সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় by লায়েকুজ্জামান ও কাফি কামাল
সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় গাজীপুরের ১০ লাখ ভোটার। ভোটের মাঠে টান টান উত্তেজনা। আছে চাপা আতঙ্ক। রণপ্রস্তুতিতে দুই পক্ষ।
চার
সিটিতে হারের পর গাজীপুরে জয় পেতে মরিয়া সরকারি দল। আর জয়ের ধারাবাহিকতা
রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা বিরোধী জোটের। গতকাল মধ্যরাত থেকে শেষ হয়েছে সব ধরনের
প্রচার-প্রচারণা। এতদিন যেসব নেতা মাঠ কাঁপিয়েছেন তারা গাজীপুর ছেড়েছেন
গতকালই। নিস্তব্ধ গাজীপুরবাসীর সামনে সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে
প্রথম ভোট দেয়ার অভিজ্ঞতার অপেক্ষা। এই ভোটে নির্বাচিত হবেন প্রথম নগরপিতা।
তাই নির্বাচন এই এলাকার ভোটারদের কাছে বড় একটি উৎসবে। একই সঙ্গে জাতীয়
নির্বাচনের আগে প্রধান দুই জোটের জনপ্রিয়তা পরীক্ষার এই যুদ্ধের ফল দেখতে
উন্মুখ সারা দেশ। কি হচ্ছে গাজীপুরে। কি হবে গাজীপুরে। সারা দেশের উৎসুক
মানুষের এমন জিজ্ঞাসার জবাব পেতে অপেক্ষা করতে হবে আর একটি দিন। আগামীকাল
বিকালেই নির্ধারণ হয়ে যাবে ভাওয়ালের অধিপতি হচ্ছেন কে। হাইভোল্টেজ এ
নির্বাচনকে সামনে রেখে দুই পক্ষের অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগের শেষ নেই। দুই
পক্ষের পাল্টাপাল্টিতে চরম উৎকণ্ঠা ভোটারদের মাঝেও। দুই পক্ষের মরিয়া
চেষ্টায় সাধারণ ভোটাররাও উদ্বিগ্ন। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে সুষ্ঠুভাবে
নির্বাচন সম্পন্ন করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয়
প্রশাসন। ১০ লাখ ২৬ হাজার ভোটারের ৩৯ বর্গকিলোমিটার এলাকার গাজীপুর সিটি
কর্পোরেশনে ভোটের দিন সামাল দিতে থাকছে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয়।
দু’পক্ষেরই ‘রণপ্রস্তুতি’
দু’পক্ষেরই রণপ্রস্তুতি গাজীপুরে। সর্বাত্মক তোড়জোড় প্রশাসনে। কাল ভোটযুদ্ধ। প্রস্তুত দুই শিবির। প্রস্তুতির সব আয়োজন শেষ। শেষ হয়েছে প্রচার-প্রচারণা। বহিরাগতরা ছেড়ে গেছেন নির্বাচনী এলাকা। ভোটের আগে গাজীপুরের আসল চিত্রটা দেখা যাবে আজ। তবে প্রচার-প্রচারণা থেমে গেলেই কৌশলে দু’পক্ষ শেষ সময়ের প্রস্তুতি শানিয়ে নেবে আজ। চলবে প্রচার-প্রচারণাও। তবে তা যার যার কৌশলে। নির্বাচনী এলাকার বাইরে থেকেও নির্বাচন পর্যবেক্ষণে রাজনৈতিক দলের সেল করা হয়েছে। ভোটের দিনে অনাকাঙিক্ষত পরিস্থিতিরও আশঙ্কা করছেন সাধারণ ভোটারদের। গতকাল দিনভর ভোটযুদ্ধের কৌশল নিয়ে বৈঠকের পর বৈঠক করেছেন দু’দলের কৌশলীরা। কিভাবে ভোট টানা যায়? কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় পরিস্থিতি। বৈঠকের আলোচনার বিষয় ছিল এসব। গতকাল সারা দিন সিটি করপোরেশন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে পুরো প্রস্তুতি নিয়ে আছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দু’দলই। ভোটে হেরফের হলে সংঘাতের আশঙ্কাও আছে নির্বাচনী এলাকায়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ভোট হবে শান্তিপূর্ণ। বিএনপির কর্মীরা ভোট কেন্দ্রে ঝামেলা করতে পারে এমন কথাও বলা হচ্ছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি বললেন, আওয়ামী লীগের ভোট কারচুপির ইতিহাস নেই। আওয়ামী লীগের শক্তি জনগণ। বর্তমান সরকার আমলে অনেক স্থানীয় ও জাতীয় সংসদের বেশ কয়েকটি আসনের উপনির্বাচন হয়েছে তার নিরপেক্ষতা নিয়ে বিএনপি প্রশ্ন তুলতে পারেনি। অন্যদিকে গতকাল দুপুরে গাজীপুর চৌরাস্তায় এম এ মান্নানের নির্বাচনী ক্যাম্পে বসে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগ ভোট কারচুপির পরিকল্পনা করছে। গাজীপুরে ভোটের গায়ে হাত দিলে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে। নির্বাচনে কোন প্রকার কারচুপি হলে পোলিং ও প্রিজাইডিং অফিসারসহ ভোট গ্রহণের সঙ্গে জড়িতদের গাজীপুরের সীমানা পার হতে দেয়া হবে না। ফলাফল ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত নারী-পুরুষদের নিয়ে ভোট কেন্দ্র ঘেরাও করে রাখা হবে।
বহিরাগতরা কেউ আছেন, কেউ ছেড়েছেন: গতকাল মধ্যরাত থেকে বহিরাগতদের গাজীপুর ত্যাগের কথা বলা হলেও সে সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে মনে করছেন এলাকাবাসী। এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যেই অতিথি পরিচয়ে বহু বহিরাগত যুবক এলাকায় অবস্থান নিয়েছে। এছাড়াও ভিআইপি কিছু সরকারি-বেসরকারি রেস্ট হাউসগুলোতেও অবস্থান নিয়ে আছেন অনেকে। সূত্রমতে, সিটি করপোরেশন এলাকা লাগোয়া উত্তরা, কালীগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি গ্রামে অবস্থান নিয়ে আছেন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা। একটি সূত্রে জানা গেছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন লাগোয়া রাজধানীর উত্তরার হোটেল ও রেস্ট হাউসগুলোতে ভোটের একদিন আগেই অবস্থান নিয়েছেন সরকারি দলের লোকেরা।
বিএনপির অভিযোগ গোপালগঞ্জের পুলিশ: গতকাল দুপুরে গাজীপুর চৌরাস্তায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এম এ মান্নানের নির্বাচনী ক্যাম্প মিডিয়া কর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপি নেতা ফজলুল হক মিলন অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থী আজমত উল্লাকে জিতিয়ে আনতে পরিকল্পনা সাজিয়েছে। ওই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা নির্বাচনের দিনের দায়িত্ব পালন করতে তাদের অনুগত গোপালগঞ্জের পুলিশকে বেছে বেছে দায়িত্ব দিয়েছে। ফজলুল হক মিলন নির্বাচনের দিনে দায়িত্ব পাওয়া ১০ জন এসআইর কথা উল্লেখ করে বলেন তাদের বাড়ি গোপালগঞ্জে। নির্বাচনে কারচুপি করতেই তাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
পর্যবেক্ষক কার্ড নিয়ে নানা কথা: পর্যবেক্ষক কার্ড নিয়ে নানা কথা শোনা যাচ্ছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায়। সূত্রমতে, পর্যবেক্ষক কার্ড নিয়ে নির্বাচনের দিনে সিটি করপোরেশন এলাকায় ঢুকে পড়তে পারে রাজনৈতিক দলের ক্যাডাররা। সূত্রটি জানিয়েছে, ইতিমধ্যেই কয়েকটি পর্যবেক্ষক সংস্থাকে ম্যানেজ করে বেশ কিছু কার্ড নিয়েছে একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীরা। অতীতে ওইসব পর্যবেক্ষক সংস্থার বেশ কয়েকটির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলের কাছে কার্ড বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। অতীতে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ দেখা গেছে। একজন বিএনপি নেতা বলেন, এটা সরকারি দলের লোকদের পক্ষে সম্ভব হতে পারে বিরোধী দলে থাকলে কেউ এগিয়ে এসে কার্ড দেয়ার সাহস পায় না।
উত্তরা বৈঠক নিয়ে আলোচনা গাজীপুরে: গতকাল গাজীপুরজুড়ে আলোচনা ছিল উত্তরা বৈঠক। সূত্রমতে গতকাল দুপুর থেকে সরকারি দলের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন নেতা, তাদের মধ্যে দু’জন মন্ত্রী বৈঠক করেছেন উত্তরার একটি রেস্ট হাউসে। বিকালের দিকে ওই বৈঠকে যোগ দেন গাজীপুরের কয়েকজন নেতা। উত্তরার ওই বৈঠকের কথা প্রচার হওয়ার পর ব্যাপক আলোচনা শুরু হয় গাজীপুরে।
ভোট পাহারার আড়ালে: সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন মহল্লায় এবং টঙ্গীর ১০টি ও গাজীপুরের ছোট-বড় ১১টি বস্তির ভোটের কেনাবেচা ঠেকাতে পাহারা বসিয়েছেন ওই এলাকার কমিশনার প্রার্থীরা। প্রতিটি কমিশনার তার নিয়ন্ত্রণে থাকা বস্তিতে লোক দিয়ে পাহারা বসিয়েছেন। মহল্লাগুলোতেও একই ভাবে পাহারা দিচ্ছে কমিশনার প্রার্থীরা। তারা কেউ আওয়ামী লীগের, কেউ বিএনপির। ভোট পাহারার নামে যুবকদের মহড়া চলছে। সাধারণ ভোটাররা বলছে এটা আসলে ভোট পাহারার নামে সরকার ও বিরোধী দলের সন্ত্রাসীদের শোডাউন। সাধারণ ভোটারদের মাঝে ভয় ধরিয়ে দেয়ার জন্যই এটা করা হচ্ছে।
গাজীপুরে অস্ত্র উদ্ধার হয়নি: অতীতে দেখা গেছে সিটি করপোরেশন নির্বাচন সমানে রেখে ওই এলাকায় অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও চিহ্নিত সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার অভিযান পরিচালিত হয়েছে। গাজীপুরে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এখানে কোন অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান হয়নি, গ্রেপ্তার হয়নি কোন চিহ্নিত সন্ত্রাসী। সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার না হওয়ায় সাধারণ মানুষের মাঝে শঙ্কা রয়েই গেছে। অনেক ভোটারই চিন্তা করছে ভোটের দিন পার করতে পারলেও পরে অনাকাঙিক্ষত ঘটনা ঘটতে পারে।
গাজীপুর সন্ত্রস্ত
প্রচার-অপপ্রচার ও আতঙ্ক-আশঙ্কায় গাজীপুর এখন সন্ত্রস্ত। মেয়র প্রার্থীদের চরিত্র হনন করে ছড়ানো হচ্ছে লিফলেট। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশেষ প্রার্থীর পক্ষে অনুষ্ঠিত হয়েছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাধিক বৈঠক। ঢেলে সাজানো হয়েছে প্রশাসনকে। নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গে প্রতিযোগিতা করেছেন সরকার দলীয় নেতারা। গতকালও রাজবাড়ী সড়কে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে বিশাল মিছিল করেছে আওয়ামী লীগ। উভয় প্রার্থীর তরফেই আসছে ভোটারদের মধ্যে টাকা বিতরণের অভিযোগ। শেষ মুহূর্তে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে এনবিআর। সরকার সমর্থিত প্রার্থী তার প্রচারণায় মূল অস্ত্র বানিয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর অতীতের দুর্নীতিকে। জিএসপি বাতিলে বিএনপি’র ভূমিকা নিয়েও সমানে প্রচারণা চালানো হচ্ছে এ শিল্পাঞ্চল শহরে। কিছু প্রচারণা নিশ্চিত করতে গণমাধ্যমকর্র্মীদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করছে বিশেষ সংস্থার লোকজন। ভোটকেন্দ্রে নৈরাজ্য, ফলাফল পাল্টে দেয়ার আশঙ্কায় ভুগছেন প্রফেসর মান্নানের সমর্থকরা। একই আশঙ্কা নগরবাসীর মধ্যেও। কিন্তু নানা বঞ্চনায় ক্ষুব্ধ গাজীপুরবাসী উন্নয়নের স্বার্থেই পরিবর্তন দেখতে চায় বলেই মনে করেন মান্নান সমর্থকরা। স্থানীয় ইস্যুর পাশাপাশি জাতীয় ইস্যুতেও তারা প্রতিবাদ করতে চান ব্যালটের মাধ্যমে। প্রত্যাশা একটাই- শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। তবে প্রশাসনিক নানামুখী প্রতিকূলতায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী ভোটারদের পাশাপাশি পাচ্ছেন প্রকৃতির সমর্থনও। এদিকে চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের নিরঙ্কুশ বিজয়ে নড়েচড়ে বসা আওয়ামী লীগ বেপরোয়াভাবে দাবড়ে বেড়িয়েছে প্রচারণার মাঠ। কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি গাজীপুরে জড়ো করেছিল সরকারদলীয় অর্ধশতাধিক এমপিকেও। কিন্তু ভোটারদের পক্ষ থেকে কাঙিক্ষত সাড়া না পেয়ে চালিয়েছে একের পর এক কৌশল। নির্বাচনের মাত্র চারদিন আগে সরকার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে এনবিআরকে। তারা হঠাৎ করেই জব্দ করেছে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এমএ মান্নানের ব্যাংক আকাউন্ট। এমনকি মান্নানকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হতে পারে বলেও প্রচারণা চালিয়েছে গাজীপুরে। সার্বিক পরিস্থিতিতে প্রধান দুই প্রার্থী এমএ মান্নান ও আজমত উল্লা খানের নির্ভরতা এখন দুই জায়গায়। বিএনপি সমর্থিত প্রফেসর মান্নান নির্ভর করছেন নীরব ভোটার ও গণমাধ্যমের ওপর। অন্যদিকে আজমতের নির্ভরতা পুরোটাই দলীয় নেতা ও প্রশাসনের ওপর। কারণ একের পর এক রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনের সমর্থন পাচ্ছেন মান্নান। ইতিমধ্যে জাতীয় পার্টি, জামায়াত, হেফাজতে ইসলামসহ গাজীপুরে কর্মরত দেশের বিভিন্ন জেলার লোকজনের প্রতিনিধিত্বকারী সমিতি তার প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন দিয়েছেন। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ নিচ্ছেন প্রচারণার মাঠেও। সার্বিকভাবে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতাদের আন্তরিক ও সুসংগঠিত প্রচারণা হয়েছে মান্নানের পক্ষে। অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে একা হয়ে পড়েছেন আজমত। শেষ পর্যন্ত এরশাদের মন গলাতে পারলেও বাস্তব সমর্থন মেলেনি স্থানীয় জাতীয় পার্টির। জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি ব্রিগেডিয়ার (অব.) কাজী মাহমুদ হাসান ও সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, জেলের ভয়ভীতি দেখিয়ে চেয়ারম্যানের সমর্থন আদায় করলেও তৃণমূল নেতাকর্মীরা সেটা মানবেন না। আমরা ১৮দলীয় প্রার্থীর পক্ষেই গণসংযোগ করছি। হেফাজতের সমর্থনের কথা প্রচার করা হলেও আজমত উল্লাহ খানের সঙ্গে প্রচারণায় নামা হেফাজতের মাওলানা কেরামত উল্লাহ বুলবুলি আসলে তার বাড়ির মসজিদের ইমাম। ১৪ দলের প্রার্থী হলেও তিনি প্রচারণার মাঠে পাননি জোটের শরিক দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের। সবচেয়ে বড় বিষয়টি হচ্ছে তিনি মাঠে সক্রিয় করতে পারেননি নিজদলের অনেক তৃণমূল কর্মীকে। জাহাঙ্গীর আলমকে জোর করে নিমরাজি করাতে পারলেও তার কর্মীরা মাঠেই নামেনি। অবমূল্যায়নের বেদনায় বিগত জাতীয় নির্বাচনে মাঠ দাবড়ে বেড়ানো কর্মীরাও ছিলেন দূরে দূরে। স্বাভাবিকভাবেই প্রচারণায় অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছেন আজমত উল্লা খান। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমানে চরিত্র হনন চলছে গাজীপুরে। কয়েকদিন আগে প্রথমে মান্নানের চরিত্র হনন করে একটি লিফলেট ছড়ানো হয় আজমতের পক্ষে। দু’দিনের মাথায় পাল্টা লিফলেট ছড়ায় মান্নান সমর্থকরা। সেই সঙ্গে টঙ্গী পৌরসভার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হাসানউদ্দিন সরকার আগামীতে আজমত উল্লা খানের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশের ঘোষণা দেন। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিন গতকাল বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকাকে কলঙ্কিত করে আরেকটি লিফলেট ছড়ানো হয়েছে আজমতের পক্ষে। এছাড়া আজমত সমর্থকরা শিল্পাঞ্চল শহর গাজীপুরে জিএসপি সুবিধা বাতিলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভূমিকা নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে কয়েকদিন ধরে। পরস্পরবিরোধী এমন অপপ্রচারের গুজবে ভাসছে গাজীপুর। এসব অপপ্রচার সচেতন ভোটারদের মধ্যে তেমন প্রভাব ফেলতে না পারলেও সাধারণ ভোটারদের কিছুটা বিভ্রান্ত করছে। ওদিকে নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী প্রচারণায় অংশ নেয়া আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র কেন্দ্রীয় ও বহিরাগত নেতারা বুধবার রাত ১২টার মধ্যে গাজীপুর ছাড়ার কথা থাকলেও ছাত্রলীগ-ছাত্রদল ও যুবলীগ-যুবদল অনেকেই অবস্থান করছেন গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায়। এছাড়া গাজীপুর সিটি করপোরেশন গঠিত হয়েছে জেলার ৪টি সংসদীয় আসন নিয়ে। ফলে চারজন এমপিই অবস্থান করছেন এলাকায়। ওদিকে জেলা পরিষদ রেস্ট হাউজ ‘ডাহুক’-এ একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার মনিটরিং সেল খোলা, নির্বাচনী দায়িত্ব পাওয়া বিশেষ অঞ্চলের ১৬ জন ওসি নির্বাচনের দিন তারা নানাভাবে প্রভাব খাটাতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন মান্নান সমর্থকরা। মান্নান সমর্থকদের অভিযোগ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গাজীপুরে অবস্থান করছেন সরকার দলীয় কিছু চিহ্নিত সন্ত্রাসী। প্রশাসন তাদের গ্রেপ্তারের কোন পদক্ষেপ না নিলেও নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন বিএনপি’র কর্মী-সমর্থকদের। মান্নানের একজন পোলিং এজেন্টসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে বেশ কয়েকজনকে। এছাড়া শ্রমিক পল্লীগুলোতে সরকারদলীয় নেতারা মহড়া দিচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, তারা শ্রমিকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে বলছেন- দোয়াত-কলম মার্কায় ভোট না দিলে কেন্দ্রে যাওয়ার দরকার নেই। কথা না শুনলে এলাকায় থাকতে দেয়া হবে না। কিন্তু শ্রমিকরা ভুলতে পারছেন না সাভার ট্র্যাজেডি। রানা প্লাজা ও তাজরীন গার্মেন্টেসের মর্মস্পর্শী ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও সরকারের ভূমিকা। এছাড়া বর্তমান সরকারের আমলে গাজীপুরে শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনায় প্রশাসনের দমন-পীড়ন। টঙ্গী, সালনা, ভোগড়া, এরশাদনগরসহ শ্রমিক পল্লীতে ঘুরে তাদের এ মনোভাব জানা গেছে। ওদিকে বর্ষাকাল হওয়ায় প্রতিদিনই নামছে বৃষ্টি। জলাবদ্ধতা ও কাদায় ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন মানুষ। সমালোচনায় মুখর হচ্ছেন সরকারের বিরুদ্ধে। অভিযোগের তীরবিদ্ধ হচ্ছেন গাজীপুর ও টঙ্গীর দুই বিদায়ী মেয়র মোজাম্মেল হক, আজমত উল্লা খান। যেন বৃষ্টি ঝরছে না, আজমতের সমালোচনা ঝরছে। ভোগড়ার সাইয়েদুল ইসলাম বলেন, আর প্রতারিত হতে চাই না। এবার বুঝে-শুনেই ভোট দেবো। এমন পরিস্থিতিতে উন্নয়নের স্বার্থেই এবার পরিবর্তন দেখতে চাইছে গাজীপুরবাসী। স্বাধীনতার পর থেকেই আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত গাজীপুর পৌরসভায় টানা ২২ বছর মেয়র ছিলেন আকম মোজাম্মেল হক। বর্তমানে তিনি সদর আসনের এমপি এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থীর প্রধান নির্বাচন সমন্বয়ক। অন্যদিকে টঙ্গী পৌরসভায় ১৮ বছর টানা মেয়র ছিলেন বর্তমান মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খান। টঙ্গী আসনের দীর্ঘ সময়ের এমপিও আওয়ামী লীগের। কিন্তু এ শিল্পাঞ্চল শহরের কাঙিক্ষত উন্নয়ন ঘটেনি তাদের হাত ধরে। কিন্তু বিএনপি সরকারে থাকাকালে গাজীপুরের বড় কোন উন্নয়নের দৃষ্টান্তও দেখাতে পারছেন না মান্নান সমর্থকরা। এছাড়া দীর্ঘসময় এমএ মান্নানকে গাজীপুরবাসী সুখে-দুঃখে পাশে না পাওয়ার কথাও আলোচনায় আসছে। কয়েকদিন গাজীপুর ও টঙ্গী নানা এলাকার সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উন্নয়নের স্বার্থেই তারা এবার প্রতিনিধি নির্বাচিত করবেন।
শেষ দিনে ৫৫৯ প্রার্থীর প্রচারণায় মুখরিত গাজীপুর
প্রচারণার শেষ দিনে গতকাল ৫৯৯ প্রার্থীর পদভারে মুখরিত ছিল গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকা। মিছিলে-মিটিংয়ে স্লোগান আর শোডাউনে সয়লাব ছিল পুরো এলাকা। গতকালের দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে ভাওয়াল রাজ্যে ভোট উৎসবের বান ডেকেছে। ৭ মেয়র প্রার্থী সহ ১২৬ জন সংরক্ষিত আসনের নারী প্রার্থী এবং ৪৪৬ জন সাধারণ কমিশনার প্রার্থীদের সকলেই মাঠে ছিলেন গতকাল। রাত ১২টা পর্যন্ত সদলবলে প্রচারণা চালিয়েছেন সকলে। গতকাল দিনের অর্ধেক ভাগ জুড়ে ছিল মুষলধারায় বৃষ্টি। প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন প্রার্থীরা। ভোট চেয়েছেন, দোয়া চেয়েছেন। মুরব্বিদের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছেন। কোন কোন প্রার্থী অতীতের ক্রিয়াকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। মেয়র প্রার্থী ৭ জন হলেও বাস্তবে মাঠে আছেন ২ জন। ১৪ দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খান এবং ১৮ দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থী অধ্যাপক এমএ মান্নান। বাকি ৫ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে জাহাঙ্গীর আলম নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেও তার প্রতীক থাকছে ব্যালটে। অন্য তিন মেয়র প্রার্থী হচ্ছেন, আমানউল্লাহ (তালা), মেজবাউদ্দিন সরকার রুবেল (হাঁস), রিনা সুলতানা এবং নাজিমউদ্দিন (ঘোড়া)।
মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে অধ্যাপক এমএ মান্নান এবং আজমত উল্লা বাদে অন্য কোন মেয়র প্রার্থীকে মাঠে দেখা যায়নি। গতকাল ভোর থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত টানা প্রচারণা চালিয়েছেন অধ্যাপক এমএ মান্নান এবং আজমত উল্লা খান। ভোরবেলা এমএ মান্নান নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন তার নিজ এলাকা থেকে। দুপুরের পরে আসেন টঙ্গীতে। অন্যদিকে আজমত উল্লা সকালে প্রচারণা শুরু করেন টঙ্গী এলাকা থেকে, দুপুরের পরে প্রচারণা চালান গাজীপুরের কাউলতিয়া এলাকায়। গতকালও উভয় প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণা চালাতে এসেছিলেন প্রায় অর্ধশত কেন্দ্রীয় নেতা। সংরক্ষিত আসনের নারী কমিশনার প্রার্থী এবং সাধারণ আসনের কমিশনার প্রার্থীরা গতকাল তাদের এলাকা মুখরিত করে রাখে মিছিলে মিছিলে নানা ধরনের স্লোগানে। মাইকের আওয়াজে এক অন্যরকম শহর ছিল গাজীপুর, টঙ্গী।
টঙ্গী-গাজীপুরে ঘুরছে অর্ধশত সন্ত্রাসী
টঙ্গী ও গাজীপুরে প্রকাশ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে অর্ধশত তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। নির্বাচনের আগে তাদের এলাকায় দেখে শঙ্কা বাড়ছে সাধারণ ভোটারদের। সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে জানা গেছে কোন কোন মহল্লায় কমিশনার ও মেয়র প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিচ্ছে ওই সন্ত্রাসীরা। নির্বাচনের আগে গাজীপুরে কোন অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান হয়নি, গ্রেপ্তার হয়নি কোন সন্ত্রাসীও। পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সন্ত্রাসীরা এলাকা নেই। নির্বাচনে তারা কোন প্রভাব ফেলতে পারবে না। কিনু্ত জয়দেব এলাকা থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেখানকার অনেক তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীই এখন ভোটের মাঠে। জয়দেবপুর থানা পুলিশের তালিকায় দেখা যায়, সেখানের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী আব্বা, আনোয়ার, শিহাব সরকার, মনির খান, নুরুল ইসলাম বাচ্চু, জসিম, আবদুল করিম, গেদু, টিটো, মেসু কামাল তোফায়েল, দেলু আছে প্রকাশ্যে। এছাড়া গাজীপুর ও টঙ্গী এলাকার বিভিন্ন মামলার আসামি। দাগী চিহ্নিত সন্ত্রাসী ১০ থেকে ১৫টি মামলার আসামি গোয়েন্দা তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীরাও আছে বাইরে। নির্বাচনের দিনে ভোট কেন্দ্রে আতঙ্ক হতে পারে তারা। গোয়েন্দা তালিকায় আছে দীপু, সেলিম। খলিল হত্যা মামলার আসামি হুমায়ন, কামালসহ তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ইস্রাফিল, সোহেল রানা, শফি, হালিম, মাহিন, আবদুল আলী, জোড়া জহির, অলিউল্লা, হারুন, গোজা আলিম, মুরগী তুষার, খোকন সুমন আলামিন। ওই সকল তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার হয়নি। নির্বাচনে তারা প্রভাব বিস্তার করতে পারে বলে আশঙ্কা আছে ভোটারদের মাঝে। যদিও গাজীপুরের পুলিশ সুপার আবদুল বাতেন বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে এরা কেউ এলাকাতে নেই। তাদের পক্ষে ভোট কেন্দ্রে প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব নয়।
গাজীপুরে নির্বাচনের পরিবেশ ইতিবাচক: সিইসি
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পরিবেশ ইতিবাচক বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ। গতকাল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দু’দফা সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ মন্তব্য করেন। সিইসি বলেন, গাজীপুর সিটি নির্বাচন একটি বড় নির্বাচন। এটি গভীর পর্যবেক্ষণীয় নির্বাচন। আমরাও পর্যবেক্ষণ করছি। তবে এখন পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কোন শঙ্কা নেই। নির্বাচনে সার্বিক পরিবেশ পজিটিভ রয়েছে। বিএনপির অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক দল থাকে। তারা প্রার্থীদের সমর্থন দিচ্ছে। এজন্য তাদের কথাও শুনতে হচ্ছে। তবে গড়পড়তা অভিযোগ হলে কোন অ্যাকশন নেয়া সম্ভব নয়। সুনির্দিষ্ট হলেই কেবল ব্যবস্থা নেয়া হবে। এরপরও রিটার্নিং কর্মকর্তাকে অভিযোগের সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিএনপির সেনা মোতায়েনের দাবির বিষয়ে তিনি জানান, স্থানীয় পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত খোঁজ নেয়া হচ্ছে। ভোটের দিন পর্যাপ্ত সংখ্যক নিরাপত্তারক্ষী নিয়োজিত থাকবে। আমরা সতর্ক। যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত আছি। ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে এসে ভোট দিতে পারে এজন্য সকল ব্যবস্থা নেয়া হবে।
দু’পক্ষেরই ‘রণপ্রস্তুতি’
দু’পক্ষেরই রণপ্রস্তুতি গাজীপুরে। সর্বাত্মক তোড়জোড় প্রশাসনে। কাল ভোটযুদ্ধ। প্রস্তুত দুই শিবির। প্রস্তুতির সব আয়োজন শেষ। শেষ হয়েছে প্রচার-প্রচারণা। বহিরাগতরা ছেড়ে গেছেন নির্বাচনী এলাকা। ভোটের আগে গাজীপুরের আসল চিত্রটা দেখা যাবে আজ। তবে প্রচার-প্রচারণা থেমে গেলেই কৌশলে দু’পক্ষ শেষ সময়ের প্রস্তুতি শানিয়ে নেবে আজ। চলবে প্রচার-প্রচারণাও। তবে তা যার যার কৌশলে। নির্বাচনী এলাকার বাইরে থেকেও নির্বাচন পর্যবেক্ষণে রাজনৈতিক দলের সেল করা হয়েছে। ভোটের দিনে অনাকাঙিক্ষত পরিস্থিতিরও আশঙ্কা করছেন সাধারণ ভোটারদের। গতকাল দিনভর ভোটযুদ্ধের কৌশল নিয়ে বৈঠকের পর বৈঠক করেছেন দু’দলের কৌশলীরা। কিভাবে ভোট টানা যায়? কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় পরিস্থিতি। বৈঠকের আলোচনার বিষয় ছিল এসব। গতকাল সারা দিন সিটি করপোরেশন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে পুরো প্রস্তুতি নিয়ে আছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দু’দলই। ভোটে হেরফের হলে সংঘাতের আশঙ্কাও আছে নির্বাচনী এলাকায়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ভোট হবে শান্তিপূর্ণ। বিএনপির কর্মীরা ভোট কেন্দ্রে ঝামেলা করতে পারে এমন কথাও বলা হচ্ছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি বললেন, আওয়ামী লীগের ভোট কারচুপির ইতিহাস নেই। আওয়ামী লীগের শক্তি জনগণ। বর্তমান সরকার আমলে অনেক স্থানীয় ও জাতীয় সংসদের বেশ কয়েকটি আসনের উপনির্বাচন হয়েছে তার নিরপেক্ষতা নিয়ে বিএনপি প্রশ্ন তুলতে পারেনি। অন্যদিকে গতকাল দুপুরে গাজীপুর চৌরাস্তায় এম এ মান্নানের নির্বাচনী ক্যাম্পে বসে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগ ভোট কারচুপির পরিকল্পনা করছে। গাজীপুরে ভোটের গায়ে হাত দিলে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে। নির্বাচনে কোন প্রকার কারচুপি হলে পোলিং ও প্রিজাইডিং অফিসারসহ ভোট গ্রহণের সঙ্গে জড়িতদের গাজীপুরের সীমানা পার হতে দেয়া হবে না। ফলাফল ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত নারী-পুরুষদের নিয়ে ভোট কেন্দ্র ঘেরাও করে রাখা হবে।
বহিরাগতরা কেউ আছেন, কেউ ছেড়েছেন: গতকাল মধ্যরাত থেকে বহিরাগতদের গাজীপুর ত্যাগের কথা বলা হলেও সে সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে মনে করছেন এলাকাবাসী। এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যেই অতিথি পরিচয়ে বহু বহিরাগত যুবক এলাকায় অবস্থান নিয়েছে। এছাড়াও ভিআইপি কিছু সরকারি-বেসরকারি রেস্ট হাউসগুলোতেও অবস্থান নিয়ে আছেন অনেকে। সূত্রমতে, সিটি করপোরেশন এলাকা লাগোয়া উত্তরা, কালীগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি গ্রামে অবস্থান নিয়ে আছেন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা। একটি সূত্রে জানা গেছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন লাগোয়া রাজধানীর উত্তরার হোটেল ও রেস্ট হাউসগুলোতে ভোটের একদিন আগেই অবস্থান নিয়েছেন সরকারি দলের লোকেরা।
বিএনপির অভিযোগ গোপালগঞ্জের পুলিশ: গতকাল দুপুরে গাজীপুর চৌরাস্তায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এম এ মান্নানের নির্বাচনী ক্যাম্প মিডিয়া কর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপি নেতা ফজলুল হক মিলন অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থী আজমত উল্লাকে জিতিয়ে আনতে পরিকল্পনা সাজিয়েছে। ওই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা নির্বাচনের দিনের দায়িত্ব পালন করতে তাদের অনুগত গোপালগঞ্জের পুলিশকে বেছে বেছে দায়িত্ব দিয়েছে। ফজলুল হক মিলন নির্বাচনের দিনে দায়িত্ব পাওয়া ১০ জন এসআইর কথা উল্লেখ করে বলেন তাদের বাড়ি গোপালগঞ্জে। নির্বাচনে কারচুপি করতেই তাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
পর্যবেক্ষক কার্ড নিয়ে নানা কথা: পর্যবেক্ষক কার্ড নিয়ে নানা কথা শোনা যাচ্ছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায়। সূত্রমতে, পর্যবেক্ষক কার্ড নিয়ে নির্বাচনের দিনে সিটি করপোরেশন এলাকায় ঢুকে পড়তে পারে রাজনৈতিক দলের ক্যাডাররা। সূত্রটি জানিয়েছে, ইতিমধ্যেই কয়েকটি পর্যবেক্ষক সংস্থাকে ম্যানেজ করে বেশ কিছু কার্ড নিয়েছে একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীরা। অতীতে ওইসব পর্যবেক্ষক সংস্থার বেশ কয়েকটির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলের কাছে কার্ড বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। অতীতে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ দেখা গেছে। একজন বিএনপি নেতা বলেন, এটা সরকারি দলের লোকদের পক্ষে সম্ভব হতে পারে বিরোধী দলে থাকলে কেউ এগিয়ে এসে কার্ড দেয়ার সাহস পায় না।
উত্তরা বৈঠক নিয়ে আলোচনা গাজীপুরে: গতকাল গাজীপুরজুড়ে আলোচনা ছিল উত্তরা বৈঠক। সূত্রমতে গতকাল দুপুর থেকে সরকারি দলের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন নেতা, তাদের মধ্যে দু’জন মন্ত্রী বৈঠক করেছেন উত্তরার একটি রেস্ট হাউসে। বিকালের দিকে ওই বৈঠকে যোগ দেন গাজীপুরের কয়েকজন নেতা। উত্তরার ওই বৈঠকের কথা প্রচার হওয়ার পর ব্যাপক আলোচনা শুরু হয় গাজীপুরে।
ভোট পাহারার আড়ালে: সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন মহল্লায় এবং টঙ্গীর ১০টি ও গাজীপুরের ছোট-বড় ১১টি বস্তির ভোটের কেনাবেচা ঠেকাতে পাহারা বসিয়েছেন ওই এলাকার কমিশনার প্রার্থীরা। প্রতিটি কমিশনার তার নিয়ন্ত্রণে থাকা বস্তিতে লোক দিয়ে পাহারা বসিয়েছেন। মহল্লাগুলোতেও একই ভাবে পাহারা দিচ্ছে কমিশনার প্রার্থীরা। তারা কেউ আওয়ামী লীগের, কেউ বিএনপির। ভোট পাহারার নামে যুবকদের মহড়া চলছে। সাধারণ ভোটাররা বলছে এটা আসলে ভোট পাহারার নামে সরকার ও বিরোধী দলের সন্ত্রাসীদের শোডাউন। সাধারণ ভোটারদের মাঝে ভয় ধরিয়ে দেয়ার জন্যই এটা করা হচ্ছে।
গাজীপুরে অস্ত্র উদ্ধার হয়নি: অতীতে দেখা গেছে সিটি করপোরেশন নির্বাচন সমানে রেখে ওই এলাকায় অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও চিহ্নিত সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার অভিযান পরিচালিত হয়েছে। গাজীপুরে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এখানে কোন অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান হয়নি, গ্রেপ্তার হয়নি কোন চিহ্নিত সন্ত্রাসী। সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার না হওয়ায় সাধারণ মানুষের মাঝে শঙ্কা রয়েই গেছে। অনেক ভোটারই চিন্তা করছে ভোটের দিন পার করতে পারলেও পরে অনাকাঙিক্ষত ঘটনা ঘটতে পারে।
গাজীপুর সন্ত্রস্ত
প্রচার-অপপ্রচার ও আতঙ্ক-আশঙ্কায় গাজীপুর এখন সন্ত্রস্ত। মেয়র প্রার্থীদের চরিত্র হনন করে ছড়ানো হচ্ছে লিফলেট। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশেষ প্রার্থীর পক্ষে অনুষ্ঠিত হয়েছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাধিক বৈঠক। ঢেলে সাজানো হয়েছে প্রশাসনকে। নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গে প্রতিযোগিতা করেছেন সরকার দলীয় নেতারা। গতকালও রাজবাড়ী সড়কে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে বিশাল মিছিল করেছে আওয়ামী লীগ। উভয় প্রার্থীর তরফেই আসছে ভোটারদের মধ্যে টাকা বিতরণের অভিযোগ। শেষ মুহূর্তে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে এনবিআর। সরকার সমর্থিত প্রার্থী তার প্রচারণায় মূল অস্ত্র বানিয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর অতীতের দুর্নীতিকে। জিএসপি বাতিলে বিএনপি’র ভূমিকা নিয়েও সমানে প্রচারণা চালানো হচ্ছে এ শিল্পাঞ্চল শহরে। কিছু প্রচারণা নিশ্চিত করতে গণমাধ্যমকর্র্মীদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করছে বিশেষ সংস্থার লোকজন। ভোটকেন্দ্রে নৈরাজ্য, ফলাফল পাল্টে দেয়ার আশঙ্কায় ভুগছেন প্রফেসর মান্নানের সমর্থকরা। একই আশঙ্কা নগরবাসীর মধ্যেও। কিন্তু নানা বঞ্চনায় ক্ষুব্ধ গাজীপুরবাসী উন্নয়নের স্বার্থেই পরিবর্তন দেখতে চায় বলেই মনে করেন মান্নান সমর্থকরা। স্থানীয় ইস্যুর পাশাপাশি জাতীয় ইস্যুতেও তারা প্রতিবাদ করতে চান ব্যালটের মাধ্যমে। প্রত্যাশা একটাই- শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। তবে প্রশাসনিক নানামুখী প্রতিকূলতায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী ভোটারদের পাশাপাশি পাচ্ছেন প্রকৃতির সমর্থনও। এদিকে চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের নিরঙ্কুশ বিজয়ে নড়েচড়ে বসা আওয়ামী লীগ বেপরোয়াভাবে দাবড়ে বেড়িয়েছে প্রচারণার মাঠ। কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি গাজীপুরে জড়ো করেছিল সরকারদলীয় অর্ধশতাধিক এমপিকেও। কিন্তু ভোটারদের পক্ষ থেকে কাঙিক্ষত সাড়া না পেয়ে চালিয়েছে একের পর এক কৌশল। নির্বাচনের মাত্র চারদিন আগে সরকার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে এনবিআরকে। তারা হঠাৎ করেই জব্দ করেছে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এমএ মান্নানের ব্যাংক আকাউন্ট। এমনকি মান্নানকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হতে পারে বলেও প্রচারণা চালিয়েছে গাজীপুরে। সার্বিক পরিস্থিতিতে প্রধান দুই প্রার্থী এমএ মান্নান ও আজমত উল্লা খানের নির্ভরতা এখন দুই জায়গায়। বিএনপি সমর্থিত প্রফেসর মান্নান নির্ভর করছেন নীরব ভোটার ও গণমাধ্যমের ওপর। অন্যদিকে আজমতের নির্ভরতা পুরোটাই দলীয় নেতা ও প্রশাসনের ওপর। কারণ একের পর এক রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনের সমর্থন পাচ্ছেন মান্নান। ইতিমধ্যে জাতীয় পার্টি, জামায়াত, হেফাজতে ইসলামসহ গাজীপুরে কর্মরত দেশের বিভিন্ন জেলার লোকজনের প্রতিনিধিত্বকারী সমিতি তার প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন দিয়েছেন। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ নিচ্ছেন প্রচারণার মাঠেও। সার্বিকভাবে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতাদের আন্তরিক ও সুসংগঠিত প্রচারণা হয়েছে মান্নানের পক্ষে। অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে একা হয়ে পড়েছেন আজমত। শেষ পর্যন্ত এরশাদের মন গলাতে পারলেও বাস্তব সমর্থন মেলেনি স্থানীয় জাতীয় পার্টির। জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি ব্রিগেডিয়ার (অব.) কাজী মাহমুদ হাসান ও সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, জেলের ভয়ভীতি দেখিয়ে চেয়ারম্যানের সমর্থন আদায় করলেও তৃণমূল নেতাকর্মীরা সেটা মানবেন না। আমরা ১৮দলীয় প্রার্থীর পক্ষেই গণসংযোগ করছি। হেফাজতের সমর্থনের কথা প্রচার করা হলেও আজমত উল্লাহ খানের সঙ্গে প্রচারণায় নামা হেফাজতের মাওলানা কেরামত উল্লাহ বুলবুলি আসলে তার বাড়ির মসজিদের ইমাম। ১৪ দলের প্রার্থী হলেও তিনি প্রচারণার মাঠে পাননি জোটের শরিক দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের। সবচেয়ে বড় বিষয়টি হচ্ছে তিনি মাঠে সক্রিয় করতে পারেননি নিজদলের অনেক তৃণমূল কর্মীকে। জাহাঙ্গীর আলমকে জোর করে নিমরাজি করাতে পারলেও তার কর্মীরা মাঠেই নামেনি। অবমূল্যায়নের বেদনায় বিগত জাতীয় নির্বাচনে মাঠ দাবড়ে বেড়ানো কর্মীরাও ছিলেন দূরে দূরে। স্বাভাবিকভাবেই প্রচারণায় অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছেন আজমত উল্লা খান। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমানে চরিত্র হনন চলছে গাজীপুরে। কয়েকদিন আগে প্রথমে মান্নানের চরিত্র হনন করে একটি লিফলেট ছড়ানো হয় আজমতের পক্ষে। দু’দিনের মাথায় পাল্টা লিফলেট ছড়ায় মান্নান সমর্থকরা। সেই সঙ্গে টঙ্গী পৌরসভার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হাসানউদ্দিন সরকার আগামীতে আজমত উল্লা খানের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশের ঘোষণা দেন। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিন গতকাল বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকাকে কলঙ্কিত করে আরেকটি লিফলেট ছড়ানো হয়েছে আজমতের পক্ষে। এছাড়া আজমত সমর্থকরা শিল্পাঞ্চল শহর গাজীপুরে জিএসপি সুবিধা বাতিলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভূমিকা নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে কয়েকদিন ধরে। পরস্পরবিরোধী এমন অপপ্রচারের গুজবে ভাসছে গাজীপুর। এসব অপপ্রচার সচেতন ভোটারদের মধ্যে তেমন প্রভাব ফেলতে না পারলেও সাধারণ ভোটারদের কিছুটা বিভ্রান্ত করছে। ওদিকে নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী প্রচারণায় অংশ নেয়া আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র কেন্দ্রীয় ও বহিরাগত নেতারা বুধবার রাত ১২টার মধ্যে গাজীপুর ছাড়ার কথা থাকলেও ছাত্রলীগ-ছাত্রদল ও যুবলীগ-যুবদল অনেকেই অবস্থান করছেন গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায়। এছাড়া গাজীপুর সিটি করপোরেশন গঠিত হয়েছে জেলার ৪টি সংসদীয় আসন নিয়ে। ফলে চারজন এমপিই অবস্থান করছেন এলাকায়। ওদিকে জেলা পরিষদ রেস্ট হাউজ ‘ডাহুক’-এ একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার মনিটরিং সেল খোলা, নির্বাচনী দায়িত্ব পাওয়া বিশেষ অঞ্চলের ১৬ জন ওসি নির্বাচনের দিন তারা নানাভাবে প্রভাব খাটাতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন মান্নান সমর্থকরা। মান্নান সমর্থকদের অভিযোগ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গাজীপুরে অবস্থান করছেন সরকার দলীয় কিছু চিহ্নিত সন্ত্রাসী। প্রশাসন তাদের গ্রেপ্তারের কোন পদক্ষেপ না নিলেও নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন বিএনপি’র কর্মী-সমর্থকদের। মান্নানের একজন পোলিং এজেন্টসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে বেশ কয়েকজনকে। এছাড়া শ্রমিক পল্লীগুলোতে সরকারদলীয় নেতারা মহড়া দিচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, তারা শ্রমিকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে বলছেন- দোয়াত-কলম মার্কায় ভোট না দিলে কেন্দ্রে যাওয়ার দরকার নেই। কথা না শুনলে এলাকায় থাকতে দেয়া হবে না। কিন্তু শ্রমিকরা ভুলতে পারছেন না সাভার ট্র্যাজেডি। রানা প্লাজা ও তাজরীন গার্মেন্টেসের মর্মস্পর্শী ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও সরকারের ভূমিকা। এছাড়া বর্তমান সরকারের আমলে গাজীপুরে শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনায় প্রশাসনের দমন-পীড়ন। টঙ্গী, সালনা, ভোগড়া, এরশাদনগরসহ শ্রমিক পল্লীতে ঘুরে তাদের এ মনোভাব জানা গেছে। ওদিকে বর্ষাকাল হওয়ায় প্রতিদিনই নামছে বৃষ্টি। জলাবদ্ধতা ও কাদায় ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন মানুষ। সমালোচনায় মুখর হচ্ছেন সরকারের বিরুদ্ধে। অভিযোগের তীরবিদ্ধ হচ্ছেন গাজীপুর ও টঙ্গীর দুই বিদায়ী মেয়র মোজাম্মেল হক, আজমত উল্লা খান। যেন বৃষ্টি ঝরছে না, আজমতের সমালোচনা ঝরছে। ভোগড়ার সাইয়েদুল ইসলাম বলেন, আর প্রতারিত হতে চাই না। এবার বুঝে-শুনেই ভোট দেবো। এমন পরিস্থিতিতে উন্নয়নের স্বার্থেই এবার পরিবর্তন দেখতে চাইছে গাজীপুরবাসী। স্বাধীনতার পর থেকেই আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত গাজীপুর পৌরসভায় টানা ২২ বছর মেয়র ছিলেন আকম মোজাম্মেল হক। বর্তমানে তিনি সদর আসনের এমপি এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থীর প্রধান নির্বাচন সমন্বয়ক। অন্যদিকে টঙ্গী পৌরসভায় ১৮ বছর টানা মেয়র ছিলেন বর্তমান মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খান। টঙ্গী আসনের দীর্ঘ সময়ের এমপিও আওয়ামী লীগের। কিন্তু এ শিল্পাঞ্চল শহরের কাঙিক্ষত উন্নয়ন ঘটেনি তাদের হাত ধরে। কিন্তু বিএনপি সরকারে থাকাকালে গাজীপুরের বড় কোন উন্নয়নের দৃষ্টান্তও দেখাতে পারছেন না মান্নান সমর্থকরা। এছাড়া দীর্ঘসময় এমএ মান্নানকে গাজীপুরবাসী সুখে-দুঃখে পাশে না পাওয়ার কথাও আলোচনায় আসছে। কয়েকদিন গাজীপুর ও টঙ্গী নানা এলাকার সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উন্নয়নের স্বার্থেই তারা এবার প্রতিনিধি নির্বাচিত করবেন।
শেষ দিনে ৫৫৯ প্রার্থীর প্রচারণায় মুখরিত গাজীপুর
প্রচারণার শেষ দিনে গতকাল ৫৯৯ প্রার্থীর পদভারে মুখরিত ছিল গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকা। মিছিলে-মিটিংয়ে স্লোগান আর শোডাউনে সয়লাব ছিল পুরো এলাকা। গতকালের দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে ভাওয়াল রাজ্যে ভোট উৎসবের বান ডেকেছে। ৭ মেয়র প্রার্থী সহ ১২৬ জন সংরক্ষিত আসনের নারী প্রার্থী এবং ৪৪৬ জন সাধারণ কমিশনার প্রার্থীদের সকলেই মাঠে ছিলেন গতকাল। রাত ১২টা পর্যন্ত সদলবলে প্রচারণা চালিয়েছেন সকলে। গতকাল দিনের অর্ধেক ভাগ জুড়ে ছিল মুষলধারায় বৃষ্টি। প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন প্রার্থীরা। ভোট চেয়েছেন, দোয়া চেয়েছেন। মুরব্বিদের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছেন। কোন কোন প্রার্থী অতীতের ক্রিয়াকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। মেয়র প্রার্থী ৭ জন হলেও বাস্তবে মাঠে আছেন ২ জন। ১৪ দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খান এবং ১৮ দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থী অধ্যাপক এমএ মান্নান। বাকি ৫ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে জাহাঙ্গীর আলম নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেও তার প্রতীক থাকছে ব্যালটে। অন্য তিন মেয়র প্রার্থী হচ্ছেন, আমানউল্লাহ (তালা), মেজবাউদ্দিন সরকার রুবেল (হাঁস), রিনা সুলতানা এবং নাজিমউদ্দিন (ঘোড়া)।
মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে অধ্যাপক এমএ মান্নান এবং আজমত উল্লা বাদে অন্য কোন মেয়র প্রার্থীকে মাঠে দেখা যায়নি। গতকাল ভোর থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত টানা প্রচারণা চালিয়েছেন অধ্যাপক এমএ মান্নান এবং আজমত উল্লা খান। ভোরবেলা এমএ মান্নান নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন তার নিজ এলাকা থেকে। দুপুরের পরে আসেন টঙ্গীতে। অন্যদিকে আজমত উল্লা সকালে প্রচারণা শুরু করেন টঙ্গী এলাকা থেকে, দুপুরের পরে প্রচারণা চালান গাজীপুরের কাউলতিয়া এলাকায়। গতকালও উভয় প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণা চালাতে এসেছিলেন প্রায় অর্ধশত কেন্দ্রীয় নেতা। সংরক্ষিত আসনের নারী কমিশনার প্রার্থী এবং সাধারণ আসনের কমিশনার প্রার্থীরা গতকাল তাদের এলাকা মুখরিত করে রাখে মিছিলে মিছিলে নানা ধরনের স্লোগানে। মাইকের আওয়াজে এক অন্যরকম শহর ছিল গাজীপুর, টঙ্গী।
টঙ্গী-গাজীপুরে ঘুরছে অর্ধশত সন্ত্রাসী
টঙ্গী ও গাজীপুরে প্রকাশ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে অর্ধশত তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। নির্বাচনের আগে তাদের এলাকায় দেখে শঙ্কা বাড়ছে সাধারণ ভোটারদের। সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে জানা গেছে কোন কোন মহল্লায় কমিশনার ও মেয়র প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিচ্ছে ওই সন্ত্রাসীরা। নির্বাচনের আগে গাজীপুরে কোন অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান হয়নি, গ্রেপ্তার হয়নি কোন সন্ত্রাসীও। পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সন্ত্রাসীরা এলাকা নেই। নির্বাচনে তারা কোন প্রভাব ফেলতে পারবে না। কিনু্ত জয়দেব এলাকা থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেখানকার অনেক তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীই এখন ভোটের মাঠে। জয়দেবপুর থানা পুলিশের তালিকায় দেখা যায়, সেখানের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী আব্বা, আনোয়ার, শিহাব সরকার, মনির খান, নুরুল ইসলাম বাচ্চু, জসিম, আবদুল করিম, গেদু, টিটো, মেসু কামাল তোফায়েল, দেলু আছে প্রকাশ্যে। এছাড়া গাজীপুর ও টঙ্গী এলাকার বিভিন্ন মামলার আসামি। দাগী চিহ্নিত সন্ত্রাসী ১০ থেকে ১৫টি মামলার আসামি গোয়েন্দা তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীরাও আছে বাইরে। নির্বাচনের দিনে ভোট কেন্দ্রে আতঙ্ক হতে পারে তারা। গোয়েন্দা তালিকায় আছে দীপু, সেলিম। খলিল হত্যা মামলার আসামি হুমায়ন, কামালসহ তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ইস্রাফিল, সোহেল রানা, শফি, হালিম, মাহিন, আবদুল আলী, জোড়া জহির, অলিউল্লা, হারুন, গোজা আলিম, মুরগী তুষার, খোকন সুমন আলামিন। ওই সকল তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার হয়নি। নির্বাচনে তারা প্রভাব বিস্তার করতে পারে বলে আশঙ্কা আছে ভোটারদের মাঝে। যদিও গাজীপুরের পুলিশ সুপার আবদুল বাতেন বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে এরা কেউ এলাকাতে নেই। তাদের পক্ষে ভোট কেন্দ্রে প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব নয়।
গাজীপুরে নির্বাচনের পরিবেশ ইতিবাচক: সিইসি
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পরিবেশ ইতিবাচক বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ। গতকাল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দু’দফা সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ মন্তব্য করেন। সিইসি বলেন, গাজীপুর সিটি নির্বাচন একটি বড় নির্বাচন। এটি গভীর পর্যবেক্ষণীয় নির্বাচন। আমরাও পর্যবেক্ষণ করছি। তবে এখন পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কোন শঙ্কা নেই। নির্বাচনে সার্বিক পরিবেশ পজিটিভ রয়েছে। বিএনপির অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক দল থাকে। তারা প্রার্থীদের সমর্থন দিচ্ছে। এজন্য তাদের কথাও শুনতে হচ্ছে। তবে গড়পড়তা অভিযোগ হলে কোন অ্যাকশন নেয়া সম্ভব নয়। সুনির্দিষ্ট হলেই কেবল ব্যবস্থা নেয়া হবে। এরপরও রিটার্নিং কর্মকর্তাকে অভিযোগের সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিএনপির সেনা মোতায়েনের দাবির বিষয়ে তিনি জানান, স্থানীয় পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত খোঁজ নেয়া হচ্ছে। ভোটের দিন পর্যাপ্ত সংখ্যক নিরাপত্তারক্ষী নিয়োজিত থাকবে। আমরা সতর্ক। যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত আছি। ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে এসে ভোট দিতে পারে এজন্য সকল ব্যবস্থা নেয়া হবে।
No comments