ব্যক্তিত্ব-লো-প্রোফাইলে থেকেই সবার হৃদয়ে by হাসান শাহরিয়ার
খুব অল্প সময়ে যারা সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন করেছে তাদের মধ্যে মৃদুল কান্তি চক্রবর্তী ছিল অন্যতম। মৃদুল ছিল নামকরা সঙ্গীতশিল্পী, লোকসঙ্গীত বিশেষজ্ঞ, গবেষক, লেখক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। বমি ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কি কুক্ষণে ভর্তি হয়েছিল রাজধানীর এক বিলাসবহুল হাসপাতালে! দেড় ঘণ্টার মধ্যেই লাশ হয়ে ফিরল।
ভর্তি ফি এগারো হাজার টাকার মধ্যে দশ হাজার টাকা দিয়েছিল। আর এক হাজার টাকা দিতে দেরি করায় চিকিৎসাসেবা বিলম্বিত হয়। আর এই বিলম্বই হলো তার কাল। এই হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদও তার বৃদ্ধা মাকে নিয়ে গিয়েছিলেন এই সেবাকেন্দ্রে। আর বোধকরি কোনোদিন যাবেন না। এমন অনেকে আছেন যারা পণ করেছেন, দ্বিতীয়বার আর ওমুখো হবেন না। মন্ত্রী-মিনিস্টার, রাজনীতিবিদ বা পদস্থ আমলাদের কথা আলাদা। তারা সেখানে গেলে জামাই আদর পান। অন্যদের মূল্যায়ন হয় অর্থের মাপকাঠিতে। যেমন অর্থ, তেমন সেবা। সম্পূর্ণ বিল পরিশোধ না করায় লাশ আটকে রাখারও অভিযোগ রয়েছে। বলিহারি ব্যবস্থা! কিন্তু এত অভিযোগ সত্ত্বেও প্রতিবারই পার পেয়ে যাচ্ছে এই চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রটি। নিন্দুকেরা বলে, সমাজের বিত্তশালী ও হোমরাচোমরারা হলেন এই হাসপাতালের পৃষ্ঠপোষক। কার সাধ্য এর গায়ে হাত দেয়? এবার হাইকোর্ট নাক গলিয়েছেন। সবার দৃষ্টি এখন এই উচ্চ আদালতের দিকে। দেখা যাক, বিচারকরা কী বলেন।
মৃদুল ও আমি ছিলাম একই শহরের বাসিন্দা। আমাদের দুই পরিবারের মধ্যেও ছিল সখ্য ও ঘনিষ্ঠতা। সে আমার চেয়ে অনেক ছোট ছিল; কিন্তু সম্পর্ক ছিল নিবিড়। তার মা দীপালি চক্রবর্তীকে সবাই একনামে চিনত। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের একজন একনিষ্ঠ কর্মী, সুনামগঞ্জ মহিলা সমিতির কর্ণধার ও নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবিকা। মহিলা সমিতি মানেই দীপালি চক্রবর্তী। সারাজীবন তিনি এই সমিতির জন্য কাজ করে গেছেন। চারুবাবু ভারত চলে গেলে তার অকৃতদার ভাই বৃদ্ধ পিলুবাবু সুনামগঞ্জেই থেকে যান। তার কাছ থেকে বিনামূল্যে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ সেবন করেছেন অনেকেই। আমাদের খুব স্নেহ করতেন তিনি। ফুটবল টিম বা অন্য কোনো সংস্থার জন্য চাঁদা চাইলে কখনও খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না। তার বাড়িতেই বসবাস করতেন মনোরঞ্জন চক্রবর্তী ও তার স্ত্রী দীপালি চক্রবর্তী। জীবনভর তারা পিলুবাবুর সেবা-শুশ্রূষা করেছেন। প্রতিদানে পেয়েছেন অনেক বিষয়-সম্পত্তি। পিলুবাবু মহিলা সমিতিকে তার বাড়ির একটি ঘর দান করে গিয়েছিলেন। আজও মহিলা সমিতির কার্যালয় সেখানে আছে। দীপালি ও তার স্বামী ছিলেন অত্যন্ত সংস্কৃতমনা। বাড়িতে গান-বাজনা লেগেই থাকত। তাদের বড় মেয়ে রত্না চক্রবর্তী চমৎকার গান গাইত। তার গলা ছিল খুব মিষ্টি। সব অনুষ্ঠানেই তার অংশগ্রহণ ছিল অনেকটা রুটিনের মতো। সে তখন ছোট; কিন্তু ছিল সব অনুষ্ঠানের মধ্যমণি। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে আমরা সুরমা-কাকলি কচি-কাঁচার মেলা গড়েছিলাম সুনামগঞ্জে। আমি ছিলাম আহ্বায়ক ও সংগঠক। আমাদের প্রতিটি অনুষ্ঠানে রত্না গান গাইত আর তবলায় থাকত তার বড়ভাই মৃণাল কান্তি চক্রবর্তী (মিঠু)। নৃত্য পরিবেশনরত রত্নার বহু ছবি তখন বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। মিঠু আমাদের মেলার একজন নিরলস কর্মী ছিল। সে ছিল শান্ত প্রকৃতির, কথা কম বলত। অন্যদিকে রত্না ছিল খুব প্রাণখোলা, সবার সঙ্গে মিশত। সে ছিল সবার স্নেহের পাত্রী। রত্না ও মিঠু আমাকে বড় ভাইয়ের মতোই শ্রদ্ধা করত। তার মা-বাবাও আমাকে খুব স্নেহ করতেন।
মৃদুল তখন খুবই ছোট। কোনো অনুষ্ঠান হলে সে মঞ্চে তার দাদার কাছে এসে বসে থাকত, আনমনে তাকিয়ে দেখত কীভাবে মিঠু তবলায় সঙ্গত করে। তখন আমরা কেউ বুঝতে পারিনি এই মৃদুল একদিন এত বড় শিল্পী হবে। রত্নার স্বামী হবিগঞ্জ কলেজের একজন অধ্যাপক। কয়েক বছর আগে তাদের বাসায় গিয়েছিলাম। কী যে খুশি হয়েছিল রত্না আমাকে পেয়ে! কথা দিয়েছিলাম, আবার যাব; কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। মিঠু সুনামগঞ্জ বারে ওকালতি শুরু করেছিল, কিন্তু কয়েক বছর আগে হঠাৎ করেই মারা যায়। তাদের বাবা-মা অনেক আগেই প্রাণত্যাগ করেছেন। এখন বেঁচে আছে দুই বোন মুক্তা ও জবা এবং ভাই শ্যামু ও রাজু। ওদের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই।
সুনামগঞ্জ শহরেই মৃদুলের জন্ম, ১৯৫৫ সালে। ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি তার ঝোঁক। তাই সঙ্গীতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য সে যায় ভারতের শান্তিনিকেতনে। প্রথমদিকে সে কিছুটা পথভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিল। এমনকি মাদকাসক্তও হয়ে গিয়েছিল। তখন সুনামগঞ্জের লোকেরা বলত_ এত ভালো একটি ছেলে নষ্ট হয়ে গেল! কলকাতার হাওয়া লেগে সে উচ্ছন্নে গেছে। একবার হঠাৎ সে সুনামগঞ্জে এসে হাজির। সঙ্গে এক ভারতীয় তরুণী। সে জানাল, ওকে সে বিয়ে করেছে। তার পরিবারের সদস্যরা খুব লজ্জিত হলো। তবে তারা নতুন বধূকে গ্রহণ করল। শান্তিনিকেতনে ফিরে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তার মধ্যে পরিবর্তন এলো। সে নেশা ছেড়ে দিল, ছেড়ে দিল ওই তরুণীর সঙ্গ। মনোযোগ দিল লেখাপড়ায়। অচিরেই প্রমাণ করল ইচ্ছা ও অধ্যবসায়ের ফলে অসাধ্য সাধন সম্ভব। তার এই পরিবর্তনে সুনামগঞ্জের সবাই খুশি হলো, তার পরিবারকে জানাল শুভাশীষ।
সে ১৯৮০ সালে ব্যাচেলর অব মিউজিক (বি মিউজ) ডিগ্রি লাভ করে থেমে থাকেনি। দু'বছরেই অর্জন করে মাস্টার অব মিউজিক (এম মিউজ)। কিন্তু মৃদুলের সঙ্গীত পিপাসা ছিল আকাশছোঁয়া। সে আরও জ্ঞান অর্জন করতে চাইল সঙ্গীতে। ফলে বিশ্ব ভারতী থেকে সঙ্গীতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করল ১৯৯৪ সালে। এ কি কম গৌরবের ব্যাপার! তার এই খবর সুনামগঞ্জে পেঁৗছলে সারা শহরে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। এর আগে আমাদের শহরের বা জেলার কেউ সঙ্গীতে ডক্টরেট হয়নি। মৃদুলের পিএইচডি ডিগ্রি লাভে আমরা হলাম গর্বিত ও গৌরবান্বিত।
পিএইচডি সম্পন্ন করার শেষ পর্যায়ে সে যখন ঢাকায় এলো তখন আমার সঙ্গে দেখা। প্রথমে তো আমরা একে অন্যকে চিনতেই পারিনি। আমি সুনামগঞ্জ ছেড়েছি ১৯৬৪ সালে। তখন তার বয়স ৯ বছর। মাঝে মধ্যে সুনামগঞ্জ যেতাম, দেখা হতো মিঠুর সঙ্গে। কিন্তু মৃদুলকে দেখিনি। আমার সঙ্গে তার নতুন করে দেখা হলে সে আমার হাতটি তার মাথায় নিয়ে বলল, 'দাদা, আমাকে আশীর্বাদ করুন।' আমি তার উত্তরোত্তর সাফল্য ও দীর্ঘজীবন কামনা করেছিলাম। আমার একটি আশীর্বাদবাণী সত্য হয়েছিল, সে তার পেশায় শীর্ষে পেঁৗছল। কিন্তু অন্যটি হয়নি। বিধাতা তো আর আমাদের সব কথা শোনেন না। সে দীর্ঘজীবন লাভ করতে পারল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৯৩ সালে সঙ্গীত বিভাগ চালু করে। মৃদুলের পিএইচডি ডিগ্রি লাভের এক বছর আগেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে এই নতুন বিভাগের প্রথম চেয়ারম্যান নিয়োগ করে। এই বিভাগ প্রতিষ্ঠায় তার অবদান ছিল অপরিসীম। গত ১৮ বছরে এই বিভাগ থেকে অনেক ছাত্রছাত্রী সঙ্গীতে উচ্চশিক্ষা লাভ করেছে।
মৃদুলের প্রিয় ছিল রবীন্দ্র ও লোকসঙ্গীত। কিন্তু সঙ্গীতের অন্যান্য ধারা তথা বাউলসঙ্গীত, নজরুলগীতি ও গণসঙ্গীতে তার বিচরণ ও চর্চা ছিল অফুরন্ত। তার গবেষণার বিষয় ছিল রাধারমণ দত্ত, হাছন রাজা, লালন শাহ, শাহ আবদুল করিম, মুকন্দ দাস, কস্ফারি আমিরউদ্দিন প্রমুখের গান। সমাজ, সঙ্গীত ও স্বর সম্পর্কে তার গবেষণাধর্মী বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো 'হাছন রাজা, তাঁর গানের তরী' (১৯৯২), 'বাংলা গানের ধারা' (১৯৯৩), 'গানের ঝর্ণা দোলায়' (১৯৯৭), 'লোকসংগীত' (১৯৯৯), 'হাজার বছরের বাংলা গান' (২০০৫) ও 'সংগীত-সংলাপ' (২০০৪)।
নিজেকে জাহির করার আগ্রহ ছিল না মৃদুলের। সবসময় লো-প্রোফাইলে থাকত। এর ফলে সব মহলে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল। সে ছিল বন্ধুবৎসল ও অজাতশত্রু, তবে আবেগপ্রবণ ও স্পর্শকাতর। শুনেছি, সে নাকি ছাত্রছাত্রীদের অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক ছিল।
মৃদুলের মৃত্যু আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনের জন্য এক বড় ধরনের ক্ষতি। এই ক্ষতি সহজে পূরণ হবে না। অনেকেই তার জন্য চোখের জল ফেলেছেন। যে একবার তার সানি্নধ্যে এসেছে, সে কখনও মৃদুলকে ভুলতে পারবে না। মানুষকে আপন করে নেওয়ার এক গড-গিফটেড গুণ ছিল তার। লন্ডনে শোকে মুহ্যমান হয়েছে 'মেমসাহেব অন টেমস' রেস্টুরেন্টের অন্যতম কর্ণধার সুনামগঞ্জের ছেলে মৃদুল কান্তি দাস মণি। তাদের মধ্যে বয়সের ব্যবধান ছিল। তবে তারা একে অন্যের খুব কাছের ছিল। বারবার তার মনে হচ্ছে, তাদের হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলার দিনগুলো। মৃদুলের ছাত্রছাত্রীরা হারিয়েছে তাদের প্রিয় শিক্ষক, জাতি হারিয়েছে একজন গুণী ও মেধাবী শিল্পীকে, সুনামগঞ্জ হারিয়েছে তার গর্বের ধনকে। আর আমি হারিয়েছি এক পরম আত্মীয়, ছোট ভাইকে। মৃদুল ও তার শিল্পী পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় আমি গর্বিত। মৃদুলের মৃত্যু নেই, সে বেঁচে থাকবে আমাদের হৃদয়ে, হৃদয়ের গভীরে।
হাসান শাহরিয়ার : ইন্টারন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট, কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (সিজেএ)
মৃদুল ও আমি ছিলাম একই শহরের বাসিন্দা। আমাদের দুই পরিবারের মধ্যেও ছিল সখ্য ও ঘনিষ্ঠতা। সে আমার চেয়ে অনেক ছোট ছিল; কিন্তু সম্পর্ক ছিল নিবিড়। তার মা দীপালি চক্রবর্তীকে সবাই একনামে চিনত। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের একজন একনিষ্ঠ কর্মী, সুনামগঞ্জ মহিলা সমিতির কর্ণধার ও নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবিকা। মহিলা সমিতি মানেই দীপালি চক্রবর্তী। সারাজীবন তিনি এই সমিতির জন্য কাজ করে গেছেন। চারুবাবু ভারত চলে গেলে তার অকৃতদার ভাই বৃদ্ধ পিলুবাবু সুনামগঞ্জেই থেকে যান। তার কাছ থেকে বিনামূল্যে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ সেবন করেছেন অনেকেই। আমাদের খুব স্নেহ করতেন তিনি। ফুটবল টিম বা অন্য কোনো সংস্থার জন্য চাঁদা চাইলে কখনও খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না। তার বাড়িতেই বসবাস করতেন মনোরঞ্জন চক্রবর্তী ও তার স্ত্রী দীপালি চক্রবর্তী। জীবনভর তারা পিলুবাবুর সেবা-শুশ্রূষা করেছেন। প্রতিদানে পেয়েছেন অনেক বিষয়-সম্পত্তি। পিলুবাবু মহিলা সমিতিকে তার বাড়ির একটি ঘর দান করে গিয়েছিলেন। আজও মহিলা সমিতির কার্যালয় সেখানে আছে। দীপালি ও তার স্বামী ছিলেন অত্যন্ত সংস্কৃতমনা। বাড়িতে গান-বাজনা লেগেই থাকত। তাদের বড় মেয়ে রত্না চক্রবর্তী চমৎকার গান গাইত। তার গলা ছিল খুব মিষ্টি। সব অনুষ্ঠানেই তার অংশগ্রহণ ছিল অনেকটা রুটিনের মতো। সে তখন ছোট; কিন্তু ছিল সব অনুষ্ঠানের মধ্যমণি। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে আমরা সুরমা-কাকলি কচি-কাঁচার মেলা গড়েছিলাম সুনামগঞ্জে। আমি ছিলাম আহ্বায়ক ও সংগঠক। আমাদের প্রতিটি অনুষ্ঠানে রত্না গান গাইত আর তবলায় থাকত তার বড়ভাই মৃণাল কান্তি চক্রবর্তী (মিঠু)। নৃত্য পরিবেশনরত রত্নার বহু ছবি তখন বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। মিঠু আমাদের মেলার একজন নিরলস কর্মী ছিল। সে ছিল শান্ত প্রকৃতির, কথা কম বলত। অন্যদিকে রত্না ছিল খুব প্রাণখোলা, সবার সঙ্গে মিশত। সে ছিল সবার স্নেহের পাত্রী। রত্না ও মিঠু আমাকে বড় ভাইয়ের মতোই শ্রদ্ধা করত। তার মা-বাবাও আমাকে খুব স্নেহ করতেন।
মৃদুল তখন খুবই ছোট। কোনো অনুষ্ঠান হলে সে মঞ্চে তার দাদার কাছে এসে বসে থাকত, আনমনে তাকিয়ে দেখত কীভাবে মিঠু তবলায় সঙ্গত করে। তখন আমরা কেউ বুঝতে পারিনি এই মৃদুল একদিন এত বড় শিল্পী হবে। রত্নার স্বামী হবিগঞ্জ কলেজের একজন অধ্যাপক। কয়েক বছর আগে তাদের বাসায় গিয়েছিলাম। কী যে খুশি হয়েছিল রত্না আমাকে পেয়ে! কথা দিয়েছিলাম, আবার যাব; কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। মিঠু সুনামগঞ্জ বারে ওকালতি শুরু করেছিল, কিন্তু কয়েক বছর আগে হঠাৎ করেই মারা যায়। তাদের বাবা-মা অনেক আগেই প্রাণত্যাগ করেছেন। এখন বেঁচে আছে দুই বোন মুক্তা ও জবা এবং ভাই শ্যামু ও রাজু। ওদের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই।
সুনামগঞ্জ শহরেই মৃদুলের জন্ম, ১৯৫৫ সালে। ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি তার ঝোঁক। তাই সঙ্গীতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য সে যায় ভারতের শান্তিনিকেতনে। প্রথমদিকে সে কিছুটা পথভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিল। এমনকি মাদকাসক্তও হয়ে গিয়েছিল। তখন সুনামগঞ্জের লোকেরা বলত_ এত ভালো একটি ছেলে নষ্ট হয়ে গেল! কলকাতার হাওয়া লেগে সে উচ্ছন্নে গেছে। একবার হঠাৎ সে সুনামগঞ্জে এসে হাজির। সঙ্গে এক ভারতীয় তরুণী। সে জানাল, ওকে সে বিয়ে করেছে। তার পরিবারের সদস্যরা খুব লজ্জিত হলো। তবে তারা নতুন বধূকে গ্রহণ করল। শান্তিনিকেতনে ফিরে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তার মধ্যে পরিবর্তন এলো। সে নেশা ছেড়ে দিল, ছেড়ে দিল ওই তরুণীর সঙ্গ। মনোযোগ দিল লেখাপড়ায়। অচিরেই প্রমাণ করল ইচ্ছা ও অধ্যবসায়ের ফলে অসাধ্য সাধন সম্ভব। তার এই পরিবর্তনে সুনামগঞ্জের সবাই খুশি হলো, তার পরিবারকে জানাল শুভাশীষ।
সে ১৯৮০ সালে ব্যাচেলর অব মিউজিক (বি মিউজ) ডিগ্রি লাভ করে থেমে থাকেনি। দু'বছরেই অর্জন করে মাস্টার অব মিউজিক (এম মিউজ)। কিন্তু মৃদুলের সঙ্গীত পিপাসা ছিল আকাশছোঁয়া। সে আরও জ্ঞান অর্জন করতে চাইল সঙ্গীতে। ফলে বিশ্ব ভারতী থেকে সঙ্গীতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করল ১৯৯৪ সালে। এ কি কম গৌরবের ব্যাপার! তার এই খবর সুনামগঞ্জে পেঁৗছলে সারা শহরে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। এর আগে আমাদের শহরের বা জেলার কেউ সঙ্গীতে ডক্টরেট হয়নি। মৃদুলের পিএইচডি ডিগ্রি লাভে আমরা হলাম গর্বিত ও গৌরবান্বিত।
পিএইচডি সম্পন্ন করার শেষ পর্যায়ে সে যখন ঢাকায় এলো তখন আমার সঙ্গে দেখা। প্রথমে তো আমরা একে অন্যকে চিনতেই পারিনি। আমি সুনামগঞ্জ ছেড়েছি ১৯৬৪ সালে। তখন তার বয়স ৯ বছর। মাঝে মধ্যে সুনামগঞ্জ যেতাম, দেখা হতো মিঠুর সঙ্গে। কিন্তু মৃদুলকে দেখিনি। আমার সঙ্গে তার নতুন করে দেখা হলে সে আমার হাতটি তার মাথায় নিয়ে বলল, 'দাদা, আমাকে আশীর্বাদ করুন।' আমি তার উত্তরোত্তর সাফল্য ও দীর্ঘজীবন কামনা করেছিলাম। আমার একটি আশীর্বাদবাণী সত্য হয়েছিল, সে তার পেশায় শীর্ষে পেঁৗছল। কিন্তু অন্যটি হয়নি। বিধাতা তো আর আমাদের সব কথা শোনেন না। সে দীর্ঘজীবন লাভ করতে পারল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৯৩ সালে সঙ্গীত বিভাগ চালু করে। মৃদুলের পিএইচডি ডিগ্রি লাভের এক বছর আগেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে এই নতুন বিভাগের প্রথম চেয়ারম্যান নিয়োগ করে। এই বিভাগ প্রতিষ্ঠায় তার অবদান ছিল অপরিসীম। গত ১৮ বছরে এই বিভাগ থেকে অনেক ছাত্রছাত্রী সঙ্গীতে উচ্চশিক্ষা লাভ করেছে।
মৃদুলের প্রিয় ছিল রবীন্দ্র ও লোকসঙ্গীত। কিন্তু সঙ্গীতের অন্যান্য ধারা তথা বাউলসঙ্গীত, নজরুলগীতি ও গণসঙ্গীতে তার বিচরণ ও চর্চা ছিল অফুরন্ত। তার গবেষণার বিষয় ছিল রাধারমণ দত্ত, হাছন রাজা, লালন শাহ, শাহ আবদুল করিম, মুকন্দ দাস, কস্ফারি আমিরউদ্দিন প্রমুখের গান। সমাজ, সঙ্গীত ও স্বর সম্পর্কে তার গবেষণাধর্মী বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো 'হাছন রাজা, তাঁর গানের তরী' (১৯৯২), 'বাংলা গানের ধারা' (১৯৯৩), 'গানের ঝর্ণা দোলায়' (১৯৯৭), 'লোকসংগীত' (১৯৯৯), 'হাজার বছরের বাংলা গান' (২০০৫) ও 'সংগীত-সংলাপ' (২০০৪)।
নিজেকে জাহির করার আগ্রহ ছিল না মৃদুলের। সবসময় লো-প্রোফাইলে থাকত। এর ফলে সব মহলে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল। সে ছিল বন্ধুবৎসল ও অজাতশত্রু, তবে আবেগপ্রবণ ও স্পর্শকাতর। শুনেছি, সে নাকি ছাত্রছাত্রীদের অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক ছিল।
মৃদুলের মৃত্যু আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনের জন্য এক বড় ধরনের ক্ষতি। এই ক্ষতি সহজে পূরণ হবে না। অনেকেই তার জন্য চোখের জল ফেলেছেন। যে একবার তার সানি্নধ্যে এসেছে, সে কখনও মৃদুলকে ভুলতে পারবে না। মানুষকে আপন করে নেওয়ার এক গড-গিফটেড গুণ ছিল তার। লন্ডনে শোকে মুহ্যমান হয়েছে 'মেমসাহেব অন টেমস' রেস্টুরেন্টের অন্যতম কর্ণধার সুনামগঞ্জের ছেলে মৃদুল কান্তি দাস মণি। তাদের মধ্যে বয়সের ব্যবধান ছিল। তবে তারা একে অন্যের খুব কাছের ছিল। বারবার তার মনে হচ্ছে, তাদের হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলার দিনগুলো। মৃদুলের ছাত্রছাত্রীরা হারিয়েছে তাদের প্রিয় শিক্ষক, জাতি হারিয়েছে একজন গুণী ও মেধাবী শিল্পীকে, সুনামগঞ্জ হারিয়েছে তার গর্বের ধনকে। আর আমি হারিয়েছি এক পরম আত্মীয়, ছোট ভাইকে। মৃদুল ও তার শিল্পী পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় আমি গর্বিত। মৃদুলের মৃত্যু নেই, সে বেঁচে থাকবে আমাদের হৃদয়ে, হৃদয়ের গভীরে।
হাসান শাহরিয়ার : ইন্টারন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট, কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (সিজেএ)
No comments