সপ্তাহের হালচাল-সংকট ও সম্ভাবনার সন্ধিক্ষণে by আব্দুল কাইয়ুম

দেশের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, খারাপের দিকে গেলে বেশ খারাপ হতে পারে, আবার ভালোর দিকে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা যে নেই, তা-ও নয়। যখন বাজারে নতুন চালের দাম কমার কথা, তখন জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হলো। ফল—পরিবহন-ভাড়া বৃদ্ধি ও বাজারে মূল্যবৃদ্ধি। মালিকেরা প্রথমে খেয়ালখুশিমতো বাসভাড়া বাড়িয়ে দেন।

পরে মন্ত্রী খুব নরম ভাষায় বলেন, সরকার যে ভাড়া নির্ধারণ করে দিচ্ছে, তা গেজেট আকারে প্রকাশের আগে কেউ ভাড়া বাড়ালে বা বেশি ভাড়া আদায় করলে তাদের রুট পারমিট বাতিল করা হবে।
ওই জিনিসটা যে কী, তা কেউ বলতে পারবে না। রুট পারমিট বলে যদি কিছু থাকত, আর অনিয়মের জন্য যদি সেটা বাতিল করার ইচ্ছা বা ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের থাকত, তাহলে তো এত সমস্যা হওয়ারই কথা নয়। তাও মন্ত্রী অসন্তুষ্ট জনগণকে বুঝবাজ দেওয়ার জন্য ছেলে ভোলানো ছড়া আওড়ে যাচ্ছেন। সবাই যদি মন্ত্রীদের মতো বোকা হতো, তাহলে নাহয় একটা কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের আইকিউ যে কত প্রখর, তা টের পাইয়ে দিতে খুব বেশি দেরি হয় না।
সরকারি দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব এক বড় উপদ্রব হয়ে দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ বিভিন্ন স্থানে গন্ডগোলে লিপ্ত হচ্ছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল। একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু ১১ দিন পর বিশ্ববিদ্যালয় খুললে এক পক্ষ আবার অবরোধ ডাকে। বাস-ট্রেন ভাঙচুর করা হয়। পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযুক্ত ছাত্ররা কীভাবে থাকে? কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? দেশের বিভিন্ন স্থানে এ রকম সংঘর্ষ চলছে। সরকার একরকম নীরব।
আদালতের রায়ে ট্রুথ কমিশন অবৈধ ঘোষিত হওয়ার পর এক অভাবনীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। যে ৪৫২ জন অবৈধভাবে উপার্জিত ৩৪ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে দায়মুক্তি নিয়েছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে এখন দুদকের মামলা চালু হবে। কারণ তাঁরা তো নিজেদের ঘোষণা অনুযায়ী দুর্নীতি করেছেন। তাহলে বিচার হবে না কেন? ট্রুথ কমিশন তাদের দায়মুক্তি দিয়েছিল। যদি আদালত তা বাতিল না-ও করতেন, তাহলেও তো তাঁদের দুর্নীতির অপরাধ থেকেই যেত। অথচ তাঁদের মধ্যে কোনো কোনো কর্মকর্তা সরকারি চাকরিতে যে শুধু বহাল ছিলেন, তা-ই নয়; ক্ষেত্রবিশেষে পদোন্নতিও পেয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকার যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনমনীয় থাকে, তাহলে তো এমন হওয়ার কথা নয়।
আমাদের মতো দেশে কমবেশি দুর্নীতি হয়। কিন্তু যেখানে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সেখানে মানুষের আস্থা ধরে রাখা যায়। সম্প্রতি ভারতে টেলিযোগাযোগ খাতে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় মন্ত্রী এ রাজা পদত্যাগ করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রথম দিকে যখন সরকার তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ইতস্তত করছিল, তখন সারা দেশে নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। ভারতের সুবিধা হলো, নিন্দাকেও সরকার মূল্য দেয়। আমাদের দেশে সমস্যা হলো, গদিতে টান পড়লেও সংবিৎ হয় না।
এ রকম দেশ এশিয়ার এই প্রান্তে আরও আছে। সম্প্রতি ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট বেনিগনো একুইনো দেশের প্রধান দুর্নীতি দমন কর্মকর্তা (অম্বুডসম্যান) মার্সিডিটাস গুটিয়েরেজকে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন। এই নারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ হলো, তিনি নাকি পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট গ্লোরিয়া অ্যারোইয়োর আমলের প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। যেহেতু সাবেক প্রেসিডেন্ট অ্যারোইয়োও তাঁকে নিয়োগ দিয়েছিলেন, তাই প্রেসিডেন্ট একুইনো তাঁকে সরানোর জন্য ছিলেন উদ্গ্রীব। সেটা তিনি করেছেন। কিন্তু এ ধরনের পদক্ষেপে যে দুর্নীতি কমবে, তা কেউ মনে করেন না। এর আগের প্রেসিডেন্ট অ্যারোইয়োও তাঁর পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে বিশেষ আদালতে বিচারের ব্যবস্থা করেন। সেই প্রেসিডেন্টের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। পরে অবশ্য অ্যারোইয়োও তাঁর দণ্ড মওকুফ করেন।
দেখা যাচ্ছে, ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্টরা অতীতের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যতটা সিদ্ধহস্ত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের ব্যাপারে ততটা নন। আমাদের দেশেও প্রায় একই ধারা চলছে। আসলে প্রয়োজন বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি তৎপর হওয়া। কারণ মানুষ তো বাঁচে বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে। অতীতের ব্যাপারেও পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু আজ সরকার কী করছে, আগামীকাল জীবন কতটা সুন্দর ও নির্ঝঞ্ঝাট হবে, সেসব প্রশ্নে সন্দেহজনক অবস্থান নিয়ে দেশের মানুষের আস্থা ধরে রাখা যায় না। সরকার যখন দুর্নীতি দমন কমিশনকে দুর্বল করার জন্য আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির অন্যতম অভিযুক্ত প্রভাবশালী মহলের বিরুদ্ধে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয় এবং তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখার ব্যবস্থা করে, তখন মানুষ কি দুর্নীতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হতাশ না হয়ে আনন্দের আতিশয্যে হাততালি দেবে?
সুতরাং দেশ কোন দিকে যাচ্ছে, তা সরকারকে ভেবে দেখতে হবে। সরকারের অনেক সুযোগ আছে। সবই যে হতাশাজনক, তা নয়। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন নিউ ইয়র্ক রিভিউ অব বুকস সাময়িকীতে এক নিবন্ধে সম্প্রতি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে উন্নয়নের বিভিন্ন দিকের তুলনা করে দেখিয়েছেন, অনেক বিবেচনায় বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। ভারতের মাথাপিছু মোট জাতীয় আয় ১১৭০ মার্কিন ডলার, আর বাংলাদেশের মাত্র ৫৯০ ডলার (ক্রয়ক্ষমতার তুলনীয় এককে, পিপিপি)। নিঃসন্দেহে ভারতের অর্থনীতি অনেক এগিয়ে। কিন্তু তা সত্ত্বেও অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৬৬ দশমিক ৯ বছর, যেখানে ভারতের মানুষের গড় আয়ু ৬৪ দশমিক ৪ বছর। বাংলাদেশে স্কুলশিক্ষা লাভের গড় সময় ৪ দশমিক ৮ বছর, ভারতে ৪ দশমিক ৪ বছর। বাংলাদেশে কিশোরী ও তরুণীদের সাক্ষরতার হার ভারতের চেয়ে বেশি। শিশুদের ডিপিটিসহ অন্যান্য টিকাদানের হার বাংলাদেশে ৯৪ শতাংশ, ভারতে ৬৬ শতাংশ।
অমর্ত্য সেন দেখাতে চেয়েছেন, বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় পিছিয়ে থেকেও স্বাস্থ্য, প্রাথমিক শিক্ষা, নারী শিক্ষা, গড় আয়ু প্রভৃতি দিক দিয়ে এগিয়ে। তাঁর মতে, কম আয়ের দেশ হয়েও বাংলাদেশ যে এসব ক্ষেত্রে এত দ্রুত এতটা এগিয়ে গেছে, তার কারণ মূলত বাংলাদেশের গ্রামীণ, ব্র্যাক প্রভৃতি এনজিও প্রতিষ্ঠানের সৃজনশীল কার্যক্রম এবং সেই সঙ্গে সরকারের দায়বদ্ধতার নীতি।
এই অর্জনগুলো যেন বিসর্জনের অতলে তলিয়ে না যায়, সেটা নিশ্চিত করলে দেশ অনেকটা এগিয়ে যাবে। এ জন্য সুশাসন নিশ্চিত করা না গেলেও অন্তত অপশাসন থেকে দূরে থাকা দরকার। প্রয়োজন ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় নীতিগত অবস্থান এবং দলের ভেতর থেকে দলাদলি দূর করা। তারপর দেখা যাক, দেশ পিছিয়ে পড়েও এগিয়ে যাওয়ার দুঃসাধ্য কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে পারে কি না।
সরকারের সামনে এটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.