মনের কোণে হীরে-মুক্তো-অর্থ কি কেবলই অনর্থের মূল by ড. সা'দত হুসাইন
একটি বাংলা দৈনিকে সম্প্রতি প্রখ্যাত সাহিত্যিক এবং দার্শনিক হাসান আজিজুল হকের অর্থ-দর্শনের ওপর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের ওপর একজন বিদগ্ধ এবং মননশীল ব্যক্তির সাক্ষাৎকার হিসেবে এর বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে। সাক্ষাৎকারটি একজন সাহিত্যিক এবং জীবনদর্শী হিসেবে জনাব হকের ভাবমূর্তি সমুন্নত করেছে।
অর্থ উপার্জন, বিশেষ করে অর্থ-সঞ্চয়, এর প্রতি তাঁর উদাসীনতা বা অনীহা যেকোনো প্রদীপ্তমনা জ্ঞানপিপাসুকে উজ্জীবিত করবে সন্দেহ নেই। আমরা আশান্বিত হই যে আমাদের সমাজে হাসান আজিজুল হকের মতো আরো অনেক ব্যক্তি আছেন, যাঁরা অর্থ উপার্জনের ঘোরে সদা ব্যস্ত না থেকে মহত্তর কোনো কাজে সময় ব্যয় করাকে বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেন।
হাসান হকের বক্তব্যের মূলভাব অক্ষুণ্ন রেখে অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমি একে সম্প্রসারিত করার তাগিদ অনুভব করছি। মুদ্রা বা টাকা হচ্ছে মানবসভ্যতার এক মহৎ সৃষ্টি। কোনো দৈবাদেশে বা অকারণে যেমন এর আবির্ভাব ঘটেনি, তেমনি কোনো ঠুনকো খেলার সামগ্রী হিসেবে এটি বিরাজমান নয়। সেই প্রাচীনকাল থেকে টাকা বা মুদ্রা আমাদের জীবনযাত্রা সহজ করেছে, অর্থবহ করেছে বা সুন্দর করেছে- এমনটি জোর গলায় বলা না গেলেও মানবজীবনের অনেক সমস্যার সমাধান যে অর্থ দিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এরই ভিত্তিতে হয়তোবা রচিত হয়েছে অতি পরিচিত আপ্তবাক্যটির : 'মানি অ্যান্ড ম্যারেজ হ্যাভ দেয়ার ওন ইউসেজ।'
আমার এক বন্ধু বরফ আচ্ছাদিত সাইবেরিয়ার তেলক্ষেত্রে কয়েক মাস ধরে কাজ করছিল। আমেরিকার হিউস্টনের আরাম-আয়েশ ছেড়ে সাইবেরিয়ার প্রত্যন্ত প্রান্তে জনবিরল তেলক্ষেত্রের বৈরী পরিবেশে কী কারণে দিনের পর দিন সে খাটাখাটুনি করছে, তা শুধু টাকার মাহাত্ম্যে অনুধাবন করা যায়। টাকাই এ ক্ষেত্রে যাবতীয় সংযোগ, সমন্বয় এবং সান্ত্বনাদাতা অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে থাকে। আমাদের দেশেও অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দেখেছি, যাঁরা পরিবার-পরিজন থেকে বহু দূরে অবস্থান করে মেসে, ব্যারাকে বা ডরমিটরিতে থেকে চাকরি করে যাচ্ছেন। মাসের রোজগার থেকে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করছেন, সন্তানদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করছেন। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্টের কথা কে না জানে। উপার্জিত টাকাই তাদের দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে দেয়, তাদের সজীব-সতেজ রাখে। তাদের পরিবার-পরিজন, স্ত্রী-সন্তানদের মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখে। বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে মুদ্রা বা টাকা না থাকলে এসব কোনো দিনই সম্ভব হতো না। মানুষের প্রতিভা, প্রজ্ঞা, দক্ষতা এবং কাজের প্রকৃতি-পদ্ধতির মূল্যায়ন-দণ্ড কিংবা প্রতিফলক হিসেবে টাকার কার্যকারিতা সর্বজনস্বীকৃত। টাকা মানুষের জীবনে গতি দিয়েছে, স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে, সুখ দিয়েছে এবং সর্বোপরি জীবনযাত্রায় নতুনমাত্রা যোগ করেছে। লেনদেন কিংবা বড় মাপের কার্য সম্পাদনে টাকার কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।
ব্যক্তিগত, পারিবারিক কিংবা সামাজিক জীবনের অনেক অর্থবহির্ভূত সমস্যার সমাধানে অর্থ বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। যে সমস্যা মূলত আবেগসম্ভূত, যেখানে টাকার আপাত কোনো ভূমিকা নেই, দেখা যায় অনেক সময় সে সমস্যার সমাধানও শেষ পর্যন্ত অর্থনির্ভর হয়ে পড়ে। গল্প আছে যে- স্বামী-স্ত্রীর প্রতিকূল মনস্তাত্তি্বক কারণে একটি পরিবার প্রায় ভাঙনের প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে সহ্য করতে পারছিল না। অবশেষে ঠিক হলো তারা আলাদা বাড়িতে অবস্থান করবে। এতে অবশ্য অনেক খরচ পড়বে। তবে সে খরচ মেটানোর মতো টাকা তাদের ছিল। দুজন দুই বাড়িতে বসবাস করার মাধ্যমে তাদের মনস্তাত্তি্বক সমস্যার শেষ পর্যন্ত শুধু সমাধানই হয়নি, তাদের জীবন অনেকটা লাবণ্য-অমিতের মতো রোমান্টিক ধারায় বইতে শুরু করে।
টাকার প্রয়োজন, ব্যবহার এবং প্রকৃতি সর্বাঙ্গীণ সমরূপ নয়। একটি সুন্দর এবং পরিশীলিত জীবনযাপনের জন্য নূ্যনতম কিছু অর্থের প্রয়োজন হয়। আপনি কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, চাকরিজীবী, পেশাজীবী- যা-ই হন না কেন, এ পরিমাণ অর্থ না থাকলে আপনার জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়বে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে অবসর নেওয়া একজন অকৃতদার বিচারপতির অর্থাভাবজনিত সমস্যার কথা আমরা দৈনিক পত্রিকায় পড়েছি। আমাদের প্রশাসন বা সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোয় এ ধরনের একজন সৎ ব্যক্তিকে সুরক্ষা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সৎ ব্যক্তি হিসেবে তিনি হয়তো অনেক প্রশংসা পেয়েছেন; কিন্তু তাঁর অর্থাভাবজনিত অসহায়ত্ব আমাদের ব্যথিত করেছে। অত্যন্ত কাছে থেকে আমি সৎ কর্মকর্তাদের অবসরে যেতে দেখেছি। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদ, সন্তান-সন্ততির সু-প্রতিষ্ঠা কিংবা নিকটাত্মীয়দের সহায়তায় তাঁদের অনেকেই সচ্ছলভাবে অবসর জীবন যাপন করতে পেরেছেন। এ ধরনের সুবিধা যাঁদের ছিল না অবসরে যাওয়ার পর পরই তাঁদের চরম দুরবস্থায় পড়তে দেখেছি। নিজের যানবাহনের অভাবে তাঁদের রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে, সরকারি বা কম্পানির বাসা ছেড়ে দেওয়ার পর সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটি বাড়ি ভাড়া নেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া তাঁদের জন্য দুষ্কর হয়ে পড়েছে। অসুখ-বিসুখ হলে তো কথাই নেই, সম্পূর্ণ অসহায়, লাচার হয়ে পড়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এককথায় আর্থিক অসচ্ছলতা তাঁদের কুরে কুরে খাচ্ছে। তাঁদের সাহায্যে তেমন কেউ এগিয়ে আসছে না। চাকরিকালীন একটি মাসিক আয় নির্দিষ্ট ছিল, একটি সরকারি বাসা ছিল, মাসিক ২০০ টাকা পরিশোধের বিনিময়ে একক নিয়ন্ত্রণাধীনে চালকসহ একটি পূর্ণকালীন বাহন ছিল। পরিমিত ব্যয়ের মধ্যে সংসার চালানো সম্ভব ছিল। এখন পেনশনের টাকা ছাড়া আর কোনো আয় নেই বললেই চলে। সমাজে মানসম্মান নিয়ে টিকে থাকা অবসরপ্রাপ্ত সৎ ব্যক্তিদের পক্ষে আর সম্ভব হয়ে উঠছে না। টাকার মাহাত্ম্য আজ তাঁরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।
এরই বিপরীতে রয়েছে প্রতি মাসে অঢেল টাকা আয়। সীমাহীন সম্পদের মালিকানা। 'হাই ফাইন্যান্স, হাই লিভিং স্টাইল।' এখানে অর্থ অনর্থের মূল। দুষ্কর্ম এবং অপরাধের পেছনে মূলশক্তি। সমাজে যাদের অনুপার্জিত বাড়তি টাকা রয়েছে, তারা এ টাকার একাংশ প্রভাব সংগ্রহের কাজে নিয়মিত ব্যয় করে। ফলে তাদের মনে এ ধারণা জন্মায় যে তারা মোটামুটি যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারে। উপার্জিত টাকার মালিকরা সাধারণত এভাবে চিন্তা করেন না, তাঁরা কষ্টোপার্জিত টাকার সদ্ব্যবহার করতে চেষ্টা করেন। অনুপার্জিত বিপুল টাকার মালিকরা সমাজে নানা অপরাধের জন্ম দেয়। এসব অপরাধ করে তারা পার পেয়ে যায়। এ ধরনের টাকার প্রবাহ বন্ধ করতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশে অনুপার্জিত উচ্চ আয় বন্ধের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও এ আন্দোলন শুরু হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। হাসান হকের মতো প্রখ্যাত ব্যক্তিদের এ উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের অনেক মানুষ তাঁদের অনুসারী হবেন।
লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও পিএসসির
সাবেক চেয়ারম্যান
হাসান হকের বক্তব্যের মূলভাব অক্ষুণ্ন রেখে অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমি একে সম্প্রসারিত করার তাগিদ অনুভব করছি। মুদ্রা বা টাকা হচ্ছে মানবসভ্যতার এক মহৎ সৃষ্টি। কোনো দৈবাদেশে বা অকারণে যেমন এর আবির্ভাব ঘটেনি, তেমনি কোনো ঠুনকো খেলার সামগ্রী হিসেবে এটি বিরাজমান নয়। সেই প্রাচীনকাল থেকে টাকা বা মুদ্রা আমাদের জীবনযাত্রা সহজ করেছে, অর্থবহ করেছে বা সুন্দর করেছে- এমনটি জোর গলায় বলা না গেলেও মানবজীবনের অনেক সমস্যার সমাধান যে অর্থ দিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এরই ভিত্তিতে হয়তোবা রচিত হয়েছে অতি পরিচিত আপ্তবাক্যটির : 'মানি অ্যান্ড ম্যারেজ হ্যাভ দেয়ার ওন ইউসেজ।'
আমার এক বন্ধু বরফ আচ্ছাদিত সাইবেরিয়ার তেলক্ষেত্রে কয়েক মাস ধরে কাজ করছিল। আমেরিকার হিউস্টনের আরাম-আয়েশ ছেড়ে সাইবেরিয়ার প্রত্যন্ত প্রান্তে জনবিরল তেলক্ষেত্রের বৈরী পরিবেশে কী কারণে দিনের পর দিন সে খাটাখাটুনি করছে, তা শুধু টাকার মাহাত্ম্যে অনুধাবন করা যায়। টাকাই এ ক্ষেত্রে যাবতীয় সংযোগ, সমন্বয় এবং সান্ত্বনাদাতা অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে থাকে। আমাদের দেশেও অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দেখেছি, যাঁরা পরিবার-পরিজন থেকে বহু দূরে অবস্থান করে মেসে, ব্যারাকে বা ডরমিটরিতে থেকে চাকরি করে যাচ্ছেন। মাসের রোজগার থেকে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করছেন, সন্তানদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করছেন। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্টের কথা কে না জানে। উপার্জিত টাকাই তাদের দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে দেয়, তাদের সজীব-সতেজ রাখে। তাদের পরিবার-পরিজন, স্ত্রী-সন্তানদের মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখে। বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে মুদ্রা বা টাকা না থাকলে এসব কোনো দিনই সম্ভব হতো না। মানুষের প্রতিভা, প্রজ্ঞা, দক্ষতা এবং কাজের প্রকৃতি-পদ্ধতির মূল্যায়ন-দণ্ড কিংবা প্রতিফলক হিসেবে টাকার কার্যকারিতা সর্বজনস্বীকৃত। টাকা মানুষের জীবনে গতি দিয়েছে, স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে, সুখ দিয়েছে এবং সর্বোপরি জীবনযাত্রায় নতুনমাত্রা যোগ করেছে। লেনদেন কিংবা বড় মাপের কার্য সম্পাদনে টাকার কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।
ব্যক্তিগত, পারিবারিক কিংবা সামাজিক জীবনের অনেক অর্থবহির্ভূত সমস্যার সমাধানে অর্থ বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। যে সমস্যা মূলত আবেগসম্ভূত, যেখানে টাকার আপাত কোনো ভূমিকা নেই, দেখা যায় অনেক সময় সে সমস্যার সমাধানও শেষ পর্যন্ত অর্থনির্ভর হয়ে পড়ে। গল্প আছে যে- স্বামী-স্ত্রীর প্রতিকূল মনস্তাত্তি্বক কারণে একটি পরিবার প্রায় ভাঙনের প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে সহ্য করতে পারছিল না। অবশেষে ঠিক হলো তারা আলাদা বাড়িতে অবস্থান করবে। এতে অবশ্য অনেক খরচ পড়বে। তবে সে খরচ মেটানোর মতো টাকা তাদের ছিল। দুজন দুই বাড়িতে বসবাস করার মাধ্যমে তাদের মনস্তাত্তি্বক সমস্যার শেষ পর্যন্ত শুধু সমাধানই হয়নি, তাদের জীবন অনেকটা লাবণ্য-অমিতের মতো রোমান্টিক ধারায় বইতে শুরু করে।
টাকার প্রয়োজন, ব্যবহার এবং প্রকৃতি সর্বাঙ্গীণ সমরূপ নয়। একটি সুন্দর এবং পরিশীলিত জীবনযাপনের জন্য নূ্যনতম কিছু অর্থের প্রয়োজন হয়। আপনি কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, চাকরিজীবী, পেশাজীবী- যা-ই হন না কেন, এ পরিমাণ অর্থ না থাকলে আপনার জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়বে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে অবসর নেওয়া একজন অকৃতদার বিচারপতির অর্থাভাবজনিত সমস্যার কথা আমরা দৈনিক পত্রিকায় পড়েছি। আমাদের প্রশাসন বা সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোয় এ ধরনের একজন সৎ ব্যক্তিকে সুরক্ষা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সৎ ব্যক্তি হিসেবে তিনি হয়তো অনেক প্রশংসা পেয়েছেন; কিন্তু তাঁর অর্থাভাবজনিত অসহায়ত্ব আমাদের ব্যথিত করেছে। অত্যন্ত কাছে থেকে আমি সৎ কর্মকর্তাদের অবসরে যেতে দেখেছি। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদ, সন্তান-সন্ততির সু-প্রতিষ্ঠা কিংবা নিকটাত্মীয়দের সহায়তায় তাঁদের অনেকেই সচ্ছলভাবে অবসর জীবন যাপন করতে পেরেছেন। এ ধরনের সুবিধা যাঁদের ছিল না অবসরে যাওয়ার পর পরই তাঁদের চরম দুরবস্থায় পড়তে দেখেছি। নিজের যানবাহনের অভাবে তাঁদের রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে, সরকারি বা কম্পানির বাসা ছেড়ে দেওয়ার পর সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটি বাড়ি ভাড়া নেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া তাঁদের জন্য দুষ্কর হয়ে পড়েছে। অসুখ-বিসুখ হলে তো কথাই নেই, সম্পূর্ণ অসহায়, লাচার হয়ে পড়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এককথায় আর্থিক অসচ্ছলতা তাঁদের কুরে কুরে খাচ্ছে। তাঁদের সাহায্যে তেমন কেউ এগিয়ে আসছে না। চাকরিকালীন একটি মাসিক আয় নির্দিষ্ট ছিল, একটি সরকারি বাসা ছিল, মাসিক ২০০ টাকা পরিশোধের বিনিময়ে একক নিয়ন্ত্রণাধীনে চালকসহ একটি পূর্ণকালীন বাহন ছিল। পরিমিত ব্যয়ের মধ্যে সংসার চালানো সম্ভব ছিল। এখন পেনশনের টাকা ছাড়া আর কোনো আয় নেই বললেই চলে। সমাজে মানসম্মান নিয়ে টিকে থাকা অবসরপ্রাপ্ত সৎ ব্যক্তিদের পক্ষে আর সম্ভব হয়ে উঠছে না। টাকার মাহাত্ম্য আজ তাঁরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।
এরই বিপরীতে রয়েছে প্রতি মাসে অঢেল টাকা আয়। সীমাহীন সম্পদের মালিকানা। 'হাই ফাইন্যান্স, হাই লিভিং স্টাইল।' এখানে অর্থ অনর্থের মূল। দুষ্কর্ম এবং অপরাধের পেছনে মূলশক্তি। সমাজে যাদের অনুপার্জিত বাড়তি টাকা রয়েছে, তারা এ টাকার একাংশ প্রভাব সংগ্রহের কাজে নিয়মিত ব্যয় করে। ফলে তাদের মনে এ ধারণা জন্মায় যে তারা মোটামুটি যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারে। উপার্জিত টাকার মালিকরা সাধারণত এভাবে চিন্তা করেন না, তাঁরা কষ্টোপার্জিত টাকার সদ্ব্যবহার করতে চেষ্টা করেন। অনুপার্জিত বিপুল টাকার মালিকরা সমাজে নানা অপরাধের জন্ম দেয়। এসব অপরাধ করে তারা পার পেয়ে যায়। এ ধরনের টাকার প্রবাহ বন্ধ করতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশে অনুপার্জিত উচ্চ আয় বন্ধের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও এ আন্দোলন শুরু হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। হাসান হকের মতো প্রখ্যাত ব্যক্তিদের এ উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের অনেক মানুষ তাঁদের অনুসারী হবেন।
লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও পিএসসির
সাবেক চেয়ারম্যান
No comments