ব্রেটনউড থেকে ডাভোস by এম আবদুল হাফিজ
‘এখন
শতকরা এক ভাগ শীর্ষ ধনীর হাতে সব বিশ্ববাসীর অর্জিত সম্পদেরও অধিক সম্পদ।’
ব্রিটেনভিত্তিক চ্যারিটি সংগঠন ‘অক্সফাম’ তাদের এই গবেষণালব্ধ তথ্য সুইস
স্কি রেসোর্ট’ ডাভোসে চলমান বিশ্ব ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক অধিবেশনকে
জানিয়ে সেখানকার সবাইকে অবাক করেছে। কিন্তু এই অধিবেশনে অংশগ্রহণকারী প্রায়
দেড়শ’ দেশের অবিশ্বাস্য ধনী রাষ্ট্রনায়ক, শিল্পপতি, ব্যবসা- প্রতিষ্ঠানের
মালিক, সমাজ-সংস্কৃতি-সাহিত্যে নতুন ধারার জন্মদাতা নোবেল লরিয়েট ও জীবনের
বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন নতুন পরিবর্তনের সূচনাকারী সেলিব্রিটিরা এবং তাবৎ
ব্র্যান্ড ও ফ্যাশন গুরুরা এই তথ্যে অবাক হননি। কেননা তারাই তো
প্রকারান্তরে এসব প্রবণতার নেপথ্যে সক্রিয় থাকেন এবং তাদের অবদানের জন্য যা
কিছু পাওয়ার তা তারা পেতে থাকেন। এক কথা তারাই এর বেনিফিসিয়ারি।
বিষয়টি বুঝতে একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক। ব্রিটেন ও তার কিছু পর ইউরোপের অন্যান্য দেশে শিল্প বিপ্লব ঘটলে এবং মুনাফাভিত্তিক পুঁজিবাদের উত্থান হলে তারই সমান্তরালে তা ‘জীবন ব্যবস্থা’ হিসেবে সমাজতন্ত্রকে উসকে দেয়। শুরু হয় উভয়ের মধ্যে একটি অসম প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় ধনতান্ত্রিক বিশ্ব অনেকটা এগিয়ে তার অন্তর্নিহিত শোষণে সমাজতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান মানবিক আবেদন ধনতন্ত্রকে ঘিরে যে জীবন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তার প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। বিংশ শতাব্দীতে দুটি প্রলয়ঙ্করী বিশ্বযুদ্ধে যদিও আলোচ্য দুই মতাদর্শের স্পষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি এবং তা নেহায়েত ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর বাজার সম্প্রসারণে ও প্রভাববলয় বিস্তৃত করতেই সংঘটিত হয়েছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ ভাগে এসে মিত্র শক্তি যা মূলত ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক উভয় শিবিরের সমন্বয়ে সংগঠিত হয়েছিল উত্তর শিবিরের অভিন্ন শত্রু হিটলারের দুর্দমনীয় প্রতিপত্তি লিপ্সাকে মোকাবিলায় তাতে ঘটনাচক্রে উভয় শিবিরের দেশগুলোর ‘জাতীয় স্বার্থের’ সংঘাতে চিড় ধরে এবং তারা পরস্পরকে অবিশ্বাস করতে শুরু করে।
জার্মানির নাৎসি নেতা এডলফ হিটলারের থার্ডবাইখের সঙ্গে স্বার্থের সংঘাত হলেও এই দুর্ধর্ষ নেতা মতাদর্শে কম ধনতান্ত্রিক ছিলেন না এবং তার দেশও ছিল শীর্ষ শিল্পোন্নত দেশগুলোর অন্যতম। তবু ধনতান্ত্রিক বিশ্বের সঙ্গে তার বিরোধ বাধে তার শক্তির অনুপাতে বিশ্ব ব্যবস্থায় তার স্থান নিরূপণ করার দাবি করলে। কিন্তু মিত্র শক্তির অন্তর্গত একমাত্র সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মিত্র শক্তির ধনতান্ত্রিক অংশের সঙ্গে সংঘর্ষ ছিল মতাদর্শগত। তাই মিত্র শক্তির নেতারা ভবিষ্যৎ বিশ্বের রূপরেখা প্রণয়ন করতে সোভিয়েত নেতা স্তালিনের চোখে ধুলো দিয়ে যুদ্ধ সমাপ্তির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার পূর্বেই গোপনে আটলান্টিকের ওপারে পাড়ি জমান। আমেরিকার অঙ্গরাজ্য নিউ হ্যাম্পশায়ারের ব্রেটনউডে রচিত হয় আগামী দিনের বিশ্ব ব্যবস্থার সুদূরপ্রসারী ব্যবস্থাপত্র, যা বাস্তবায়নের জন্য সব আনুষঙ্গিক প্রতিষ্ঠান তাৎক্ষণিকভাবে অস্তিত্বে না আসলেও সেগুলোরও সব খুঁটিনাটি ব্যবস্থাপত্রে সংযোজিত হয়েছিল। সুচিন্তিতভাবে ব্রেটেনউডে প্রণীত ব্যবস্থাপত্রে বিশ্বব্যাংক বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, বিশ্বায়ন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং ক্রমে ক্রমে পরবর্তীতে সেগুলোর অস্তিত্বে আসাও আমরা দেখেছি। ব্রেটনউডেই সম্ভবত আজকে এতদিন পর আমরা যে ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক বৈষম্য দেখছি, হাজার কোটি টাকার এলিট শ্রেণী এবং তার গা ঘেঁষেই দেখছি সমাজের তলানিতে আন্ডারডগ ও ছিন্নমূলদের অবস্থান তার ব্যবস্থাও ব্রেটনউডে স্থিরিকৃত হয়েছিল।
ডাভোসে শীর্ষ ধনীদের বিলাসবহুল পুনর্মিলনী এবং ধনতান্ত্রিক বিশ্বকে আপন মর্যাদায় স্থায়িত্ব দেয়ার কৌশল প্রণয়নে ব্রেটনউড মডেলকেই অনুসরণ করা হয়। আমার জানা মতে ডাভোসে অংশগ্রহণকারী একমাত্র সম্ভবত আমাদের দেশের একটি রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের ফসল অস্বাভাবিক ও অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান ড. ফখরুদ্দীন আহমদ। তিনি সরকারের প্রধান নির্বাহী হিসেবে ওই সেলিব্রেটি সম্মেলনে গিয়েছিলেন এবং হামিদ কারজাই প্রমুখদের সঙ্গে কাঁধ ঘেঁষাঘেঁষি করেছিলেন। হায়রে সমাজতন্ত্র যাকে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা আন্দোলনের ছাত্র সমাজের চাপে সমাজতন্ত্রের দাবি সংবলিত এগোরো দফা গ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীনতার পর সমাজতন্ত্র রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির সঙ্গে সংবিধানে স্থান পেয়েছিল। এখন হাজার কোটি টাকার সুপার রিচদের দাপটে সমাজতন্ত্র এ দেশে নির্বাসিত।
তবু সমাজতন্ত্রের বাতি আজো ধিকি ধিকি জ্বলছে সুদূর লাতিন আমেরিকায় ‘সোশ্যাল ফোরামের’ ব্যানারে। ব্রেটনউডের কাছে সোভিয়েতরা হার মানলেও বিশ্বের কোটি কোটি মুক্তিকামী মানুষ এখনো আশায় বুক বাঁধে এবং সোশ্যাল ফোরামে সংঘবদ্ধ হয় এশিয়ায়, আফ্রিকায় এবং লাতিন আমেরিকায়। তারাও দেখে তারা বলিভিয়ায়, হুগো শ্যাভেজ, চে গুয়েভারা ও ফিদেল ক্যাস্ট্রোর দেশে।
লেখক: সাবেক সেনা কর্মকর্তা, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও কলামিস্ট। সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
বিষয়টি বুঝতে একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক। ব্রিটেন ও তার কিছু পর ইউরোপের অন্যান্য দেশে শিল্প বিপ্লব ঘটলে এবং মুনাফাভিত্তিক পুঁজিবাদের উত্থান হলে তারই সমান্তরালে তা ‘জীবন ব্যবস্থা’ হিসেবে সমাজতন্ত্রকে উসকে দেয়। শুরু হয় উভয়ের মধ্যে একটি অসম প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় ধনতান্ত্রিক বিশ্ব অনেকটা এগিয়ে তার অন্তর্নিহিত শোষণে সমাজতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান মানবিক আবেদন ধনতন্ত্রকে ঘিরে যে জীবন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তার প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। বিংশ শতাব্দীতে দুটি প্রলয়ঙ্করী বিশ্বযুদ্ধে যদিও আলোচ্য দুই মতাদর্শের স্পষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি এবং তা নেহায়েত ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর বাজার সম্প্রসারণে ও প্রভাববলয় বিস্তৃত করতেই সংঘটিত হয়েছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ ভাগে এসে মিত্র শক্তি যা মূলত ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক উভয় শিবিরের সমন্বয়ে সংগঠিত হয়েছিল উত্তর শিবিরের অভিন্ন শত্রু হিটলারের দুর্দমনীয় প্রতিপত্তি লিপ্সাকে মোকাবিলায় তাতে ঘটনাচক্রে উভয় শিবিরের দেশগুলোর ‘জাতীয় স্বার্থের’ সংঘাতে চিড় ধরে এবং তারা পরস্পরকে অবিশ্বাস করতে শুরু করে।
জার্মানির নাৎসি নেতা এডলফ হিটলারের থার্ডবাইখের সঙ্গে স্বার্থের সংঘাত হলেও এই দুর্ধর্ষ নেতা মতাদর্শে কম ধনতান্ত্রিক ছিলেন না এবং তার দেশও ছিল শীর্ষ শিল্পোন্নত দেশগুলোর অন্যতম। তবু ধনতান্ত্রিক বিশ্বের সঙ্গে তার বিরোধ বাধে তার শক্তির অনুপাতে বিশ্ব ব্যবস্থায় তার স্থান নিরূপণ করার দাবি করলে। কিন্তু মিত্র শক্তির অন্তর্গত একমাত্র সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মিত্র শক্তির ধনতান্ত্রিক অংশের সঙ্গে সংঘর্ষ ছিল মতাদর্শগত। তাই মিত্র শক্তির নেতারা ভবিষ্যৎ বিশ্বের রূপরেখা প্রণয়ন করতে সোভিয়েত নেতা স্তালিনের চোখে ধুলো দিয়ে যুদ্ধ সমাপ্তির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার পূর্বেই গোপনে আটলান্টিকের ওপারে পাড়ি জমান। আমেরিকার অঙ্গরাজ্য নিউ হ্যাম্পশায়ারের ব্রেটনউডে রচিত হয় আগামী দিনের বিশ্ব ব্যবস্থার সুদূরপ্রসারী ব্যবস্থাপত্র, যা বাস্তবায়নের জন্য সব আনুষঙ্গিক প্রতিষ্ঠান তাৎক্ষণিকভাবে অস্তিত্বে না আসলেও সেগুলোরও সব খুঁটিনাটি ব্যবস্থাপত্রে সংযোজিত হয়েছিল। সুচিন্তিতভাবে ব্রেটেনউডে প্রণীত ব্যবস্থাপত্রে বিশ্বব্যাংক বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, বিশ্বায়ন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং ক্রমে ক্রমে পরবর্তীতে সেগুলোর অস্তিত্বে আসাও আমরা দেখেছি। ব্রেটনউডেই সম্ভবত আজকে এতদিন পর আমরা যে ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক বৈষম্য দেখছি, হাজার কোটি টাকার এলিট শ্রেণী এবং তার গা ঘেঁষেই দেখছি সমাজের তলানিতে আন্ডারডগ ও ছিন্নমূলদের অবস্থান তার ব্যবস্থাও ব্রেটনউডে স্থিরিকৃত হয়েছিল।
ডাভোসে শীর্ষ ধনীদের বিলাসবহুল পুনর্মিলনী এবং ধনতান্ত্রিক বিশ্বকে আপন মর্যাদায় স্থায়িত্ব দেয়ার কৌশল প্রণয়নে ব্রেটনউড মডেলকেই অনুসরণ করা হয়। আমার জানা মতে ডাভোসে অংশগ্রহণকারী একমাত্র সম্ভবত আমাদের দেশের একটি রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের ফসল অস্বাভাবিক ও অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান ড. ফখরুদ্দীন আহমদ। তিনি সরকারের প্রধান নির্বাহী হিসেবে ওই সেলিব্রেটি সম্মেলনে গিয়েছিলেন এবং হামিদ কারজাই প্রমুখদের সঙ্গে কাঁধ ঘেঁষাঘেঁষি করেছিলেন। হায়রে সমাজতন্ত্র যাকে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা আন্দোলনের ছাত্র সমাজের চাপে সমাজতন্ত্রের দাবি সংবলিত এগোরো দফা গ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীনতার পর সমাজতন্ত্র রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির সঙ্গে সংবিধানে স্থান পেয়েছিল। এখন হাজার কোটি টাকার সুপার রিচদের দাপটে সমাজতন্ত্র এ দেশে নির্বাসিত।
তবু সমাজতন্ত্রের বাতি আজো ধিকি ধিকি জ্বলছে সুদূর লাতিন আমেরিকায় ‘সোশ্যাল ফোরামের’ ব্যানারে। ব্রেটনউডের কাছে সোভিয়েতরা হার মানলেও বিশ্বের কোটি কোটি মুক্তিকামী মানুষ এখনো আশায় বুক বাঁধে এবং সোশ্যাল ফোরামে সংঘবদ্ধ হয় এশিয়ায়, আফ্রিকায় এবং লাতিন আমেরিকায়। তারাও দেখে তারা বলিভিয়ায়, হুগো শ্যাভেজ, চে গুয়েভারা ও ফিদেল ক্যাস্ট্রোর দেশে।
লেখক: সাবেক সেনা কর্মকর্তা, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও কলামিস্ট। সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
No comments