বাঘা তেঁতুল-জীবনের জানালা by সৈয়দ আবুল মকসুদ

বাংলা ভাষায় বহু বিষয়ে রচনা লেখা হয়েছে। গরু, ঘোড়া, বিড়াল, কুকুর, পোষা পাখি প্রভৃতি প্রাণী সম্পর্কে শুধু নয়; নদী, রাজপথ, বটগাছ প্রভৃতির বর্ণনামূলক অথবা আত্মকথামূলক রচনাও স্কুলপড়ুয়াদের লিখতে হয়। আমাদের সবচেয়ে বড় কবি ‘ঘাটের কথা’ নামে একটি অনবদ্য ছোটো গল্পও লিখেছেন।


বহু দেশের যোগাযোগ ও নৌপরিবহনমন্ত্রী মহোদয়েরা জেনে খুশি হবেন যে মোটরগাড়ি নিয়ে ‘অযান্ত্রিক’ নামে একটি চমৎকার গল্প লিখেছেন এক আধুনিক কথাশিল্পী। বাড়িঘর নিয়েও লেখা হয়েছে। তবে জানালা নিয়ে কোনো রচনা আমার চোখে পড়েনি। অথচ জীবনে জানালার প্রয়োজন লিখে শেষ করা যাবে না।
শুধু জানালার কারণে বহু মানুষের শেষ রক্ষা হয়েছে। পালানোর জন্য যখন সব দরজা বন্ধ হয়ে যায়, তখন একমাত্র ভরসা জানালা। জীবনে প্রথম দরকার সদর দরজা। তা বন্ধ থাকলে খিড়কি দরজা। তা না থাকলে জানালা। লক্ষণ সেন খিড়কি দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বলে ইতিহাস বইতে পড়েছি। সিরাজদৌলা সে সুযোগ পাননি বা পেলেও নবাবের পক্ষে মর্যাদাহানিকর মনে করে তার সদ্ব্যবহার করেননি। কিন্তু বিশ্বব্যাপী বহু চোর-ডাকাত, অপরাধী ও অপকর্মকারী জানালা দিয়ে পালিয়ে বেঁচে গেছে।
জানালার সর্বশেষ সদ্ব্যবহার হয়েছে গত শুক্রবার। ‘অন্যের হয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে ধরা পড়ার পর শৌচাগারে গিয়ে জানালা ভেঙে পালিয়েছেন এক যুবক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে “খ” ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা চলাকালে লালমাটিয়া মহিলা কলেজ কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে।’
প্রথম আলো ও অন্যান্য জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধরা পড়ার পর ওই যুবক নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র বলে দাবি করেন। তিনি অন্য একজনের ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। খাতায় নাম কাটাকাটি নিয়ে সন্দেহ হলে হল পরিদর্শক তাঁকে আটক করেন। তাঁকে পুলিশে সোপর্দ করার সিদ্ধান্ত হয়। একপর্যায়ে তিনি শৌচাগারে যান। অনেকক্ষণ পরও তিনি বেরিয়ে না আসায় শিক্ষকেরা টয়লেটে গিয়ে বুঝতে পারেন, তিনি জানালা ভেঙে পালিয়ে গেছেন।
আমাদের সমাজে পরোপকারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যিনি অন্যের হয়ে পরীক্ষা দিতে যেতে পারেন, তাঁর যে সাহসের কিছু অভাব আছে তা মনে করা বোকামি। বাথরুমের জানালা ভাঙতে খুব বেশি সাহসের প্রয়োজন হয় না।
টয়লেটে গিয়ে কেউ ছোট বা বড় যে কাজটিই সম্পন্ন করুক তা অনির্দিষ্ট সময় ধরে হয় না। কঠিন কোষ্ঠকাঠিন্য যার তার পক্ষেও দীর্ঘ সময় ওখানে গিয়ে বসে থাকা সম্ভব নয়। টয়লেট থেকে তাঁর প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় ছিলেন পরীক্ষকেরা। একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর তাঁদের শঙ্কা হয়। পরীক্ষাকেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্তরা ভয়ে ভয়ে টয়লেটের দরজা ভাঙেন।
এ তো গেল ভাড়াটে পরীক্ষার্থী ও জানালার সদ্ব্যবহারকারীর কথা। যার হয়ে তিনি পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়েছিলেন তার ভূমিকা কী? এই সমাজ তার খোঁজ করবে না। সে আড়ালেই থেকে যাবে। নিতান্ত কপাল মন্দ বলে যুবকটি ধরা পড়েছিলেন। প্রতিবছর এভাবেই তো কিছু ছেলেমেয়ে ভর্তি হচ্ছেন। তাঁরা ঠিকঠাক পড়াশোনা করে পাস করেও বেরিয়ে যাচ্ছেন। তারপর কর্মজীবনে ঢোকেন। তাঁরাই হন শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা, আইনজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিচারক, ব্যাংকার, সাংবাদিক বা রাজনীতিক। দুর্নীতি করে ভর্তি হয়ে কর্মজীবনে সাধুতার পরিচয় দেবেন তা অবিশ্বাস্য।
অপরাধী কে বেশি? যে ভাড়া করে সে? নাকি যে ভাড়া খাটে সে? সমাজে যখন কোনো প্রবণতার সৃষ্টি হয় তা কোনো একটি বিশেষ ক্ষেত্রে হয় না—সব ক্ষেত্রে হয়। যে সমাজে ভাড়াটে খুনি সহজলভ্য, সেখানে ভাড়াটে পরীক্ষার্থী পাওয়া আরও বেশি সহজ।
জীবনের লক্ষ্য অর্জনে আজ কৌশলের শেষ নেই। কোন কাগজে পড়েছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় কোনো কোনো ‘সৎ’ পরীক্ষার্থী তাঁকে প্রক্সি দিতে বা প্রতিনিধিত্ব করতে কাউকে হলে পাঠান না। তাতে ঝুঁকি বেশি। সব কেন্দ্রের বাথরুমেই যে বড় জানালা থাকবে সে নিশ্চয়তা নেই। পরীক্ষার্থী আগের বছরের দুজন ভালো ছাত্রকে দিয়ে পরীক্ষা দেওয়ান। বিশেষ ব্যবস্থায় তাঁদের সিট পড়ে তাঁর দুই পাশে। তাঁদের কাজ শুধু সঠিক উত্তরের ঘরে টিক মারতে সাহায্য করা। ফলে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া ও ভালো বিষয় পাওয়া কে ঠেকায়?
শোনা যায়, যা শতভাগ সত্য, পরীক্ষাকেন্দ্রের ত্রিসীমানায় না গিয়েও কেউ জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করছে। ভালো কলেজে ভর্তি হচ্ছে। একই প্রক্রিয়ায় উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। সবই সম্ভব হচ্ছে কোনো কোনো কোচিং সেন্টারের আনুকূল্যে। দুর্নীতি শুধু পদ্মা ব্রিজের দরপত্রের ব্যাপারে নয়, পরীক্ষার ব্রিজ পার হতেও দুর্নীতি হচ্ছে। তবে কোনো দুর্নীতি ও অপকর্মই একা করা যায় না, পার্টনার লাগে। যার ভাগ্য ভালো সে একটি জানালা পায় পালানোর জন্য। জানালার অভাবে কেউ যায় ফেঁসে।
সংকটের সময় ব্যক্তির যেমন পালানোর জন্য দরকার একটি জানালা, সব দেশের সরকারেরও জানালা থাকা চাই। গণতন্ত্রে নির্বাচন একটি জানালা। কিন্তু স্বৈরশাসকদের কোনো জানালা নেই। জানালা থাকলে তিউনিসিয়ার বেন আলী, মিসরের মোবারক ও লিবিয়ার গাদ্দাফির এই দশা হতো না। ইয়েমেনের আলী আবদুল্লাহ সালেহ ও সিরিয়ার বাশার আল-আসাদও জানালার অভাবেই আটকে গেছেন। সবারই উচিত আত্মরক্ষার জন্য শিক্ষাবিহীন জীবনের জানালাটি ঠিকঠাক আছে কি না সেদিকে লক্ষ রাখা।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.