হাবিবের সবুজ জামা... by অজয় দাশগুপ্ত
তাহমিনা মুনি্ন আলমারিটা খুলে একটা পুরনো জামা পেল_ রঙ সবুজ। কিছুটা বিবর্ণ। বাবার জামা? কই তাকে তো এটা গায়ে দিতে দেখিনি? আলমারিতেই-বা রেখে দিয়েছেন কেন এমন যত্ন করে? নবম শ্রেণীতে পড়া তাহমিনার কত প্রশ্ন। এসবের উত্তর জানার জন্য কথা বলতে হবে বাবার সঙ্গে। কিন্তু তিনি কিছুটা রাগী ধরনের। তাও সাহস করে বলে ফেলল তালুকদার হাবিবুর রহমানকে_ এ সবুজ জামাটা কি তোমার?
মুহূর্তে পিতা-কন্যার যাবতীয় ব্যবধান ঘুচিয়ে দিল সবুজ জামাটি। বরিশালের বরাকোঠার নৌকার দিনগুলোতে ফিরে গেলেন হাবিবুর রহমান। ১৭ বছরের এক কিশোরের কয়েক মাসের জন্য ঠাঁই হয়েছিল ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরের নৌকায়। খালে-নদীতে ভেসে চলা এ নৌকায় আরও থাকতেন মহিউদ্দিন মানিক ও রফিকুল হাসান বাদশা। বাকেরগঞ্জ, রাজাপুর, ইন্দিরহাট, আশোকাঠি_ কত যুদ্ধের স্মৃতি! এ জামাটি গায়ে চড়িয়েছেন অনেকবার। তাহমিনা এবং তার আরেক বোন ও ভাইয়ের প্রশ্ন_ তুমি যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়েছ, সেটা তো বলোনি কখনও। তোমার মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট কোথায়?
পুত্র-কন্যাদের কাছে স্বপ্ন ও সাহসের সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে করতে হঠাৎই যেন অভিমানী হয়ে পড়লেন। বলেন, সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য তো এসব করিনি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটে নাম তোলার কথা অনেকে বলেছেন। কিন্তু দেশের জন্য যা করেছি, সেটা জানে সহযোদ্ধারা। রাজাকার-আলবদররাও জানে।
তালুকদার হাবিবুর রহমান স্বাধীনতার ৪১ বছর পর এই মার্চ মাসেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বরিশাল জেলা কমান্ড এবং আগৈলঝাড়া থানা কমান্ডের সদস্যরা চাইলেন, তার সম্মানে গার্ড অব অনার দেওয়া হোক। এটা সরকারের সিদ্ধান্ত। কিন্তু একাত্তরে যে যোদ্ধার কাছে গুলি-বেয়নেট চার্জ করা ছিল প্রতিদিনের রুটিন, তার জন্য হলো না গান স্যালুট। কারণ, গেজেটে নাম নেই যে!
মহিউদ্দিন মানিক একাত্তরে অসম সাহসিকতার জন্য বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছিলেন। একাত্তরে তার একটি টেপরেকর্ডার ছিল। হাবিবুর রহমানের ছিল একটি রেডিও। তারা নৌকায় কখনও যেতেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে অভিযানে। কখনও-বা অন্য যোদ্ধাদের সঙ্গে দেখা করতে। রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে তা এই রেকর্ডারে ধরে রেখেছেন। মহিউদ্দিন মানিক বলেন, কিশোর হাবিবুর রহমানকে সাহসিকতার পদক দেওয়ার সুপারিশ ছিল কমান্ডারের। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তা হয়নি। এখন তো মৃত্যুর পর মিলল না বাংলাদেশ সরকারের গার্ড অব অনারও। কিন্তু তাতে কি? মুক্তিযুদ্ধের সাথী মনিরুল ইসলাম সেন্টু, রইস সেরনিয়াবাত, সিরাজুল হক সরকার, আবদুল কাদের সরদাররা আছেন না। তারাই শেষ বিদায় জানালেন। মহিউদ্দিন মানিকের লাইসেন্স করা রিভলবার থেকে একে একে শূন্যে নিক্ষিপ্ত হলো সাতটি গুলি। অশ্রুসিক্ত বিদায় জানালেন নৌকা-জীবনের বহু দিন-রাতের প্রিয় বন্ধুকে।
ভারতের চাকুলিয়ায় প্রথম ব্যাচে সামরিক ট্রেনিং নিয়েছিলেন তালুকদার হাবিবুর রহমান। ট্রেনিং শেষে দ্রুতই দেশে ফিরে এসে সবার প্রিয় হতে পেরেছিলেন যেসব কারণে তার একটি হলো বয়স, অন্যটি সাহস ও বুদ্ধিমত্তা। একবার ভাত খেতে খেতেই খবর পেলেন, হানাদাররা আসছে...। এ অবস্থাতেই অস্ত্র হাতে নিয়ে ছুটতে হলো তাদের মোকাবেলায়। এমন যোদ্ধার সনদ কেন মিলল না, সেটা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে অবশ্যই ভাবতে হবে। সারাদেশে এমন আরও কত 'সনদবিহীন হাবিবুর রহমান' রয়েছেন, নিশ্চয়ই তারা খুঁজে বের করতে পারবেন। তবে এ জন্য বেশি দেরি করলে চলবে না। কারণ যারা সঠিক তথ্য দিতে পারবেন, একাত্তরের সেসব সহযোদ্ধা যে একে একে বিদায় নিচ্ছেন। ভুল ও বিকৃত ইতিহাস যে লিপিবদ্ধ না হয়, সেটাও নিশ্চিত করতে পারেন তারা।
হাবিবুর রহমানকে গার্ড অব অনার দিয়েছেন সহযোদ্ধারা। মহিউদ্দিন মানিক একাত্তরের পর প্রথম গুলি ছুড়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হাসান বাদশাকে সম্মান জানানোর জন্য। বরিশাল মুসলিম গোরস্তানে 'গান স্যালুট' দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাকে শেষ বিদায় জানিয়েছেন, এ খবর সংবাদপত্রে প্রকাশের পর নানা গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা ছুটে এসেছিলেন। তাদের একটিই প্রশ্ন ছিল_ এমন 'অপরাধ' কেন করলেন? প্রশাসনেও তোলপাড় এ ঘটনায়। তবে এখন তিনি সান্ত্বনা পেতেই পারেন_ গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধারা 'সম্মান' পাচ্ছে। কিন্তু যাদের নাম নেই সরকারি তালিকায়? তাদের সন্তানদের তাহমিনা-শারমিনের মতোই কষ্ট_ পিতার অতুলন কীর্তির কথা যখন কাউকে বলতে যান, পাল্টা প্রশ্ন আসে_ কাগজ দেখাও তো।
তাহমিনা এবং তার মা ও ভাইবোনদের কাছে আছে পিতার যুদ্ধকালের শার্ট। তাদের কাছে মনে হয়, ৪১ বছরেও এর ঔজ্জ্বল্য একটু ম্লান হয়নি। বাংলাদেশের পতাকার মতোই চিরকাল তা উড়বে দ্যুতি ছড়িয়ে। বাবার মৃত্যুর পর তারা বারবার স্পর্শ করছে জামাটি। সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে হারানোর সীমাহীন কষ্টের মধ্যেও শুধু সান্ত্বনা নয়, সুন্দর-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে নিজেদের সবকিছু উজাড় করে দেওয়ার প্রেরণাও
পায় এর মধ্যে।
ajoydg@gmail.com
পুত্র-কন্যাদের কাছে স্বপ্ন ও সাহসের সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে করতে হঠাৎই যেন অভিমানী হয়ে পড়লেন। বলেন, সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য তো এসব করিনি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটে নাম তোলার কথা অনেকে বলেছেন। কিন্তু দেশের জন্য যা করেছি, সেটা জানে সহযোদ্ধারা। রাজাকার-আলবদররাও জানে।
তালুকদার হাবিবুর রহমান স্বাধীনতার ৪১ বছর পর এই মার্চ মাসেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বরিশাল জেলা কমান্ড এবং আগৈলঝাড়া থানা কমান্ডের সদস্যরা চাইলেন, তার সম্মানে গার্ড অব অনার দেওয়া হোক। এটা সরকারের সিদ্ধান্ত। কিন্তু একাত্তরে যে যোদ্ধার কাছে গুলি-বেয়নেট চার্জ করা ছিল প্রতিদিনের রুটিন, তার জন্য হলো না গান স্যালুট। কারণ, গেজেটে নাম নেই যে!
মহিউদ্দিন মানিক একাত্তরে অসম সাহসিকতার জন্য বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছিলেন। একাত্তরে তার একটি টেপরেকর্ডার ছিল। হাবিবুর রহমানের ছিল একটি রেডিও। তারা নৌকায় কখনও যেতেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে অভিযানে। কখনও-বা অন্য যোদ্ধাদের সঙ্গে দেখা করতে। রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে তা এই রেকর্ডারে ধরে রেখেছেন। মহিউদ্দিন মানিক বলেন, কিশোর হাবিবুর রহমানকে সাহসিকতার পদক দেওয়ার সুপারিশ ছিল কমান্ডারের। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তা হয়নি। এখন তো মৃত্যুর পর মিলল না বাংলাদেশ সরকারের গার্ড অব অনারও। কিন্তু তাতে কি? মুক্তিযুদ্ধের সাথী মনিরুল ইসলাম সেন্টু, রইস সেরনিয়াবাত, সিরাজুল হক সরকার, আবদুল কাদের সরদাররা আছেন না। তারাই শেষ বিদায় জানালেন। মহিউদ্দিন মানিকের লাইসেন্স করা রিভলবার থেকে একে একে শূন্যে নিক্ষিপ্ত হলো সাতটি গুলি। অশ্রুসিক্ত বিদায় জানালেন নৌকা-জীবনের বহু দিন-রাতের প্রিয় বন্ধুকে।
ভারতের চাকুলিয়ায় প্রথম ব্যাচে সামরিক ট্রেনিং নিয়েছিলেন তালুকদার হাবিবুর রহমান। ট্রেনিং শেষে দ্রুতই দেশে ফিরে এসে সবার প্রিয় হতে পেরেছিলেন যেসব কারণে তার একটি হলো বয়স, অন্যটি সাহস ও বুদ্ধিমত্তা। একবার ভাত খেতে খেতেই খবর পেলেন, হানাদাররা আসছে...। এ অবস্থাতেই অস্ত্র হাতে নিয়ে ছুটতে হলো তাদের মোকাবেলায়। এমন যোদ্ধার সনদ কেন মিলল না, সেটা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে অবশ্যই ভাবতে হবে। সারাদেশে এমন আরও কত 'সনদবিহীন হাবিবুর রহমান' রয়েছেন, নিশ্চয়ই তারা খুঁজে বের করতে পারবেন। তবে এ জন্য বেশি দেরি করলে চলবে না। কারণ যারা সঠিক তথ্য দিতে পারবেন, একাত্তরের সেসব সহযোদ্ধা যে একে একে বিদায় নিচ্ছেন। ভুল ও বিকৃত ইতিহাস যে লিপিবদ্ধ না হয়, সেটাও নিশ্চিত করতে পারেন তারা।
হাবিবুর রহমানকে গার্ড অব অনার দিয়েছেন সহযোদ্ধারা। মহিউদ্দিন মানিক একাত্তরের পর প্রথম গুলি ছুড়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হাসান বাদশাকে সম্মান জানানোর জন্য। বরিশাল মুসলিম গোরস্তানে 'গান স্যালুট' দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাকে শেষ বিদায় জানিয়েছেন, এ খবর সংবাদপত্রে প্রকাশের পর নানা গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা ছুটে এসেছিলেন। তাদের একটিই প্রশ্ন ছিল_ এমন 'অপরাধ' কেন করলেন? প্রশাসনেও তোলপাড় এ ঘটনায়। তবে এখন তিনি সান্ত্বনা পেতেই পারেন_ গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধারা 'সম্মান' পাচ্ছে। কিন্তু যাদের নাম নেই সরকারি তালিকায়? তাদের সন্তানদের তাহমিনা-শারমিনের মতোই কষ্ট_ পিতার অতুলন কীর্তির কথা যখন কাউকে বলতে যান, পাল্টা প্রশ্ন আসে_ কাগজ দেখাও তো।
তাহমিনা এবং তার মা ও ভাইবোনদের কাছে আছে পিতার যুদ্ধকালের শার্ট। তাদের কাছে মনে হয়, ৪১ বছরেও এর ঔজ্জ্বল্য একটু ম্লান হয়নি। বাংলাদেশের পতাকার মতোই চিরকাল তা উড়বে দ্যুতি ছড়িয়ে। বাবার মৃত্যুর পর তারা বারবার স্পর্শ করছে জামাটি। সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে হারানোর সীমাহীন কষ্টের মধ্যেও শুধু সান্ত্বনা নয়, সুন্দর-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে নিজেদের সবকিছু উজাড় করে দেওয়ার প্রেরণাও
পায় এর মধ্যে।
ajoydg@gmail.com
No comments