কলকাতায় বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মন্দা, বইমেলা ও চলচ্চিত্র উৎসব থেকে বাদ by পরিতোষ পাল
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী ও নাট্যকার অভিনেতা ব্রাত্য বসু গত বছর বইয়ের স্বর্গ কলেজ স্ট্রিটে আয়োজিত বাংলাদেশ বইমেলার উদ্বোধন মঞ্চে দাঁড়িয়ে গর্বের সঙ্গে জানিয়েছিলেন, দুই বাংলাকে জুড়ে রেখেছে আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি এবং অবশ্যই বই। যা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আটকে রাখা যাবে না।
কিন্তু এ বছর একটা মন্দার ছবি দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর একটা পরিবর্তন এসেছে ঠিকই। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেও শীতলতা দেখা দিয়েছে। দূতাবাস ও উপদূতাবাসগুলোতেও একটা আপাত স্থবিরতা বিরাজ করছে। ফলে বাংলাদেশের তরফে সাংস্কৃতিক কোনো কর্মকাণ্ডের চঞ্চলতা এখন পর্যন্ত চোখে পড়ছে না। ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে যে ‘বাংলাদেশ বইমেলা’ ও ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসবে'র আয়োজন করা হতো তার ইঙ্গিত কোনও সূত্র থেকেই মেলেনি। অবশ্য নিরাপত্তার বিষয়টি এ ক্ষেত্রে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে বলে একটি সূত্রে দাবি করা হয়েছে। আর কলকাতা বইমেলায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণও এক প্রকার অনিশ্চিত। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব থেকেও বাদ রাখা হয়েছে বাংলাদেশকে।
ইতিমধ্যেই এই সব খবর মিডিয়ার কল্যাণে জানাজানি হওয়ার পর থেকে কলকাতার বাংলাদেশ অনুরাগীদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের সাহিত্যের এক নিবিষ্ট পাঠক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের স্নাতকোত্তর ছাত্র নীলাঞ্জন সেন তার হতাশার কথা কোনওরকম গোপন না রেখেই বলছিলেন, সাহিত্য -সংস্কৃতির অঙ্গনে রাজনীতির প্রবেশ কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তিনি প্রতিবছর বাংলাদেশের নতুন নতুন লেখকদের সাহিত্য পড়ার জন্য বইমেলায় বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নের দিকে তাকিয়ে থাকতেন জানিয়ে বলেন, আমার মতো বহু সাহিত্য অনুরাগীই এ বছর বঞ্চিত হতে চলেছেন। অবশ্য শেষ মুহূর্তে কোনো সিদ্ধান্ত হলে তা আলাদা কথা।
কলকাতা বইমেলার বয়স ৪৮ বছর হলেও গত ২৮ বছর ধরে এই বইমেলায় বাংলাদেশ অন্যতম অতিথি দেশ হিসেবে মর্যাদা পেয়ে এসেছে। বাংলাদেশ থিম কান্ট্রি হিসেবেও বিবেচিত হয়েছে একাধিকবার। বইমেলার ১২ দিনের মধ্যে একটি দিন পালন করা হতো বাংলাদেশ দিবস হিসেবে। সারাদিন ধরে মেলা প্রাঙ্গনে বাজতো বাংলাদেশের নানা সঙ্গীত। আর সেমিনার হতো বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির নানা অভিমুখ নিয়ে।
সম্প্রতি কলকাতা বইমেলার আয়োজক সংস্থা পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের তরফে বইমেলায় অংশগ্রহণের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে তাতে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স থেকে লাতিন আমেরিকার দেশের নাম থাকলেও নাম নেই প্রতিবেশী বাংলাদেশের।
পর্যবেক্ষক মহলের মতে, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণেই এই সিদ্ধান্ত। গিল্ডের সভাপতি ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় সব দায়ভার কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন।
বাংলাদেশের সরকারি সংস্থা জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের ডিরেক্টার আফসানা বেগম অবশ্য সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে বলেছেন, কলকাতা বইমেলায় অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ প্রবলভাবে আগ্রহী ছিল। আগ্রহী ছিলেন বাংলাদেশের প্রকাশকরাও। সরকারিভাবে কলকাতা বইমেলায় অংশগ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে তারা আয়োজক সংস্থার কাছে ই-মেইল এবং একাধিকবার হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটে কথা বললেও কোনও উত্তর পান নি। আর তাই হাল ছেড়ে দিয়েছেন।
আগামী ২৮ জানুয়ারি থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে কলকাতা বইমেলা। গত বছর এই বইমেলায় ২৬ লাখ মানুষের সমাগম হয়েছিল। বই বিক্রি হয়েছিল ২০ কোটি রুপির বেশি। বইমেলার বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে প্রবশের জন্য বইপ্রেমীদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতো হতো।
তবে এবারের পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজক সংস্থা পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের সভাপতি ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ভারতের ভিসা কার্যক্রম এক প্রকার বন্ধ থাকার কারণে গিল্ডের পক্ষে নিজের থেকে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। আমরা নীতিগত সিদ্ধান্তের জন্য ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রকের পরামর্শ চেয়েছি। সেইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির স্বার্থে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে অনুমতি চেয়েছি।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে ভারত সরকারের নীরব থাকার নীতি নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও একই পথ নিয়েছে। আর তাই রাজ্য সরকার আয়োজিত আন্তর্জাতিক কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশকে এ বছর বাদ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন উৎসব কমিটির প্রধান চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ।
চলচ্চিত্র সংক্রান্ত কোনও আলোচনাতেও বাংলাদেশের কাউকে রাখা হয়নি বলে জানা গিয়েছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেই সহজ অজুহাত হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
পর্যবেক্ষক মহলের অভিমত, বাংলাদেশে পট পরিবর্তন ও ভারত বিরোধীতার দিকে লক্ষ্য রেখেই সম্ভবত ভারতের প্রশাসনিক মহল একরকম নীরব থাকার পথ নিয়েছে। ফলে ভারতের কোনও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের অংশগ্রহণকে দূরে রাখা হয়েছে।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, কলকাতা বইমেলা বা চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের উপস্থিতি ঘিরে বিতর্ক তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু মৌলবাদীরা ইতিমধ্যেই বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে রয়েছেন। ইতিমধ্যেই তারা কলকাতায় বাংলাদেশ উপদূতাবাসের অদূরে বিক্ষোভ করেছে। বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন ও উপাসনালয় ভাঙার প্রতিবাদে দূতাবাসে স্মারকলিপিও দিয়েছে। তাই বইমেলা বা চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে কোনওরকম বিক্ষোভ বা প্রতিবাদ হলে নতুন করে সমস্যা তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অবশ্য বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদদের মতে, কোনও আশঙ্কার কথা মাথায় রেখে সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে ঘেরাটোপের মধ্যে রাখা ঠিক নয়। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য পবিত্র সরকার কলকাতা বইমেলা ও চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশকে যোগ দিতে না দেয়াকে অন্যায় সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন। তিনি এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় বলেন, বাংলাদেশে পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই। কিন্তু সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এইভাবে অংশগ্রহণ করতে না দিয়ে বাধা তৈরির নীতি মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়।
তবে সাফটা চুক্তি অনুযায়ী দুদেশের মধ্যে চলচ্চিত্র বিনিময় হতে চলেছে। ভারতের দুটি ছবি বহুরূপি ও পুষ্পা ২ বাংলাদেশে মুক্তি পাচ্ছে ডিসেম্বরেই। তেমনি ভারতে মুক্তি পেতে চলেছে বাংলাদেশের ছবি রায়হান রাফির দামাল। রহুরূপির পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এই খবর জানিয়ে বলেছেন, প্রক্রিয়াকরণের কাজ প্রায় সম্পূর্ণ। শুধু সরকারি স্তরে চূড়ান্ত অনুমতির অপেক্ষা। প্রশ্ন থেকেই যায়, অনুমতি আসবে তো?
No comments