লোডশেডিংয়ের কবলে দেশ
রমজানে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে সরকারের কোনো প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে না। অথচ কয়েক দিনের মধ্যেই শুরু হচ্ছে মাহে রমজান। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। ফলে আগামীতে ঢাকার বাইরে লোডশেডিং বাড়বে। এতে বাড়বে মানুষের দুর্ভোগও। জানা গেছে, রোববার সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৭ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। এ সময় সারা দেশে চাহিদা ছিল ৯ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। এতে সরকারি হিসাবেই ঘাটতি দাঁড়ায় ১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। বেসরকারি হিসাবে এ ঘাটতি ১৫শ’ থেকে ১৭শ’ মেগাওয়াট। এ কারণে দেশব্যাপী চরম লোডশেডিং করতে হচ্ছে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোকে। সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং করেছে আরইবি (পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড)। আরইবির একটি সমিতির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জেনারেল ম্যানেজার যুগান্তরকে বলেন, ঢাকার চাহিদা মেটাতে গিয়ে তাদের সরবরাহ অনেকাংশে কাটছাঁট করেছে পিডিবি (বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড)। এ কারণে ঢাকার বাইরের সমিতিগুলোতে গড়ে ৬-৭ ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হয়েছে। কোথাও কোথাও আরও বেশি। ঢাকাকে আলোকিত রাখতে রাতে বেশিরভাগ গ্রামকে রাখা হচ্ছে অন্ধকারে। বিদ্যুৎ সংকটে ঢাকার বাইরে অনেক শিল্পকারখানা সন্ধ্যার পর বন্ধ রাখতে হচ্ছে। দিনেও অধিকাংশ কল-কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না আরইবি। রোববার আরইবির বিদ্যুৎ চাহিদা ছিল সাড়ে ৪ হাজার মেগাওয়াট।
কিন্তু তারা পেয়েছে সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াটের মতো। সংস্থার প্রেস কনসালট্যান্ট তালুকদার রুমী যুগান্তরকে বলেন, চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না বলেই বাধ্য হয়ে তাদের লোডশেডিং করতে হচ্ছে। তবে রমজানের আগে লোডশেডিং আরও সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে তিনি জানান। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক সাইফুল হাসান চৌধুরী বলেন, রমজানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ১০ হাজার মেগাওয়াট করার টার্গেট আছে সরকারের। এ কারণে বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র মেরামতের জন্য বন্ধ রাখতে হয়েছে। এর মধ্যে মেঘনাঘাট, সিরাজগঞ্জ, আশুগঞ্জ, রংপুর, বড়পুকুরিয়াসহ বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ আছে। কয়েকটি মেরামতের পর ইতিমধ্যে চালু হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভেড়ামারার ২১৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বাকিগুলো আগামী ২-৩ দিনের মধ্যে চালু হলে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। তিনি আশা করছেন রমজানের আগেই লোডশেডিং শূন্য পর্যায়ে চলে আসবে। তার মতে, অতিরিক্ত গরমের কারণে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কিছু কিছু এলাকায় বর্তমানে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। শনিবার রাতে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানি সামিট পাওয়ারের বিবিয়ানা ইউনিট ২-এর ৩৪১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। সামিট গ্রুপের হেড অব পিআর অ্যান্ড মিডিয়া মোহসেনা হাসান যুগান্তরকে বলেন, কারিগরি ক্রুটির কারণে শনিবার রাত সাড়ে ৯টায় তাদের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে মেরামতের কাজ চলছে।
শিগগিরই কেন্দ্রটি চালু হবে বলে তিনি আশা করছেন। এ কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সিলেট, হবিগঞ্জ ও আশপাশের এলাকায় ব্যাপক লোডশেডিং চলছে। বিদ্যুতের অভাবে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে বন্ধ আছে এরকম বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো হল বিবিয়ানা ৩৪১ মেগাওয়াট, রংপুর ২০০ মেগাওয়াট, ভেড়ামারা ২১৪ মেগাওয়াট, বড়পুকুরিয়া ২১০ মেগাওয়াট, মেঘনাঘাট ৪২৫ মেগাওয়াট, সিরাজগঞ্জ ২২৫ মেগাওয়াট, আশুগঞ্জ ৩৬০ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, বর্তমানে সর্বোচ্চ ৯ হাজার ২১২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড আছে। রমজানে এটা বাড়িয়ে ১০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করা হবে। এজন্য সব ধরনের প্রস্তুতি শুরু করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। পাশাপাশি উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছানোর জন্য সঞ্চালন লাইনেরও সংস্কার করা হচ্ছে। এ অবস্থায় রমজানে ইফতার-তারাবি ও সেহেরির সময় লোডশেডিং থাকবে না। লোডশেডিং করতে হলে আগে থেকেই সংশ্লিষ্ট এলাকায় জানিয়ে দেয়া হবে। এজন্য অগ্রিম শিডিউল তৈরি করে সবাইকে জানানো হবে। তিনি বলেন, প্রথম রমজান থেকেই বিকাল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সিএনজি স্টেশন বন্ধ রাখা হবে। সম্প্রতি আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক সভায় চলতি গ্রীষ্ম মৌসুম ও আসন্ন রমজানে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতির সার্বিক বিষয়ে আলোচনা হয়। সভায় বলা হয়, রমজানে দোকানপাট, মার্কেট ও বিপণিবিতানগুলো খোলা রাখার বিষয়ে বিদ্যমান আইন অনুসরণ করা হবে। রমজানে পিক আওয়ারে রি-রোলিং মিল, ওয়েল্ডিং মেশিন, ওভেন, ইস্ত্রির দোকানসহ অধিক বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী সরঞ্জামাদির ব্যবহার বন্ধ রাখা হবে।
এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন গ্যাস বিতরণ কোম্পানিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুপার মার্কেট, পেট্রলপাম্প ও সিএনজি গ্যাস স্টেশনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাতি ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। ইফতার ও তারাবির সময় এসি ব্যবহার বন্ধ, বিদ্যুতের অপচয় রোধে সিএফএল বাল্বের পরিবর্তে এলইডি বাল্ব প্রতিস্থাপনের নির্দেশনা দেয়া হয়। তবে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এবারের পুরো রমজানজুড়ে গরম থাকবে। এতে সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেড়ে যাবে। সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর যে অবস্থা তাতে রমজানে সরকারের টার্গেট অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ১০ হাজার মেগাওয়াট করা সম্ভব হবে না। এতে রোজাদারদের ভোগান্তির মুখে পড়তে হবে। ইফতারি, তারাবি ও সেহেরির সময় চাহিদা বেড়ে গেলে গ্রামের লোডশেডিং চরম আকার ধারণ করবে। ডিপিডিসি ও ডেসকোকে ঢাকায়ও বিভিন্ন স্থানে লোডশেডিং করতে হবে। তাছাড়া ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন সংস্কার না হওয়ায় উৎপাদিত বিদ্যুৎ লাইনে সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। দুর্বল বিতরণ লাইনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করলেই বিভিন্ন স্থান লাইন ও ট্রান্সফরমার জ্বলে যাবে। এতে মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়বে। তিতাস গ্যাস সূত্রে জানা গেছে রমজানে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হলে সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখার বিকল্প নেই। ইতিমধ্যে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমানে সারকারখানাগুলোতে ২১ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করতে হচ্ছে। যা মোট উৎপাদিত গ্যাসের ৮ শতাংশের বেশি। রমজানে এ পরিমাণ গ্যাস যদি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে দেয়া সম্ভব না হয় তাহলে অনেকগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে না। এতে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের টার্গেট কোনোভাবেই অর্জন করা সম্ভব হবে না।
No comments