দশ বছরে ৪ হাজার কোটি টাকা লুট
দেশের ২৬৫টি মাল্টিপারপাস সমবায় সমিতি ২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে আমানতকারীদের কাছ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করেছে। উচ্চহারে মুনাফা দেয়ার লোভ দেখিয়ে এ অর্থ লুটে নেয় তারা। সমবায় অধিদফতরের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্যসহ সমিতিগুলোর নানা অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য উঠে এসেছে। আত্মসাৎ করা এসব টাকা ব্যক্তির নামে ভূ-সম্পত্তি ক্রয়, বিদেশে পাচার ও সরকারবিরোধী কার্যক্রমে ব্যবহারের অভিযোগও উঠেছে। প্রতিবেদনটি আজ স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। তবে এসব সমিতি কমপক্ষে ২০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। অধিদফতরে থাকা অডিট রিপোর্টের তথ্যের ভিত্তিতে ৪ হাজার ৬৯ কোটি টাকা আত্মসাতের তথ্য বের করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনগণের কাছ থেকে নেয়া অর্থের আসল তথ্য অডিট রিপোর্টে স্থান পায়নি। অধিদফতরের কিছু কর্মকর্তা এসব সমিতিকে বুদ্ধি-পরামর্শ, অডিট রিপোর্ট তৈরি করে দেয়াসহ নানাভাবে সহায়তা করতেন। সমিতিগুলো হিসাব সংরক্ষণের জন্য দুটি লেজার বই ব্যবহার করত। প্রকৃত অর্থের হিসাব থাকত এক বইয়ে। আর অডিটের জন্য রাখা হতো অন্য লেজার বই, যাতে সদস্য-অসদস্য সংখ্যা ও তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় অনেক কম দেখানো হতো। ফলে আমানতের অন্তত ৮০ ভাগই অডিট রিপোর্টে আসেনি। কোনো কোনো সমিতি মানুষকে প্রলুব্ধ করতে নামের আগে ‘আল’ শব্দটি যুক্ত করে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এলজিআরডি মন্ত্রণালয়,
এ সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিসহ সরকারের বিভিন্ন দফতরে প্রতারিতদের অভিযোগ এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের ধারণা পাওয়া যায়। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে স্থায়ী কমিটি সমবায় অধিদফতরের কাছে তথ্য তলব করে। এর ভিত্তিতে দেশব্যাপী অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানো হয়। তাতে ২৬৫টি সমিতির অর্থ আত্মসাতের নানা তথ্য বেরিয়ে আসে। এ ব্যাপারে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব মাফরুহা পারভীন যুগান্তরকে বলেন, সংসদীয় কমিটি বিভিন্ন অনিয়মে জড়িত সমবায় সমিতির একটি তালিকা করে পাঠানোর জন্য নির্দেশনা দেয়। সেই অনুযায়ী একটি তালিকা পাঠানো হয়েছে। সংসদীয় কমিটির নির্দেশনা পেলে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। জানা গেছে, সমবায় আইন অনুযায়ী, ‘ব্যাংক, ‘কমার্স’, ‘ক্রেডিট’, ‘ইনভেস্টমেন্ট- এসব নাম যুক্ত করে সমিতি করা যাবে না। তা সত্ত্বেও কিছু ব্যক্তি এসব শব্দ যোগ করে সমিতি গঠন করে। অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও তা পরিচালনার অনুমতি দেয় অধিদফতরের একশ্রেণীর কর্মকর্তা। সংসদীয় কমিটির নির্দেশে ওইসব কমিটি ও কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে ১৭ মে একটি ফাইল দুদকে পাঠনো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সমবায় অধিদফতরের নিবন্ধক ও মহাপরিচালক আবদুল মজিদ যুগান্তরকে বলেন, এর আগে নিয়ম লঙ্ঘন করে যেসব সমিতি মাইক্রো ক্রেডিট কার্যক্রম পরিচালনা করেছে এবং বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাদের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। ওই তালিকা সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে। এ সংক্রান্ত অনিয়মের আইনগত বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সমবায় অধিদফতরের এক যুগ্ম নিবন্ধক বলেন, দেশে প্রায় ১ লাখ ৭৮ হাজার সমবায় সমিতি আছে।
এর মধ্যে মাল্টিপারপাস সমবায় সমিতি আছে ২০ থেকে ২৫ হাজার। এসব সমিতির উত্থান হয়েছে ২০০৩ সালে বা তারপর। ওই বছর তৎকালীন সরকার আইন সংশোধন করে সমিতির সদস্য নয় এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকেও মূলধন সংগ্রহের রাস্তা করে দেয়। ফলে লুটপাটের পথ সুগম হয়। এ কর্মকর্তা আরও জানান, অনুসন্ধানে তারা দেখেছেন, সাধারণ জনগণের জমানো টাকা দিয়ে সমিতির নামে সম্পত্তি না কিনে ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নামে কেনা হয়। ফলে ওই টাকা আর আদায় করা সম্ভব হয় না। সমবায় সেক্টরে এমন লুটপাটের কারণে ২০১৩ সালে সরকার আইন সংশোধন করে। প্রতিবেদন অনুসারে, ২৬৫টি সমিতির মধ্যে ৭৬টির অডিট রিপোর্টে সংগৃহীত আমানত দেখানো হয়েছে ৪১২ কোটি ৯ লাখ ৬২ হাজার ৭৮০ টাকা। কিন্তু বিভিন্ন খাতে এসব সমিতির বিনিয়োগ পাওয়া গেছে ৬৩১ কোটি ৪৪ লাখ ১১ হাজার ৩৭১ টাকা। বাড়তি ২১৯ কোটি ৩৫ লাখ টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কর্মকর্তারা মনে করছেন, এ অর্থও আমানতকারীদের কাছ থেকে সংগৃহীত। কিন্তু তা লেজার বইয়ে দেখানো হয়নি। ফলে অডিট রিপোর্টেও আসেনি। আর বাকি ১৮৯টি সমিতির আমানত বা মূলধন ৩ হাজার ৬৫৬ কোটি ৬৮ লাখ ৪৩ হাজার ৮৩৬ টাকা। কিন্তু এগুলোর বিনিয়োগ মাত্র ২ হাজার ৮ কোটি টাকা। বাকি ১ হাজার ৬৪৮ কোটি ৫১ লাখ টাকার হদিস নেই। এ টাকা সমিতিগুলো লোপাট করেছে বলে মনে করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। প্রতিবেদনের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কোনো কোনো সমিতি আমানতকারীদের কাছ থেকে আদায় করা অর্থ বিনিয়োগ না করে সরিয়ে ফেলেছে।
এক্ষেত্রে বেশিরভাগ টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে বলে সমবায় অধিদফতরের কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন। সমিতির নামে হলেও কিছু অর্থ (সমিতির) ব্যক্তির নামে সরিয়ে নানা প্রতিষ্ঠান ও জমি-ফ্ল্যাট ক্রয়ে ব্যয় করা হয়েছে। জঙ্গি ও সরকারবিরোধী আন্দোলনেও কিছু অর্থ ব্যয় হয়ে থাকতে পারে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আশঙ্কা। জানা গেছে, সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও এমন অভিযোগ করা হয়েছে। এর ভিত্তিতে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের দুই কর্মকর্তা বিষয়টি তদন্ত করেন। জানা গেছে, এসব সমিতি প্রতিষ্ঠাকারীদের অনেকেই সাবেক শিবির নেতা ও জামায়াতপন্থী। বিএনপিপন্থীও আছে। অপরদিকে এসব ব্যক্তিকে অধিদফতরের যে বা যারা নানাভাবে প্রশ্রয় দিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে, তারাও বিএনপি-জামায়াতপন্থী। এদের মধ্যে একজন ছাত্রদলের প্যানেল থেকে নির্বাচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলের সাবেক জিএস। এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চাকরিজীবনে নানা অপকর্মে জড়িত হওয়ার অভিযোগে একাধিক বিভাগীয় মামলা হয়েছে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও রহস্যজনক কারণে বড় কোনো শাস্তি পাননি। অভিযোগ আছে, এ কর্মকর্তাকে বর্তমানে প্রশ্রয় দিচ্ছেন এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ ব্যক্তির পিএস (ব্যক্তিগত কর্মকর্তা)। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এই পিএস অধিদফতরের ওই কর্মকর্তার রুমমেট ছিলেন বলে জানা গেছে। ২৬৫ সমিতির একটি আইডিয়েল কো-অপারেটিভ সোসাইটি। ২০০৭ সালে নিবন্ধন পাওয়া এই একটি সমিতিই জনগণের কাছ থেকে ৭৬৮ কোটি টাকা লুটপাট করেছে। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ম্যাক্সিম ফাইন্যান্স অ্যান্ড কমার্স নামে একটি সমিতির আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ ২৮৫ কোটি ২ লাখ ৩৬ হাজার ২৩০ টাকা। নিয়ম না থাকলেও এই প্রতিষ্ঠানটি সারা দেশে ৬৪টি শাখা পরিচালনা করে, কিন্তু তদারকির দায়িত্বে থাকা অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা রহস্যজনক কারণে এ ব্যাপারে নিশ্চুপ ছিল। এ সমিতির সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাবাস করছেন। ডেসটিনি মাল্টিপারপাস সমিতি ২০০৫ সালে যাত্রা করে। অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী এটি প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা নানাভাবে সংগ্রহ করে। কিন্তু স্থায়ী সম্পদ গড়েছে মাত্র ২২৭ কোটি টাকার। ৫৬৯কোটি টাকার ঋণ দেয়ার তথ্যও পাওয়া যায়। ৮৮৮ কোটি টাকার হদিস নেই। জানা গেছে, গত ২৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির ১৬তম বৈঠকে সমিতিগুলোর অর্থ আত্মসাৎ, অনিয়ম-দুর্নীতি এবং এতে সমবায় অধিদফতরের কিছু কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা ও রহস্যজনক ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় কমিটির সভাপতি আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ঢাকার মিরপুরে দশমিক ৭৫ একর জমিতে বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় শিল্প সমিতির ১৫তলা ভবন করা হয়।
সমিতি নেবে এ ভবনের ১৬ শতাংশ। ৮৪ শতাংশ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান নেবে। এই অসম চুক্তির ফলে সরকারের বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এ চুক্তির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে তিনি আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দেন। তিনি এ সময় ৬টি সমবায় সমিতির নাম উল্লেখ করে বলেন, এগুলো ৭৭৩ কোটি ৭৮ লাখ ২৯ হাজার ৪৪০ টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়েছে। এরপরও মন্ত্রণালয় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বৈঠকে কমিটির সভাপতি আরও বলেন, মতিঝিলের বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ সোসাইটির ব্যবস্থাপনার কমিটির বিরুদ্ধে সমবায় অধিদফতর কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং অর্থ আত্মসাতের সুযোগ করে দিয়েছে। অন্যদিকে ব্যবস্থাপনা কমিটি জামায়াত-শিবির ও যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর তৎপরতায় লিপ্ত থাকার পরও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে শুধুমাত্র একটি পত্র দিয়েই নিশ্চুপ আছে অধিদফতর। এই পত্রে প্রেরক যুগ্ম সচিবের কোনো স্বাক্ষরও নেই। অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়ের এসব কর্মকাণ্ডে তিনি হতাশা ব্যক্ত করেন। তিনি জরুরি ভিত্তিতে ওই সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের অপসারণ ও অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠনের পরামর্শ দেন। পাশাপাশি এই সমিতির অবৈধ কাজে সহায়তাকারী অধিদফতরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেন। সূত্র জানায়, এ বৈঠকে মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সমবায় সমিতির মাধ্যমে সাধারণ জনগণের জমানো টাকা আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল মামলা করা যেতে পারে। পাশাপাশি এসব সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও সমবায় অধিদফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। এই উভয় গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলা করার পরামর্শও দেন তিনি।
No comments