ইসরায়েল কী চায়?
‘ইসরায়েল কী করে একটি গণতান্ত্রিক এবং ইহুদি (রাষ্ট্র) থাকবে, যদি সে পশ্চিম তীরে বসবাসরত লাখ লাখ মানুষকে শাসন করতে চায়? সে কী করে শান্তিতে থাকবে যদি না সে সীমান্ত নির্ধারণ করতে চায়, দখলের অবসান না ঘটায় এবং ফিলিস্তিনিদের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং মর্যাদা না দেয়? আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোতে ফিলিস্তিনিদের প্রতি অন্য দেশের সমর্থন সে কী করে বন্ধ করবে, যদি না এটা দেখা যায় যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইসরায়েল অঙ্গীকারবদ্ধ?’ এই প্রশ্নগুলো আমার নয়, এগুলো তুলেছিলেন ফিলিপ গর্ডন, যিনি হোয়াইট হাউসের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক কার্যক্রমের সমন্বয়কারী।এই প্রশ্নগুলো গর্ডন তুলেছিলেন তেল আবিবে দেওয়া এক বক্তব্যে, এ বছরের ৮ জুলাই।বক্তব্য দেওয়ার তারিখটা উল্লেখযোগ্য; কেননা ওই দিনই ইসরায়েল গাজায় বিমান হামলার সূচনা করে। এখন ইসরায়েল গাজায় স্থল অভিযানও শুরু করেছে। বিমান হামলার কয়েক দিনের মধ্যেই বোঝা যাচ্ছিল যে ইসরায়েলিরা এ দফায় স্থল অভিযানের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।আন্তর্জাতিক যত চাপ ও নিন্দাই হোক না কেন, ইসরায়েলিরা তাদের অভিযান থেকে পিছিয়ে আসেনি। আত্মরক্ষার এবং জাতীয় নিরাপত্তার যে যুক্তি ইসরায়েল দিয়ে আসছে, তা যে ধোপে টেকে না, সেটা সবাই জানেন। প্রতিবারের মতো এবারের অভিযানেও ইসরায়েলিরা তাদের সামরিক উদ্দেশ্য হিসেবে বলেছে হামাসের ধ্বংস সাধন। এই কথা বলে ইসরায়েল আগেও গাজায় হামলা করেছে।
তাও একবার নয়, একাধিকবার।কিন্তু তার ফলাফল কী হয়েছে আমরা জানি। হামাসের ধ্বংস সাধনে ‘সাফল্যের’ তো প্রশ্নই ওঠে না, বরং শেষ পর্যন্ত এই ধরনের হামলা ও নির্বিচার হত্যাকাণ্ড হামাসকে আরও বেশি শক্তিশালী করেছে। হামাসকে ধ্বংস করার কথা ২০০৬ সালের নির্বাচনে হামাসের অভাবনীয় বিজয়ের পর থেকে আরও জোরেশোরে বলা হচ্ছে। ২০০৮ সালের সেনা অভিযানের সময় এই কথা বলা হয়েছে, বলা হয়েছে ২০১২ সালের আক্রমণের সময়ও। এসব অভিযানের ফলে প্রাণ হারিয়েছে নিরপরাধ মানুষ। তাদের মধ্যে রয়েছে শিশু এবং বয়স্ক মানুষ। সাংগঠনিকভাবে হামাসের দুর্বলতা থাকলেও ইসরায়েলের হামলার পরিণতিতে হামাস আরও বেশি করে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। এটা ইসরায়েলের রাজনৈতিক ও সামরিক নীতিনির্ধারকেরা জানেন না, তা নয়। তাঁরা সেটা জানার পরেও এই ধরনের হামলা, স্থল অভিযান, দখলদারি, নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালিয়ে গেছেন। আর যখন প্রত্যক্ষ যুদ্ধ পরিচালিত হয়নি তখন চলেছে বসতি স্থাপন, জমি দখল, পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ।এ ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কখনোই ইসরায়েলকে দোষী সাব্যস্ত করেনি। মৃদু তিরস্কারের পাশাপাশি ইসরায়েলের টিকে থাকার অধিকারের, তার নিরাপত্তার অধিকারের কথা এমনভাবে বলা হয়েছে, যেন রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকেও সমর্থনে সামান্য ঘাটতি পড়েনি। শান্তি আলোচনায় কোয়ার্টেট (যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ) কোনো রকম অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। ফলে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বেড়েছে হতাশা; অব্যাহত নিপীড়ন এবং দখলদারির চাপে থাকা মানুষের সামনে আরও বেশি করে বিকল্প হিসেবে উপস্থিত হয়েছে হামাসের পথ।
তাহলে ইসরায়েল কী বিবেচনা থেকে বারবার এ ধরনের যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে? তাদের স্ট্র্যাটেজি বা কৌশলটি কী? ইসরায়েলের সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য অনুযায়ী, ইসরায়েল এক দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ের অংশ হিসেবেই এসব স্বল্পমেয়াদি সংঘাতে যুক্ত আছে। তঁাদের যুক্তি হলো, এটি হলো ইংরেজিতে যাকে বলে ‘লং ওয়ার অব অ্যাট্রিশন’; আমরা বলতে পারি ‘স্বল্প ক্ষতির দীর্ঘ লড়াই’। এর মূল কথাটি হলো যে ইসরায়েল একটি বড় যুদ্ধে বিজয়ী হবে না, তাই তাদের কাজ হচ্ছে আস্তে আস্তে হামাসের শক্তি ক্ষয় করা। তাঁরা মনে করেন যে এই কৌশলে তাঁরা সাফল্য লাভ করছেন। প্রমাণ হিসেবে তাঁরা ইসরায়েলি সরকারের একটি হিসাব তুলে ধরেন, যাতে বলা হচ্ছে যে হামাসের শক্তি ক্রমাগতভাবে দুর্বল হচ্ছে। ২০০৮ সালে হামাস তিন হাজার ৭১৬টি রকেট বা মর্টার হামলা করে। ২০১০ সালে ৩৬৯টি। ২০১২ সালে ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের আগে হামাসের রকেট বা মর্টার হামলা ছিল দুই হাজার ৫৫৭; ২০১৩ সালে তা দাঁড়ায় মাত্র ৭৪টি। তাঁরা এও দাবি করেন যে ২০১২ সালের অভিযানের পর তিন মাসে হামাস মাত্র তিনটি হামলা চালাতে পেরেছে। তাঁরা এই সামরিক অভিযানের সাফল্যের সঙ্গে এটাও যুক্ত করেন যে এই সময়ে হামাস ক্রমাগতভাবে তার সমর্থন হারিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এ কথাও তাঁরা স্মরণ করিয়ে দেন যে ২০১১ সালে ইসরায়েলে ‘আয়রন ডোম’ বা রকেট হামলা মোকাবিলার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর ইসরায়েলের নিজের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কম এবং তাতে করে আগে ইসরায়েলের ভেতরে এ ধরনের যুদ্ধের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের যে বিরোধিতা ছিল এখন তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে। ইসরায়েলের এই ‘স্বল্প ক্ষতির দীর্ঘ লড়াই’য়ের কৌশলের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কোথায়?
তা হলো এই মতের অনুসারীরা বিস্মৃত হয়েছে যে গাজার জনসংখ্যা প্রায় ১৯ লাখ। তারা সবাই হামাসের সমর্থক না হলেও তারা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দেবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। আগ্রাসন এবং দখলদারির বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ যে অচিরেই শেষ হয়ে যাবে না, সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এই কৌশলে যারা আস্থা রেখেছে তারা এও বিস্মৃত হয়েছে যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে হামাসের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পেলেও সর্বত্র তা হয়েছে, এই ধারণা সঠিক নয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিভিন্ন ধরনের সহিংস গোষ্ঠীর উত্থান, যুদ্ধ ও সহিংসতার বিস্তারের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর মধ্যে যেকোনো ধরনের সশস্ত্র প্রতিরোধের ব্যাপারেই এখন রয়েছে সংশয় এবং ভীতি। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, মিসর তাদের অবস্থানগত পার্থক্য সত্ত্বেও তারা মনে করে যে এখন হামাসের প্রতি খোলামেলা সমর্থন তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। কিন্তু আরেক ধরনের পরিবর্তনও ঘটছে। ইউরোপের দেশগুলো প্রকাশ্যে ইসরায়েলের ব্যাপারে তাদের অস্বস্তি না জানালেও তারা ক্রমেই ইসরায়েলের আচরণে অখুশি। এই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ইসরায়েল সফরের সময় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে সে কথা জানিয়েছেন। ইসরায়েলিরা তা পছন্দ করেনি বটে, কিন্তু তার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই ব্রিটেনের সদ্য বিদায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগের দেওয়া শেষ বিবৃতিতে। এ বছরের গোড়ায় ফিলিস্তিনি নেতা মাহমুদ আব্বাস জন কেরিকে স্পষ্ট করেই জানিয়েছিলেন যে শান্তি প্রচেষ্টায় অগ্রগতি না হলে তিনি হামাসের সঙ্গে জাতীয় ঐক্য সরকার প্রতিষ্ঠা করবেন। অনেকে সেটাকে হুমকি বলে মনে করেছিল; এখন তা বাস্তবায়িত হয়েছে, যা হামাসের জন্য ইতিবাচক বলেই গণ্য করতে হবে। ইসরায়েলের অনুসৃত কৌশলে হামাস আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়বে বলে ইসরায়েলের নীতিনির্ধারকদের যুক্তিটি আমাদের ধর্তব্যের মধ্যে নেওয়া দরকার অন্য কারণে। কেননা একার্থে তাঁরা ঠিক; কিন্তু তাঁরা যা ভাবছেন যে এতে করে ফলাফল তাঁদের অনুকূলে যাবে, সেটা ঠিক নয়। গত কয়েক বছরে আমরা দেখছি যে গাজায় হামাসের চেয়েও বেশি কট্টরপন্থী সংগঠনের উত্থান ঘটছে। তার পেছনে কাজ করেছে ইসরায়েলিদের সামরিক অভিযান,
নির্বিচার হত্যাকাণ্ড এবং দীর্ঘমেয়াদি শান্তিপ্রক্রিয়ার ব্যাপারে অনুৎসাহ। গত বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে যে ইসলামিক জিহাদ গাজার অধিবাসীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ওয়াতান সেন্টার ফর স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চের করা জনমত জরিপে দেখা যায় যে হামাসের জনপ্রিয়তা কমছে এবং ইসলামিক জিহাদের প্রতি সমর্থন আছে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষের। ২০১০ সালে করা জরিপে ইসলামিক জিহাদের প্রতি সমর্থন ছিল মাত্র ১ শতাংশ। ফলে যদি ইসরায়েলিরা হামাসের দুর্বল অবস্থান দেখে আনন্দিত হয় এবং ভাবে যে এই ধরনের হামলা ও যুদ্ধ তাদের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে ভালো, তবে তারা বড় রকমের ভুল করছে। ইসরায়েলের এই আচরণের কারণে এখন সবাই প্রশ্ন করছেন, ইসরায়েল আদৌ শান্তি চায় কি না। শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইসরায়েলের অঙ্গীকার নিয়ে যে প্রশ্ন ফিলিপ গর্ডন তুলেছেন, যার উদ্ধৃতি দিয়েছি এই নিবন্ধের শুরুতে, সেটা কেবল তাঁর প্রশ্ন নয়। সেই প্রশ্ন আগে কেবল ইসরায়েলের সমালোচকদের মধ্যে ছিল; এখন ইসরায়েলের বন্ধুদের মধ্য থেকেই এও প্রশ্ন উঠছে। ‘স্বল্প ক্ষতির দীর্ঘ যুদ্ধ’-এর কৌশল ইসরায়েল বিচার-বিবেচনা করেই নিয়েছে; হামাস সম্ভবত না বলেই সেই পথে পা বাড়িয়েছে। হামাসের নেতারা সম্ভবত মনে করেন যে বারবার যুদ্ধে জড়িত হয়ে ইসরায়েলের সামরিক ক্ষতি না হলেও রাজনৈতিক ক্ষতি এতটাই হবে যে তারা হামাসের দাবি মানতে বাধ্য হবে। সামরিক ক্ষতি কেন হবে না তার বিস্তারিত বলা অনাবশ্যক। এ ধরনের কৌশলে ইসরায়েল যেমন হামাসকে ধ্বংস করতে পারবে না; তেমনি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলকে ধ্বংস করার হামাসের লক্ষ্যও অর্জিত হওয়ার কারণ নেই। এই পথে সাফল্য অর্জনের চেষ্টায় নিরীহ গাজাবাসীকে প্রাণ দিতে হচ্ছে। তাহলে সমাধান কোথায়? আমরা সবাই তা জানি। ফিলিপ গর্ডনের ভাষায় বলি, ইসরায়েল কী করে শান্তিতে থাকবে যদি না সে সীমান্ত নির্ধারণ করতে চায়, যদি না সে দখলের অবসান ঘটায় এবং যদি না সে ফিলিস্তিনিদের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং মর্যাদা দেয়?
ইলিনয়, ১৯ জুলাই ২০১৪
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
ইলিনয়, ১৯ জুলাই ২০১৪
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments