কলকাতার চিঠি-লালবাড়িতে সবুজ বিপ্লব এবং মমতা by অমর সাহা
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি সাধারণত দুটি বাড়ি নিয়ে আবর্তিত হয়। বাড়ি দুটিই লাল। দুটি বাড়িরই অবস্থান কলকাতার কেন্দ্রস্থলে। একটি বিবাদিবাগে। আগের সেই ডালহৌসি স্কয়ারে। আর অন্যটি ধর্মতলায়। ধর্মতলাকে এখনো বলা হয় এসপ্লানেড। দুটি বাড়ির একটি রাজ্য সচিবালয়—মহাকরণ।
আবার বলা হয় রাইটার্স বিল্ডিংও। অন্যটি পৌরভবন—কলকাতা পৌর করপোরেশনের অফিস। রাইটার্স বিল্ডিংকে বলা হয় ১ নম্বর লালবাড়ি আর পৌর ভবনকে বলা হয় ২ নম্বর লালবাড়ি। এই দুই বাড়ির দুই প্রধান চেয়ারে বসেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও কলকাতার মেয়র। আর এই দুই বাড়িকে কেন্দ্র করেই এখনো পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি আবর্তিত হয়।
এই লালবাড়ির দখল নিয়ে পাঁচ বছর পর পর লড়াই হয়। দুই নম্বর লালবাড়িটার দখল নিয়ে সর্বশেষ লড়াই হয়েছিল ২০১০ সালে। সেদিনের লড়াইয়ে দুই দলের কমান্ডার ছিলেন তখনকার কলকাতার মেয়র বিকাশ ভট্টাচার্য আর বর্তমান মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। বিকাশ ছিলেন বামদলের লাল ঝান্ডা নিয়ে আর শোভন ছিলেন তৃণমূলের কমলা-সাদা-সবুজ রঙের ঝান্ডা নিয়ে। সেই লড়াইয়ে পরাজিত হয়েছিল লাল ঝান্ডার দল। আর জয়ী হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসের কমলা-সাদা-সবুজের দল। ক্ষমতায় বসেছিলেন জোড়াফুলের ঝান্ডাধারী শোভন চট্টোপাধ্যায় আর পরাজিত হয়েছিলেন কাস্তে-হাতুড়ির ঝান্ডাবাহী বিকাশ ভট্টাচার্য।
এবার লড়াই হলো কলকাতার ১ নম্বর লালবাড়িটার দখল নিয়ে। একদিকে লাল ঝান্ডাধারী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, অন্যদিকে কমলা-সাদা-সবুজ ঝান্ডাধারী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই লড়াইয়ে হেরে গেলেন বুদ্ধদেব। জিতলেন মমতা। এবার এই বাড়ির চেয়ারে বসবেন মমতা। লালবাড়ির দখল নেবেন তিনি।
কলকাতার এই ১ নম্বর লালবাড়ির ইতিহাস পুরোনো। এটি এক ঐতিহাসিক বাড়ি।
ব্রিটিশ ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কর্মরত করণিক বা রাইটার্সদের জন্য সেই ১৬৩০ সালে এটি তৈরি করা হয়েছিল। ১৬৯৫ সালের ২৫ জুন এ বাড়িকে রাইটার্স বিল্ডিং হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ যেসব কর্মচারী করণিক পদে থেকে কাজ করতেন, তখন তাঁদের বলা হতো রাইটার্স। আর সেই রাইটার্স থেকে হয়ে যায় রাইটার্স বিল্ডিং—আজকের মহাকরণ—রাজ্য সচিবালয়। তখন এই ভবন এলাকার ব্যাপ্তি ছিল ২ দশমিক ৮ একর জমি। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ একর। এখন এখানে ছয় হাজার সরকারি কর্মী কাজ করেন।
আর ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই এই লালবাড়িটাকে নিয়ে কলকাতার রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে। ব্রিটিশরাও রাজত্ব করে গেছে এই ভবনে বসে। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই এই লালবাড়ি আজ এক ঐতিহাসিক ভবন হিসেবে স্বীকৃত। রাজনীতিও চলে এই লালবাড়ি ঘিরে। নির্বাচনের আগে দাবিও জোরদার হয় এই লালবাড়ির দখল নিয়ে। কে নিতে পারে এই লালবাড়ির দখল। দীর্ঘ ৩৪ বছর পর বামফ্রন্টের কাছ থেকে এই ১ নম্বর লালবাড়িটার দখল নিয়ে নিলেন মমতা। মমতাই এখন এই বাড়ির কর্তা। সেই ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত এই বাড়ির অধিকাংশ সময় দখল ছিল কংগ্রেসের হাতে। সেই ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৭—দীর্ঘ ৩০ বছর। আবার দীর্ঘ ৩৪ বছর দখলে রাখল বামফ্রন্ট। এবার নতুন করে এই বাড়ি দখলে রাখার জন্য জনগণের কাছ থেকে সার্টিফিকেট পেলেন মমতা।
মমতাই হচ্ছেন এই বাড়ির প্রথম নারী মুখ্যমন্ত্রী। শুধু তা-ই নয়, এই ভবনে এর আগে সাতজন মুখ্যমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করে গেছেন। মমতা হলেন অষ্টম মুখ্যমন্ত্রী, যিনি এই বাড়ির দখল পেলেন। এর আগে এই বাড়ির দখল ছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে। ছিলেন প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ (১৯৪৭-৪৮), ডা. বিধান চন্দ্র রায় (১৯৪৮-৬২), প্রফুল্ল চন্দ্র সেন (১৯৬২-৬৭), অজয় কুমার মুখার্জি (১৯৬৭ সালের মার্চ থেকে নভেম্বর), প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ (১৯৬৭-৬৮), অজয় কুমার মুখার্জি (১৯৬৭-৭১), সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় (১৯৭২-৭৭) ও জ্যোতি বসু (১৯৭৭-২০০০)। আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছিলেন ২০০০-২০১১ পর্যন্ত।
এদিকে এই বাড়ি নিয়ে ইতিমধ্যে একটি প্রশ্ন উঠে এসেছে রাজনৈতিক মহলে। মমতার ভক্তরা নির্বাচনের আগেই মমতার কাছে একটি প্রশ্নও তুলেছিলেন, তিনি জিতলে সত্যি কি পাল্টে দেবেন বাড়ির লাল রং? তবে মমতা এই প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেননি। এবার নির্বাচনে জয়ের পর মমতার একান্ত ভক্তরা চাইছেন, মমতা পাল্টে দিক লালবাড়ির রংটা। লাল তো সিপিএমের রং। না-হয় ওখানে আসুক সবুজ রং। কিন্তু সেই প্রশ্নের জবাব এখনো আসেনি। তবে এ কথা ঠিক, মমতা রেলমন্ত্রী হওয়ার পর বহু রেলস্টেশন, এমনকি শিয়ালদহ রেলস্টেশনের রংও বদলে দিয়েছেন। তবে কলকাতার রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা এমনটা মনে করেন না যে মমতা পাল্টে দেবেন ১ নম্বর লালবাড়িটার রং। কারণ, সুদীর্ঘকাল ধরে এই লাল রং গায়ে মেখে কলকাতার কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে আছে এই লালবাড়িটা। ঠিক একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে কলকাতার ২ নম্বর লালবাড়িটাও। সেই কলকাতা পৌর করপোরেশন ভবনও। মমতা লালবাড়ি নিয়ে সবুজ বিপ্লব করলেও লালবাড়িটা অতীতের ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে বলেই মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা।
এত কথার মাঝে এখন নতুন করে এই ১ নম্বর লালবাড়িটা সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছেন মমতা। বলেছেন, এখান থেকে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হয়ে প্রথম যুদ্ধ শুরু করবেন। তারপর তিনি হাসি ফোটাবেন রাজ্যবাসীর মুখে। তাই রাজ্যবাসীও এখন তাকিয়ে আছেন মমতার দিকে। দেখতে চাইছেন এই ১ নম্বর লালবাড়ি থেকে মমতার যুদ্ধ। রাজ্যকে গড়ার যুদ্ধ।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।
এই লালবাড়ির দখল নিয়ে পাঁচ বছর পর পর লড়াই হয়। দুই নম্বর লালবাড়িটার দখল নিয়ে সর্বশেষ লড়াই হয়েছিল ২০১০ সালে। সেদিনের লড়াইয়ে দুই দলের কমান্ডার ছিলেন তখনকার কলকাতার মেয়র বিকাশ ভট্টাচার্য আর বর্তমান মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। বিকাশ ছিলেন বামদলের লাল ঝান্ডা নিয়ে আর শোভন ছিলেন তৃণমূলের কমলা-সাদা-সবুজ রঙের ঝান্ডা নিয়ে। সেই লড়াইয়ে পরাজিত হয়েছিল লাল ঝান্ডার দল। আর জয়ী হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসের কমলা-সাদা-সবুজের দল। ক্ষমতায় বসেছিলেন জোড়াফুলের ঝান্ডাধারী শোভন চট্টোপাধ্যায় আর পরাজিত হয়েছিলেন কাস্তে-হাতুড়ির ঝান্ডাবাহী বিকাশ ভট্টাচার্য।
এবার লড়াই হলো কলকাতার ১ নম্বর লালবাড়িটার দখল নিয়ে। একদিকে লাল ঝান্ডাধারী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, অন্যদিকে কমলা-সাদা-সবুজ ঝান্ডাধারী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই লড়াইয়ে হেরে গেলেন বুদ্ধদেব। জিতলেন মমতা। এবার এই বাড়ির চেয়ারে বসবেন মমতা। লালবাড়ির দখল নেবেন তিনি।
কলকাতার এই ১ নম্বর লালবাড়ির ইতিহাস পুরোনো। এটি এক ঐতিহাসিক বাড়ি।
ব্রিটিশ ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কর্মরত করণিক বা রাইটার্সদের জন্য সেই ১৬৩০ সালে এটি তৈরি করা হয়েছিল। ১৬৯৫ সালের ২৫ জুন এ বাড়িকে রাইটার্স বিল্ডিং হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ যেসব কর্মচারী করণিক পদে থেকে কাজ করতেন, তখন তাঁদের বলা হতো রাইটার্স। আর সেই রাইটার্স থেকে হয়ে যায় রাইটার্স বিল্ডিং—আজকের মহাকরণ—রাজ্য সচিবালয়। তখন এই ভবন এলাকার ব্যাপ্তি ছিল ২ দশমিক ৮ একর জমি। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ একর। এখন এখানে ছয় হাজার সরকারি কর্মী কাজ করেন।
আর ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই এই লালবাড়িটাকে নিয়ে কলকাতার রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে। ব্রিটিশরাও রাজত্ব করে গেছে এই ভবনে বসে। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই এই লালবাড়ি আজ এক ঐতিহাসিক ভবন হিসেবে স্বীকৃত। রাজনীতিও চলে এই লালবাড়ি ঘিরে। নির্বাচনের আগে দাবিও জোরদার হয় এই লালবাড়ির দখল নিয়ে। কে নিতে পারে এই লালবাড়ির দখল। দীর্ঘ ৩৪ বছর পর বামফ্রন্টের কাছ থেকে এই ১ নম্বর লালবাড়িটার দখল নিয়ে নিলেন মমতা। মমতাই এখন এই বাড়ির কর্তা। সেই ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত এই বাড়ির অধিকাংশ সময় দখল ছিল কংগ্রেসের হাতে। সেই ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৭—দীর্ঘ ৩০ বছর। আবার দীর্ঘ ৩৪ বছর দখলে রাখল বামফ্রন্ট। এবার নতুন করে এই বাড়ি দখলে রাখার জন্য জনগণের কাছ থেকে সার্টিফিকেট পেলেন মমতা।
মমতাই হচ্ছেন এই বাড়ির প্রথম নারী মুখ্যমন্ত্রী। শুধু তা-ই নয়, এই ভবনে এর আগে সাতজন মুখ্যমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করে গেছেন। মমতা হলেন অষ্টম মুখ্যমন্ত্রী, যিনি এই বাড়ির দখল পেলেন। এর আগে এই বাড়ির দখল ছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে। ছিলেন প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ (১৯৪৭-৪৮), ডা. বিধান চন্দ্র রায় (১৯৪৮-৬২), প্রফুল্ল চন্দ্র সেন (১৯৬২-৬৭), অজয় কুমার মুখার্জি (১৯৬৭ সালের মার্চ থেকে নভেম্বর), প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ (১৯৬৭-৬৮), অজয় কুমার মুখার্জি (১৯৬৭-৭১), সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় (১৯৭২-৭৭) ও জ্যোতি বসু (১৯৭৭-২০০০)। আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছিলেন ২০০০-২০১১ পর্যন্ত।
এদিকে এই বাড়ি নিয়ে ইতিমধ্যে একটি প্রশ্ন উঠে এসেছে রাজনৈতিক মহলে। মমতার ভক্তরা নির্বাচনের আগেই মমতার কাছে একটি প্রশ্নও তুলেছিলেন, তিনি জিতলে সত্যি কি পাল্টে দেবেন বাড়ির লাল রং? তবে মমতা এই প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেননি। এবার নির্বাচনে জয়ের পর মমতার একান্ত ভক্তরা চাইছেন, মমতা পাল্টে দিক লালবাড়ির রংটা। লাল তো সিপিএমের রং। না-হয় ওখানে আসুক সবুজ রং। কিন্তু সেই প্রশ্নের জবাব এখনো আসেনি। তবে এ কথা ঠিক, মমতা রেলমন্ত্রী হওয়ার পর বহু রেলস্টেশন, এমনকি শিয়ালদহ রেলস্টেশনের রংও বদলে দিয়েছেন। তবে কলকাতার রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা এমনটা মনে করেন না যে মমতা পাল্টে দেবেন ১ নম্বর লালবাড়িটার রং। কারণ, সুদীর্ঘকাল ধরে এই লাল রং গায়ে মেখে কলকাতার কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে আছে এই লালবাড়িটা। ঠিক একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে কলকাতার ২ নম্বর লালবাড়িটাও। সেই কলকাতা পৌর করপোরেশন ভবনও। মমতা লালবাড়ি নিয়ে সবুজ বিপ্লব করলেও লালবাড়িটা অতীতের ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে বলেই মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা।
এত কথার মাঝে এখন নতুন করে এই ১ নম্বর লালবাড়িটা সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছেন মমতা। বলেছেন, এখান থেকে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হয়ে প্রথম যুদ্ধ শুরু করবেন। তারপর তিনি হাসি ফোটাবেন রাজ্যবাসীর মুখে। তাই রাজ্যবাসীও এখন তাকিয়ে আছেন মমতার দিকে। দেখতে চাইছেন এই ১ নম্বর লালবাড়ি থেকে মমতার যুদ্ধ। রাজ্যকে গড়ার যুদ্ধ।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।
No comments