গণতন্ত্র-বাংলাদেশে সংসদীয় পরিভাষা by আল মাসুদ হাসানউজ্জামান
পার্লামেন্ট তথা সংসদের ঐতিহাসিক বিকাশ ঘটে ইউরোপে এবং এর প্রাথমিক পর্যায় শুরু হয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। অ্যাংলো স্যাক্সন যুগে ব্রিটেনে সংসদের উৎপত্তি বলা যায় এবং এর ঐতিহাসিক বিকাশ নির্বাচনী গণতন্ত্র প্রবর্তনের বহু আগেই ঘটে। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সংসদ, এর কাঠামো এবং ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা সংসদীয় প্রথার আন্তর্জাতিক
প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ভারতীয় উপমহাদেশে ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পর্যায়ে আধুনিক সংসদীয় কাঠামো ক্রমান্বয়ে গড়ে তোলা হয়। এ কাঠামোর গণতান্ত্রিক রূপদান ছিল পর্যায়ভিত্তিক এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালে ভারত ও পাকিস্তান ডোমিনিয়নে ওয়েস্টমিনিস্টার পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। বস্তুত ব্রিটিশ ভারতে বঙ্গীয় আইনসভায় সংসদীয় কার্যক্রম এ অঞ্চলে সংসদীয় গণতন্ত্রের সূচনা করে। ওই আইনসভায় তর্কবিতর্ক, প্রশ্নোত্তর ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড ভারতের সাংবিধানিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন এবং বঙ্গীয় আইনসভার অনুসৃত বিধিবিধান অদ্যাবধি অনুসরণ করা হচ্ছে।
পাকিস্তানের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির প্রথম দশকে পূর্ব বাংলায় দুইটি সংসদীয় সভা গঠন করা হয় এবং ওই সময়ই সংসদের সাংগঠনিক কাঠামোর দুর্বলতা, সরকারি দলের একচেটিয়া মনোভাব, স্পিকারের ঈপ্সিত ভূমিকা পালনের ব্যর্থতা, সংসদীয় দলগুলোর মতপার্থক্য এবং পারস্পরিক সহনশীলতার অভাব ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান হয়। ফলে একপর্যায়ে তৎকালীন ডেপুটি স্পিকার শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত, আহত ও মৃত্যুবরণ করেন। প্রায় এক দশকের বিভিন্ন জটিলতা ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানে সংসদীয় ধাঁচের সংবিধান প্রণীত হওয়ার পরও কেন্দ্রে এবং প্রদেশে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকে। ফলে সংসদীয় রীতিনীতি-সংবলিত সংসদ ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ সম্ভবপর হয়নি।
পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিদের আন্দোলন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তথা সংসদীয় পদ্ধতির গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভের পর ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধান ওয়েস্টমিনিস্টার পদ্ধতির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করে সংবিধান নির্মাণের দীর্ঘদিনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়। এভাবে সুস্থ সংসদীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে গণতন্ত্র নির্মাণ ও রাষ্ট্রের মৌল বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করে জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন এবং উন্নয়ন অর্জনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। তবে হতাশাজনকভাবে স্বাধীনতা-উত্তরকালের সংসদীয় কার্যক্রম ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে। ১৯৭৩ সাল থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশে নয়টি জাতীয় সংসদ হয়েছে। নব্বইয়ের দশকের শেষে কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসনের অবসান হলে ১৯৯১ সালে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সর্বসম্মতিক্রমে সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতির পুনঃপ্রবর্তন সংসদীয় যাত্রায় নতুন মাত্রা যোগ করে। ইতিমধ্যে পঞ্চম, অষ্টম এবং বর্তমানে নবম জাতীয় সংসদের কার্যক্রম দেশবাসী প্রত্যক্ষ করছে। সার্বিকভাবে এসব সংসদের অর্জনকে নেতিবাচক বলা যাবে না। তবে যেসব উপাদান সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করেছে এবং করছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাজনৈতিক অসহনশীলতা। এর প্রকাশ ঘটানো হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক, সৌজন্যহীন, অপরিশীলিত বক্তব্য, বিবৃতিদান ইত্যাদির মাধ্যমে। এর সীমানা দলীয় সভা বা রাজনৈতিক মাঠেই শুধু সীমাবদ্ধ থাকেনি, উপস্থাপন করা হয়েছে জাতীয় সংসদের আনুষ্ঠানিক ফ্লোরে। ’৯১-পরবর্তী সংসদগুলোতে এসব দৃষ্টান্ত লক্ষ করা গেলেও চলমান নবম সংসদ অতীতের সব মাত্রাকে যেন ছাড়িয়ে গেছে। জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদ বলতে বাধ্য হয়েছেন যে ‘সাংসদদের অশালীন বক্তব্য সরকারি দল, বিরোধী দল, সংসদ ও জাতির জন্য লজ্জাকর’ (প্রথম আলো, ২০ মার্চ, ২০১২)।
ওই বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে বাংলাদেশে ব্যবহূত রাজনৈতিক পরিভাষা বিশেষত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রায়োগকৃত ভাষা গণতান্ত্রিক রাজনীতি, সংসদীয় আচার-আচরণের সঙ্গে কোনোভাবেই সংগতিপূর্ণ নয়। তবে তা চলমান সংঘাতময় রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সাংঘাতিকভাবে সংগতিপূর্ণ। ’৯১-পরবর্তী সময় সংসদীয় প্রক্রিয়া, আচার, প্রথা ও সংস্কৃতি নির্মাণে সরকার ও বিরোধী পক্ষের মতৈক্যহীনতা জাতীয় সংসদকে অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। একই সঙ্গে প্রধান বিরোধী দলের লাগাতার সংসদ বয়কট গণতন্ত্রায়ণের পথ কণ্টকময় করে। সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈরিতাগুলো অকার্যকর সংসদ এবং এলিট বলয়ে রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত করে। গঠনমূলক রাজনীতির অভাব, কথাসর্বস্ব ও বাগাড়ম্বরপূর্ণ রাজনীতিচর্চার ফলে দেশের প্রকৃত সমস্যা, অর্থনীতি ও অন্যান্য মৌল বিষয় উপেক্ষিত হয়। ইস্যুভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার স্থলে নৈরাশ্যজনক বিভক্তি ও দ্বন্দ্ব দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে গ্রাস করে। আন্তর্দলীয় রাজনীতি রাজপথকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে এবং দলের নিয়ন্ত্রিত বাহিনী হিসেবে ছাত্রসমাজ, শ্রমিক ও অন্যান্য গোষ্ঠী ব্যবহূত হতে থাকে। সমাজের বিভিন্ন শক্তি, সংগঠন এমনকি সিভিল সোসাইটির মধ্যেও দলীয় ভিত্তিতে বিভক্তি এবং পারস্পরিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী সকল পক্ষ দলীয় সুরে কথা বলায় অর্থপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সমঝোতার ফর্মুলা প্রণয়নের সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়। সংসদে এবং সংসদের বাইরে অসহনশীল আচরণ বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয় এবং অগণতন্ত্রসুলভ পরিবেশ অব্যাহত রাখে। এ জন্য বাংলাদেশের দলীয় কাঠামোয় গণতন্ত্রচর্চার অভাব, রাজনৈতিক সুবিধাবাদ, কেন্দ্র-নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনী মনোনয়ন প্রক্রিয়া, অস্বচ্ছ দলীয় তহবিল ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা, সহিংস রাজনৈতিক সম্পর্ক, পৃষ্ঠপোষক-অধস্তন কাঠামোকে স্থায়ী করা চলে।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের গঠন, কাঠামো, কার্যাবলি, সংসদের প্লেনারি এবং কমিটি অধিবেশনসহ সাংসদদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে দেশের সংবিধান এবং জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিলি বা pules of proudare of partiament-এ দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে। উল্লেখ্য, সাংসদেরা প্লেনারি অধিবেশনে এককভাবে এবং কমিটি অধিবেশনে যৌথভাবে সংসদীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন। একক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সাংসদের প্রশ্নোত্তর পর্ব, রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনা, দৃষ্টি আকর্ষণ আলোচনা ইত্যাদি প্রাধান্য পায়। এসব সংসদীয় মেকানিজমের মূল উদ্দেশ্য হলো সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ সরকার তথা নির্বাহীর দায়িত্বশীলতা দাবি এবং স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করা। দুর্ভাগ্যক্রমে সাম্প্রতিক সংসদগুলোসহ বর্তমান সংসদের বর্ণিত সংসদীয় অস্ত্র ব্যবহারে কোনো কোনো ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থ অধিক প্রাধান্য পেয়েছে। দলীয় স্বার্থের বিষয়টি সংসদে বিরোধী দলের ক্ষণিক উপস্থিতি ও অংশগ্রহণে বেশি প্রকট হয়েছে। উত্তরপক্ষের সংঘাতময় রাজনৈতিক সম্পর্ক সংসদের ‘ব্যাকবেঞ্চার’ ও পরোক্ষভাবে নির্বাচিত নারী সাংসদদের কু-বক্তব্যে ও আচরণে প্রতিফলিত হয়েছে। এ আচরণ বিরোধী দল সমন্বয়ে সংসদের ওভারসাইট বা তদারকি ভূমিকা ক্ষুণ্ন করেছে। অসংসদীয় পরিভাষা তথা আপত্তিকর বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করা হলেও এ দেশের জাতীয় সংসদের ইতিহাসে কালো দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে।
বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের সংসদে প্রতিপক্ষ সংসদদের মধ্যে বিবাদ-কলহের দৃষ্টান্ত রয়েছে। পার্শ্ববর্তী ভারত ও জাপানের সংসদেও হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছে। তবে এগুলো নিতান্তই ব্যতিক্রম, নিত্যদিনের ঘটনা নয়। দলীয় ও সংসদীয় রাজনীতি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। এ জন্য সাংসদদের আচরণ সুষ্ঠ করার লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন সংসদে ‘সংসদীয় আচরণবিধি’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এর পাশাপাশি নৈতিকতা ও গণতন্ত্রের মান সমুন্নত রাখতে নৈতিকতার বিধান সংযোজিত হয়েছে। ব্রিটেনের সংসদ তথা কমন্স সভায় সাংসদদের আচরণ নিয়ন্ত্রণে code of conduct এবং নির্দেশিকা প্রণীত হয়েছে। এ বিধির উদ্দেশ্য হলো, জনআস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে একজন সাংসদকে যা অনুসরণ করতে হবে তা হচ্ছে স্বার্থপরহীনতা (selflessness), সংহতি (integrity), বস্তুনিষ্ঠতা (objectivity), দায়িত্বশীলতা (acccoontability), উন্মুক্ততা (openness), সততা (honesty) এবং নেতৃত্ব (leadership)। ব্রিটেনের সংসদে আচরণবিধির পাশাপাশি ‘পার্লামেন্টারি কমিশনার’ (যাকে অন্যান্য দেশে ওমহুডসম্যান বলা হয়) এবং ‘কমিটি অন স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড প্রিডিলেজ’-এর ভূমিকা পালনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এসব কাঠামোগত বিন্যাস সংসদীয় কর্মকাণ্ডকে আরও ফলপ্রসূ ও গণতন্ত্রকে মজবুত করে, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশেও সাংসদদের আচরণ সুষ্ঠু করার উদ্দেশ্যে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ লক্ষ করা যাচ্ছে। সম্প্রতি সাবের হোসেন চৌধুরী (নির্বাচনী এলাকা-১৮২, ঢাকা-৯) আনীত ‘সংসদ সদস্যগণের আচরণ’ নির্ধারণকল্পে প্রস্তুতকৃত বিল নম্বর-৫-এর প্রসঙ্গ প্রণিধানযোগ্য। এ বিলে সাংসদদের নৈতিক চরিত্রের অধিকারী, যৌক্তিক চিন্তার ধারক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী, দুর্নীতি ও অপরাধমুক্ত হওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহিষ্ণুতা প্রদর্শন, জনজবাবদিহি, আর্থিক তথ্য-প্রমাণসহ নিজ দায়িত্ব পালনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। আচরণবিধি বাস্তবায়নের জন্য স্পিকারের নেতৃত্বে এথিকস বা নৈতিকতা কমিটি গঠনেরও উল্লেখ রয়েছে।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদকে কার্যকর করার লক্ষ্যে আচরণবিধি ও সংশ্লিষ্ট আইন প্রণয়ন চলমান রাজনীতির প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত জরুরি বিষয়। আর এ আইন প্রণীত হতে হবে সকল পক্ষের মতৈক্যের ভিত্তিতে। সংসদীয় সংস্কৃতি নির্মাণের সঙ্গে সংসদীয় পরিশীলিত পরিভাষার ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। গণতান্ত্রিক, সহনশীল ও সুষ্ঠু পরিভাষা রপ্তকরণ ও প্রয়োগের জন্য আবশ্যক যথাযথ রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা ও দীক্ষাদান, সাংসদদের বিশেষত নবীন ও সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদদের প্রশিক্ষণ প্রদান, কার্যপ্রণালি বিধি অনুসরণ, সাংসদদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য কঠোর আইন তৈরি, অসংসদীয় ভাষা ব্যবহারকারী সাংসদের জন্য তিরস্কারের বিধান চালু বা শাস্তি প্রদান ইত্যাদি। এ প্রক্রিয়ায় স্টেকহোল্ডারসহ দেশের বিভিন্ন সচেতন সামাজিক গোষ্ঠী ও সিভিল সোসাইটির ভূমিকা পালন অনস্বীকার্য। আরও প্রয়োজন নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রতিনিধিত্ব বিশেষত আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব প্রদান, দলীয় ও সংসদীয় কাঠামোয় অধিক গণতন্ত্রায়ণ বাস্তবায়ন এবং ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় জাতীয় সংসদে দুটি কক্ষ তথা দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
আল মাসুদ হাসানউজ্জামান: অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
পাকিস্তানের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির প্রথম দশকে পূর্ব বাংলায় দুইটি সংসদীয় সভা গঠন করা হয় এবং ওই সময়ই সংসদের সাংগঠনিক কাঠামোর দুর্বলতা, সরকারি দলের একচেটিয়া মনোভাব, স্পিকারের ঈপ্সিত ভূমিকা পালনের ব্যর্থতা, সংসদীয় দলগুলোর মতপার্থক্য এবং পারস্পরিক সহনশীলতার অভাব ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান হয়। ফলে একপর্যায়ে তৎকালীন ডেপুটি স্পিকার শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত, আহত ও মৃত্যুবরণ করেন। প্রায় এক দশকের বিভিন্ন জটিলতা ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানে সংসদীয় ধাঁচের সংবিধান প্রণীত হওয়ার পরও কেন্দ্রে এবং প্রদেশে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকে। ফলে সংসদীয় রীতিনীতি-সংবলিত সংসদ ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ সম্ভবপর হয়নি।
পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিদের আন্দোলন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তথা সংসদীয় পদ্ধতির গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভের পর ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধান ওয়েস্টমিনিস্টার পদ্ধতির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করে সংবিধান নির্মাণের দীর্ঘদিনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়। এভাবে সুস্থ সংসদীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে গণতন্ত্র নির্মাণ ও রাষ্ট্রের মৌল বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করে জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন এবং উন্নয়ন অর্জনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। তবে হতাশাজনকভাবে স্বাধীনতা-উত্তরকালের সংসদীয় কার্যক্রম ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে। ১৯৭৩ সাল থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশে নয়টি জাতীয় সংসদ হয়েছে। নব্বইয়ের দশকের শেষে কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসনের অবসান হলে ১৯৯১ সালে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সর্বসম্মতিক্রমে সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতির পুনঃপ্রবর্তন সংসদীয় যাত্রায় নতুন মাত্রা যোগ করে। ইতিমধ্যে পঞ্চম, অষ্টম এবং বর্তমানে নবম জাতীয় সংসদের কার্যক্রম দেশবাসী প্রত্যক্ষ করছে। সার্বিকভাবে এসব সংসদের অর্জনকে নেতিবাচক বলা যাবে না। তবে যেসব উপাদান সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করেছে এবং করছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাজনৈতিক অসহনশীলতা। এর প্রকাশ ঘটানো হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক, সৌজন্যহীন, অপরিশীলিত বক্তব্য, বিবৃতিদান ইত্যাদির মাধ্যমে। এর সীমানা দলীয় সভা বা রাজনৈতিক মাঠেই শুধু সীমাবদ্ধ থাকেনি, উপস্থাপন করা হয়েছে জাতীয় সংসদের আনুষ্ঠানিক ফ্লোরে। ’৯১-পরবর্তী সংসদগুলোতে এসব দৃষ্টান্ত লক্ষ করা গেলেও চলমান নবম সংসদ অতীতের সব মাত্রাকে যেন ছাড়িয়ে গেছে। জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদ বলতে বাধ্য হয়েছেন যে ‘সাংসদদের অশালীন বক্তব্য সরকারি দল, বিরোধী দল, সংসদ ও জাতির জন্য লজ্জাকর’ (প্রথম আলো, ২০ মার্চ, ২০১২)।
ওই বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে বাংলাদেশে ব্যবহূত রাজনৈতিক পরিভাষা বিশেষত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রায়োগকৃত ভাষা গণতান্ত্রিক রাজনীতি, সংসদীয় আচার-আচরণের সঙ্গে কোনোভাবেই সংগতিপূর্ণ নয়। তবে তা চলমান সংঘাতময় রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সাংঘাতিকভাবে সংগতিপূর্ণ। ’৯১-পরবর্তী সময় সংসদীয় প্রক্রিয়া, আচার, প্রথা ও সংস্কৃতি নির্মাণে সরকার ও বিরোধী পক্ষের মতৈক্যহীনতা জাতীয় সংসদকে অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। একই সঙ্গে প্রধান বিরোধী দলের লাগাতার সংসদ বয়কট গণতন্ত্রায়ণের পথ কণ্টকময় করে। সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈরিতাগুলো অকার্যকর সংসদ এবং এলিট বলয়ে রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত করে। গঠনমূলক রাজনীতির অভাব, কথাসর্বস্ব ও বাগাড়ম্বরপূর্ণ রাজনীতিচর্চার ফলে দেশের প্রকৃত সমস্যা, অর্থনীতি ও অন্যান্য মৌল বিষয় উপেক্ষিত হয়। ইস্যুভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার স্থলে নৈরাশ্যজনক বিভক্তি ও দ্বন্দ্ব দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে গ্রাস করে। আন্তর্দলীয় রাজনীতি রাজপথকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে এবং দলের নিয়ন্ত্রিত বাহিনী হিসেবে ছাত্রসমাজ, শ্রমিক ও অন্যান্য গোষ্ঠী ব্যবহূত হতে থাকে। সমাজের বিভিন্ন শক্তি, সংগঠন এমনকি সিভিল সোসাইটির মধ্যেও দলীয় ভিত্তিতে বিভক্তি এবং পারস্পরিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী সকল পক্ষ দলীয় সুরে কথা বলায় অর্থপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সমঝোতার ফর্মুলা প্রণয়নের সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়। সংসদে এবং সংসদের বাইরে অসহনশীল আচরণ বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয় এবং অগণতন্ত্রসুলভ পরিবেশ অব্যাহত রাখে। এ জন্য বাংলাদেশের দলীয় কাঠামোয় গণতন্ত্রচর্চার অভাব, রাজনৈতিক সুবিধাবাদ, কেন্দ্র-নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনী মনোনয়ন প্রক্রিয়া, অস্বচ্ছ দলীয় তহবিল ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা, সহিংস রাজনৈতিক সম্পর্ক, পৃষ্ঠপোষক-অধস্তন কাঠামোকে স্থায়ী করা চলে।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের গঠন, কাঠামো, কার্যাবলি, সংসদের প্লেনারি এবং কমিটি অধিবেশনসহ সাংসদদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে দেশের সংবিধান এবং জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিলি বা pules of proudare of partiament-এ দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে। উল্লেখ্য, সাংসদেরা প্লেনারি অধিবেশনে এককভাবে এবং কমিটি অধিবেশনে যৌথভাবে সংসদীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন। একক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সাংসদের প্রশ্নোত্তর পর্ব, রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনা, দৃষ্টি আকর্ষণ আলোচনা ইত্যাদি প্রাধান্য পায়। এসব সংসদীয় মেকানিজমের মূল উদ্দেশ্য হলো সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ সরকার তথা নির্বাহীর দায়িত্বশীলতা দাবি এবং স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করা। দুর্ভাগ্যক্রমে সাম্প্রতিক সংসদগুলোসহ বর্তমান সংসদের বর্ণিত সংসদীয় অস্ত্র ব্যবহারে কোনো কোনো ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থ অধিক প্রাধান্য পেয়েছে। দলীয় স্বার্থের বিষয়টি সংসদে বিরোধী দলের ক্ষণিক উপস্থিতি ও অংশগ্রহণে বেশি প্রকট হয়েছে। উত্তরপক্ষের সংঘাতময় রাজনৈতিক সম্পর্ক সংসদের ‘ব্যাকবেঞ্চার’ ও পরোক্ষভাবে নির্বাচিত নারী সাংসদদের কু-বক্তব্যে ও আচরণে প্রতিফলিত হয়েছে। এ আচরণ বিরোধী দল সমন্বয়ে সংসদের ওভারসাইট বা তদারকি ভূমিকা ক্ষুণ্ন করেছে। অসংসদীয় পরিভাষা তথা আপত্তিকর বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করা হলেও এ দেশের জাতীয় সংসদের ইতিহাসে কালো দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে।
বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের সংসদে প্রতিপক্ষ সংসদদের মধ্যে বিবাদ-কলহের দৃষ্টান্ত রয়েছে। পার্শ্ববর্তী ভারত ও জাপানের সংসদেও হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছে। তবে এগুলো নিতান্তই ব্যতিক্রম, নিত্যদিনের ঘটনা নয়। দলীয় ও সংসদীয় রাজনীতি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। এ জন্য সাংসদদের আচরণ সুষ্ঠ করার লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন সংসদে ‘সংসদীয় আচরণবিধি’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এর পাশাপাশি নৈতিকতা ও গণতন্ত্রের মান সমুন্নত রাখতে নৈতিকতার বিধান সংযোজিত হয়েছে। ব্রিটেনের সংসদ তথা কমন্স সভায় সাংসদদের আচরণ নিয়ন্ত্রণে code of conduct এবং নির্দেশিকা প্রণীত হয়েছে। এ বিধির উদ্দেশ্য হলো, জনআস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে একজন সাংসদকে যা অনুসরণ করতে হবে তা হচ্ছে স্বার্থপরহীনতা (selflessness), সংহতি (integrity), বস্তুনিষ্ঠতা (objectivity), দায়িত্বশীলতা (acccoontability), উন্মুক্ততা (openness), সততা (honesty) এবং নেতৃত্ব (leadership)। ব্রিটেনের সংসদে আচরণবিধির পাশাপাশি ‘পার্লামেন্টারি কমিশনার’ (যাকে অন্যান্য দেশে ওমহুডসম্যান বলা হয়) এবং ‘কমিটি অন স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড প্রিডিলেজ’-এর ভূমিকা পালনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এসব কাঠামোগত বিন্যাস সংসদীয় কর্মকাণ্ডকে আরও ফলপ্রসূ ও গণতন্ত্রকে মজবুত করে, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশেও সাংসদদের আচরণ সুষ্ঠু করার উদ্দেশ্যে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ লক্ষ করা যাচ্ছে। সম্প্রতি সাবের হোসেন চৌধুরী (নির্বাচনী এলাকা-১৮২, ঢাকা-৯) আনীত ‘সংসদ সদস্যগণের আচরণ’ নির্ধারণকল্পে প্রস্তুতকৃত বিল নম্বর-৫-এর প্রসঙ্গ প্রণিধানযোগ্য। এ বিলে সাংসদদের নৈতিক চরিত্রের অধিকারী, যৌক্তিক চিন্তার ধারক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী, দুর্নীতি ও অপরাধমুক্ত হওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহিষ্ণুতা প্রদর্শন, জনজবাবদিহি, আর্থিক তথ্য-প্রমাণসহ নিজ দায়িত্ব পালনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। আচরণবিধি বাস্তবায়নের জন্য স্পিকারের নেতৃত্বে এথিকস বা নৈতিকতা কমিটি গঠনেরও উল্লেখ রয়েছে।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদকে কার্যকর করার লক্ষ্যে আচরণবিধি ও সংশ্লিষ্ট আইন প্রণয়ন চলমান রাজনীতির প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত জরুরি বিষয়। আর এ আইন প্রণীত হতে হবে সকল পক্ষের মতৈক্যের ভিত্তিতে। সংসদীয় সংস্কৃতি নির্মাণের সঙ্গে সংসদীয় পরিশীলিত পরিভাষার ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। গণতান্ত্রিক, সহনশীল ও সুষ্ঠু পরিভাষা রপ্তকরণ ও প্রয়োগের জন্য আবশ্যক যথাযথ রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা ও দীক্ষাদান, সাংসদদের বিশেষত নবীন ও সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদদের প্রশিক্ষণ প্রদান, কার্যপ্রণালি বিধি অনুসরণ, সাংসদদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য কঠোর আইন তৈরি, অসংসদীয় ভাষা ব্যবহারকারী সাংসদের জন্য তিরস্কারের বিধান চালু বা শাস্তি প্রদান ইত্যাদি। এ প্রক্রিয়ায় স্টেকহোল্ডারসহ দেশের বিভিন্ন সচেতন সামাজিক গোষ্ঠী ও সিভিল সোসাইটির ভূমিকা পালন অনস্বীকার্য। আরও প্রয়োজন নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রতিনিধিত্ব বিশেষত আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব প্রদান, দলীয় ও সংসদীয় কাঠামোয় অধিক গণতন্ত্রায়ণ বাস্তবায়ন এবং ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় জাতীয় সংসদে দুটি কক্ষ তথা দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
আল মাসুদ হাসানউজ্জামান: অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments