ইন্টারন্যাশনাল লিজিং দেউলিয়ার নেপথ্যে এনআই খান by এম এম মাসুদ
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং একসময় ভালো প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাতি ছিল। দেশের ভালো কয়েকটি গ্রুপও পরিচালনা পর্ষদে ছিল। কিন্তু আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার) মিলে আরও ডজনখানেক প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নেয় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা, যা আর ফেরত দিচ্ছেন না। হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে আইএলএফএসএলে নিরপেক্ষ পর্ষদ বসানো হলেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। আমানতকারীরা টাকা না পেয়ে আদালতে গেলে প্রয়াত সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি এক মাসের মাথায় পদ ছেড়ে দেন। জানিয়ে দেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সক্রিয় না হলে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। আইএলএফএসএল আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে না পারার পরিস্থিতিতে ২০২০ সালের ১লা জুন আদালত সাবেক শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম (এনআই) খানকে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন।
এনআই খান যোগ দিয়ে জানিয়েছিলেন, উন্নতির চেষ্টা করে যাবেন। তবে উন্নতির বদলে প্রতিষ্ঠানটি দেউলিয়া হওয়ার পথে আরও বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছে। অবশ্য এনআই খান যোগ দেয়ার পর কয়েকজন আমানতকারী টাকা ফেরত পেয়েছেন, সেটা খুবই সামান্য।
অভিযোগ আছে, এনআই খান, পিকে হালদার গংদের আত্মসাৎ করা ২৫০০ কোটি টাকা জায়েজ করার ব্যবস্থা করেছিলেন। এ ছাড়া ১০৫ কোটি টাকার ঋণ খেলাপির মামলায় উদ্দীপন এনজিওর সাবেক চেয়ারম্যান পিকে হালদারের ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন ড. মিহির কান্তি মজুমদারকে অব্যাহতি দেয়ার কাজটিও তিনি করেছিলেন।
২০১৪ সালে এনআই খানে বিরুদ্ধে দুর্নীতি তদন্তে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়। ওই সময় রিটকারীর আইনজীবী ড. ইউনুস আলী আকন্দ বলেছিলন, রিটে এনআই খানের দুর্নীতির বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ চাওয়া হয়েছে। পরে পিকে হালদার কাণ্ডে সাবেক সচিব এনআই খানসহ ২৫ জনের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দেন হাইকোর্ট। ২০২১ সালে এনআই খানের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করেছেন চেম্বার আদালত। আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান ননী এই আদেশ দেন।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক এজিএম হাসান মোহাম্মদ তারেক বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস বিভাগে (এফআইসিএসডি) লিখিত অভিযোগ করেছেন। তিনি তার অভিযোগে বলেন, প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মশিউর রহমান এবং মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান জসিম উদ্দিন বিভিন্ন সময় অবৈধভাবে রেপটাইল ফার্ম লিমিটেড এবং আনান কেমিক্যাল লিমিটেডের নামে বিভিন্ন সময়ে বিপুল পরিমাণের অর্থ ছাড় করেছে। পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ব্যতীত মো. মশিউর রহমান এবং জসিম উদ্দিন ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে বড় অঙ্কের অর্থ সিটি ব্যাংকে তাদের বেতন হিসেবে স্থানান্তর করেন। মো. মশিউর রহমান এবং জসিম উদ্দিন আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধের পরিবর্তে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন নতুন প্রকল্পে ঋণ প্রদানে বেশি উৎসাহিত ছিলেন।
২০১৫ সালের দিকে নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার কিনে মালিক বনে যান পিকে হালদার। এরপর নামে বেনামে ঋণ বের করেন। প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ৩০শে জুন সময়ে প্রতিষ্ঠানটির আয়ের বিপরীতে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ২ টাকা ৭৬ পয়সা, যা ২০২২ সালের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল ২ টাকা ১১ পয়সা। অর্থাৎ ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান বেড়েছে ৬৫ পয়সা। ২০২২ সালের তুলনায় ১৪ কোটি ৪১ লাখ ৭৬ হাজার ৬৫৯ টাকা লোকসান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯ কোটি ২২ লাখ ৩৩ হাজার ৩৫৬ টাকা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুন সময়ে লোকসান ছিল ৪৬ কোটি ৮০ লাখ ১৯ হাজার ৬১৯ টাকা। বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ না দেয়া প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার সংখ্যা ২২ কোটি ১৮ লাখ ১০ হাজার ২৪৬টি।
পিকে হালদার গংদের আত্মসাৎ করা ২৫০০ কোটি টাকার মধ্যে অর্থ আদায়ের পরিমাণ একেবারেই শূন্য। শুধুমাত্র পিকে হালদারের ১১০ কোটি টাকার কুমিরের খামার পাতানো নিলাম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিক্রি বাবদ মাত্র ৩৮.২০ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। খামারে ৪০০০ কুমিরের স্থলে ২৫০০ কুমির আছে বলে সংখ্যা কমিয়ে খামারের প্রকৃত মূল্য গোপন করে পাতানো নিলাম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান এনআই খান কে কম মূল্যে ক্রয় করতে সহযোগিতা করেছেন সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মশিউর রহমান। সম্প্রতি প্রতারণার শিকার বিনিয়োগকারীরা আত্মসাৎ করা টাকা ফিরিয়ে দিতে আদালতের এসব তথ্য জানান।
এই বিষয়ে ব্যারিস্টার অনিক আর হক বলেন, বিক্রেতা ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এবং ক্রেতা উদ্দীপন এনজিও উভয় প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান এন আই খান, যেখানে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট জড়িত। অর্থাৎ রক্ষকই যখন ভক্ষক। এ ছাড়া ১০৫ কোটি টাকার ঋণখেলাপির মামলায় উদ্দীপন এনজিওর সাবেক চেয়ারম্যান পিকে হালদারের ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন ড. মিহির কান্তি মজুমদারকে অব্যাহতি দেয়া, পিকে হালদারের ৮০০০ মুরগি বিক্রি বাবদ ২৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ, আমানতকারীদের অর্থ ফেরত না দিয়ে বড় অঙ্কের ঋণ অনুমোদন, ঋণ পরিশোধের আগেই সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং জাহাঙ্গীর আলম নামক খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে দায়মুক্তি, আনান কেমিক্যাল লি. নামক প্রতিষ্ঠানকে ১৫ কোটি টাকা ঋণ প্রদানের অপচেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট টিমকে অডিট কার্যক্রমে বাধা প্রদান ও ভীতিপ্রদর্শন, নিয়ম বহির্ভূতভাবে গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে অর্থ স্থানান্তর, বিধি বহির্ভূতভাবে এনআই খানের সহযোগীদের পদোন্নতি ও উত্তরায় ১০ তলা বাড়িসহ শতকোটি টাকা তুরস্কে পাচারের অভিযোগ করা হয়।
আবেদনে মহামান্য হাইকোর্টে যাবতীয় তথ্য পেশ করে এনআই খানের নেতৃত্বাধীন পর্ষদ বিলুপ্ত করে আর্থিক খাতে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নতুন পর্ষদ গঠন করে ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় জরুরিভিত্তিতে আইনগত পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত এমডি মশিউর রহমান মানবজমিনকে বলেন, এখনো এনআই খান চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত আছেন। এর বেশি মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। তবে আইএলএফএসএল’র আরেক কর্মকর্তা বলেন, এনআই খান অফিসে আসেন না। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ ছাড়া তো পর্ষদ ভেঙে দেয়াও সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়ে জানতে এনআই খানের মোবাইলে ফোন দেয়া হলে নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে।
ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারী ফোরামের সমন্বয়ক তাসদিক আহমেদ বলেন, পিকে হালদার গোষ্ঠীর লুটপাটের পর ২০২০ সালে অবসরপ্রাপ্ত আমলা নজরুল ইসলাম খানকে (এনআই) চেয়ারম্যান করে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়। কিন্তু আমানতকারীদের অভিযোগ, দীর্ঘ এই চার বছরেও এ পরিচালনা পর্ষদ তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারেনি। এনআই খানকে অবিলম্বে চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে স্বল্প সময়ে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করার দাবি জানিয়েছেন আমানতকারীরা।
No comments