কালের পুরাণ-ক্ষমতা বদল, মমতা বদলাবেন কি? by সোহরাব হাসান

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে এবার বামফ্রন্ট যে পরাজিত হবে, সে কথা বিমান বসু ছাড়া আর সবাই ধারণা করেছিলেন। বিমান বসু বর্তমানে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান। তিনি সব সময় চাঁছাছোলা কথা বলেন, যা মাঝেমধ্যে অভব্যতার পর্যায়ে পড়ে।

বিধানসভা নির্বাচন সামনে রেখে সেখানকার পত্রিকাগুলো একাধিকবার জনমত জরিপ করে এবং প্রতিটিতেই দেখা যায়, তৃণমূল-কংগ্রেস জোট অনেক বেশি আসনে জয়ী হচ্ছে। আর যায় কোথা? বিমান বসু সংবাদমাধ্যমকে একেবারে তুলোধোনা করলেন, নাগরিক সমাজকেও বেশ চটিয়ে দিলেন। সর্বশেষ বুথ-ফেরত জরিপকে উড়িয়ে দিয়ে তিনি বললেন, যেসব সাংবাদিক এ জরিপ ছাপিয়ে তৃণমূলকে বিজয়ী করেছেন, তাঁরা আহাম্মক ছাড়া কিছু নন। তাঁরা টাকা খেয়ে এ কাজ করেছেন। বৃহস্পতিবার কলকাতার গণমাধ্যমে এটি ছিল মুখরোচক খবর। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল বিমান বসুর বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেছে। সাংবাদিকেরা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন, ভোটের ফলাফলের সঙ্গে বুথ-ফেরত জরিপ মিলে গেলে তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিতে হবে। তার আগেই অবশ্য জনগণ বিমান বসুর দলের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তথ্য-উপাত্ত ছাড়া মনগড়া প্রতিবেদন লেখার জন্য যেমন সাংবাদিকের শাস্তি হওয়া উচিত, তেমনি রাজনীতিকদেরও কথাবার্তায়ও শালীনতা থাকা উচিত। তাঁরা চান, সাংবাদিকেরা কেবল তাঁদের প্রশংসা করবেন, সমর্থন জানাবেন, জয়ধ্বনি দেবেন; কিন্তু দুর্বলতার কথা বলতে পারবেন না। বললেই প্রতিপক্ষের দালাল বলে চিহ্নিত হবেন। যখন যে দল হারে, সেই দল আর কাউকে সামনে না পেয়ে সাংবাদিকদের একহাত নেন। বিমান বসুর মতো পুরোনো মার্ক্সবাদী রাজনীতিক কেন সেই কাজটি করতে গেলেন, তা রহস্যাবৃত। তিনি সাংবাদিকদের গালাগাল না করে মানুষের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করলে বামফ্রন্টের বিপর্যয়টা কমানো যেত। এর পাশাপাশি বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কথা ভাবুন। বিমান বসুর মতো তিনি কাউকে আঘাত করে কথা বলেন না। নিজের ও দলের হার বুঝতে পেরে ফল ঘোষণার আগেই গতকাল তিনি রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে এসেছেন। জনরায় মেনে নেওয়াই গণতন্ত্র।

২.
নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণাকালে শুক্রবার তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কালীঘাটে তাঁর বাড়ির দহলিজে তাৎক্ষণিক যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, তাতে সহিষ্ণুতার পাশাপাশি বামফ্রন্টের প্রতি তির্যক মন্তব্যও ছিল। তিনি বলেছেন, ৩৪ বছর পর রাজ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ বক্তব্য সমঝোতার বদলে বৈরিতাকেই উসকে দেবে। তবে মমতার যে কথাটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে তা হলো ‘এই বিজয় বাংলার মানুষের জন্য উৎসর্গ করা হলো।’ এখানেই মমতার অনন্যতা। যদি ক্ষমতার পাঁচটি বছর তিনি এ কথা মনে রাখেন, পশ্চিমবঙ্গের মানুষও তাঁকে মনে রাখবে। রাজনীতিক হিসেবে মমতা যেমন অসাধারণ কিছু গুণের অধিকারী, তেমনি ঘন ঘন অবস্থান বদলের কারণে তাঁর প্রতি অনেকেই আস্থা রাখতে পারছেন না।
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কাটিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। দিনভর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বিধানসভা নির্বাচনের ফল। ভারতের পাঁচটি রাজ্যে একই সময়ে নির্বাচন হলেও কোথাও এতটা উত্তাপ ছড়ায়নি। প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেস সভানেত্রীও নির্বাচনী প্রচারণায় অন্য রাজ্যে যাননি। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, ‘এবার তারা পরিবর্তনের পক্ষে। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট ২৩৩টি আসন পেয়েছিল, পাঁচ বছরের ব্যবধানে তা ষাটের কোঠায় নেমে আসাকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক বলা যায় না। বামফ্রন্টের অধিকাংশ মন্ত্রী পরাজিত হয়েছেন। ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনেও যখন তৃণমূল আশাতীত ভালো ফল করল, তখনো বামফ্রন্ট কুম্ভকর্ণের ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। বামফ্রন্টের ব্যর্থতা হলো গণমানুষ থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, জনগণের জীবনমান উন্নয়নে তেমন কিছু না করা, কর্মী-ক্যাডারের ওপর বেশি নির্ভরশীল হওয়া, ক্ষমতাকে স্থায়ী ভাবা।

৩.
গত নির্বাচনে মমতার স্লোগান ছিল, ‘আসুন, সব উল্টে-পাল্টে দিই।’ এবারের স্লোগান, ‘মা মাটি মানুষ। বদলা নয়, বদল চাই।’ পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সেই বদলের পক্ষে রায় দিয়েছেন। কথা হলো, মমতা তৃণমূল নিজে বদলাতে পারবেন কি না। মানুষ তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে। তৃণমূলের সহযোগী রাজ্য কংগ্রেসের কাছে তারা বেশি কিছু আশা করে না। কেননা ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার পর থেকে কংগ্রেস কখনোই এ রাজ্যে কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। আগে কংগ্রেস নেতাদের ঠাট্টা করে বলা হতো ‘তরমুজ’—বাইরে সবুজ, ভেতরে লাল। কংগ্রেস নেতারা প্রকাশ্যে বাম সরকারের বিরোধিতা করলেও গোপনে নানা সুযোগ-সুবিধা নিতেন। এই দ্বৈত ভূমিকার কারণে সেখানে কংগ্রেস নামক দলটিকে হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজতে হয়। পশ্চিমবঙ্গে মমতার যে ভাবমূর্তি, তা তাঁর ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য বিশাল সম্পদ হতে পারে। আবার সামান্য ভুল ডেকে আনতে পারে সর্বনাশ। মমতা জনদরদি ও সাহসী, তাঁর সততা নিয়েও কোনো প্রশ্ন নেই। রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে এসব গুণ অনেক বেশি সাফল্য এনে দেয়। বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল-কংগ্রেস জোটের বিজয়ের সিংহভাগ কৃতিত্ব তাঁর। কিন্তু ঘন ঘন অবস্থান ও নীতি পরিবর্তন রাজনীতিতে বে-গুণ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেত্রী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। সেখান থেকে শিল্পোদ্যোক্তাদের বিতাড়িত করেছেন। যে ন্যানো গাড়ি এখন গুজরাটে বানানো হচ্ছে, সেটি পশ্চিমবঙ্গেও বানানোর কথা ছিল। মমতার বিরোধিতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। এতে চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। বামফ্রন্ট সেখানে শক্তি প্রয়োগ করে ভুল করেছে। তাদের উচিত ছিল এলাকাবাসীকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করানো। গত মঙ্গলবার উত্তর প্রদেশের নওদায়েও অধিগ্রহণ হয়ে যাওয়া ভূমির মালিকদের প্রতি রাহুল গান্ধী যেটুকু সহানুভূতি জানালেন, কৃষকদের সঙ্গে ধরনা দিতে গিয়ে নিজে গ্রেপ্তার হলেন, পশ্চিমবঙ্গের বাম নেতারা তার উল্টো পথেই হেঁটেছেন। জোর খাটিয়েছেন। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের ঘটনার তাৎক্ষণিক সুবিধা হয়তো মমতা পেয়েছেন, কিন্তু তাতে রাজ্যের বাসিন্দাদের বেকারত্ব দূর হবে কি? এখন বিজয়ী নেত্রী হিসেবে তিনি কি পশ্চিমবঙ্গে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য দরজা বন্ধ করে রাখবেন? মমতা এত দিন বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করে আসছেন, সেগুলো তাঁর সরকারের বিরুদ্ধেও আসবে না, তারই বা নিশ্চয়তা কী?
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বদলের পক্ষে রায় দিয়েছে নিজেদের ভাগ্য বদলের জন্য। সরকার যদি নিজেদের ভাগ্য বদল নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকে, তাহলে জনগণ বামফ্রন্টের মতোই তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। মমতা দিনবদলের ডাক দিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে নিজে কতটা বদলাবেন, সেটাই দেখার বিষয়।

৪.
ভারতের পাঁচটি রাজ্যে একই সময়ে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও সবার চোখ ছিল পশ্চিমবঙ্গের দিকে। এবারের নির্বাচনে যে মমতা ৩৪ বছর স্থায়ী বামফ্রন্ট সরকারকে শক্ত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবেন, তা সবারই জানা। তিনি আটঘাট বেঁধেই নেমেছেন। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেছেন। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রথম ধাক্কা খায় বামফ্রন্ট। তৃণমূল ১৬টি আসন ছিনিয়ে নেয়। কিন্তু এবারের ধাক্কাটি এতই ব্যাপক ও জোরালো যে বামফ্রন্ট মাথা তুলেই দাঁড়াতে পারেনি। ২৯৪ আসনের বিধানসভায় বামফ্রন্ট এগিয়ে আছে মাত্র ৬৫তে।
নির্বাচনী লড়াইয়ে পশ্চিমবঙ্গের ভোটাররা মমতার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন। প্রত্যাখ্যান করেছেন বামফ্রন্টকে। এতে প্রমাণিত হয়, জনপ্রিয়তা কারও একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। ভালো কাজ করলে মানুষ সমর্থন দেবে, না করলে সমর্থন তুলে নেবে। সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ জানানোর আর কোনো অস্ত্র নেই। শেষ দুই মেয়াদে বামফ্রন্ট সরকার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, চাওয়া-পাওয়া পূরণে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। দলীয় কর্মীদের মাস্তানি ও সন্ত্রাস সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। তাদের মধ্যে আত্মম্ভরিতা এসে গিয়েছিল যে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ নেই। অর্থনীতি ভঙ্গুর, কৃষি উৎপাদন বাড়েনি। অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। শ্রমিকেরা বেকার হয়ে পড়েছেন। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মান নিম্নমুখী। এসব কারণে রাজ্যজুড়ে সামাজিক অস্থিরতা ছিল। পিছিয়ে পড়া যে মানুষগুলো বামফ্রন্টের মূল শক্তি, তাদের সঙ্গেও দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিল। ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের ভোট একচেটিয়া বামফ্রন্ট পেলেও তাদের কল্যাণে তেমন কিছু করেনি। সাচার কমিটির প্রতিবেদনে সামাজিক বৈষম্যের ভয়ংকর চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রতিবাদ হয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। কোনো প্রতিকার হয়নি। মানুষ সেই প্রতিকারের জন্যই পরিবর্তন চেয়েছে। প্রশ্ন হলো, পরিবর্তনটাকে মমতা কোন দিকে নিয়ে যাবেন—শিল্পায়ন, না শিল্প বন্ধের পথে? সুশাসন না দলীয় শাসনের পথে? বন্ধুত্ব না বৈরিতার পথে?
মমতার সততা, দক্ষতা ও জনগণের প্রতি মমতার যে ভালোবাসা, সে ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু সেই সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি তাঁর চরম অবস্থানের কথাও জানি। গণতন্ত্রের মূল কথা হলো, একযোগে কাজ করা, ভিন্নমতকে সহ্য করা। মমতা কি পারবেন সেই কাজটি করতে?
আরেকটি বিষয়ের প্রতি হবু মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করব। কয়েক মাস আগে বাংলাদেশ ও ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী বৈঠক করে তিস্তা নদীর পানি বণ্টনে একটি চুক্তি করার ব্যাপারে মতৈক্যে পৌঁছান। কিন্তু চুক্তিটি হয়নি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন সামনে ছিল বলে। পানি বণ্টন কিংবা সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি রাজ্য সরকারের সম্মতি ছাড়া সম্ভব নয়। মমতা এ ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেন, সেটাও দেখার বিষয়। বামফ্রন্টের বিরোধিতা করতে গিয়ে ১৯৯৬ সালে তিনি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির ‘মৃদু ’বিরোধিতা করেছিলেন। তখন ছিলেন বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএর শরিক। এবারে কেন্দ্র ও রাজ্যে কংগ্রেসের মিত্র। কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তা নদীর পানি বণ্টন, ছিটমহল বদলসহ সীমান্ত সমস্যা সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কেন্দ্র (বর্তমানে রেলমন্ত্রী) থেকে রাজ্যে এসে নিশ্চয়ই মমতা সেই প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে যাবেন না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.