মৃত্যুফাঁদ

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ওপর নির্মিত শাহ আমানত সেতুর উভয় পাশে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে দুটি গোল চত্বর। নগরীতে যানবাহন প্রবেশ ও বাহির পথের এই গোল চত্বর দুটি এখন আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে। সেতুসংলগ্ন দুই পাশের গোল চত্বর দুটিতে প্রতিদিনই ঘটছে কোনো না কোনো দুর্ঘটনা, ঝরছে প্রাণ। চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, ট্রাফিক আইন অমান্য, সর্বোপরি অনিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার কারণে এই গোল চত্বর এলাকা মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে।
এমন বক্তব্য সেতুর বশরুজ্জামান গোল চত্বর এলাকায় ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে কর্মরত ট্রাফিক ইন্সপেক্টর অচ্যুত দাশগুপ্তের। শুধু তিনি নন, একই বক্তব্য ওই চত্বরের পুলিশ বক্সে কর্মরত ট্রাফিক সার্জেন্ট আজিজ, এএসআই সুবল ও কনস্টেবল অনিলেরও।
তারা বলেন, নানা অনিয়মের কারণে এই গোল চত্বরে ট্রাফিক আইন নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কষ্টকর। বলতে গেলে প্রতিদিন যানজট নিরসনের মাধ্যমে সড়ক সচল রাখতে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। তার উপরে নেই প্রয়োজনীয় লোকবল। ফলে প্রায়ই কোনো না কোনো দুর্ঘটনা এই চত্বর দুটিতে ঘটছেই।
তারা জানান, দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে নগরীতে প্রবেশ ও বাহির পথে প্রায় সময়ই বাস-ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাত্রীবাহী সিএনজি, ট্যাক্সি, ভ্যান, রিকশাকে চাপা দেয়। এই চত্বরে প্রতিবছর বড় ধরনের ১৮-২০টি দুর্ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে কোনো কোনো মাসে ৪-৫টি, আবার কোনো কোনো মাসে ২-৩টি, আবার কোনো মাসে হয়তো ঘটে না এমনও হয়ে থাকে। কিন্তু ছোট ও মাঝারি ধরনের দুর্ঘটনা লেগেই আছে। আর এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানির পাশাপাশি আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণও করতে হয় যাত্রীদের।
ট্রাফিক ইন্সপেক্টর অচ্যুত দাশগুপ্ত জানান, সর্বশেষ শনিবার বাঁশখালী থেকে নগরমুখী আসা বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সিএনজি ট্যাক্সি ও রিকশা ভ্যানকে চাপা দিলে ৬ যাত্রী গুরুতর আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর আগে ১৭ই মার্চ যাত্রীবাহী একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়। এতে এক যাত্রী নিহত ও ২০-২১ জন যাত্রী আহত হয়। এরপর ১২, ৯ ও ৩ মার্চ তিনটি দুর্ঘটনা ঘটে। এর আগে ২৪শে জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে পৃথক পৃথক দুর্ঘটনায় ৩ যাত্রী নিহত ও অর্ধশতাধিক যাত্রী আহত হন। তিনি বলেন, যাত্রীবাহী বাসের পাশাপাশি পণ্যবাহী ট্রাক-কাভার্ডভ্যান দুর্ঘটনার শিকার হয় বেশি। এর কারণ সড়কের মাঝে যে ডিভাইডার রয়েছে তা নিরাপদ নয়। ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের সঙ্গে আইল্যান্ড লেগে যায়। তাছাড়া সেতু নামার পথে সড়কে কোনো স্পিডব্রেকার না থাকায় প্রায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয় বাস-ট্রাকও কাভার্ডভ্যান। তার উপরে গোল চত্বরগুলো অপ্রশস্ত। এ অবস্থায় সড়কের ওপর চালকরা দাঁড় করিয়ে রাখে শত শত বাস ও ট্রাক। এসব সরানোর জন্য চাপ দিলে তার চেয়ে ওপর মহল থেকে চাপ আসে আরও বড় ধরনের। যার কারণে মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে শাহ আমানতের গোল চত্বর দুটি।
সরজমিনে দেখা যায়, কর্ণফুলী নদীর এপার-ওপারে সংযোগ স্থাপনকারী চার লেনের শাহ আমানত সেতু দিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রাম, পর্যটন নগরী কক্সবাজার ও পার্বত্য জেলা বান্দরবানের ১৯টি সড়কের গাড়ি যাতায়াত করছে। সঙ্গে পণ্যবাহী ট্রাক কিংবা দূরপাল্লার বাস তো আছেই। এই সেতুর দুই পাশে নির্মিত ত্রুটিপূর্ণ গোল চত্বর দুটি সরিয়ে নিতে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী দু’বছর আগে নির্দেশ দিয়ে গেলেও সেটি এখনো সরানো হয়নি। বরং, দুর্ঘটনা রোধে সড়ক বিভাগ গোল চত্বরটির চতুর্দিক আরও চার ফুট আকারে ছোট করে। এতে দুর্ঘটনা তো কমেইনি, বরং বেড়েছে। গোল চত্বরের চারপাশে সব ধরনের যানবাহন যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকায় দুর্ঘটনা এড়ানো যাচ্ছে না বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। স্থানীয় লোকজন জানান, গোল চত্বরের চারপাশে সব সময় বাস, সিএনজি ট্যাক্সি বা রিকশার চালকরা যাত্রী উঠানোর জন্য সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে থাকেন। এতে দুর্ঘটনা যেমন ঘটে তেমনি যানজটের সৃষ্টি হয়। যানজট নিরসন ও দুর্ঘটনা রোধে গোল চত্বর এলাকাটিতে চারমুখী সড়কে ৪টি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি) স্থাপন করা হলেও তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের চোখের সামনেই প্রবেশ ও বাহির পথটিতে সব সময় যানজট লেগেই থাকে। শাহ আমানত পুলিশ বক্সের সামনে সিএনজি ট্যাক্সিচালক মোহাম্মদ হারুন বলেন, দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলা থেকে আসা যাত্রীদের ভাড়ায় উঠানোর জন্য, ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়াতে হয়। সড়কের ওপর না দাঁড়ালে যাত্রী পাওয়া যায় না বলে জানান ওই চালক।
সিএনজি ট্যাক্সির লাইনম্যান মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, শহর এলাকার যাত্রীদের উঠানোর জন্য চালকরা পাগল হয়ে পড়ে। অনেকবার বারণ করেও চালকদেরকে রোধ করা যায় না। দুর্ঘটনায় সিএনজি ট্যাক্সির ক্ষতি ছাড়াও চালকও মারা গেছে। তবুও সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে যাত্রী নেওয়া বন্ধ হয়নি।
তিনি বলেন, ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের গাফিলতি, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও অনিয়মের কারণেই সেখানে অব্যবস্থাপনা সৃষ্টি হয়। ট্রাফিক পুলিশ চাইলে মুহূর্তের মধ্যে তা বন্ধ করতে পারে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের চট্টগ্রাম জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল আলম বলেন, চালকদের অদক্ষতাই গোল চত্বরে দুর্ঘটনার মূল কারণ। চালকরা গাড়ি ছাড়ার আগে যেমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে না, তেমনি ট্রাফিক আইনও মানে না। সড়কের ওপর গাড়ি দাঁড়িয়ে রেখে যাত্রী উঠানামা করে। ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে।

No comments

Powered by Blogger.