মিডিয়া ভাবনা-প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করতে হবে by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
বসুন্ধরা গ্রুপের আরেকটি দৈনিক পত্রিকা বাংলাদেশ প্রতিদিন (সম্পাদক: শাহজাহান সরদার) হলুদ সাংবাদিকতা করেছেন বলে ‘বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল’ রায় দিয়েছেন। এ জন্য প্রেস কাউন্সিল বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর প্রকাশক (মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন) ও সম্পাদককে ভর্ৎসনা ও সতর্ক করে দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, কয়েক সপ্তাহ আগে বসুন্ধরা গ্রুপের আরেকটি দৈনিক কালের কণ্ঠ-এর প্রকাশক ও সম্পাদককেও হলুদ সাংবাদিকতার জন্য সতর্ক করা হয়েছিল।
ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ হচ্ছে: দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন গত ৪ এপ্রিল ২০১০ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে যুক্ত করে অভিযুক্ত করা হয়। খবরের শিরোনাম ছিল: ‘একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা: মতিউর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে গোয়েন্দারা’। এ খবরটিকে আপত্তিকর, অসত্য ও বানোয়াট আখ্যায়িত করে মতিউর রহমান প্রেস কাউন্সিলে মামলা দায়ের করেন। পাঁচ দিন শুনানি শেষে, উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে প্রেস কাউন্সিল এই রায় দিয়েছেন। বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর উল্লিখিত প্রতিবেদনের কোনো বস্তুনিষ্ঠতা প্রেস কাউন্সিল খুঁজে পাননি। প্রেস কাউন্সিল তাঁদের রায়ে বলেছেন: তর্কিত সংবাদগুলো পড়লে মনে হয় যে এটা ব্যক্তিগত আক্রোশ ও বিষোদ্গার এবং সেই সঙ্গে অসত্য ও কুৎসাপ্রসূত সংবাদ। এর উদ্দেশ্য প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে জনসমক্ষে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা। কোনো দলিল-দস্তাবেজ বা সাক্ষীসাবুদ ছাড়া এ ধরনের সংবাদ হলুদ সাংবাদিকতার নামান্তর।
রায়ে আরও বলা হয়েছে: প্রতিবেদনে এমন সব অভিযোগ করা হয়েছে, যার সপক্ষে বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর আইনজীবী কোনো দলিল বা আইনগত ভিত্তি প্রকাশ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। রায়ে আরও বলা হয়েছে: বাংলাদেশ প্রতিদিন এ ধরনের সংবাদ ছাপিয়ে সাংবাদিকতার নীতিমালার মান ক্ষুণ্ন করেছে এবং সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে পেশাগত অসদাচরণ করেছে মর্মে প্রেস কাউন্সিলের বিশ্বাস জন্মেছে।’ (সূত্র: প্রথম আলো ১২ মে ২০১১)
হলুদ সাংবাদিকতা, মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য প্রকাশ করে নাগরিকের সম্মান ও বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করার অভিযোগে বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর প্রকাশক ও সম্পাদককে প্রেস কাউন্সিল সতর্ক করে দিয়েছেন। এর আগে বসুন্ধরা গ্রুপের আরেকটি দৈনিক কালের কণ্ঠ-এর প্রকাশক ও সম্পাদককেও প্রেস কাউন্সিল ভর্ৎসনা ও সতর্ক করে দিয়েছিলেন প্রায় একই রকম ভিত্তিহীন, বানোয়াট, মিথ্যা ও মানহানিকর খবর প্রকাশের জন্য। বসুন্ধরা গ্রুপের দুটি দৈনিক পত্রিকাই প্রেস কাউন্সিলের সতর্ক বাণী লাভ করেছে। আশা করি, পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদকেরা এখন বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পথে আসবেন। মিথ্যা ও বানোয়াট সংবাদ লিখে কয়েক শ পত্রিকা বেশি বিক্রি হয় হয়তো; কিন্তু নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও সম্মান বলে কিছু আর থাকে না। একটি সংবাদপত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকলে তা সোনায় মুড়ে প্রকাশ করলেও পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। শুধু মতিউর রহমানই নন, পত্রিকা দুটি অন্য যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধেও লাগাতার যে কুৎসা প্রকাশ করে চলেছে, তা কতটা তথ্যভিত্তিক, এখন পাঠকের মনে সেই প্রশ্নও সৃষ্টি হয়েছে। তারা এমন সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে কুৎসামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে, যাতে সরকারের কোনো কোনো ব্যক্তির মন পাওয়া যায়। কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। সরকারি প্রেস কাউন্সিল তাদের রক্ষা করেননি। যথাযথ রায় দিয়েছেন হলুদ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে। অভিনন্দন প্রেস কাউন্সিল ও বর্তমান চেয়ারম্যান বিচারপতি বি কে দাশকে।
প্রেস কাউন্সিল যদি এভাবে হলুদ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন, তাহলে হাতেগোনা যে কয়েকটি পত্রিকা এ দেশের ঐতিহ্যবাহী সাংবাদিকতাকে কালিমালিপ্ত করছে, তাদের নিবৃত্ত করা সম্ভব হবে। তবে ‘ভর্ৎসনা ও সতর্ক’ করাই যথেষ্ট নয়। ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ প্রমাণিত হলে কোটি টাকার অঙ্কে অর্থদণ্ড, রিপোর্টারের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড স্থায়ীভাবে বাতিল, অন্তত এক দিনের জন্য ডিক্লারেশন স্থগিত ইত্যাদি শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রেস কাউন্সিলের বর্তমান আইন সংশোধন করে কিছু শাস্তির ব্যবস্থা করে হলুদ সাংবাদিকতাকে প্রতিরোধ করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে সম্পাদক, সাংবাদিক, ইউনিয়ন, প্রেসক্লাব, শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, ছাত্র, পেশাজীবী, রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী তথা নাগরিক সমাজের সবাইকে সোচ্চার হওয়ার জন্য আমি অনুরোধ করছি। প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করতে হবে। তা না হলে অপসাংবাদিকতা বন্ধ করা সম্ভব হবে না।
টিভি অনুষ্ঠানের সমালোচনা
আমাদের সংবাদপত্র বা ম্যাগাজিনে টিভি অনুষ্ঠান নিয়ে তেমন কোনো পর্যালোচনা হয় না। ফলে টিভি অনুষ্ঠানের শিল্পী, লেখক, কলাকুশলীরা তাঁদের কাজের কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বা মতামত পান না। যাঁরা নবীন, তাঁরা জানতে পারেন না তাঁদের দুর্বলতা কোথায় বা কোথায় তাঁরা ভালো করছেন। সংবাদপত্রে শুধু অনুষ্ঠানের খবর বা কখনো ছবি ছাপা হয়। কিন্তু মতামত ছাপা হয় না বললেই চলে।
এ কথাগুলো ভিন্নভাবে আগেও হয়তো এই কলামে লিখেছি। তবু আজ আবার লিখছি শুধু একটু ভূমিকা হিসেবে। একটি টিভি অনুষ্ঠান ও একটি দৈনিক পত্রিকা এ ব্যাপারে প্রথা ভেঙেছে বলে আবার প্রসঙ্গটির অবতারণা করতে ইচ্ছে হলো।
টিভি অনুষ্ঠানটির নাম ইত্যাদি আর দৈনিক পত্রিকাটি যুগান্তর। জনপ্রিয় উপস্থাপক হানিফ সংকেত তাঁর ইত্যাদি অনুষ্ঠানে প্রায়ই টিভি মিডিয়ার নানা অনুষ্ঠান, শিল্পী, উপস্থাপক, সাংবাদিক বা খোদ টিভি চ্যানেল নিয়েই নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে থাকেন। যদিও কোনো বিশেষ অনুষ্ঠান বা ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে তিনি এসব ব্যঙ্গ করেন না, তবু দর্শকদের বুঝতে এতটুকু কষ্ট হয় না, তিনি কার বা কী সমালোচনা করছেন। যেখানে ঢাকার প্রায় সব দৈনিক পত্রিকা টিভি অনুষ্ঠান সম্পর্কে নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করেছে, সেখানে একা হানিফ সংকেত তিন মাস অন্তর ইত্যাদি অনুষ্ঠানে টিভি অনুষ্ঠানের নানা অসংগতি, দুর্বলতা ও স্ববিরোধিতা সাহসের সঙ্গে তুলে ধরছেন। এ জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানাই। সাহসের কথা বললাম এ জন্য, আজকাল সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কেউ কারও লিখিত সমালোচনা করতে চায় না। কারণ সমালোচনা করলেই তাঁকে নানাভাবে বিপদে পড়তে হয়। টিভি মিডিয়ায় তিনি নানা সুযোগ-সুবিধা বা অনুষ্ঠান পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। টিভি মিডিয়ার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী প্রায় সবাই দুর্বল। আমাদের সমাজে এমন ব্যক্তির সংখ্যা খুব কম, যাঁরা টিভি মিডিয়াকে কোনো পাত্তা দেয় না। একমাত্র সে রকম নির্লোভ সাংবাদিক বা লেখকের পক্ষেই টিভি অনুষ্ঠান নিয়ে নিয়মিত সমালোচনা লেখা সম্ভব। নিয়মিত না লিখলে বা না বললে তার প্রভাব পড়ে না।
এ রকম একটা প্রতিকূল পরিবেশে হানিফ সংকেত প্রায় নিয়মিত টিভির নানা অসংগতি নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে যাচ্ছেন। তাঁর এই ভূমিকার খুব প্রয়োজন ছিল। যদিও এই ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ টিভি চ্যানেলের কোনো ব্যক্তি গায়ে মাখে বলে মনে হয় না। কারণ তারা প্রায় সবাই প্রশংসার (স্তুতির) পুকুরে হাবুডুবু খাচ্ছেন।
তবে ইত্যাদি অনুষ্ঠানের এই ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ যথেষ্ট নয়। একটি টিভি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান তার উপযুক্ত জায়গাও নয়। সংবাদপত্রের সংস্কৃতি পাতায় কোনো উপযুক্ত ব্যক্তি নিয়মিত টিভি অনুষ্ঠানের পক্ষপাতহীন পর্যালোচনা লিখলে টিভি মিডিয়ার ও শিল্পীদের খুব উপকার হতো। সমালোচনার একটা বড় শর্ত হলো ‘উপযুক্ত ব্যক্তিকে’ তা লিখতে হবে। তা না হলে ওই সমালোচনার কোনো গুরুত্ব থাকবে না। বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান (নাটক, গান, টক শো, নৃত্য, রিয়েলিটি শো, উন্নয়ন অনুষ্ঠান, খবর ও অন্যান্য) বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিকে দিয়েও লেখানো যেতে পারে। এক সপ্তাহে শুধু একটি বিষয় নিয়েও লেখা ছাপা হতে পারে।
একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে যখন ঢাকার টিভি অনুষ্ঠান দেখি, তখন আমার মতো আনাড়ির চোখেও কত দুর্বল দিক, ভালো দিক ধরা পড়ে। বিশেষজ্ঞ বা অভিজ্ঞরা নিশ্চয় আরও অনেক কিছু দেখেন। সেগুলো তাঁরা লিখলে শিল্পী ও কলাকুশলীরা অনেক উপকৃত হতেন।
সংবাদপত্রে টিভি ও চলচ্চিত্রবিষয়ক ফিচার পড়ে এবং টিভিতে তারকাদের নানা অনুষ্ঠান দেখলে মনে হয়, আমাদের শিল্পীরা প্রায় সবাই অস্কার পুরস্কার পেতে পারেন! এ তো প্রশংসা ও বিশেষণের ছড়াছড়ি। প্রকৃত সমঝদারই শুধু জানেন, এগুলো কী জিনিস!
গঠনমূলক সমালোচনার অভাবে আমরা টিভি মিডিয়ায় একটা কৃত্রিম জগৎ তৈরি করে ফেলেছি। সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনগুলো এদের প্রশ্রয় দেয়। এর পরিণতি কী, তা আমি জানি না। তবে পরিণতি যে শুভ নয়, তা বুঝতে পারি।
যুগান্তর পত্রিকার সাংবাদিক শাহনেওয়াজকে ধন্যবাদ জানাই, অনিয়মিতভাবে ‘বিটিভি’ সম্পর্কে প্রতিবেদন লেখার জন্য। তিনি অনুষ্ঠান নিয়ে তেমন মতামত দেন না; তবে বিটিভির ভেতর অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, দলীয়করণ, কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ দলাদলি ইত্যাদি অনেক কিছুই পাঠকদের নিয়মিত জানাচ্ছেন। তিনি অনুসন্ধান করে ভেতরের খবর না জানালে সাধারণ পাঠকেরা তা কোনোদিন জানতে পারতেন না।
যুগান্তর-এ প্রতিবেদন ছাপা হলে বিটিভির অব্যবস্থাপনা বা দলীয়করণ বন্ধ হয়ে যাবে, তা আমি আশা করি না। কারণ বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই আমলেই বিটিভির দলীয়করণ ও অব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয়ে থাকে। যুগান্তর-এর প্রতিবেদনগুলো বিটিভির অব্যবস্থাপনা ও দলীয়করণকে পাঠক ও দর্শকদের সামনে উন্মোচন করে দিচ্ছে। এটাই যুগান্তর-এর কৃতিত্ব।
সংবাদপত্রের ‘সংস্কৃতি পাতা’ শুধু তারকাবন্দনায় সীমিত রাখা ঠিক নয়। সাংস্কৃতিক অঙ্গন, বিভিন্ন একাডেমি, বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, সরকারি ‘বিটিভি’ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে কী হচ্ছে, তা নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়া উচিত। রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সরকারিভাবে যে অনুষ্ঠানমালা হয়ে গেল তার মান, শিল্পী নির্বাচন, অনুষ্ঠানের কাঠামো, বিষয়বস্তু ইত্যাদি নিয়ে কোনো পর্যালোচনা হবে না? শুধু শিল্পীর সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা ও অনুষ্ঠানের বিবরণ প্রকাশ করাই কি সংবাদপত্রের একমাত্র দায়িত্ব? অন্তত বড় মাপের সরকারি-বেসরকারি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের একটা পর্যালোচনা হওয়া খুব প্রযোজন।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়ন কর্মী।
ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ হচ্ছে: দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন গত ৪ এপ্রিল ২০১০ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে যুক্ত করে অভিযুক্ত করা হয়। খবরের শিরোনাম ছিল: ‘একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা: মতিউর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে গোয়েন্দারা’। এ খবরটিকে আপত্তিকর, অসত্য ও বানোয়াট আখ্যায়িত করে মতিউর রহমান প্রেস কাউন্সিলে মামলা দায়ের করেন। পাঁচ দিন শুনানি শেষে, উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে প্রেস কাউন্সিল এই রায় দিয়েছেন। বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর উল্লিখিত প্রতিবেদনের কোনো বস্তুনিষ্ঠতা প্রেস কাউন্সিল খুঁজে পাননি। প্রেস কাউন্সিল তাঁদের রায়ে বলেছেন: তর্কিত সংবাদগুলো পড়লে মনে হয় যে এটা ব্যক্তিগত আক্রোশ ও বিষোদ্গার এবং সেই সঙ্গে অসত্য ও কুৎসাপ্রসূত সংবাদ। এর উদ্দেশ্য প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে জনসমক্ষে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা। কোনো দলিল-দস্তাবেজ বা সাক্ষীসাবুদ ছাড়া এ ধরনের সংবাদ হলুদ সাংবাদিকতার নামান্তর।
রায়ে আরও বলা হয়েছে: প্রতিবেদনে এমন সব অভিযোগ করা হয়েছে, যার সপক্ষে বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর আইনজীবী কোনো দলিল বা আইনগত ভিত্তি প্রকাশ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। রায়ে আরও বলা হয়েছে: বাংলাদেশ প্রতিদিন এ ধরনের সংবাদ ছাপিয়ে সাংবাদিকতার নীতিমালার মান ক্ষুণ্ন করেছে এবং সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে পেশাগত অসদাচরণ করেছে মর্মে প্রেস কাউন্সিলের বিশ্বাস জন্মেছে।’ (সূত্র: প্রথম আলো ১২ মে ২০১১)
হলুদ সাংবাদিকতা, মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য প্রকাশ করে নাগরিকের সম্মান ও বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করার অভিযোগে বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর প্রকাশক ও সম্পাদককে প্রেস কাউন্সিল সতর্ক করে দিয়েছেন। এর আগে বসুন্ধরা গ্রুপের আরেকটি দৈনিক কালের কণ্ঠ-এর প্রকাশক ও সম্পাদককেও প্রেস কাউন্সিল ভর্ৎসনা ও সতর্ক করে দিয়েছিলেন প্রায় একই রকম ভিত্তিহীন, বানোয়াট, মিথ্যা ও মানহানিকর খবর প্রকাশের জন্য। বসুন্ধরা গ্রুপের দুটি দৈনিক পত্রিকাই প্রেস কাউন্সিলের সতর্ক বাণী লাভ করেছে। আশা করি, পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদকেরা এখন বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পথে আসবেন। মিথ্যা ও বানোয়াট সংবাদ লিখে কয়েক শ পত্রিকা বেশি বিক্রি হয় হয়তো; কিন্তু নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও সম্মান বলে কিছু আর থাকে না। একটি সংবাদপত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকলে তা সোনায় মুড়ে প্রকাশ করলেও পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। শুধু মতিউর রহমানই নন, পত্রিকা দুটি অন্য যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধেও লাগাতার যে কুৎসা প্রকাশ করে চলেছে, তা কতটা তথ্যভিত্তিক, এখন পাঠকের মনে সেই প্রশ্নও সৃষ্টি হয়েছে। তারা এমন সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে কুৎসামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে, যাতে সরকারের কোনো কোনো ব্যক্তির মন পাওয়া যায়। কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। সরকারি প্রেস কাউন্সিল তাদের রক্ষা করেননি। যথাযথ রায় দিয়েছেন হলুদ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে। অভিনন্দন প্রেস কাউন্সিল ও বর্তমান চেয়ারম্যান বিচারপতি বি কে দাশকে।
প্রেস কাউন্সিল যদি এভাবে হলুদ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন, তাহলে হাতেগোনা যে কয়েকটি পত্রিকা এ দেশের ঐতিহ্যবাহী সাংবাদিকতাকে কালিমালিপ্ত করছে, তাদের নিবৃত্ত করা সম্ভব হবে। তবে ‘ভর্ৎসনা ও সতর্ক’ করাই যথেষ্ট নয়। ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ প্রমাণিত হলে কোটি টাকার অঙ্কে অর্থদণ্ড, রিপোর্টারের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড স্থায়ীভাবে বাতিল, অন্তত এক দিনের জন্য ডিক্লারেশন স্থগিত ইত্যাদি শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রেস কাউন্সিলের বর্তমান আইন সংশোধন করে কিছু শাস্তির ব্যবস্থা করে হলুদ সাংবাদিকতাকে প্রতিরোধ করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে সম্পাদক, সাংবাদিক, ইউনিয়ন, প্রেসক্লাব, শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, ছাত্র, পেশাজীবী, রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী তথা নাগরিক সমাজের সবাইকে সোচ্চার হওয়ার জন্য আমি অনুরোধ করছি। প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করতে হবে। তা না হলে অপসাংবাদিকতা বন্ধ করা সম্ভব হবে না।
টিভি অনুষ্ঠানের সমালোচনা
আমাদের সংবাদপত্র বা ম্যাগাজিনে টিভি অনুষ্ঠান নিয়ে তেমন কোনো পর্যালোচনা হয় না। ফলে টিভি অনুষ্ঠানের শিল্পী, লেখক, কলাকুশলীরা তাঁদের কাজের কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বা মতামত পান না। যাঁরা নবীন, তাঁরা জানতে পারেন না তাঁদের দুর্বলতা কোথায় বা কোথায় তাঁরা ভালো করছেন। সংবাদপত্রে শুধু অনুষ্ঠানের খবর বা কখনো ছবি ছাপা হয়। কিন্তু মতামত ছাপা হয় না বললেই চলে।
এ কথাগুলো ভিন্নভাবে আগেও হয়তো এই কলামে লিখেছি। তবু আজ আবার লিখছি শুধু একটু ভূমিকা হিসেবে। একটি টিভি অনুষ্ঠান ও একটি দৈনিক পত্রিকা এ ব্যাপারে প্রথা ভেঙেছে বলে আবার প্রসঙ্গটির অবতারণা করতে ইচ্ছে হলো।
টিভি অনুষ্ঠানটির নাম ইত্যাদি আর দৈনিক পত্রিকাটি যুগান্তর। জনপ্রিয় উপস্থাপক হানিফ সংকেত তাঁর ইত্যাদি অনুষ্ঠানে প্রায়ই টিভি মিডিয়ার নানা অনুষ্ঠান, শিল্পী, উপস্থাপক, সাংবাদিক বা খোদ টিভি চ্যানেল নিয়েই নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে থাকেন। যদিও কোনো বিশেষ অনুষ্ঠান বা ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে তিনি এসব ব্যঙ্গ করেন না, তবু দর্শকদের বুঝতে এতটুকু কষ্ট হয় না, তিনি কার বা কী সমালোচনা করছেন। যেখানে ঢাকার প্রায় সব দৈনিক পত্রিকা টিভি অনুষ্ঠান সম্পর্কে নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করেছে, সেখানে একা হানিফ সংকেত তিন মাস অন্তর ইত্যাদি অনুষ্ঠানে টিভি অনুষ্ঠানের নানা অসংগতি, দুর্বলতা ও স্ববিরোধিতা সাহসের সঙ্গে তুলে ধরছেন। এ জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানাই। সাহসের কথা বললাম এ জন্য, আজকাল সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কেউ কারও লিখিত সমালোচনা করতে চায় না। কারণ সমালোচনা করলেই তাঁকে নানাভাবে বিপদে পড়তে হয়। টিভি মিডিয়ায় তিনি নানা সুযোগ-সুবিধা বা অনুষ্ঠান পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। টিভি মিডিয়ার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী প্রায় সবাই দুর্বল। আমাদের সমাজে এমন ব্যক্তির সংখ্যা খুব কম, যাঁরা টিভি মিডিয়াকে কোনো পাত্তা দেয় না। একমাত্র সে রকম নির্লোভ সাংবাদিক বা লেখকের পক্ষেই টিভি অনুষ্ঠান নিয়ে নিয়মিত সমালোচনা লেখা সম্ভব। নিয়মিত না লিখলে বা না বললে তার প্রভাব পড়ে না।
এ রকম একটা প্রতিকূল পরিবেশে হানিফ সংকেত প্রায় নিয়মিত টিভির নানা অসংগতি নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে যাচ্ছেন। তাঁর এই ভূমিকার খুব প্রয়োজন ছিল। যদিও এই ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ টিভি চ্যানেলের কোনো ব্যক্তি গায়ে মাখে বলে মনে হয় না। কারণ তারা প্রায় সবাই প্রশংসার (স্তুতির) পুকুরে হাবুডুবু খাচ্ছেন।
তবে ইত্যাদি অনুষ্ঠানের এই ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ যথেষ্ট নয়। একটি টিভি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান তার উপযুক্ত জায়গাও নয়। সংবাদপত্রের সংস্কৃতি পাতায় কোনো উপযুক্ত ব্যক্তি নিয়মিত টিভি অনুষ্ঠানের পক্ষপাতহীন পর্যালোচনা লিখলে টিভি মিডিয়ার ও শিল্পীদের খুব উপকার হতো। সমালোচনার একটা বড় শর্ত হলো ‘উপযুক্ত ব্যক্তিকে’ তা লিখতে হবে। তা না হলে ওই সমালোচনার কোনো গুরুত্ব থাকবে না। বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান (নাটক, গান, টক শো, নৃত্য, রিয়েলিটি শো, উন্নয়ন অনুষ্ঠান, খবর ও অন্যান্য) বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিকে দিয়েও লেখানো যেতে পারে। এক সপ্তাহে শুধু একটি বিষয় নিয়েও লেখা ছাপা হতে পারে।
একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে যখন ঢাকার টিভি অনুষ্ঠান দেখি, তখন আমার মতো আনাড়ির চোখেও কত দুর্বল দিক, ভালো দিক ধরা পড়ে। বিশেষজ্ঞ বা অভিজ্ঞরা নিশ্চয় আরও অনেক কিছু দেখেন। সেগুলো তাঁরা লিখলে শিল্পী ও কলাকুশলীরা অনেক উপকৃত হতেন।
সংবাদপত্রে টিভি ও চলচ্চিত্রবিষয়ক ফিচার পড়ে এবং টিভিতে তারকাদের নানা অনুষ্ঠান দেখলে মনে হয়, আমাদের শিল্পীরা প্রায় সবাই অস্কার পুরস্কার পেতে পারেন! এ তো প্রশংসা ও বিশেষণের ছড়াছড়ি। প্রকৃত সমঝদারই শুধু জানেন, এগুলো কী জিনিস!
গঠনমূলক সমালোচনার অভাবে আমরা টিভি মিডিয়ায় একটা কৃত্রিম জগৎ তৈরি করে ফেলেছি। সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনগুলো এদের প্রশ্রয় দেয়। এর পরিণতি কী, তা আমি জানি না। তবে পরিণতি যে শুভ নয়, তা বুঝতে পারি।
যুগান্তর পত্রিকার সাংবাদিক শাহনেওয়াজকে ধন্যবাদ জানাই, অনিয়মিতভাবে ‘বিটিভি’ সম্পর্কে প্রতিবেদন লেখার জন্য। তিনি অনুষ্ঠান নিয়ে তেমন মতামত দেন না; তবে বিটিভির ভেতর অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, দলীয়করণ, কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ দলাদলি ইত্যাদি অনেক কিছুই পাঠকদের নিয়মিত জানাচ্ছেন। তিনি অনুসন্ধান করে ভেতরের খবর না জানালে সাধারণ পাঠকেরা তা কোনোদিন জানতে পারতেন না।
যুগান্তর-এ প্রতিবেদন ছাপা হলে বিটিভির অব্যবস্থাপনা বা দলীয়করণ বন্ধ হয়ে যাবে, তা আমি আশা করি না। কারণ বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই আমলেই বিটিভির দলীয়করণ ও অব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয়ে থাকে। যুগান্তর-এর প্রতিবেদনগুলো বিটিভির অব্যবস্থাপনা ও দলীয়করণকে পাঠক ও দর্শকদের সামনে উন্মোচন করে দিচ্ছে। এটাই যুগান্তর-এর কৃতিত্ব।
সংবাদপত্রের ‘সংস্কৃতি পাতা’ শুধু তারকাবন্দনায় সীমিত রাখা ঠিক নয়। সাংস্কৃতিক অঙ্গন, বিভিন্ন একাডেমি, বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, সরকারি ‘বিটিভি’ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে কী হচ্ছে, তা নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়া উচিত। রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সরকারিভাবে যে অনুষ্ঠানমালা হয়ে গেল তার মান, শিল্পী নির্বাচন, অনুষ্ঠানের কাঠামো, বিষয়বস্তু ইত্যাদি নিয়ে কোনো পর্যালোচনা হবে না? শুধু শিল্পীর সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা ও অনুষ্ঠানের বিবরণ প্রকাশ করাই কি সংবাদপত্রের একমাত্র দায়িত্ব? অন্তত বড় মাপের সরকারি-বেসরকারি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের একটা পর্যালোচনা হওয়া খুব প্রযোজন।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়ন কর্মী।
No comments