বায়োজিদ বুকস্ by মঈনুস সুলতান
চিকেন স্ট্রিটের বায়োজিদ বুকস বলে এক
বারোয়ারি কেতাব-ফুরুশি বা বইয়ের দোকানের কোর্ট-ইয়ার্ডে বসে আমি এক পেয়ালা
চা খাই। আমার চায়ের রং তাজা লেবুর মতোই সবুজে খানিক হলুদ মিশ্রিত। তা থেকে
ছড়ায় এলাচির খুশবু।
কেতাব ফুরুশির মালিক আবদুল ওয়াসে
উসুলি তস্তরিতে করে পরিবেশন করেন নিমকির মতো ত্রিকোনা করে কাটা উজবেকি নান।
এ রুটির খামিরাতে তেলের মিশেল দেওয়ার কারণে তাকে কেউ কেউ রোগনি নানও বলে
থাকেন। সারা রুটির গায়ে বোধ করি আলপিন ফুটিয়ে করা বিন্দু বিন্দু নকশা। আমি
এক চিমটে কিশমিশের সঙ্গে রোগনি রুটি চিবোতে গেলে আমার মাথার ওপর উড়ে আসে এক
জোড়া অত্যন্ত ছোট্ট পাখি। তাদের বর্ণাঢ্য উড্ডয়ন ও স্রেফ কিচিরমিচিরে মনে
হয় রুটির ওপর তাদের রীতিমতো মৌরুসি হক আছে। আমি রুটির টুকরা ভেঙে খানিক
দূরের চাতালে ছুড়ে দিই। ওখানে এক জোড়া গোলাপের পাশে টবে রাখা আফতাব পরস্তি
বা সূর্যমুখী ফুল আলো-রিক্ততায় যেন ঝুঁকে আছে রুকু-সেজদায়। নাম না-জানা
পাখিজোড়া তার তলায় বসে খুঁটে খায় রোগনি নান।
কাবুল শহরে বায়োজিদ বুকস খুঁজে পাওয়া কঠিন কিছু নয়। চিকেন স্ট্রিটের যেখানে নুরিস্তানের শিল্পশোভন নাজুক মালের দোকান, একটু খেয়াল করলেই যেখানে কাফেরি আমলের পৌত্তলিক মূর্তিরাজিকে সিনা চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়; এবং তার নিচে জরিমোড়া পয়জারগুলোর পাশে দলা করে রাখা কুহে-পামির পাহাড়ের নীল বর্ণের বৈদ্যুর্য মণি পাথর; ওখানে পয়লা দাঁড়িয়ে পড়ে ফুটপাতে নিরিখ করে তাকাতে হয়। দেয়ালে ঝুলছে একাধিক তুর্কমেনি কার্পেট, তাই ফুটপাতটি হয়ে আছে হরেক বর্ণে রংবহুল। পায়ে চলার বারিক-মুরিক পথের দুপাশে ডিসপ্লে করা তরতাজা সব চিত্রকর্ম। এখানে ছবিতে সম্রাট কণিষ্কের পাশে আমির আবদুর রহমান ও কালো চশমা পরা সরদার দাউদ খান। গুলিবিদ্ধ রাশান হেলিকপ্টারের পাশে নীল বোরকাপরা আফগান জেনানা, তার মাথায় পিঞ্জিরা—তাতে রাখা অচিন পাখি। মাঝেমধ্যে এক চিত্রকর ফ্লোরে বসে ব্রাশ হাতে ধুন্দুরমুন্দুর করে। এখানে সদ্য রং করা পেইনটিংয়ের সঙ্গে উষ্টাবিষ্টা না খাওয়ার জন্য হাঁটতে হয় হুঁশিয়ারির সঙ্গে।
কেতাব-ফুরুশির ভেতরবাগে চান্দোয়ায় ঢাকা কোর্ট-ইয়ার্ড। তার বাঁ-দিকের কামরায় শেলফগুলোতে সিজিল মিছিল করে রাখা লাহোর, ইস্পাহান বা হিরাত থেকে ছাপা বইপুস্তক। বিজুলির কানেকশন প্রায়ই কাটা পড়ে বলে আবদুল ওয়াসে ওসুলি কেতাব খুঁজনেওয়ালাদের শামাদানে মোম জ্বালিয়ে দিয়ে সাহায্য করে থাকেন। এখানে বইয়ের সিলেকশন বিচিত্র, কোনো কোনো কেতাবাদি পাঠের দিক থেকে যতটা না গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় তাদের মুদ্রণ ইতিহাসের জন্য। কিছু কিছু বই বহু পাঠকের বে-এখতেয়ার ব্যবহারে রীতিমতো ফর্দাফাই। ২০০৪ সালে আমি এখান থেকে আল্লামা ইকবাল লাহোরীর আসরারে খুদি কেতাবখানা ক্রয় করি। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল হিন্দুস্তানের রায়বেরিলি থেকে, তার প্রকাশকের নাম ও সালের জায়গা পোকায় কেটেছে নিখুঁতভাবে। ওই দিন এখানে বইয়ের সওদা করতে আসেন প্রফেসর জন বেইলি। এ সিনিয়র ইংরেজ অধ্যাপক বিলেতে কোথাও ওরিওন্টলজি পড়ান। পেশায় তিনি এথনোমিউজিকোলজিস্ট। তরুণ বয়সে বেইলি অনেক বছর হিরাতে কাটান প্রাচ্যের ফারসি সংগীতের তালাশে। তিনি দামদর করে ক্রয় করেন মিরাট থেকে ১৯১৮ সালে প্রকাশিত আদবিয়াতে ফারসির মশহুর শায়ের বেদিলের কখানা কেতাব। আবদুল ওয়াসে ওসুলি প্রফেসরকে তাঁর সিন্দুক থেকে বের করে দেখান বাদশাহ জহির শাহের সই করা হাসিয়ায় মিনিওতোর চিত্র আঁকা শাহনামা। কেতাবখানা তো আগ্র প্রসাদ লুণ্ঠনের স্পষ্ট নিশানাবিশেষ! এর কিম্মত অনেক, খরিদ করতে পারলে খারাপ হতো না, তবে তাতে বাদবাকি পুরো মাস-শুখা নান ও মুলার চাট জোটানোর জন্য জেবে অবশিষ্ট কিছু থাকত না।
পর্দার আবডালে আছে এ কেতাব-ফুরুশির অন্দরমহল। কাবুলে আমার জিগরি দোস্ত ডোয়াইট লয়েড আমাকে এ মহলের তালাশ দেয়। পর্দা গুটিয়ে গুটিগুটি পায়ে চাপলিশে ঢুকে পড়তে হয় আরেকটি বারিক-মুরিক করিডরে। এল শেইপের এ স্পেশে ডাঁই করে রাখা পুরোনো সব কিতাবাদি। এখানে চলাচল করতে পারেন কেবল একজন পড়নেওয়ালা। জেবে করে দেশলাই নিয়ে আসতে পারলে সুবিধা হয়। ফস্ করে কাঠি জ্বালিয়ে ধরানো যায় পিতলের পিলসুজ। কুপিটি দেখতে অনেকটা আলিফ লায়লার আলাদীনের চেরাগের মতো। তার পাশে চান্দির কাজ করা ক্যাশ-বাক্সের ওপর রাখা মরক্কো লেদারে বাঁধাই ঢাউস একখানা কেতাব। জরুরি এ পুস্তক কে লিখেছেন তা জানার কোনো উপায় নেই বটে, তবে তাতে ফিরোজে-হরিৎ ও ছরকে-লালে আঁকা তসবিরগুলো দেখে মনে হয় তা কামাসূত্রার উজবেকি ভার্সন। এ বইয়ের শেষ পাতায় আগ্র প্রাসাদের শাহি কেতাবখানার মোহরের ছাপ আছে। যারা কামে উদ্যম-রহিত হালতে আছেন, অথবা স্রেফ অন্তরঙ্গ কর্মে অপটু—এ কেতাবের তসবির দর্শনে তাদের কামিয়াব হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমার জিগরি দোস্ত ডোয়াইট লয়েড এখানে হামেশা আসে ধ্রুপদি রুশ কেতাবাদির তালাশে। কাবুলে সোভিয়েত অকুপেশনের সময় কিংবা তারও অনেক আগ থেকে এ শহরের বাস করছেন হাজার বিজার রুশ এক্সপার্ট, গোয়েন্দা ও ডিপ্লোমেট। পুশকিন, গোগোল বা লারমানতভের ক্ল্যাসিকগুলো সম্ভবত তাঁদের চাকর-নফররা চাপলিশে সের দরে বিক্রি করে দিয়েছেন। ডোয়াইটের পরামিশ মোতাবেক আমি একবার কেতাব-ফুরুশির অন্দরের তলকুটুরি অবধি গিয়েছিলাম। স্থানটি দস্যু মোহনের গোপন আস্তানার মতো। কাঠের আলমারির দুয়ার খুলে তার ভেতরে ঢুকে তারপর নেমে যেতে হয় ক্যাচমেচানো সিঁড়ি ধরে রীতিমতো পাতালে। পড়নেওয়ালাদের পকেটে করে পেনসিল টর্চ নিয়ে যাওয়ার কোনো জরুরত নেই। আবদুল ওয়াসে ওসুলি নিজে সরবরাহ করেন পাঁচ ব্যাটারির টর্চ; এ ছাড়া কফিনের মতো দেখতে সিন্দুকের ওপর রাখা আছে চার্জার ল্যাম্প।
ডোয়াইট লয়েড কাবুলি পেইনটিংয়ের উমেদার। আমি তার অছিলা ধরে তলকুঠুরিতে আসার মওকা পাই একদিন। সে বছর তিনেক আগের কথা। ওসুলি চার্জার জ্বেলে মেলে ধরেন সিন্দুকের ঢালা। তা থেকে বেরোয় সেলোফোনে মোড়া এক রাশ পেইনটিং। অত্যন্ত রিয়ালিস্টিক ভঙ্গিতে আঁকা পেইনটিংয়ে ধ্রুপদি মিনিওতোর চিত্রের দৃশ্যপট ব্লোআপ করা। বিষয়বস্তুতে ঘুরে-ফিরে আসে বাগিচা ও রাজদরবার। এসব ছবিতে চমৎকার করে সৃজিত হয়েছে বৃক্ষ, বর্ণিল পুষ্প,কাফেলার রেখা, রংচঙে ফরাস, স্বর্ণালি কুরছি, পানপাত্র ও সোরাই—যা নেই তা হচ্ছে জনজীবন-চাষাবাদ, গবাধিপশু, সংসার, ঘরকন্না, শিশু, মসজিদ ও এবাদত। সে রকম করে মানুষের ছবিও এখানে অনুপস্থিত; তবে শিল্পী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এঁকেছেন মানবী। নারীরা গোপন সিন্দুকের ছবিতে প্রায় সবাই কিশোরী, এবং কেউ কেউ যুবতী হতে হতে পুষ্পের বিকশিত পাপড়িতে সাজিয়েছেন দেহের পসরা। চিত্রকর কারও চোখে এঁকে দিয়েছেন শরমের অঞ্জন, কেউ কেউ কটাক্ষে ইশারাপ্রবণ। তাদের পরিপূর্ণ ওষ্ঠে শৃঙ্গারের অস্থির প্রয়াস। শিল্পী এদের শরীর আব্রুতে ঢাকার তেমন জরুরত বোধ করেননি। বরং তাদের স্তনযুগলের ডৌল বা নিতম্বের বঙ্কিমতাকে উর্বর বাগিচায় ফলন্ত আশ্চর্য মেওয়ার মতো বৃত্তাকার করে এঁকেছেন। নারীদের কারও কারও দেহে জড়ানো আবেরেশমের গোলাপি-পার্পোল বা ফিরোজা রঙের ট্রান্সপারেন্ট ওড়না, তার আলো-ছায়ায় বৃদ্ধি পেয়েছে তাদের ঊরুদেশের বর্ণিল মসৃণতা। এবং তাদের দেহ-সম্পদ রঙে ও রেখায় বিবর্তিত হয়েছে শিল্পশোভন দ্রষ্টব্যে। খরিদদার হিসেবে ডোয়াইট বিস্তর সময় নিয়ে তাড়া তাড়া পেইনটিং থেকে বাছাই করে চমকপ্রদ কটি নমুনা। এ সুযোগে ওসুলি আমাকে দেখান ঘোড়ার পিঠে ক্যারি করার কটি স্যাডেল ব্যাগ বলে পরিচিত বস্তা। ছালার মুখ খুলে অতঃপর তিনি বের করে আনেন এ আত্রাফে সরকারি ফরমানে নিষিদ্ধ কখানা কিতাব। আমি তাঁর কাছ থেকে এক তালেবান কারাবন্দীর লেখা একখানা বই খরিদ করি। বন্দী গুয়ানতানামো বে কারাগারের কথা লিখেছেন। এ বইটি কোথাও মুদ্রিত হয়নি, টাইপ করে বিতরণের জন্য ফটোকপি করা হয়েছে। আমি যখন বইটি কেনার জন্য দামদর করছি তখন আমাদের মাথার ওপর টর্চের আলোয় বিরক্ত হয়ে ওড়ে একটি কম বয়সী কছমা বাদুড়।
সে বছর তিনেক আগের কথা। আমাকে বায়োজিদ বুকসে পয়লা নিয়ে আসেন নরওয়ের এক ভ্রাম্যমাণ লেখিকা অ্যাসনে সিয়ারস্টেড। মিস অ্যাসনে তখন কাবুলের এক বই বিক্রেতা সুলতান খানের বাড়িতে তাঁর পরিবারের সঙ্গে বাস করছেন। তিনি এর আগে চেচনিয়া ও বলকানে সাংবাদিকতা করেছেন। তার পরও কাবুলে তথ্য সংগ্রহ ও লেখালেখির কাজ করা তাঁর কাছে ঠুলি পরা বলদের ঘানি টানার মতোই ক্লান্তিকর মনে হতো। মাঝেমধ্যে কাবুলি পরিবারের পর্দানশিন বাস্তবতা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তিনি চলে আসতেন বায়োজিদ বুকসে। কোর্ট-ইয়ার্ডে এ মুহূর্তে আমি যেখানে বসে সবুজ চা খাচ্ছি, তার পাশের চেয়ারের হাতায় বোরকা রেখেই বসতে বসতে ফস করে ধরাতেন মার্লবরো সিগারেট। তিনি থার্মসে করে নিয়ে আসতেন কলম্বিয়ার তাজা কফি। চারদিকে ফুটন্ত ক্যাফিনের সৌরভ ছড়িয়ে তাঁর অবজারভেশনের নোটস লিখতেন কাঠপেনসিলে। পরে তিনি বুক সেলার অব কাবুল বইটি লিখলেন, বইখানার তরজমা বেরোলো নানা ভাষায়; তিনিও মশহুর হলেন তামাম দুনিয়ায়। তার পর থেকে তাঁকে কিন্তু আর কখনো কাবুলের বায়োজিদ বুকসে দেখা যায়নি। শোনা যায়, তার একাধিক স্ত্রীর জিন্দেগির নানাবিধ বন্দেগি তাঁর গ্রন্থে চাউর করে দিয়ে মিস অ্যাসনে কেতাব বিক্রেতা সুলতান খানের জানি দুশমন বনেছেন। খান তক্কে তক্কে আছেন মওকা পেলে বদলা নেওয়ার ।
হালফিল কাবুল শহর ক্রমাগত খতরনাক হয়ে উঠছে। আজকাল আর বায়োজিদ বুকসে উল্লেখযোগ্য কোনো লেখকের পা পড়ে না। তবে আমরা যারা আবর্জনা বাদাছাদা কিসিমের মানুষ, উইকেন্ডে এর চেয়ে বেহতর কোথাও যাওয়ার মুরদ নেই, আমরা এখনো বায়োজিদ বুকসে আসি, পুরোনো বইপত্রের পাতা ঘাঁটি, নিরলে বসে পান করি পেয়ালা তিনেক সবুজ চা। আজ আমি আমার জিগরি দোস্ত ডোয়াইট লয়েডের ইন্তেজারিতে আছি। এ কোর্ট-ইয়ার্ডের দেয়ালে ঝোলানো জলরং ও তেলের কিছু কাজ। কোনো কোনো চিত্রে সবুজে বেগুনি লোহিত ডোরাকাটা চাপান পরা আফগানরা ঘোড়া ছুটিয়ে ছাগলের মৃতদেহ নিয়ে খেলছে বুঝকাশি। আবার জলরঙের কাজে কুচি গোত্রের নেকাবহীন নারীরা মণিমানিক্য মরকতের মতো বর্ণাঢ্য গারেরা পরে নহর থেকে ভরে নিচ্ছে পানীয় জল।
একটি আফগান পরিবার এসে ডাঁই করে রাখা তাড়া তাড়া পেইনটিং ঘাঁটে। তারা যুগপৎ দারি ও জার্মান ভাষায় কথা বলে। মনে হয় মিউনিখে বাসরত এ পরিবার অনেক বছর পর কাবুলে ফিরে এসেছে। তাদের মেয়েটি বয়সে সে নিতান্ত কিশোরী, আলগা হেজাবের নিচে পরে আছে হিপহ্যাগার জিনস ও স্লিভলেস টপ। বায়োজিদ বুকসের বাঁধা চিত্রকর ওবায়েদ উল্লাহ আসকরী ইজেলে আঁকছিল এক সফেদ শ্মশ্রু বুড়া বুজুর্গের তসবির। সে উঠে মেয়েটির পোর্ট্রেট এঁকে দেওয়ার জন্য অ্যাপ্রোচ করে। ওয়ায়েদ উল্লাহ বয়স আন্দাজ করা মুশকিল। তার বাটকুল কিসিমের দেহে অনেক দিন হলো থির হয়ে আছে গ্রোথ। ছবি আঁকিয়ে এ ছেলেটি অত্যন্ত পোলাইট, কিন্তু তার চোখের দিকে তাকানো যায় না। কথাবার্তায় আমি যা জেনেছি তা হলো, গেলবারের মার্কিনি বোমাবাজির সময় ওবায়েদ উল্লাহ ছাদে খেলছিল। ঝোপঝাড়ে যাতে তালেবানরা অ্যামবুশ করতে না পারে, সে জন্য জঙ্গিবিমান থেকে ছড়ানো হয় বৃক্ষ-বিধ্বংসী বিষাক্ত কেমিক্যালস। তিফিল বালক ওবায়েদ খেলতে খেলতে কপালে হাত দিয়ে আসমানে জঙ্গি বিমানের উড্ডয়ন দেখছিল। হালকা কুয়াশার মতো কিছু নেমে এসে ভিজে হলুদ আভায় ঢেকে দেয় তার মুখমণ্ডল। শুরু হয় চোখে জ্বালাপোড়া প্রদাহ। তার জননী পাশের বুনোহাঁস ভাসা পুকুর থেকে জল এনে বারবার চোখ ধুইয়ে দিলেও ফায়দা কিছু হয়নি। সারা রাত ওবায়েদের কান্নাকাটিতে ঘুম হয় না সংসারের কারও। পরদিন তরতাজা মাছ ও হাঁসের মৃতদেহে ভরে ওঠে জলাশয়। তার চোখে ইনফেকশন হয়। মাস তিনেক পর তা সেরে উঠলেও তার চোখের শেইপে আসে পার্মানেন্ট বিকৃতি।
ওবায়েদ উল্লাহর আঁকাজোঁকার হাত কিন্তু খারাপ না। তার তাৎক্ষিকভাবে স্কেচে প্রাণের খামতি কিছু নেই। আমি খোঁজখবর নিয়েও ঠিক বুঝতে পারিনি ছেলেটি এতিম কি না? ছবি আঁকার কাজ সে শিখল কোথায়? এ মুহূর্তে ওবায়েদ উল্লাহ ইজেলের সামনে বসিয়ে মিউনিখ থেকে আসা আফগান মেয়েটির পোর্ট্রেট করে দিচ্ছে। টুলে বসা মেয়েটি দাড়ে রাখা টিয়া পাখির চেয়েও অস্থির। সে মুঠোফোন টিপে, কবজিতে চুলের ব্যান্ড জড়িয়ে চুয়িংগামের র্যাপার খুঁটে খুব তৎপর হয়ে আছে। তাকে স্কেচ করতে ওবায়েদের বোধ করি অসুবিধা হয়। সে থেকে থেকে আঁকা বন্ধ করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটির নড়াচড়ায় ছেদ পড়ার জন্য অপেক্ষা করে পেনসিলের গোড়ালি দিয়ে তার দাঁতে ঠুক ঠুক করে বাড়ি মারে।
চা-পান শেষ হলে আমি কেতাব ফুরুশির আরেকটি কামরায় ইরান থেকে আমদানি করা হাফিজ, সাদি, জামি ও খৈয়ামের নতুন সংস্করণের বইগুলো দেখি। বরাত জোরে ফিরে আসে বিজুলি। তার আলোয় দাঁড়িয়ে কালো বোরকাপরা এক আফগান দুহিতা। সিন্দুকের অন্ধকারে জড়োয়ার ছায়াময় দ্যুতির মতো কালো আবরণ ভেদ করে ঠিকরে পড়ে তার রূপের আভা। কপালের নিচে অভাল শেইপের ছিদ্রপথে মহর্ঘ পাথরের মতো ঝিকমিক করে তার অনিমিখ দৃষ্টি। কার কেতাব, কোন কবির অনাবিল সৃষ্টি খরিদ করতে এসেছে সে—জানতে স্রেফ কৌতূহল হয়।
কাবুল শহরে বায়োজিদ বুকস খুঁজে পাওয়া কঠিন কিছু নয়। চিকেন স্ট্রিটের যেখানে নুরিস্তানের শিল্পশোভন নাজুক মালের দোকান, একটু খেয়াল করলেই যেখানে কাফেরি আমলের পৌত্তলিক মূর্তিরাজিকে সিনা চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়; এবং তার নিচে জরিমোড়া পয়জারগুলোর পাশে দলা করে রাখা কুহে-পামির পাহাড়ের নীল বর্ণের বৈদ্যুর্য মণি পাথর; ওখানে পয়লা দাঁড়িয়ে পড়ে ফুটপাতে নিরিখ করে তাকাতে হয়। দেয়ালে ঝুলছে একাধিক তুর্কমেনি কার্পেট, তাই ফুটপাতটি হয়ে আছে হরেক বর্ণে রংবহুল। পায়ে চলার বারিক-মুরিক পথের দুপাশে ডিসপ্লে করা তরতাজা সব চিত্রকর্ম। এখানে ছবিতে সম্রাট কণিষ্কের পাশে আমির আবদুর রহমান ও কালো চশমা পরা সরদার দাউদ খান। গুলিবিদ্ধ রাশান হেলিকপ্টারের পাশে নীল বোরকাপরা আফগান জেনানা, তার মাথায় পিঞ্জিরা—তাতে রাখা অচিন পাখি। মাঝেমধ্যে এক চিত্রকর ফ্লোরে বসে ব্রাশ হাতে ধুন্দুরমুন্দুর করে। এখানে সদ্য রং করা পেইনটিংয়ের সঙ্গে উষ্টাবিষ্টা না খাওয়ার জন্য হাঁটতে হয় হুঁশিয়ারির সঙ্গে।
কেতাব-ফুরুশির ভেতরবাগে চান্দোয়ায় ঢাকা কোর্ট-ইয়ার্ড। তার বাঁ-দিকের কামরায় শেলফগুলোতে সিজিল মিছিল করে রাখা লাহোর, ইস্পাহান বা হিরাত থেকে ছাপা বইপুস্তক। বিজুলির কানেকশন প্রায়ই কাটা পড়ে বলে আবদুল ওয়াসে ওসুলি কেতাব খুঁজনেওয়ালাদের শামাদানে মোম জ্বালিয়ে দিয়ে সাহায্য করে থাকেন। এখানে বইয়ের সিলেকশন বিচিত্র, কোনো কোনো কেতাবাদি পাঠের দিক থেকে যতটা না গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় তাদের মুদ্রণ ইতিহাসের জন্য। কিছু কিছু বই বহু পাঠকের বে-এখতেয়ার ব্যবহারে রীতিমতো ফর্দাফাই। ২০০৪ সালে আমি এখান থেকে আল্লামা ইকবাল লাহোরীর আসরারে খুদি কেতাবখানা ক্রয় করি। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল হিন্দুস্তানের রায়বেরিলি থেকে, তার প্রকাশকের নাম ও সালের জায়গা পোকায় কেটেছে নিখুঁতভাবে। ওই দিন এখানে বইয়ের সওদা করতে আসেন প্রফেসর জন বেইলি। এ সিনিয়র ইংরেজ অধ্যাপক বিলেতে কোথাও ওরিওন্টলজি পড়ান। পেশায় তিনি এথনোমিউজিকোলজিস্ট। তরুণ বয়সে বেইলি অনেক বছর হিরাতে কাটান প্রাচ্যের ফারসি সংগীতের তালাশে। তিনি দামদর করে ক্রয় করেন মিরাট থেকে ১৯১৮ সালে প্রকাশিত আদবিয়াতে ফারসির মশহুর শায়ের বেদিলের কখানা কেতাব। আবদুল ওয়াসে ওসুলি প্রফেসরকে তাঁর সিন্দুক থেকে বের করে দেখান বাদশাহ জহির শাহের সই করা হাসিয়ায় মিনিওতোর চিত্র আঁকা শাহনামা। কেতাবখানা তো আগ্র প্রসাদ লুণ্ঠনের স্পষ্ট নিশানাবিশেষ! এর কিম্মত অনেক, খরিদ করতে পারলে খারাপ হতো না, তবে তাতে বাদবাকি পুরো মাস-শুখা নান ও মুলার চাট জোটানোর জন্য জেবে অবশিষ্ট কিছু থাকত না।
পর্দার আবডালে আছে এ কেতাব-ফুরুশির অন্দরমহল। কাবুলে আমার জিগরি দোস্ত ডোয়াইট লয়েড আমাকে এ মহলের তালাশ দেয়। পর্দা গুটিয়ে গুটিগুটি পায়ে চাপলিশে ঢুকে পড়তে হয় আরেকটি বারিক-মুরিক করিডরে। এল শেইপের এ স্পেশে ডাঁই করে রাখা পুরোনো সব কিতাবাদি। এখানে চলাচল করতে পারেন কেবল একজন পড়নেওয়ালা। জেবে করে দেশলাই নিয়ে আসতে পারলে সুবিধা হয়। ফস্ করে কাঠি জ্বালিয়ে ধরানো যায় পিতলের পিলসুজ। কুপিটি দেখতে অনেকটা আলিফ লায়লার আলাদীনের চেরাগের মতো। তার পাশে চান্দির কাজ করা ক্যাশ-বাক্সের ওপর রাখা মরক্কো লেদারে বাঁধাই ঢাউস একখানা কেতাব। জরুরি এ পুস্তক কে লিখেছেন তা জানার কোনো উপায় নেই বটে, তবে তাতে ফিরোজে-হরিৎ ও ছরকে-লালে আঁকা তসবিরগুলো দেখে মনে হয় তা কামাসূত্রার উজবেকি ভার্সন। এ বইয়ের শেষ পাতায় আগ্র প্রাসাদের শাহি কেতাবখানার মোহরের ছাপ আছে। যারা কামে উদ্যম-রহিত হালতে আছেন, অথবা স্রেফ অন্তরঙ্গ কর্মে অপটু—এ কেতাবের তসবির দর্শনে তাদের কামিয়াব হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমার জিগরি দোস্ত ডোয়াইট লয়েড এখানে হামেশা আসে ধ্রুপদি রুশ কেতাবাদির তালাশে। কাবুলে সোভিয়েত অকুপেশনের সময় কিংবা তারও অনেক আগ থেকে এ শহরের বাস করছেন হাজার বিজার রুশ এক্সপার্ট, গোয়েন্দা ও ডিপ্লোমেট। পুশকিন, গোগোল বা লারমানতভের ক্ল্যাসিকগুলো সম্ভবত তাঁদের চাকর-নফররা চাপলিশে সের দরে বিক্রি করে দিয়েছেন। ডোয়াইটের পরামিশ মোতাবেক আমি একবার কেতাব-ফুরুশির অন্দরের তলকুটুরি অবধি গিয়েছিলাম। স্থানটি দস্যু মোহনের গোপন আস্তানার মতো। কাঠের আলমারির দুয়ার খুলে তার ভেতরে ঢুকে তারপর নেমে যেতে হয় ক্যাচমেচানো সিঁড়ি ধরে রীতিমতো পাতালে। পড়নেওয়ালাদের পকেটে করে পেনসিল টর্চ নিয়ে যাওয়ার কোনো জরুরত নেই। আবদুল ওয়াসে ওসুলি নিজে সরবরাহ করেন পাঁচ ব্যাটারির টর্চ; এ ছাড়া কফিনের মতো দেখতে সিন্দুকের ওপর রাখা আছে চার্জার ল্যাম্প।
ডোয়াইট লয়েড কাবুলি পেইনটিংয়ের উমেদার। আমি তার অছিলা ধরে তলকুঠুরিতে আসার মওকা পাই একদিন। সে বছর তিনেক আগের কথা। ওসুলি চার্জার জ্বেলে মেলে ধরেন সিন্দুকের ঢালা। তা থেকে বেরোয় সেলোফোনে মোড়া এক রাশ পেইনটিং। অত্যন্ত রিয়ালিস্টিক ভঙ্গিতে আঁকা পেইনটিংয়ে ধ্রুপদি মিনিওতোর চিত্রের দৃশ্যপট ব্লোআপ করা। বিষয়বস্তুতে ঘুরে-ফিরে আসে বাগিচা ও রাজদরবার। এসব ছবিতে চমৎকার করে সৃজিত হয়েছে বৃক্ষ, বর্ণিল পুষ্প,কাফেলার রেখা, রংচঙে ফরাস, স্বর্ণালি কুরছি, পানপাত্র ও সোরাই—যা নেই তা হচ্ছে জনজীবন-চাষাবাদ, গবাধিপশু, সংসার, ঘরকন্না, শিশু, মসজিদ ও এবাদত। সে রকম করে মানুষের ছবিও এখানে অনুপস্থিত; তবে শিল্পী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এঁকেছেন মানবী। নারীরা গোপন সিন্দুকের ছবিতে প্রায় সবাই কিশোরী, এবং কেউ কেউ যুবতী হতে হতে পুষ্পের বিকশিত পাপড়িতে সাজিয়েছেন দেহের পসরা। চিত্রকর কারও চোখে এঁকে দিয়েছেন শরমের অঞ্জন, কেউ কেউ কটাক্ষে ইশারাপ্রবণ। তাদের পরিপূর্ণ ওষ্ঠে শৃঙ্গারের অস্থির প্রয়াস। শিল্পী এদের শরীর আব্রুতে ঢাকার তেমন জরুরত বোধ করেননি। বরং তাদের স্তনযুগলের ডৌল বা নিতম্বের বঙ্কিমতাকে উর্বর বাগিচায় ফলন্ত আশ্চর্য মেওয়ার মতো বৃত্তাকার করে এঁকেছেন। নারীদের কারও কারও দেহে জড়ানো আবেরেশমের গোলাপি-পার্পোল বা ফিরোজা রঙের ট্রান্সপারেন্ট ওড়না, তার আলো-ছায়ায় বৃদ্ধি পেয়েছে তাদের ঊরুদেশের বর্ণিল মসৃণতা। এবং তাদের দেহ-সম্পদ রঙে ও রেখায় বিবর্তিত হয়েছে শিল্পশোভন দ্রষ্টব্যে। খরিদদার হিসেবে ডোয়াইট বিস্তর সময় নিয়ে তাড়া তাড়া পেইনটিং থেকে বাছাই করে চমকপ্রদ কটি নমুনা। এ সুযোগে ওসুলি আমাকে দেখান ঘোড়ার পিঠে ক্যারি করার কটি স্যাডেল ব্যাগ বলে পরিচিত বস্তা। ছালার মুখ খুলে অতঃপর তিনি বের করে আনেন এ আত্রাফে সরকারি ফরমানে নিষিদ্ধ কখানা কিতাব। আমি তাঁর কাছ থেকে এক তালেবান কারাবন্দীর লেখা একখানা বই খরিদ করি। বন্দী গুয়ানতানামো বে কারাগারের কথা লিখেছেন। এ বইটি কোথাও মুদ্রিত হয়নি, টাইপ করে বিতরণের জন্য ফটোকপি করা হয়েছে। আমি যখন বইটি কেনার জন্য দামদর করছি তখন আমাদের মাথার ওপর টর্চের আলোয় বিরক্ত হয়ে ওড়ে একটি কম বয়সী কছমা বাদুড়।
সে বছর তিনেক আগের কথা। আমাকে বায়োজিদ বুকসে পয়লা নিয়ে আসেন নরওয়ের এক ভ্রাম্যমাণ লেখিকা অ্যাসনে সিয়ারস্টেড। মিস অ্যাসনে তখন কাবুলের এক বই বিক্রেতা সুলতান খানের বাড়িতে তাঁর পরিবারের সঙ্গে বাস করছেন। তিনি এর আগে চেচনিয়া ও বলকানে সাংবাদিকতা করেছেন। তার পরও কাবুলে তথ্য সংগ্রহ ও লেখালেখির কাজ করা তাঁর কাছে ঠুলি পরা বলদের ঘানি টানার মতোই ক্লান্তিকর মনে হতো। মাঝেমধ্যে কাবুলি পরিবারের পর্দানশিন বাস্তবতা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তিনি চলে আসতেন বায়োজিদ বুকসে। কোর্ট-ইয়ার্ডে এ মুহূর্তে আমি যেখানে বসে সবুজ চা খাচ্ছি, তার পাশের চেয়ারের হাতায় বোরকা রেখেই বসতে বসতে ফস করে ধরাতেন মার্লবরো সিগারেট। তিনি থার্মসে করে নিয়ে আসতেন কলম্বিয়ার তাজা কফি। চারদিকে ফুটন্ত ক্যাফিনের সৌরভ ছড়িয়ে তাঁর অবজারভেশনের নোটস লিখতেন কাঠপেনসিলে। পরে তিনি বুক সেলার অব কাবুল বইটি লিখলেন, বইখানার তরজমা বেরোলো নানা ভাষায়; তিনিও মশহুর হলেন তামাম দুনিয়ায়। তার পর থেকে তাঁকে কিন্তু আর কখনো কাবুলের বায়োজিদ বুকসে দেখা যায়নি। শোনা যায়, তার একাধিক স্ত্রীর জিন্দেগির নানাবিধ বন্দেগি তাঁর গ্রন্থে চাউর করে দিয়ে মিস অ্যাসনে কেতাব বিক্রেতা সুলতান খানের জানি দুশমন বনেছেন। খান তক্কে তক্কে আছেন মওকা পেলে বদলা নেওয়ার ।
হালফিল কাবুল শহর ক্রমাগত খতরনাক হয়ে উঠছে। আজকাল আর বায়োজিদ বুকসে উল্লেখযোগ্য কোনো লেখকের পা পড়ে না। তবে আমরা যারা আবর্জনা বাদাছাদা কিসিমের মানুষ, উইকেন্ডে এর চেয়ে বেহতর কোথাও যাওয়ার মুরদ নেই, আমরা এখনো বায়োজিদ বুকসে আসি, পুরোনো বইপত্রের পাতা ঘাঁটি, নিরলে বসে পান করি পেয়ালা তিনেক সবুজ চা। আজ আমি আমার জিগরি দোস্ত ডোয়াইট লয়েডের ইন্তেজারিতে আছি। এ কোর্ট-ইয়ার্ডের দেয়ালে ঝোলানো জলরং ও তেলের কিছু কাজ। কোনো কোনো চিত্রে সবুজে বেগুনি লোহিত ডোরাকাটা চাপান পরা আফগানরা ঘোড়া ছুটিয়ে ছাগলের মৃতদেহ নিয়ে খেলছে বুঝকাশি। আবার জলরঙের কাজে কুচি গোত্রের নেকাবহীন নারীরা মণিমানিক্য মরকতের মতো বর্ণাঢ্য গারেরা পরে নহর থেকে ভরে নিচ্ছে পানীয় জল।
একটি আফগান পরিবার এসে ডাঁই করে রাখা তাড়া তাড়া পেইনটিং ঘাঁটে। তারা যুগপৎ দারি ও জার্মান ভাষায় কথা বলে। মনে হয় মিউনিখে বাসরত এ পরিবার অনেক বছর পর কাবুলে ফিরে এসেছে। তাদের মেয়েটি বয়সে সে নিতান্ত কিশোরী, আলগা হেজাবের নিচে পরে আছে হিপহ্যাগার জিনস ও স্লিভলেস টপ। বায়োজিদ বুকসের বাঁধা চিত্রকর ওবায়েদ উল্লাহ আসকরী ইজেলে আঁকছিল এক সফেদ শ্মশ্রু বুড়া বুজুর্গের তসবির। সে উঠে মেয়েটির পোর্ট্রেট এঁকে দেওয়ার জন্য অ্যাপ্রোচ করে। ওয়ায়েদ উল্লাহ বয়স আন্দাজ করা মুশকিল। তার বাটকুল কিসিমের দেহে অনেক দিন হলো থির হয়ে আছে গ্রোথ। ছবি আঁকিয়ে এ ছেলেটি অত্যন্ত পোলাইট, কিন্তু তার চোখের দিকে তাকানো যায় না। কথাবার্তায় আমি যা জেনেছি তা হলো, গেলবারের মার্কিনি বোমাবাজির সময় ওবায়েদ উল্লাহ ছাদে খেলছিল। ঝোপঝাড়ে যাতে তালেবানরা অ্যামবুশ করতে না পারে, সে জন্য জঙ্গিবিমান থেকে ছড়ানো হয় বৃক্ষ-বিধ্বংসী বিষাক্ত কেমিক্যালস। তিফিল বালক ওবায়েদ খেলতে খেলতে কপালে হাত দিয়ে আসমানে জঙ্গি বিমানের উড্ডয়ন দেখছিল। হালকা কুয়াশার মতো কিছু নেমে এসে ভিজে হলুদ আভায় ঢেকে দেয় তার মুখমণ্ডল। শুরু হয় চোখে জ্বালাপোড়া প্রদাহ। তার জননী পাশের বুনোহাঁস ভাসা পুকুর থেকে জল এনে বারবার চোখ ধুইয়ে দিলেও ফায়দা কিছু হয়নি। সারা রাত ওবায়েদের কান্নাকাটিতে ঘুম হয় না সংসারের কারও। পরদিন তরতাজা মাছ ও হাঁসের মৃতদেহে ভরে ওঠে জলাশয়। তার চোখে ইনফেকশন হয়। মাস তিনেক পর তা সেরে উঠলেও তার চোখের শেইপে আসে পার্মানেন্ট বিকৃতি।
ওবায়েদ উল্লাহর আঁকাজোঁকার হাত কিন্তু খারাপ না। তার তাৎক্ষিকভাবে স্কেচে প্রাণের খামতি কিছু নেই। আমি খোঁজখবর নিয়েও ঠিক বুঝতে পারিনি ছেলেটি এতিম কি না? ছবি আঁকার কাজ সে শিখল কোথায়? এ মুহূর্তে ওবায়েদ উল্লাহ ইজেলের সামনে বসিয়ে মিউনিখ থেকে আসা আফগান মেয়েটির পোর্ট্রেট করে দিচ্ছে। টুলে বসা মেয়েটি দাড়ে রাখা টিয়া পাখির চেয়েও অস্থির। সে মুঠোফোন টিপে, কবজিতে চুলের ব্যান্ড জড়িয়ে চুয়িংগামের র্যাপার খুঁটে খুব তৎপর হয়ে আছে। তাকে স্কেচ করতে ওবায়েদের বোধ করি অসুবিধা হয়। সে থেকে থেকে আঁকা বন্ধ করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটির নড়াচড়ায় ছেদ পড়ার জন্য অপেক্ষা করে পেনসিলের গোড়ালি দিয়ে তার দাঁতে ঠুক ঠুক করে বাড়ি মারে।
চা-পান শেষ হলে আমি কেতাব ফুরুশির আরেকটি কামরায় ইরান থেকে আমদানি করা হাফিজ, সাদি, জামি ও খৈয়ামের নতুন সংস্করণের বইগুলো দেখি। বরাত জোরে ফিরে আসে বিজুলি। তার আলোয় দাঁড়িয়ে কালো বোরকাপরা এক আফগান দুহিতা। সিন্দুকের অন্ধকারে জড়োয়ার ছায়াময় দ্যুতির মতো কালো আবরণ ভেদ করে ঠিকরে পড়ে তার রূপের আভা। কপালের নিচে অভাল শেইপের ছিদ্রপথে মহর্ঘ পাথরের মতো ঝিকমিক করে তার অনিমিখ দৃষ্টি। কার কেতাব, কোন কবির অনাবিল সৃষ্টি খরিদ করতে এসেছে সে—জানতে স্রেফ কৌতূহল হয়।
No comments