেছে এককভাবে, নিজেদের ইচ্ছামতো দেশ চালানোর লাইসেন্স তারা পেয়ে গেছে। মিসরকে তারা ‘পূর্ণাঙ্গ ইসলামি রাষ্ট্রে’ পরিণত করতে চায়; দেশটিতে যে আরও ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ আছে, ভিন্ন ধর্মের নাগরিকেরা আছে, তারা সেটা চায় কি না, মুসলিম ব্রাদারহুডের তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। তারা নিজেদের ইচ্ছামতো সংবিধান রচনা করবে, তাতে অন্যদের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগই রাখবে না।
কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুড ধর্মের ভিত্তিতে যে মিসর গড়ে তুলতে চায়, দেশটির শিক্ষিত সচেতন জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ সেটা চায় না। এই জনগোষ্ঠীই গণতন্ত্র, মুক্তি, বাক্স্বাধীনতা, নাগরিক-মানবিক স্বাধীনতার দাবিতে তাহরির স্কয়ারে আরব বসন্ত শুরু করেছিল। তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ নারী। কয়েক দিন ধরে তাহরির স্কয়ারে যে বিপুল জনসমাবেশের ছবি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি, সেখানে নারীদের ব্যাপক উপস্থিতি দুই বছর আগের তাহরির স্কয়ারের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। আড়াই বছর আগে তাহরির স্কয়ারে যে নারীরা ফুল, রুটি ও পানির বোতল হাতে সামরিক স্বৈরশাসনবিরোধী গণজাগরণে যোগ দিয়েছিলেন, এখন তাঁরাই মুরসি ও ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে সেখানে সমবেত হয়েছেন। মিসরীয় আরব বসন্তের সেই সক্রিয় অংশটি নির্বাচনের পরে দেখতে পেল, মুসলিম ব্রাদারহুডের মুরসি সরকার নারীকে ধর্মের নামে গৃহকোণে বন্দী করার আয়োজনে মেতেছে। ব্রাদারহুডের নেতারা বলতে লাগলেন, মেয়েরা, ঘরে ফিরে যাও। রাজনীতি তোমাদের কাজ নয়। ওটা করবে তোমাদের ভাই, স্বামী ও বাবারা। তোমরা পর্দা করো, গৃহকর্মে মনোযোগী হও। তাহরির স্কয়ারের সেই নারীরা একসময় আফসোসের সঙ্গে বলা শুরু করলেন, এ কেমন দিন আনলাম আমরা? এর চেয়ে মোবারকের আমলেই তো বেশি স্বাধীন ছিলাম।
তারপর আছে ফেসবুক-টুইটার প্রজন্ম, অর্থাৎ মিসরীয় শিক্ষিত যুবসমাজ। স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি, গণতন্ত্র, কর্মসংস্থান, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের স্বপ্নে-আকাঙ্ক্ষায় তারাই সূচনা করেছিল আরব বসন্তের। কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুডের সরকার তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। তারা বলছে, নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি শাসক হিসেবে অদক্ষ ও ব্যর্থ। তাঁর আমলে অর্থনীতির কোনো উন্নয়ন ঘটেনি, যুবসমাজের কর্মসংস্থান বাড়েনি, জনসাধারণের জীবনযাত্রায় একটুও অর্থনৈতিক স্বস্তি আসেনি। উল্টো বিদ্যুৎ-সংকট বেড়েছে, ক্রমাগত বেড়ে চলেছে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে: রাজধানী কায়রোসহ অন্যান্য শহরের রাস্তাঘাটে নিরাপত্তাহীনতা, যানজট ও আবর্জনা বেড়েছে। অথচ মিসরের জনসাধারণের প্রত্যাশা ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলে জনগণের নির্বাচিত সরকারের দ্বারা এই সব ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটবে।
স্বৈরশাসনবিরোধী বিপুল গণবিক্ষোভের মধ্যে মিসরের জনমনে যে বিরাট আশা-প্রত্যাশা জেগেছিল, মুরসির নির্বাচিত সরকারের পক্ষে তার সামান্য অংশও পূরণ করা সম্ভব হয়নি। জনগণের এই বিরাট আশাভঙ্গই মিসরের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংকটের অন্তর্নিহিত কারণগুলোর মধ্যে প্রধান বলে মনে হয়।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই রাজনৈতিক সংকটের যে একটা রাজনৈতিক সমাধান হতে পারত, মিসরীয় রাজনীতির কোনো অংশে তেমন দৃষ্টিভঙ্গির দেখা মেলে না। গণবিক্ষোভের চাপে মুরসি সরকার যখন একটা জাতীয় ঐকমত্যের সরকার ও সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনের জন্য একটা নিরপেক্ষ কমিটি গঠনের বিষয়ে আন্দোলনরত বিরোধী পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিলেন, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কারণ, ইতিমধ্যে সামরিক বাহিনী দৃশ্যপটে ঢুকে পড়ে সরকারকে আলটিমেটাম দিয়ে বসেছে। প্রেসিডেন্ট মুরসি বিরোধী পক্ষের সঙ্গে আলোচনার কথা আগে ভাবলে সামরিক বাহিনীর হাতে এত তাড়াতাড়ি আলটিমেটাম ঘোষণার সুযোগ আসত না।
অন্যদিকে, উদার-গণতন্ত্রী হিসেবে নিজেদের প্রচার করে যেসব রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও দল, তাদের উদারপন্থা ও গণতন্ত্র-মনস্কতার দৈন্য হলো এই যে, নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করতে সামরিক হস্তক্ষেপ আহ্বান করা যে খাল কেটে কুমির আনা, এটা তারা বুঝতেই পারছে না। মুসলিম ব্রাদারহুড যে ইসলামপন্থা মিসরে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সেটার বিপরীতে কোনো ‘সেক্যুলার’ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়া ছাড়া আর কোনো গণতান্ত্রিক পন্থা নেই। সামরিক বাহিনী মিসরে গণতন্ত্র এনে দেবে না। বরং গণতন্ত্র যেন শিকড় গাড়তে না পারে, তা যেন সব সময়ই ভঙ্গুর ও নাজুক অবস্থায় থাকে, তারা সেটাই চাইবে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
No comments