ফিফার অন্ধকার ও অনুসন্ধানী জেনিংস by মনজুরুল আহসান বুলবুল
গত
২৭ মে ভোরে সুইজারল্যান্ড পুলিশের ফোন পেয়ে কিছুটা বিরক্তই হন
অ্যান্ড্রু জেনিংস। ইংল্যান্ডের পাহাড়ি উত্তরের বাড়ি থেকে তিনি বলছিলেন:
তখন সকাল ছয়টা, আমার ফোনটি বেজেই চলেছে। ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে আমি রিংটোনটি
বন্ধ করে আরও কিছু সময় ঘুমাতে পাশ ফিরে শুই। ভাবছিলাম যা সকাল ছয়টায় ঘটতে
পারে, তা ঘটতে পারে দুপুরের খাবারের সময়ও, আমার তাতে হেরফের নেই। জেনিংস
তখন জানতেও পারেননি, সেই ভোরেই তাঁর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কাঁপিয়ে
দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। তিনি যখন ফোনের রিংটোন বন্ধ করে ঘুমাচ্ছেন, তখন
দুনিয়াকাঁপানো এক খবর জন্ম নিচ্ছে তাঁর অনুসন্ধানের সূত্র ধরেই। সুইস
পুলিশ জুরিখের বিলাসবহুল পাঁচতারা হোটেল থেকে সে মুহূর্তেই বিশ্ব ফুটবলের
নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফার সাত শীর্ষ কর্তাকে ধরে ফেলেছে ১৫০ মিলিয়ন ডলারের
ঘুষ কেলেঙ্কারির দায়ে। এই কেলেঙ্কারি নিয়ে অ্যান্ড্রু জেনিংস ২০০৬ সালেই
লিখেছিলেন: ফাউল! দ্য সিক্রেট ওয়ার্ল্ড অব ফিফা: ব্রাইবস, ভোট রিগিং
অ্যান্ড টিকিট স্ক্যান্ডালস [ফাউল! ফিফার গোপন কথা: ঘুষ এবং ভোট চুরি ও
টিকিট কেলেঙ্কারি]। শুনতে খবরের শিরোনাম মনে হলেও এটি ফিফার অন্ধকার জগৎ
নিয়ে এক ঢাউস বই। এই লেখার জন্য ২০১১ সালে ফিফাকে নিয়ে ব্রাজিলে এক
গণশুনানিতে তাঁকে অংশ নিতে হয়। কিন্তু হুমকি-ধমকিতে থেমে থাকেননি জেনিংস।
ফুটবল কেলেঙ্কারি নিয়ে অনুষ্ঠান করেছেন বিবিসির ‘প্যানোরোমা’য়। ২০১৪ সালে
লিখেছেন ওমেরটা: সেপ ব্ল্যাটারস ফিফা অর্গানাইজড ক্রাইম ফ্যামিলি।
জেনিংস অর্ধশতাব্দী ধরে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা জগতের এক উজ্জ্বল নাম। একজন আদর্শ অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে তিনি কেতাবি ধারারই অনুসারী, অর্থাৎ ধীরগতির পরিকল্পিত সাংবাদিকতারই পথিক তিনি। জটিল বিষয়ে সময় নিয়ে সংঘবদ্ধ অপরাধের রহস্য উন্মোচনে তাঁর মুনশিয়ানার পরিচয় মেলে থাইল্যান্ডের হেরোইন ব্যবসা বা ইতালির সংঘবদ্ধ অপরাধজগৎ নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী রিপোর্টে। নব্বইয়ের দশকে ক্রীড়াজগতের অপরাধ ঘেঁটে দেখতে তিনি পা রাখেন আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির দুর্নীতির অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে। ১৫ বছর ধরে তিনি ফিফাকে অনুসরণ করছেন ছায়ার মতো। অন্য ক্রীড়া সাংবাদিকেরা যখন খেলার গ্ল্যামার নিয়ে ব্যস্ত, তখন জেনিংস ঘেঁটে চলেছেন বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলার নেপথ্যের নোংরা জগৎ।
জেনিংস জন্মেছেন স্কটল্যান্ডে, শিশুকাল থেকেই থিতু হন ইংল্যান্ডে। তাঁর দাদা নামী ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন, তবে খেলার পায়ের চেয়ে জেনিংসের সাংবাদিকতার নাক ছিল সবচেয়ে সজাগ। পেশার শুরুতেই জেনিংস যোগ দেন সানডে টাইমস-এ, পরে বিবিসিতে। বিবিসি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দুর্নীতি নিয়ে তাঁর এক প্রামাণ্য অনুষ্ঠান প্রচারে অস্বীকৃতি জানালে তিনি বিবিসি ছাড়েন। পরে অপর এক টিভিতে তঁার ‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডস কোকেইন কানেকশন’ প্রামাণ্যচিত্রটি ব্যাপক আলোড়ন তোলে।
এরপর জেনিংসের অনুসন্ধানী চোখ খেলার জগতে, কিন্তু মাঠে নয়, নেপথ্যের অন্ধকার অনুসন্ধানে। জেনিংস নিজেই বলেন: আমি প্রামাণ্য খুঁজে বেড়াই। হাতভর্তি প্রমাণ পেলে সাংবাদিকতার কাজটি সহজ হয়। কোনটি সঠিক নয় তা সবাই জানে, কিন্তু সাংবাদিকতা চায় প্রমাণ। সময় নাও, অন্ধকারে হাতড়াতে থাকো এবং ক্ষমতাধরদের বিশ্বাস করবে না—জেনিংস তাঁর নিজের কাজেও এসব শর্ত মেনে চলেছেন বরাবর। জেনিংস বলেন, এভাবেই সূত্রবিহীন এক ক্রীড়ামোদী হিসেবে আমি ঢুকে পড়ি আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির অন্দরমহলে। এবং অচিরেই আবিষ্কৃত হয় এই সংস্থার প্রধানের কুৎসিত চেহারা। জেনিংসের অনুসন্ধানেই বের হয়ে আসে ২০০২ সালে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে ঘুষ ও মাদকের ভয়াবহ চিত্র। তাঁর প্রতিবেদনের কারণেই সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন অলিম্পিক কমিটির লৌহমানব চেয়ারম্যান হোয়ান আন্তনিও সামারাঞ্চ। চাকরি হারান কয়েক ডজন কর্মকর্তা। জেনিংস বলেন, সাধারণ ক্রীড়া সাংবাদিকেরা ক্রীড়া তারকাদের এসব অন্ধকার নিয়ে রিপোর্ট করতে চান না, পাছে আবার এই তারকাদের সঙ্গে তাঁদের সখ্য নষ্ট হয়। পরিশ্রম ছাড়াই গ্ল্যামার বিক্রি করা খবর নিয়েই তাঁরা খুশি। বোধ করি সে কারণেই সাধারণ খেলা ও তারকা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে চান তাঁরা।
দৃশ্যত আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির অনুসন্ধানে সাফল্যের পরই জেনিংস নজর দেন ফিফার দিকে। কীভাবে তিনি ফিফার অন্দরমহলে ঢুকলেন? জেনিংসের জবাব: যখন একটি সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ে দুর্নীতি হয়, তখন সেই প্রতিষ্ঠানের মাঝারি পর্যায়ের সৎ কর্মীরা সব বুঝেও চুপচাপ থাকেন, কিন্তু তাঁরা সব সময়ই এমন এক অস্বস্তিতে ভোগেন যে তাঁরা দেখছেন অন্যায় হচ্ছে কিন্তু চাকরি হারানোর ভয়ে কিছু বলতে পারছেন না। একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিকের কাজ হচ্ছে এই অংশটিকেই হাত করা, তাঁদের আস্থাভাজন হওয়া এবং তাঁদের আস্থায় নেওয়া। এ পথেই হাঁটেন জেনিংস।
২০০২ সালে প্রথমবারের মতো ফিফার শীর্ষ বস সেপ ব্ল্যাটারের সংবাদ সম্মেলন কভার করার কথা বলছিলেন জেনিংস। তাঁর বর্ণনা—জুরিখে ফিফা সদর দপ্তরে গিয়ে দেখি, ফিফার ব্লেজার পরা ডজন ডজন কর্মী দেয়ালের পাশজুড়ে দাঁড়ানো, সবাই যেন কাজ করছে রোবটের মতো। আমি ঠিক করলাম এদের মধ্য থেকেই আমার সূত্র বের করতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে ফিফা প্রেসিডেন্ট সেপ ব্ল্যাটার আনুষ্ঠানিক বক্তব্য শেষ করার পরই মাইক্রোফোন হাতে নেন জেনিংস। সরাসরি প্রশ্নটি ছুড়ে দেন, মি. ব্ল্যাটার আপনি কি কখনো ঘুষ নিয়েছেন? চারপাশে ঘিরে থাকা বনেদি, অভিজাত ক্রীড়া সাংবাদিকদের সামনে যেন বোমা ফাটালেন জেনিংস। বর্ণনা দেন জেনিংস: আমি যেন সাজানো একটি পার্টি গুঁড়িয়ে দিলাম। সব প্রতিবেদক আমার দিকে তাকিয়ে, আমি যেন পচা খাবারের গন্ধ ছড়াচ্ছি; আমিও আসলে এমনটিই চাচ্ছিলাম। আমি তাকাচ্ছিলাম ফিফার ব্লেজার গায়ে দেওয়া রোবটগুলোর দিকে এবং মনে হলো আমার যা প্রত্যাশা তা পেয়ে গেছি। যথারীতি ব্ল্যাটার অভিযোগ অস্বীকার করলেন, কিন্তু গণমাধ্যমগুলোয় শিরোনাম হলো বিষয়টি।
পরের রোমাঞ্চকর বর্ণনা শুনুন সাংবাদিক অ্যান্ড্রু জেনিংসের মুখেই: এ ঘটনার ছয় সপ্তাহ পরে, একজনের আমন্ত্রণে জুরিখে লেকের পাড়ে মধ্যরাতে উনিশ শতকের এক কফিশপের সামনে চলে গেলাম। একসময় দরজা খুলল, আমাকে নেওয়া হলো এক জমকালো অফিসের সামনে। আধা ঘণ্টা পর একজন ফিফা কর্মকর্তা সেখানে আমার হাতে তুলে দিলেন ফিফার দুর্নীতির বিস্তারিত দলিল। এবং সেখান থেকেই শুরু। সেই দলিলেরই তথ্য তুলে ধরছে ফিফার অন্ধকার জগৎ। ব্ল্যাটার নিজেই নিজেকে দিয়েছেন ছয় ডিজিটের বোনাস, ব্যক্তিগত জেট যেন ছিল তাঁর নিত্যদিনের যান। বড় মার্সিডিজ তাঁর দুয়ারে খাড়া থাকত সারাক্ষণ। এই খবর প্রকাশিত হলে ব্ল্যাটার তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করার হুমকি দিয়েছিলেন, কিন্তু পরে আর এগোননি। জেনিংস থেমে থাকেননি। এ সময় তাঁর ফোনে আড়ি পাতা হয়, হ্যাক করা হয় কম্পিউটারে। ফিফা কেলেঙ্কারি নিয়ে জেনিংসের বই প্রকাশিত হলে ফিফার বিগ বসরা তা শুধু প্রত্যাখ্যানই করেননি; তাঁরা জেনিংসকে দৈহিকভাবেও অপদস্থ করেন। ফিফা ভাইস প্রেসিডেন্ট (এখন আটক) জ্যাক ওয়ার্নার জেনিংসকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করেন, তাঁর মুখে থুতু ছোড়েন। ক্যামেরার সামনেই। অভিযোগ তোলা হয় জেনিংস কোনো কোম্পানির কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে বইটি লিখেছেন।
বইটি প্রকাশের তিন বছর পর ঘটে আরেক নাটকীয় ঘটনা। লন্ডনের ডাউনটাউনে এফবিআইয়ের অর্গানাইজড ক্রাইম স্কোয়াডের তিনজন স্পেশাল এজেন্ট জেনিংসের সঙ্গে কথা বলেন। জেনিংস বুঝতে পারছিলেন ইউরোপীয় পুলিশ এ বিষয়ে কিছুই করবে না, তাই শেষ পর্যন্ত সব প্রামাণ্য তথ্য দিয়ে তিনি এফবিআইকেই সহায়তা করেন। কিন্তু তাঁকে অপেক্ষা করতে হয় আরও তিন বছর। ২০০৬-০৯ এবং শেষে ২০১৫। তাঁর অনুসন্ধানী কাজের ফল দেখে উচ্ছ্বসিত জেনিংস। ২৭ মের ভোরের দৃশ্যপট বর্ণনা করে ওয়াশিংটন পোস্টকে তিনি বলেছেন: কী চমৎকার দৃশ্য! মঙ্গলবার রাতভর ফিফার টাকায় শ্যাম্পেন পান করে, ফিফার টাকায় বিল পরিশোধ করা জুরিখের বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেলে আপনি ঘুমাতে গেলেন, আর বুধবার কাকডাকা ভোরে দরজায় টোকা, পুলিশ বলছে, কাপড় পরে নিন, আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে, স্যার!!
ফিফায় নিশ্চয়ই বড় পরিবর্তন আসবে, দুর্বৃত্তদের নিশ্চয়ই সাজা হবে, এই তৃপ্তি নিয়েই ৭১ বছর বয়সী অনুসন্ধানী সাংবাদিক অ্যান্ড্রু জেনিংস অবসর নিতে চান পেশা থেকে। বাকি জীবন কাটাতে চান বাগানের আর পরিবারের পরিচর্যা করে।
মনজুরুল আহসান বুলবুল: সাংবাদিক।
bulbulahsan@gmail.com
জেনিংস অর্ধশতাব্দী ধরে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা জগতের এক উজ্জ্বল নাম। একজন আদর্শ অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে তিনি কেতাবি ধারারই অনুসারী, অর্থাৎ ধীরগতির পরিকল্পিত সাংবাদিকতারই পথিক তিনি। জটিল বিষয়ে সময় নিয়ে সংঘবদ্ধ অপরাধের রহস্য উন্মোচনে তাঁর মুনশিয়ানার পরিচয় মেলে থাইল্যান্ডের হেরোইন ব্যবসা বা ইতালির সংঘবদ্ধ অপরাধজগৎ নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী রিপোর্টে। নব্বইয়ের দশকে ক্রীড়াজগতের অপরাধ ঘেঁটে দেখতে তিনি পা রাখেন আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির দুর্নীতির অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে। ১৫ বছর ধরে তিনি ফিফাকে অনুসরণ করছেন ছায়ার মতো। অন্য ক্রীড়া সাংবাদিকেরা যখন খেলার গ্ল্যামার নিয়ে ব্যস্ত, তখন জেনিংস ঘেঁটে চলেছেন বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলার নেপথ্যের নোংরা জগৎ।
জেনিংস জন্মেছেন স্কটল্যান্ডে, শিশুকাল থেকেই থিতু হন ইংল্যান্ডে। তাঁর দাদা নামী ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন, তবে খেলার পায়ের চেয়ে জেনিংসের সাংবাদিকতার নাক ছিল সবচেয়ে সজাগ। পেশার শুরুতেই জেনিংস যোগ দেন সানডে টাইমস-এ, পরে বিবিসিতে। বিবিসি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দুর্নীতি নিয়ে তাঁর এক প্রামাণ্য অনুষ্ঠান প্রচারে অস্বীকৃতি জানালে তিনি বিবিসি ছাড়েন। পরে অপর এক টিভিতে তঁার ‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডস কোকেইন কানেকশন’ প্রামাণ্যচিত্রটি ব্যাপক আলোড়ন তোলে।
এরপর জেনিংসের অনুসন্ধানী চোখ খেলার জগতে, কিন্তু মাঠে নয়, নেপথ্যের অন্ধকার অনুসন্ধানে। জেনিংস নিজেই বলেন: আমি প্রামাণ্য খুঁজে বেড়াই। হাতভর্তি প্রমাণ পেলে সাংবাদিকতার কাজটি সহজ হয়। কোনটি সঠিক নয় তা সবাই জানে, কিন্তু সাংবাদিকতা চায় প্রমাণ। সময় নাও, অন্ধকারে হাতড়াতে থাকো এবং ক্ষমতাধরদের বিশ্বাস করবে না—জেনিংস তাঁর নিজের কাজেও এসব শর্ত মেনে চলেছেন বরাবর। জেনিংস বলেন, এভাবেই সূত্রবিহীন এক ক্রীড়ামোদী হিসেবে আমি ঢুকে পড়ি আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির অন্দরমহলে। এবং অচিরেই আবিষ্কৃত হয় এই সংস্থার প্রধানের কুৎসিত চেহারা। জেনিংসের অনুসন্ধানেই বের হয়ে আসে ২০০২ সালে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে ঘুষ ও মাদকের ভয়াবহ চিত্র। তাঁর প্রতিবেদনের কারণেই সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন অলিম্পিক কমিটির লৌহমানব চেয়ারম্যান হোয়ান আন্তনিও সামারাঞ্চ। চাকরি হারান কয়েক ডজন কর্মকর্তা। জেনিংস বলেন, সাধারণ ক্রীড়া সাংবাদিকেরা ক্রীড়া তারকাদের এসব অন্ধকার নিয়ে রিপোর্ট করতে চান না, পাছে আবার এই তারকাদের সঙ্গে তাঁদের সখ্য নষ্ট হয়। পরিশ্রম ছাড়াই গ্ল্যামার বিক্রি করা খবর নিয়েই তাঁরা খুশি। বোধ করি সে কারণেই সাধারণ খেলা ও তারকা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে চান তাঁরা।
দৃশ্যত আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির অনুসন্ধানে সাফল্যের পরই জেনিংস নজর দেন ফিফার দিকে। কীভাবে তিনি ফিফার অন্দরমহলে ঢুকলেন? জেনিংসের জবাব: যখন একটি সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ে দুর্নীতি হয়, তখন সেই প্রতিষ্ঠানের মাঝারি পর্যায়ের সৎ কর্মীরা সব বুঝেও চুপচাপ থাকেন, কিন্তু তাঁরা সব সময়ই এমন এক অস্বস্তিতে ভোগেন যে তাঁরা দেখছেন অন্যায় হচ্ছে কিন্তু চাকরি হারানোর ভয়ে কিছু বলতে পারছেন না। একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিকের কাজ হচ্ছে এই অংশটিকেই হাত করা, তাঁদের আস্থাভাজন হওয়া এবং তাঁদের আস্থায় নেওয়া। এ পথেই হাঁটেন জেনিংস।
২০০২ সালে প্রথমবারের মতো ফিফার শীর্ষ বস সেপ ব্ল্যাটারের সংবাদ সম্মেলন কভার করার কথা বলছিলেন জেনিংস। তাঁর বর্ণনা—জুরিখে ফিফা সদর দপ্তরে গিয়ে দেখি, ফিফার ব্লেজার পরা ডজন ডজন কর্মী দেয়ালের পাশজুড়ে দাঁড়ানো, সবাই যেন কাজ করছে রোবটের মতো। আমি ঠিক করলাম এদের মধ্য থেকেই আমার সূত্র বের করতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে ফিফা প্রেসিডেন্ট সেপ ব্ল্যাটার আনুষ্ঠানিক বক্তব্য শেষ করার পরই মাইক্রোফোন হাতে নেন জেনিংস। সরাসরি প্রশ্নটি ছুড়ে দেন, মি. ব্ল্যাটার আপনি কি কখনো ঘুষ নিয়েছেন? চারপাশে ঘিরে থাকা বনেদি, অভিজাত ক্রীড়া সাংবাদিকদের সামনে যেন বোমা ফাটালেন জেনিংস। বর্ণনা দেন জেনিংস: আমি যেন সাজানো একটি পার্টি গুঁড়িয়ে দিলাম। সব প্রতিবেদক আমার দিকে তাকিয়ে, আমি যেন পচা খাবারের গন্ধ ছড়াচ্ছি; আমিও আসলে এমনটিই চাচ্ছিলাম। আমি তাকাচ্ছিলাম ফিফার ব্লেজার গায়ে দেওয়া রোবটগুলোর দিকে এবং মনে হলো আমার যা প্রত্যাশা তা পেয়ে গেছি। যথারীতি ব্ল্যাটার অভিযোগ অস্বীকার করলেন, কিন্তু গণমাধ্যমগুলোয় শিরোনাম হলো বিষয়টি।
পরের রোমাঞ্চকর বর্ণনা শুনুন সাংবাদিক অ্যান্ড্রু জেনিংসের মুখেই: এ ঘটনার ছয় সপ্তাহ পরে, একজনের আমন্ত্রণে জুরিখে লেকের পাড়ে মধ্যরাতে উনিশ শতকের এক কফিশপের সামনে চলে গেলাম। একসময় দরজা খুলল, আমাকে নেওয়া হলো এক জমকালো অফিসের সামনে। আধা ঘণ্টা পর একজন ফিফা কর্মকর্তা সেখানে আমার হাতে তুলে দিলেন ফিফার দুর্নীতির বিস্তারিত দলিল। এবং সেখান থেকেই শুরু। সেই দলিলেরই তথ্য তুলে ধরছে ফিফার অন্ধকার জগৎ। ব্ল্যাটার নিজেই নিজেকে দিয়েছেন ছয় ডিজিটের বোনাস, ব্যক্তিগত জেট যেন ছিল তাঁর নিত্যদিনের যান। বড় মার্সিডিজ তাঁর দুয়ারে খাড়া থাকত সারাক্ষণ। এই খবর প্রকাশিত হলে ব্ল্যাটার তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করার হুমকি দিয়েছিলেন, কিন্তু পরে আর এগোননি। জেনিংস থেমে থাকেননি। এ সময় তাঁর ফোনে আড়ি পাতা হয়, হ্যাক করা হয় কম্পিউটারে। ফিফা কেলেঙ্কারি নিয়ে জেনিংসের বই প্রকাশিত হলে ফিফার বিগ বসরা তা শুধু প্রত্যাখ্যানই করেননি; তাঁরা জেনিংসকে দৈহিকভাবেও অপদস্থ করেন। ফিফা ভাইস প্রেসিডেন্ট (এখন আটক) জ্যাক ওয়ার্নার জেনিংসকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করেন, তাঁর মুখে থুতু ছোড়েন। ক্যামেরার সামনেই। অভিযোগ তোলা হয় জেনিংস কোনো কোম্পানির কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে বইটি লিখেছেন।
বইটি প্রকাশের তিন বছর পর ঘটে আরেক নাটকীয় ঘটনা। লন্ডনের ডাউনটাউনে এফবিআইয়ের অর্গানাইজড ক্রাইম স্কোয়াডের তিনজন স্পেশাল এজেন্ট জেনিংসের সঙ্গে কথা বলেন। জেনিংস বুঝতে পারছিলেন ইউরোপীয় পুলিশ এ বিষয়ে কিছুই করবে না, তাই শেষ পর্যন্ত সব প্রামাণ্য তথ্য দিয়ে তিনি এফবিআইকেই সহায়তা করেন। কিন্তু তাঁকে অপেক্ষা করতে হয় আরও তিন বছর। ২০০৬-০৯ এবং শেষে ২০১৫। তাঁর অনুসন্ধানী কাজের ফল দেখে উচ্ছ্বসিত জেনিংস। ২৭ মের ভোরের দৃশ্যপট বর্ণনা করে ওয়াশিংটন পোস্টকে তিনি বলেছেন: কী চমৎকার দৃশ্য! মঙ্গলবার রাতভর ফিফার টাকায় শ্যাম্পেন পান করে, ফিফার টাকায় বিল পরিশোধ করা জুরিখের বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেলে আপনি ঘুমাতে গেলেন, আর বুধবার কাকডাকা ভোরে দরজায় টোকা, পুলিশ বলছে, কাপড় পরে নিন, আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে, স্যার!!
ফিফায় নিশ্চয়ই বড় পরিবর্তন আসবে, দুর্বৃত্তদের নিশ্চয়ই সাজা হবে, এই তৃপ্তি নিয়েই ৭১ বছর বয়সী অনুসন্ধানী সাংবাদিক অ্যান্ড্রু জেনিংস অবসর নিতে চান পেশা থেকে। বাকি জীবন কাটাতে চান বাগানের আর পরিবারের পরিচর্যা করে।
মনজুরুল আহসান বুলবুল: সাংবাদিক।
bulbulahsan@gmail.com
No comments