অর্থনীতি-চীন-মার্কিন অর্থনৈতিক সম্পর্ক পরস্পর নির্ভরতার by আবু এন. এম. ওয়াহিদ

আজকাল টেলিভিশন দেখা বলতে গেলে ছেড়েই দিয়েছি। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো সংবাদ না থাকলে সপ্তাহে একদিন (প্রতি রোববার দুপুরে আমেরিকার কেন্দ্রীয় সময় ১২টা-১টা পর্যন্ত) মাত্র এক ঘণ্টা সিএনএনে ফরিদ জাকারিয়ার টক শো 'জিপিএস' অর্থাৎ 'গ্গ্নোবাল পাবলিক স্কয়ার' দেখে থাকি।

এ টক শোতে সাম্প্রতিক বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনার জন্য ফরিদ অনেক নামিদামি ও জ্ঞানী-গুণী লোক নিয়ে আসেন। তারা নিজ নিজ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর মূল্যবান বক্তব্য রাখেন, আলোচনা করেন, তর্ক-বিতর্ক করেন। দর্শক-শ্রোতারা এ থেকে অনেক কিছু শেখেন, অনেক কিছু জানেন, অনেক উপকৃত হন। এ টক শোর কোনো এক ফাঁকে ফরিদ একটি নাতিদীর্ঘ ব্যক্তিগত বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্যও হয় জ্ঞানগর্ভ, সাজানো-গোছানো এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। একেকদিন তিনি একেক বিষয়ের ওপর কথা বলেন। আগস্ট মাসের দ্বিতীয় রোববারের 'জিপিএসে' ফরিদের বক্তব্যের বিষয়বস্তু ছিল চীন-মার্কিন অর্থনৈতিক সম্পর্ক।
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণসীমা বাড়ানো নিয়ে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান পার্টিদ্বয় এক মারাত্মক নোংরা রাজনৈতিক খেলায় মেতে ওঠে। অনেক দিন ধরে বিভিন্ন জাতের দরকষাকষি ও টানাহেঁচড়ার পর অবশেষে দুই দল এক আপস রফায় রাজি হতে বাধ্য হয়। এর ভিত্তিতে ঋণসীমা বাড়ানো হয়। শর্ত থাকে যে, কোম্পানি বা ব্যক্তি কোনো খাতেই আয়কর বাড়ানো যাবে না এবং ২০১২ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এ নিয়ে আর কোনো নতুন বিতর্কও তোলা যাবে না। কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের সংখ্যা ও গলার জোরের কারণে শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ওবামা বড়লোকদের প্রতি বুশের আমলের দেওয়া দু'দুটি কর রেয়াতির একটিও বাতিল করতে পারেননি। ধনীদের ওপর কর না বাড়িয়ে কেবল সরকারের খরচ কমানোর প্রতিশ্রুতি ওয়াল স্ট্রিট এবং বিশ্ব পুঁজিবাজার খুব একটা ভালো চোখে দেখেনি। ফলে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন অর্থ প্রতিষ্ঠান 'স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস' মার্কিন ফেডারেল গভর্নমেন্টের ক্রেডিট রেটিং 'ট্রিপল এ' থেকে একধাপ কমিয়ে 'ডাবল এ পল্গাস' করে দিয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়ার সর্বত্র পুঁজিবাজারে দেখা দিয়েছে টালমাটাল অবস্থা। এখনও চলছে এর জের।
এই ঢেউ সেটেল করতে আরও কয়েক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তবে এর সঙ্গে ইতিমধ্যে নেতিবাচক অন্য কোনো উপসর্গ যোগ হলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা মুহূর্তের মধ্যে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সে যাই হোক, ইতিমধ্যে চীনের সরকার, ব্যবসায়ী এবং জনগণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অবিরাম করুণা বর্ষণ করে যাচ্ছেন। তাদের মতে, আমেরিকান অর্থনীতি বুঝি এখনই ডুবতে বসেছে। আর তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে করুণা করে ঋণ দিয়ে কোনো মতে ভাসিয়ে রেখেছেন। এ প্রসঙ্গে ফরিদ জাকারিয়া যা বলেছেন আজকের এ কলামের মাধ্যমে আমি সংক্ষেপে তা আমার পাঠক-পাঠিকাদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই।
বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ঋণ ১৪ লাখ কোটি ডলারের কিছু ওপরে। তার মধ্যে মাত্র ১ লাখ ১১ হাজার ৬শ' কোটি ডলারের ঋণ চীনের কাছে। বাকি ঋণের বেশিরভাগই আমেরিকান কোম্পানি এবং জনগণ থেকে ধার করা। অর্থাৎ আমেরিকান সরকার ঋণ করেছে আমেরিকানদের কাছ থেকেই। ঘরের সম্পদ ঘরেই আছে। চীনের কাছে আমেরিকার যে ঋণ তাতে দেখা যায় গড়ে প্রতিটি চীনা নাগরিক আমেরিকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পায় আনুমানিক ৯শ' ডলার। আর এ ঋণের সুদ বাবদ প্রতি সেকেন্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে দিচ্ছে ৮শ' ডলারের কিছু বেশি। আমেরিকার সরকারি বন্ড অর্থাৎ ট্রেজারি বিল কিনে চীন কি আমেরিকাকে একতরফা সুবিধা দিচ্ছে, নাকি আমেরিকা চীন থেকে ঋণ নিয়ে এবং চীনের জিনিস কিনে চীনকে একতরফা সুবিধা দিচ্ছে, নাকি দু'জনই দু'জনের ওপর সমানভাবে নির্ভরশীল? এ প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর খুঁজে বের করাই বর্তমান নিবন্ধের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
প্রথমত দেখা যাক 'স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস' কর্তৃক মার্কিন ফেডারেল গভর্নমেন্টের ক্রেডিট রেটিং ডাউনগ্রেড করার ফলে কী হয়েছে? বিশ্ব পুঁজিবাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে সত্যি, কিন্তু ঋণ বাজারে মার্কিন ট্রেজারি বিলের চাহিদায় কোনো দুর্বলতা বা কমতি দেখা যাচ্ছে না। তার মানে, বড় বড় বিনিয়োগকারীর সামনে মার্কিন ট্রেজারি বিল ছাড়া বিনিয়োগের জন্য ভালো কোনো বিকল্প নেই। অন্যদের বেলা যতটুকু চীনের বেলা এটা আরও বেশি সত্য। কারণ চীনের অর্থনৈতিক উন্নতি ও প্রবৃদ্ধি হলো পুরোপুরি রফতানি-নির্ভর। প্রতি বছর রফতানি থেকে প্রাপ্ত বিশাল অঙ্কের টাকা দিয়ে চীন যদি আমেরিকান ট্রেজারি বিল না কেনে তা হলে ওই টাকা দিয়ে তারা কী করতে পারে? এটা দিয়ে তারা জাপানি সরকারের ঋণ কিনতে পারে। কিন্তু সেটা তারা করবে না। কারণ চীনের সঙ্গে জাপানের রাজনৈতিক সম্পর্ক বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারণে অনেক দিন থেকেই ভালো নয়। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কোনো ট্রেজারি বিল বিক্রি করে না। তা হলে রফতানি থেকে অর্জিত এত বিরাট অঙ্কের টাকা চীন কী করতে পারে? সম্ভবত তারা ইউরো মুদ্রা কিনে রাখতে পারে। এমনিতে চীনের যথেষ্ট ইউরো রিজার্ভ আছে। এ খাতে পোর্টফলিও আরও বাড়ানো অর্থনৈতিকভাবে খুব একটা ঝুঁকিমুক্ত নয়। ৬ মাস আগেও বিশ্ববাজারে ইউরোর যে অবস্থান ছিল এখন সেটা আরও দুর্বল। কারও কারও মতে, হার্ড কারেন্সি হিসেবে ইউরো আরও ১৫ বছর টিকবে কিনা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এ অবস্থায় চীন তার উদ্বৃত্ত টাকা দিয়ে মার্কিন ট্রেজারি বিল না কিনলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজারে চীনা ইউয়ানের মূল্য বেড়ে যাবে। ফলে তার রফতানি কমে যাবে এবং চীনা কল-কারখানা বন্ধ হতে শুরু করবে। চীনে দেখা দেবে ব্যাপক বেকার সমস্যা এবং তার সঙ্গে শুরু হবে সারাদেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা এবং একবার এ জাতীয় অস্থিরতা দেখা দিলে সেটা সামাল দেওয়া চীনের কমিউনিস্ট সরকারের পক্ষে হবে রীতিমতো কষ্টকর।
চীনকে এ বেকায়দা অবস্থায় পড়তে হতো না যদি চীনের অভ্যন্তরীণ বাজার আরও চাঙ্গা ও শক্তিশালী হতো। কিন্তু আসলে তা নয়। বর্তমান অবস্থায়, চীনের কল-কারখানায় যে পরিমাণ জিনিস উৎপাদিত হয় তার ১০ শতাংশ চাহিদাও চীনের অভ্যন্তরীণ বাজারে নেই, যদিও চীনে ৩০ কোটি মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ আছে। খরচ করা একটি জাতীয় চরিত্র ও সংস্কৃতির বিষয়। চীনের মানুষের আয় এবং উপার্জনের সঙ্গে তাদের সঞ্চয় বেড়েছে ঠিকই; কিন্তু সেই হারে খরচ করার প্রবণতা বাড়েনি। খরচের ব্যাপারে আমেরিকানদের কেউ হারাতে পারবে না। আর তাই চীনের ক্রমবর্ধমান এ উৎপাদন ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে বিদেশি বাজার, বিশেষ করে আমেরিকার বাজারকে ধরে রাখা চীনের জন্য একান্তই অপরিহার্য। এ জন্য দুটি কাজ চীনের অবশ্য কর্তব্য। প্রথমত, আমেরিকাকে ঋণ দিয়ে আমেরিকার সরকার ও জনগণের খরচের অভ্যাসকে টিকিয়ে রাখতে হবে। অর্থাৎ মার্কিন ট্রেজারি বিল কিনতে হবে এবং এটা করলে আপনাআপনি আরেকটি কাজ হয়ে যাবে অর্থাৎ চাপের মুখে ইউয়ানের মূল্য কম থাকবে। ফলে চীনের জিনিসপত্র বিশ্ববাজারে অন্যদের তুলনায় বেশি প্রতিযোগিতামূলক থাকবে।
অন্যভাবে বলতে গেলে, চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চাকা ক্রমাগত সচল রাখার পূর্বশর্ত হলো মার্কিন বাজারের চাহিদাকে চাঙ্গা করে রাখা। তাই চীনের উন্নতি ও অগ্রগতি আর আমেরিকার স্ট্যাটাস ধরে রাখা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একটি ছাড়া আরেকটি সম্ভব নয়। আর তাই একজন আরেকজনের ওপর সমানভাবেই নির্ভরশীল। কেউ কারও করুণার পাত্র নয়।

আবু এন. এম. ওয়াহিদ : অধ্যাপক
টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি; এডিটর
জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
awahid2569@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.