দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বন্যা-আক্রান্তদের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসন

সাম্প্রতিক অতিবর্ষণে খুলনার পাইকগাছা, সাতক্ষীরার তালা, কলারোয়া ও আশাশুনি এবং যশোরের মনিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা ঢলজনিত বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে এসব এলাকার সাড়ে ৭ লক্ষাধিক মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে মহাসড়কে আশ্রয় নিয়েছে।

ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে ৩৩০টি গ্রামের ৮৭ হাজার একর জমির ফসল, ১৭৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও প্রায় ১ লাখ ঘরবাড়ি। এরই মধ্যে খুলনা শহরের সঙ্গে সাতক্ষীরা, পাইকগাছা ও কয়রার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। জাতীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের তথ্যানুসারে দেশের উত্তর-পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের বন্যার পানি দ্রুত নেমে গেলেও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পানি নামতে কয়েক মাস লেগে যেতে পারে। কেননা এ অঞ্চলের পানি নিষ্কাশনের প্রধান পথগুলো পলি পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে।
আমরা জানি, গত বছর জাতীয় বাজেটে কপোতাক্ষ নদসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মরে যাওয়া নদীগুলো খননের জন্য ২৮১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এমনকি প্রকল্পটি গত ফেব্রুয়ারিতে (ফেব্রুয়ারি ২০১১) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদিতও হয়। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীন পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতির কারণে কোনো কাজ করা হয়নি। গত বছর 'কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প'-এর আওতায় খনন করা হলেও ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়। স্থানীয় জনগণের অভিযোগ, খননের নামে কপোতাক্ষ নদটি একটি খালের চেয়েও ছোট করে ফেলা হয়েছে। যে কারণে, এ বছর বর্ষা মৌসুম শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই কপোতাক্ষ ও এর শাখানদীর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো তলিয়ে যেতে শুরু করে। ধীরে ধীরে এ জলাবদ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে সাতক্ষীরার তালা, কলারোয়া ও আশাশুনি; যশোরের কেশবপুর ও মনিরামপুর এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও পাইকগাছা উপজেলা পর্যন্ত। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো, কয়রার মহারাজপুর ইউনিয়নও এ বছর ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে।
উপকূলীয় বেড়িবাঁধ প্রকল্পের (সিইপি) নির্মম শিকার হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাধারণ মানুষ আশির দশক থেকে দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতার শিকার হয়ে আসছে। নব্বইয়ের দশকে পুলিশি নির্যাতন উপেক্ষা করে জনগণ নিজস্ব ধারণায় বিল ডাকাতিয়া ও ভরত ভায়নায় 'জোয়ারাধার' বা টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) চালু করে। এর ফলে আবাদি জমি উঁচু হয়, নদীর নাব্যতা ফিরে আসে এবং জলাবদ্ধতা স্থায়ীভাবে দূর হয়ে যায়। এরপর গত ২০ বছর ধরে সাধারণ মানুষ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক হারে জোয়ারাধার চালু করার দাবি জানিয়ে আসছে। ২০০৫ সালে ভবদহে দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতার পরও জনগণ কার্যকরভাবে টিআরএম চালু করার জন্য দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু এ প্রক্রিয়া চালু করলে প্রকৌশলী-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায় বিধায় পানি উন্নয়ন বোর্ড কখনোই পর্যাপ্তসংখ্যক টিআরএম চালু করেনি। ফলে ক্রমাগত নদী মরে গেছে, যার ফল আজকের এই ক্রমবর্ধমান জলাবদ্ধতা।
ঢলের পানিতে তলিয়ে যাওয়া গ্রামগুলোর সিংহভাগই গরিব মানুষ, কৃষিই যাদের একমাত্র আয়ের উৎস। মাত্র কয়েকদিন আগে এ অঞ্চলে আমন চাষ শুরু হয়। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা তাদের সবটুকু সামর্থ্য ও পুঁজি বিনিয়োগ করে ফসলের দিকে মুখ চেয়ে বসে ছিলেন। কেউ কেউ ব্যাংক ও এনজিওদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েও বিনিয়োগ করেছিলেন কৃষিতে। আমন ফসল ডুবে যাওয়ায় ক্ষুদ্র কৃষকরা সামান্য ঝুপড়ি বেঁধে থাকারও ক্ষমতা হারিয়েছেন। খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। শিশু, নারী ও বৃদ্ধদের অবস্থা আরও করুণ। দুর্গতদের পুনর্বাসনে এখনও কোনো সামগ্রিক উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না, যদিও স্থানীয় সংসদ সদস্যরা ইতিমধ্যে দুর্গত এলাকা সফর করেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হলেও কোনো খাবার বা ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করা হয়নি। ইতিমধ্যে দুর্গত এলাকায় ব্যাপক হারে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। এনজিওগুলো তাদের কিস্তি আদায়ে দুর্গত মানুষকে তাড়া করে ফিরছে।
আমরা জেনেছি, গত ১১ আগস্ট স্বাস্থ্যমন্ত্রী এক সপ্তাহের মধ্যে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড কি এই নির্দেশ যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে পালন করেছে? রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতির মহীরুহে পরিণত হয়েছে। অনেকে প্রতিষ্ঠানটিকে 'পানিবিষয়ক দুর্নীতি বোর্ড' নামে আখ্যায়িত করেন। মনে আছে? গত ২০১০ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও পানি উন্নয়ন বোর্ড আইলাদুর্গত এলাকার বেড়িবাঁধ নির্মাণে কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। অনেকেই জলাবদ্ধ তালা, কলারোয়া, পাইকগাছা, আশাশুনি, কেশবপুর ও মনিরামপুর উপজেলাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। আমরা এ দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করছি এবং অবিলম্বে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করে ত্বরিত ত্রাণ ও পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। আসন্ন সর্বজনীন ঈদ উৎসব থেকে এই সাড়ে ৭ লাখ মানুষ যেন বঞ্চিত না হয় তা দেখার দায়িত্ব সরকারের।
২০০৯ সালে বর্তমান সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন প্রণয়নে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইতিমধ্যে চূড়ান্ত খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনটি কার্যকর হলে জনগণ দুর্যোগের জন্য দায়ী কিংবা দুর্যোগের সময় দায়িত্ব পালনে গাফিলতির জন্য সংশিল্গষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর অধিকার পেত। এ ছাড়া এ আইন অনুসারে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি দুর্যোগাক্রান্ত এলাকাকে 'দুর্গত এলাকা' ঘোষণারও দায়িত্ব পেত। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্রম বৃদ্ধি ও প্রেক্ষাপটে এ ধরনের আইন দরকারি। শোনা গিয়েছিল সংসদের চলতি অধিবেশনে আইনটি পাস হবে। কিন্তু তার কোনো আলামত এখনও দেখা যাচ্ছে না। এটিও কি আমলাতন্ত্রের হাতে বন্দি হয়ে পড়বে? আমরা দাবি করছি_ পানিবন্দি উপজেলাগুলোকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করে পর্যাপ্ত খাদ্য, পানীয় জল, চিকিৎসা সহায়তা ও আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে; পানি সরানোর জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বাধ্য করতে হবে। এ কাজে ব্যর্থতার জন্য সংশিল্গষ্ট কর্মকর্তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে; পানি নিষ্কাশন পথের ওপর থেকে সব বাধা অপসারণ করতে হবে; 'কপোতাক্ষ খনন প্রকল্প'সহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদীগুলো খনন করে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা স্বাভাবিক করতে হবে; সংসদের এ অধিবেশনেই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন পাস ও কার্যকর করার ব্যবস্থা করতে হবে; সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জোয়ারাধার চালু করে জলাবদ্ধতা দূর করতে হবে এবং নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে; দুর্গত এলাকার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের কৃষিঋণ ও ক্ষুদ্রঋণ মওকুফ করতে হবে এবং পানি সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের বীজ, সার, সেচ ও কীটনাশকের সহায়তা দিতে হবে।

লেখকবৃন্দ : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মানবাধিকারকর্মী, প্রকৌশলী
 

No comments

Powered by Blogger.