রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিয়ানমারের হতবুদ্ধিকর আচরণ by এম আবদুল হাফিজ
২০০৯
সালে হংকংয়ে মিয়ানমারের তৎকালীন কনসাল জেনারেল স্থানীয় গণমাধ্যমে এবং চীনে
কর্তব্যরত মিয়ানমারের কূটনীতিকদের বরাবর একটি চিঠি পাঠান। এতে তার (কনসাল
জেনারেলের) মিয়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আচরণ নিয়ে উদ্বেগের কথা
ছিল। সে সময় মিয়ানমারের এই সুবিধাবঞ্চিত, নির্যাতিত এবং এমনকি
নাগরিকত্ববিহীন দেশটির সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা নামক মুসলিম জাতি-গোষ্ঠীর
অনাহার-অর্ধাহারে নৌকায় দেশান্তরে আশ্রয় গ্রহণের সংবাদ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে
ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছিল।
হংকংয়ে মিয়ানমারের কূটনৈতিক প্রতিনিধি ইয়েমিন্ট আউং তখন এই বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের জন্য কোনো সহমর্মিতা সৃষ্টি থেকে স্থানীয়দের বিরত রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তারই অংশ হিসেবে তিনি এমনকি তার বর্ণবাদী মনোভাব প্রকাশেও পিছ পা হননি। রোহিঙ্গাদের স্বরূপ উদ্ঘাটনে তাদের সম্পর্কে আলোচ্য কূটনীতিকের বক্তব্য ছিল বেদনাদায়ক। তার ভাষায় রোহিঙ্গারা ‘রাক্ষুস সুলভ এক কুৎসিত জীব।’ তাদের চর্মবর্ণ এবং পেলবতা মিয়ানমারের অন্য অধিবাসীদের অনুরূপ নয়। সুতরাং তারা মিয়ানমারিজ বলে অভিহিত হতে পারে না। তারা কোনো এক সময় কোনোভাবে মিয়ানমারে অনাধিকার প্রবেশ করে থাকবে। তাই তাদের দেশের নাগরিক অধিকার দেয়া যায় না।
এরপর প্রায় অর্ধযুগ কেটে গেছে। মিয়ানমারের রাজনীতিতেও এসেছে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন। মিয়ানমার আর আগের মতো রাজনৈতিকভাবে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় নেই। সামরিক জান্তা দীর্ঘদিন পর দেশে নামকাওয়াস্তে হলেও গণতন্ত্রের কিছু প্রতীকী প্রত্যাবর্তনে সম্মতি দিয়েছে। দীর্ঘ গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে গণতন্ত্রপন্থি নোবেল বিজয়ী অং সান সুচিকে। কিন্তু রোহিঙ্গা যে মানবেতর দুরবস্থায় ছিল তার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখনো তারা রাষ্ট্রহীন অবহেলিত জনগোষ্ঠী। জাতিসংঘের দৃষ্টিতে ‘রোহিঙ্গারা বিশ্বের অন্যতম সর্বাধিক নিগৃহীত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।’
এদের সংখ্যা আনুমানিক ১৩ লাখ যাদের অধিকাংশই মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ, যা দেশের পশ্চিম প্রান্তে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন সেখানেই বাস করে এবং জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানোর নিরন্তর প্রচেষ্টায় থাকে। রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য জাতিসংঘের সাম্প্রতিক আহ্বান মিয়ানমার সরকারের বৈরিতায় কোনো ফল বয়ে আনতে পারেনি। বরং ক্রুদ্ধ রোহিঙ্গাবিরোধী মার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছে দেশজুড়ে। সরকারের ইতোপূর্বে রোহিঙ্গাদের যে কিছু অস্থায়ী সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পরিকল্পনা ছিল, সেগুলোও বাতিল করতে দাবি উঠেছে নতুন করে। একটি বিশ্বজনীন ধারণা যে, বৌদ্ধরা অহিংসাবাদী ধর্মের ধারক। সেই ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে মিয়ানমারের কট্টর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাই ঘূর্ণায়মান রোহিঙ্গাবিরোধী অসন্তোষের বার্তাবাহক। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের একটি অংশ রোহিঙ্গাদের অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী বলে অভিহিত করে। যদিও যুগ যুগ ধরে রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষরা মিয়ানমারেই বসবাস করে এসেছে।
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিয়ানমারের হতবুদ্ধিকর আচরণঅশ্বিন ভিরায়ু নামের এক বৌদ্ধ ধর্মগুরু উগ্রজাতীয়তার দোষে দুষ্ট, যার বক্তব্যের কুখ্যাতি আছে তিনি দুর্ভাগ্যক্রমে ‘টাইমস’-এর মতো পত্রিকার আন্তর্জাতিক সংরক্ষণের প্রচ্ছেদে স্থান লাভ করেন। ঞরসবং তাকে ‘ঞযব ঋধপব ড়ভ ইঁফযরংঃ ঞবৎৎড়ৎ’ বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। ভিরায়ু নিজেও নিজকে মিয়ানমারের বিন লাদেন বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন এবং উন্মত্ত রেটোরিকে মিয়ানমারের মুসলিমদের বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে। এই যখন মুসলমানদের অবস্থা, সেই তাদের একটি ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর ভাগ্যলিপি কী হতে পারে। তবু এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হাল ছাড়ার কোনো অবকাশ নেই। রোহিঙ্গা এপিসডের সবচেয়ে বেদনাদায়ক বিষয় হলো রোহিঙ্গাদের অমানবিক মানবাধিকার লঙ্ঘনে একদার গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নেত্রীর নীরবতা। অথচ অং সান সু চির চরম দুর্দিনে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে গোটা বিশ্বের মুসলমান দেশগুলোও তার মুক্তির দাবি জানিয়েছিল। রোহিঙ্গারা ক্রমেই বিতারিত হচ্ছে মিয়ানমার থেকে। তারা নানা রকম জীবন বৈরী আচরণের শিকার হচ্ছে এবং ক্রমেই বিপন্ন-বিপর্যস্তদের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। জীবিকার তাগিদে তারা শরণার্থী শিবিরে থেকেও বেছে নিচ্ছে ভয়ঙ্কর সব পিচ্ছিল পথ। বর্তমান সময়ে মানবপাচারের যেসব চিত্র ক্রম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পাশাপাশি বহুবিধ প্রশ্ন দাঁড় করাচ্ছে এবং বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃতদের মধ্যে তাদের অংশটা কম নয়। আবার তাদের অনেকেই এ দেশে নানাভাবে নাগরিকত্বও নিয়ে নিয়েছে এমন অভিযোগও আছে। আগেই লিখেছি ইতোমধ্যে মিয়ানমারের কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু মিয়ানমারের ইতিবাচক পরিবর্তনের স্পর্শ রোহিঙ্গারা পায়নি। তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও শাসক শ্রেণীর পাল্টায়নি। অং সান সুচির চরম দুর্দিনে যারা তার পাশে দাঁড়িয়েছিল তিনিও তাদের জন্য তেমন কোনোই অবদান রাখতে পারছেন না। তিনিও এ ক্ষেত্রে বড় বিস্ময়করভাবে নীরব। রোহিঙ্গাদের জীবনে এমন করুণ পরিণতির ব্যাপারে বিশ্ব বিবেকের সাড়াও তেমন জোরদার নয়। এমতাবস্থায় তাদের চূড়ান্ত পরিণতি কী এটি বড় একটি প্রশ্ন হয়েই আছে।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট। সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
হংকংয়ে মিয়ানমারের কূটনৈতিক প্রতিনিধি ইয়েমিন্ট আউং তখন এই বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের জন্য কোনো সহমর্মিতা সৃষ্টি থেকে স্থানীয়দের বিরত রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তারই অংশ হিসেবে তিনি এমনকি তার বর্ণবাদী মনোভাব প্রকাশেও পিছ পা হননি। রোহিঙ্গাদের স্বরূপ উদ্ঘাটনে তাদের সম্পর্কে আলোচ্য কূটনীতিকের বক্তব্য ছিল বেদনাদায়ক। তার ভাষায় রোহিঙ্গারা ‘রাক্ষুস সুলভ এক কুৎসিত জীব।’ তাদের চর্মবর্ণ এবং পেলবতা মিয়ানমারের অন্য অধিবাসীদের অনুরূপ নয়। সুতরাং তারা মিয়ানমারিজ বলে অভিহিত হতে পারে না। তারা কোনো এক সময় কোনোভাবে মিয়ানমারে অনাধিকার প্রবেশ করে থাকবে। তাই তাদের দেশের নাগরিক অধিকার দেয়া যায় না।
এরপর প্রায় অর্ধযুগ কেটে গেছে। মিয়ানমারের রাজনীতিতেও এসেছে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন। মিয়ানমার আর আগের মতো রাজনৈতিকভাবে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় নেই। সামরিক জান্তা দীর্ঘদিন পর দেশে নামকাওয়াস্তে হলেও গণতন্ত্রের কিছু প্রতীকী প্রত্যাবর্তনে সম্মতি দিয়েছে। দীর্ঘ গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে গণতন্ত্রপন্থি নোবেল বিজয়ী অং সান সুচিকে। কিন্তু রোহিঙ্গা যে মানবেতর দুরবস্থায় ছিল তার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখনো তারা রাষ্ট্রহীন অবহেলিত জনগোষ্ঠী। জাতিসংঘের দৃষ্টিতে ‘রোহিঙ্গারা বিশ্বের অন্যতম সর্বাধিক নিগৃহীত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।’
এদের সংখ্যা আনুমানিক ১৩ লাখ যাদের অধিকাংশই মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ, যা দেশের পশ্চিম প্রান্তে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন সেখানেই বাস করে এবং জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানোর নিরন্তর প্রচেষ্টায় থাকে। রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য জাতিসংঘের সাম্প্রতিক আহ্বান মিয়ানমার সরকারের বৈরিতায় কোনো ফল বয়ে আনতে পারেনি। বরং ক্রুদ্ধ রোহিঙ্গাবিরোধী মার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছে দেশজুড়ে। সরকারের ইতোপূর্বে রোহিঙ্গাদের যে কিছু অস্থায়ী সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পরিকল্পনা ছিল, সেগুলোও বাতিল করতে দাবি উঠেছে নতুন করে। একটি বিশ্বজনীন ধারণা যে, বৌদ্ধরা অহিংসাবাদী ধর্মের ধারক। সেই ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে মিয়ানমারের কট্টর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাই ঘূর্ণায়মান রোহিঙ্গাবিরোধী অসন্তোষের বার্তাবাহক। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের একটি অংশ রোহিঙ্গাদের অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী বলে অভিহিত করে। যদিও যুগ যুগ ধরে রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষরা মিয়ানমারেই বসবাস করে এসেছে।
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিয়ানমারের হতবুদ্ধিকর আচরণঅশ্বিন ভিরায়ু নামের এক বৌদ্ধ ধর্মগুরু উগ্রজাতীয়তার দোষে দুষ্ট, যার বক্তব্যের কুখ্যাতি আছে তিনি দুর্ভাগ্যক্রমে ‘টাইমস’-এর মতো পত্রিকার আন্তর্জাতিক সংরক্ষণের প্রচ্ছেদে স্থান লাভ করেন। ঞরসবং তাকে ‘ঞযব ঋধপব ড়ভ ইঁফযরংঃ ঞবৎৎড়ৎ’ বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। ভিরায়ু নিজেও নিজকে মিয়ানমারের বিন লাদেন বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন এবং উন্মত্ত রেটোরিকে মিয়ানমারের মুসলিমদের বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে। এই যখন মুসলমানদের অবস্থা, সেই তাদের একটি ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর ভাগ্যলিপি কী হতে পারে। তবু এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হাল ছাড়ার কোনো অবকাশ নেই। রোহিঙ্গা এপিসডের সবচেয়ে বেদনাদায়ক বিষয় হলো রোহিঙ্গাদের অমানবিক মানবাধিকার লঙ্ঘনে একদার গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নেত্রীর নীরবতা। অথচ অং সান সু চির চরম দুর্দিনে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে গোটা বিশ্বের মুসলমান দেশগুলোও তার মুক্তির দাবি জানিয়েছিল। রোহিঙ্গারা ক্রমেই বিতারিত হচ্ছে মিয়ানমার থেকে। তারা নানা রকম জীবন বৈরী আচরণের শিকার হচ্ছে এবং ক্রমেই বিপন্ন-বিপর্যস্তদের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। জীবিকার তাগিদে তারা শরণার্থী শিবিরে থেকেও বেছে নিচ্ছে ভয়ঙ্কর সব পিচ্ছিল পথ। বর্তমান সময়ে মানবপাচারের যেসব চিত্র ক্রম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পাশাপাশি বহুবিধ প্রশ্ন দাঁড় করাচ্ছে এবং বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃতদের মধ্যে তাদের অংশটা কম নয়। আবার তাদের অনেকেই এ দেশে নানাভাবে নাগরিকত্বও নিয়ে নিয়েছে এমন অভিযোগও আছে। আগেই লিখেছি ইতোমধ্যে মিয়ানমারের কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু মিয়ানমারের ইতিবাচক পরিবর্তনের স্পর্শ রোহিঙ্গারা পায়নি। তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও শাসক শ্রেণীর পাল্টায়নি। অং সান সুচির চরম দুর্দিনে যারা তার পাশে দাঁড়িয়েছিল তিনিও তাদের জন্য তেমন কোনোই অবদান রাখতে পারছেন না। তিনিও এ ক্ষেত্রে বড় বিস্ময়করভাবে নীরব। রোহিঙ্গাদের জীবনে এমন করুণ পরিণতির ব্যাপারে বিশ্ব বিবেকের সাড়াও তেমন জোরদার নয়। এমতাবস্থায় তাদের চূড়ান্ত পরিণতি কী এটি বড় একটি প্রশ্ন হয়েই আছে।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট। সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
No comments