চারদিক-মুল্লুকে চলো by আকমল হোসেন
স্বপ্নভরা চোখ নিয়ে একদিন একদল মানুষ আপন নাড়িপোঁতা মাটি ছেড়ে দেশান্তরী হয়েছিল। তাদের বুকভরা প্রত্যাশা ছিল—পরিবার, সন্তান নিয়ে আরও উন্নত, সচ্ছল ও সুন্দর একটি জীবন। কিন্তু খুব দ্রুতই স্বপ্নচ্যুতি ঘটে। চরম হতাশায় ডোবে তারা।
যে উন্নতির আশা নিয়ে ছুটে এসেছিল, সেই জীবন থেকে আপন মাটির কাছে ফিরে যাওয়ার টান তাদের আকুল করে তোলে। সেই টানে যখন তারা পথে নামল, দেখল পথে পথে অনেক বাধা। ফেরার পথ মসৃণ নয়, বিপৎসংকুল। তবু মুক্তির অদম্যতায় সব বাধাই তুচ্ছ মনে হয়েছে। জীবনের রক্তে পথ লাল করেছে। এখন বছর ঘুরলে তাদের সেই রক্ত লাল করা সময়টিকে কেউ কেউ মনে করে। অনেকেই মনে রাখে না। আপন মাটি, আপন মানুষ ও আপন সংস্কৃতি থেকে একদল মানুষ বাঁচার জন্য জীবনকে পথেই নিঃশেষ করেছে।
এখন বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের কথা বললে আরও অনেক কিছুর সঙ্গে চা-বাগানের কথাটা অনেকেরই মনে আসে। তখন এই অঞ্চলে চা ছিল অজানা এক উদ্ভিদ। আজকের এই চা-রাজ্য তৈরির পেছনে সেই রক্ত লাল করা মানুষগুলোর অবদান রয়েছে। এটা হয়তো অনেকেরই জানা নেই, পথে বের হওয়া সেই স্বপ্নকাতর মানুষগুলোর রক্ত ও জীবনের বিনিময়ে চা-বাগান আজ এমন সবুজ হয়েছে। চায়ের পাতা হয়েছে নগদ অর্থ উপার্জনের মাধ্যম।
১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়া চা-বাগান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চা-বাগান তৈরি শুরু হয়। ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের টিলাভূমিতে চা-বাগান তৈরি করতে থাকে। চা-বাগান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন পড়ে বিপুল পরিমাণ চা-শ্রমিকের। কিন্তু এই অঞ্চলে পাহাড়ি জমিতে সাপ-জোঁক ও পোকামাকড়ের মধ্যে কাজ করার শ্রমিকের অভাব। ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো দালাল বা ফড়িয়ার মাধ্যমে দক্ষিণ ও মধ্য ভারতের তৎকালীন ওড়িষ্যা, মাদ্রাজ, বিহার, মধ্যপ্রদেশের অভাবপীড়িত ও অনুর্বর অঞ্চলে জাল বিস্তার করে। হাজার হাজার মানুষকে সুন্দর ও উন্নত জীবনের মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে চা-বাগান তৈরির জন্য নিয়ে আসে।
চা-শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, চা-বাগান কোম্পানির মালিকেরা তখন সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখা এই মানুষগুলোকে আসাম ও বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের গহিন জঙ্গলে চা-বাগান প্রস্তুত করার অমানুষিক কাজে বাধ্য করে। মালিকেরা চা-শ্রমিকদের নিয়মিত এক বেলা পেট পুরে খেতেও দিত না। অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে অনেক শ্রমিকই অসুখে-বিসুখে আক্রান্ত হন। তার ওপর কথায় কথায় তাঁদের ওপর চালানো হতো শারীরিক নির্যাতন, নিপীড়ন।
এ অবস্থায় চা-শ্রমিকদের সুন্দর জীবনের মোহ কেটে যায়। অসহনীয় হয়ে ওঠে নিপীড়ন। তাঁরা গোপনে গোপনে ‘নিজ মুল্লুুুকে’ (নিজ দেশে) চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ‘নিজ মুল্লুুুকে’ ফিরে যাওয়ার পথ কারও জানা নেই। এঁরা হয়তো জন্মভিটা ছেড়ে এর আগে কোথাও যাননি। তাঁদের শুধু জানা ছিল, চাঁদপুর থেকে স্টিমারে কলকাতা যাওয়া যায়। এই জানাটুকুর পুঁজি নিয়েই ১৯২১ সালে দিনক্ষণ ঠিক করে কাছাড় ও সিলেটের প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক ‘মুল্লুকে চলো’ ডাক দিয়ে পথে নামেন। দিনের পর দিন দীর্ঘ পথ হেঁটে একসময় নদীবন্দর চাঁদপুরে পৌঁছান। পথে পথে খাদ্যের অভাব ও অসুখে অনেক শিশু ও নারীর মৃত্যু ঘটে। এ সময় চা-শ্রমিকদের এই স্বতঃস্ফূর্ত ‘মুল্লুকে চলো’ আন্দোলনে নেতৃত্বে দেন চা-শ্রমিকনেতা পণ্ডিত দেওশরণ ও পণ্ডিত গঙ্গা দীক্ষিত।
এদিকে চা-বাগান ছেড়ে বেরিয়ে আসা চা-শ্রমিকদের পথ রোধ করতে নানা ফন্দি করে চা-বাগানের মালিকেরা। সরকারের সহযোগিতায় শ্রমিকদের পথ রোধ করতে চাঁদপুরে মোতায়েন করা হয় আসাম রাইফেলের গোর্খা সৈন্য। তাতে কী, শ্রমিকেরাও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন, তাঁরা দাসত্বের এ শৃঙ্খল ছিন্ন করে নিজ মুল্লুকে পৌঁছাবেনই। তাঁরা হয়তো বুঝতে পারেন, আজীবন দাসত্বের শৃঙ্খলে তাঁরা বাঁধা পড়েছেন। এই দাসত্বে আর আবদ্ধ থাকতে চান না তাঁরা। শ্রমিকেরা স্টিমারে উঠতে চাইলে গোর্খা সৈন্যের প্রতিরোধের মুখে পড়েন। শ্রমিকেরা তখন বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। শ্রমিকদের বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ করতে সৈন্যরা নির্বিচারে গুলি করে। এতে স্টিমারঘাট ও রেলস্টেশনে অপেক্ষমাণ বিপুলসংখ্যক শ্রমিক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এই সংখ্যা কত? এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু এটি এই অঞ্চলে চা-বাগান গড়ে ওঠার ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি ঘটনা। ২০ মে এলেই তাই সেদিনটিকে এখনো কেউ কেউ মনে করেন। কারও কাছে এটি নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনে প্রেরণা জোগানোর এক শক্তি।
চা শ্রমিকনেতা রামভজন কৈরী বলেন, ‘চা-শ্রমিকদের ওপর খুব বড় ধরনের নির্যাতনের ঘটনা এটি। শ্রমিকদের দমন-পীড়নের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে এই দিনটি অনুপ্রেরণা জুগিয়ে চলছে। এদিন শ্রমিকদের পাখির মতো গুলি করে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছিল। সেই সময়ের কাগজপত্র থেকে ঠিক কতজনের মৃত্যু হয়েছিল, সেই পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। এই হত্যার প্রতিবাদে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের কর্মচারীরা সে সময় ১০দিন ধর্মঘট করেছিলেন।’
বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ফেডারেশন আজ শুক্রবার (২০ মে) এই দিনটিকে চা-শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করছে। এ উপলক্ষে তারা বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে। বিভিন্ন চা-বাগানেও অনাড়ম্বরভাবে সেই দিন জীবন দেওয়া মানুষগুলোকে স্মরণ করা হবে।
আকমল হোসেন
প্রথম আলোর মৌলভীবাজার প্রতিনিধি
এখন বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের কথা বললে আরও অনেক কিছুর সঙ্গে চা-বাগানের কথাটা অনেকেরই মনে আসে। তখন এই অঞ্চলে চা ছিল অজানা এক উদ্ভিদ। আজকের এই চা-রাজ্য তৈরির পেছনে সেই রক্ত লাল করা মানুষগুলোর অবদান রয়েছে। এটা হয়তো অনেকেরই জানা নেই, পথে বের হওয়া সেই স্বপ্নকাতর মানুষগুলোর রক্ত ও জীবনের বিনিময়ে চা-বাগান আজ এমন সবুজ হয়েছে। চায়ের পাতা হয়েছে নগদ অর্থ উপার্জনের মাধ্যম।
১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়া চা-বাগান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চা-বাগান তৈরি শুরু হয়। ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের টিলাভূমিতে চা-বাগান তৈরি করতে থাকে। চা-বাগান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন পড়ে বিপুল পরিমাণ চা-শ্রমিকের। কিন্তু এই অঞ্চলে পাহাড়ি জমিতে সাপ-জোঁক ও পোকামাকড়ের মধ্যে কাজ করার শ্রমিকের অভাব। ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো দালাল বা ফড়িয়ার মাধ্যমে দক্ষিণ ও মধ্য ভারতের তৎকালীন ওড়িষ্যা, মাদ্রাজ, বিহার, মধ্যপ্রদেশের অভাবপীড়িত ও অনুর্বর অঞ্চলে জাল বিস্তার করে। হাজার হাজার মানুষকে সুন্দর ও উন্নত জীবনের মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে চা-বাগান তৈরির জন্য নিয়ে আসে।
চা-শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, চা-বাগান কোম্পানির মালিকেরা তখন সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখা এই মানুষগুলোকে আসাম ও বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের গহিন জঙ্গলে চা-বাগান প্রস্তুত করার অমানুষিক কাজে বাধ্য করে। মালিকেরা চা-শ্রমিকদের নিয়মিত এক বেলা পেট পুরে খেতেও দিত না। অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে অনেক শ্রমিকই অসুখে-বিসুখে আক্রান্ত হন। তার ওপর কথায় কথায় তাঁদের ওপর চালানো হতো শারীরিক নির্যাতন, নিপীড়ন।
এ অবস্থায় চা-শ্রমিকদের সুন্দর জীবনের মোহ কেটে যায়। অসহনীয় হয়ে ওঠে নিপীড়ন। তাঁরা গোপনে গোপনে ‘নিজ মুল্লুুুকে’ (নিজ দেশে) চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ‘নিজ মুল্লুুুকে’ ফিরে যাওয়ার পথ কারও জানা নেই। এঁরা হয়তো জন্মভিটা ছেড়ে এর আগে কোথাও যাননি। তাঁদের শুধু জানা ছিল, চাঁদপুর থেকে স্টিমারে কলকাতা যাওয়া যায়। এই জানাটুকুর পুঁজি নিয়েই ১৯২১ সালে দিনক্ষণ ঠিক করে কাছাড় ও সিলেটের প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক ‘মুল্লুকে চলো’ ডাক দিয়ে পথে নামেন। দিনের পর দিন দীর্ঘ পথ হেঁটে একসময় নদীবন্দর চাঁদপুরে পৌঁছান। পথে পথে খাদ্যের অভাব ও অসুখে অনেক শিশু ও নারীর মৃত্যু ঘটে। এ সময় চা-শ্রমিকদের এই স্বতঃস্ফূর্ত ‘মুল্লুকে চলো’ আন্দোলনে নেতৃত্বে দেন চা-শ্রমিকনেতা পণ্ডিত দেওশরণ ও পণ্ডিত গঙ্গা দীক্ষিত।
এদিকে চা-বাগান ছেড়ে বেরিয়ে আসা চা-শ্রমিকদের পথ রোধ করতে নানা ফন্দি করে চা-বাগানের মালিকেরা। সরকারের সহযোগিতায় শ্রমিকদের পথ রোধ করতে চাঁদপুরে মোতায়েন করা হয় আসাম রাইফেলের গোর্খা সৈন্য। তাতে কী, শ্রমিকেরাও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন, তাঁরা দাসত্বের এ শৃঙ্খল ছিন্ন করে নিজ মুল্লুকে পৌঁছাবেনই। তাঁরা হয়তো বুঝতে পারেন, আজীবন দাসত্বের শৃঙ্খলে তাঁরা বাঁধা পড়েছেন। এই দাসত্বে আর আবদ্ধ থাকতে চান না তাঁরা। শ্রমিকেরা স্টিমারে উঠতে চাইলে গোর্খা সৈন্যের প্রতিরোধের মুখে পড়েন। শ্রমিকেরা তখন বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। শ্রমিকদের বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ করতে সৈন্যরা নির্বিচারে গুলি করে। এতে স্টিমারঘাট ও রেলস্টেশনে অপেক্ষমাণ বিপুলসংখ্যক শ্রমিক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এই সংখ্যা কত? এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু এটি এই অঞ্চলে চা-বাগান গড়ে ওঠার ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি ঘটনা। ২০ মে এলেই তাই সেদিনটিকে এখনো কেউ কেউ মনে করেন। কারও কাছে এটি নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনে প্রেরণা জোগানোর এক শক্তি।
চা শ্রমিকনেতা রামভজন কৈরী বলেন, ‘চা-শ্রমিকদের ওপর খুব বড় ধরনের নির্যাতনের ঘটনা এটি। শ্রমিকদের দমন-পীড়নের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে এই দিনটি অনুপ্রেরণা জুগিয়ে চলছে। এদিন শ্রমিকদের পাখির মতো গুলি করে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছিল। সেই সময়ের কাগজপত্র থেকে ঠিক কতজনের মৃত্যু হয়েছিল, সেই পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। এই হত্যার প্রতিবাদে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের কর্মচারীরা সে সময় ১০দিন ধর্মঘট করেছিলেন।’
বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ফেডারেশন আজ শুক্রবার (২০ মে) এই দিনটিকে চা-শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করছে। এ উপলক্ষে তারা বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে। বিভিন্ন চা-বাগানেও অনাড়ম্বরভাবে সেই দিন জীবন দেওয়া মানুষগুলোকে স্মরণ করা হবে।
আকমল হোসেন
প্রথম আলোর মৌলভীবাজার প্রতিনিধি
No comments